ড. আবদুল হাসিব চৌধুরী
ড. আবদুল হাসিব চৌধুরী

বিশেষ সাক্ষাৎকার: ড. আবদুল হাসিব চৌধুরী

ছাত্ররাজনীতি বুয়েটে বাইরের হস্তক্ষেপ ডেকে আনবে

ড. আবদুল হাসিব চৌধুরী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বুয়েটের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিসহ ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নিয়ে সরকারি পদক্ষেপ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব

প্রশ্ন

বুয়েটে আবারও ছাত্ররাজনীতির দুয়ার খুলল। পরিবর্তিত পরিস্থিতি এখন কেমন?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: আমি বরং বলব, দলীয় রাজনীতির দুয়ার খোলার একটি চেষ্টা চলছে। এ লক্ষ্যে দলীয় ও আইনি চেষ্টা আছে, এখনো তার মীমাংসা হয়নি। ছাত্ররা তাঁদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। যত দূর শুনেছি, আইনি দিক থেকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি তাই এখনো পরিবর্তিত হয়নি।

প্রশ্ন

কোন পরিস্থিতিতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলো এবং আবার চালুর সিদ্ধান্ত এল। উভয় সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন।

আবদুল হাসিব চৌধুরী: বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হয় ২০১৯ সালে, ছাত্রদের প্রবল আন্দোলনের মুখে, যখন বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আবরার ফাহাদ। ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তির সমালোচনা করায় তঁাকে নির্যাতন ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

তবে এটা ছিল বুয়েট ছাত্রদের পুরোনো দাবি, যা প্রথম শোনা যায় ২০০২ সালে, যখন টেন্ডার দখল নিয়ে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন বুয়েটের ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি। ২০১৩ সালে ধর্মীয় উগ্রবাদী এক ছাত্র দ্বারা ছুরিকাঘাত নিহত হন ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দীপ। এই যে তিনটি হত্যাকাণ্ড, তার প্রতিটির সঙ্গেই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল।

দুই যুগে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রদের এই সমষ্টিগত (কালেকটিভ) অভিজ্ঞতা, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার ঘটনা, এসব ঘটনা বন্ধে ছাত্রসংগঠনগুলোর আন্দোলন গড়ে তোলায় ব্যর্থতা এবং সর্বোপরি নিরাপদ ক্যাম্পাস তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের অক্ষমতা, অবহেলা, উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ—এত কিছুর মুখোমুখি হয়ে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতের একমাত্র উপায় হিসেবে দেখছেন ছাত্ররাজনীতির অনুপস্থিতি।

সুতরাং ছাত্ররা যখন বলছেন ‘বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চাই না,’ আপনাকে বুঝতে হবে, তাঁরা আসলে কী চান। তাঁরা চান নিরাপদ ক্যাম্পাস, যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারবেন, হলগুলোতে কারোর অনুগত হয়ে থাকতে হবে না; তাঁরা চান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু ও সুস্থ পরিবেশ থাকবে। ছাত্রদের এই চাওয়াকে কীভাবে অযৌক্তিক বলবেন?

আদালত কোন বিবেচনায় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে বুয়েট কর্তৃপক্ষের জারি করা নির্দেশ স্থগিত করেছেন, তা আমার জানা নেই। তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা আমার দায়িত্ব নয়।

প্রশ্ন

আদালতের আদেশের পর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতিতে আর বাধা থাকল না। এতে বুয়েটে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হবে কি না?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: দেখুন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি মানে এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইরের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালু হলে বাইরে থেকে এখানে হস্তক্ষেপ করাটা সহজ হয়ে উঠবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

অভ্যন্তরীণ শর্তাবলির পরিবর্তনে বা নিয়ন্ত্রণে বুয়েটের ছাত্ররা কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারলেও বাইরের শর্তাবলি তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

এই অবস্থায় বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালু হলে বাইরের শর্তাবলিই বুয়েটের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এতে করে বুয়েটে শিক্ষার পরিবেশ ভালো হবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

প্রশ্ন

ছাত্ররাজনীতি চালুর বিপক্ষে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের অংশ হিসেবে শুরু থেকে পরীক্ষা বর্জন আসছেন। ঈদের ছুটির পরও দেখা গেল দুটি ব্যাচের অধিকাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষা বর্জন করেছেন। বিষয়টি একাডেমিক কার্যক্রমে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: যাঁরা এ বছর পরীক্ষাটা দিলেই পাস করে বেরিয়ে যাবেন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এরপরও তাঁরা পরীক্ষা বর্জন করেছেন। আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের সময় তাঁরা প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। এরপর করোনার কারণে একাডেমিক কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। সব মিলিয়ে তাঁদের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পার হয়ে গেল ক্যাম্পাসে। তাঁরা প্রত্যেকেই আসলে এ ক্ষতিটা স্বীকার করে নিয়ে পরীক্ষা বর্জন করেছেন। এ থেকে আন্দোলনের তীব্রতাটা স্পষ্ট হয়।

নানা সময়ে নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পিছিয়ে যায়। করোনা মহামারির সময় তেমনটি আমরা দেখেছি। এর ফলে একাডেমিক শিডিউল যথাযথ মেনে চলা সম্ভব হয়ে ওঠে না। পরীক্ষা বর্জনের কারণে সেখানেও কিছুটা বিচ্যুতি ঘটবে।

বুয়েট কর্তৃপক্ষকে সময়–সময় হতোদ্যম এবং পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণকারী বলে মনে হয়েছে। অতীতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বিভিন্ন সময় নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছিল। এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যে হলের ভেতরে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা সম্ভব হয়েছিল। এ নিয়ে যে আত্মানুসন্ধান করা প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি।
প্রশ্ন

গোটা দেশে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চালু থাকতে পারলে বুয়েটে সমস্যা কোথায়?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: ভালো প্রশ্ন। কথা হলো, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্ররাজনীতি বাস্তবে চালু আছে, সেটা ছাত্রদের স্বার্থরক্ষা করতে পারছে কি? ক্যাম্পাস কি নিরাপদ? শিক্ষার পরিবেশ, হলের পরিবেশের কী অবস্থা?

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতিকে প্রথমত নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের স্বার্থরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হতে হবে। সময় সময় সামান্য প্রতিবাদ–আন্দোলন ছাড়া প্রচলিত ছাত্ররাজনীতি বর্তমানে প্রায় অস্তিত্বহীন। এই প্রায় অস্তিত্বহীন ছাত্ররাজনীতি নিয়ে স্মৃতিকাতর হলে হবে না।

যাঁরা আন্তরিকভাবে সক্রিয় ও প্রাণবন্ত ছাত্ররাজনীতি দেখতে চান, ছাত্রদের এবং দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত ছাত্ররাজনীতি দেখতে চান, তাঁদের অতীতমুখী না হয়ে বরং নতুন চিন্তা করতে হবে।

প্রশ্ন

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবির পেছনে একটি অভিযোগ, এখানে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রভাব বিস্তার করেছে। এটিকে কীভাবে দেখেন?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: এটি একটি বাজে ও সস্তা অভিযোগ। যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন, সেই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়ার অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। এটা সাধারণভাবে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে জঘন্য অপপ্রচারও বটে।

এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে সরকারি সংস্থাগুলো ব্যবস্থা নিক। এর সঙ্গে ছাত্ররাজনীতির প্রশ্নটি এক করে দেখার প্রয়োজন কোথায়? এই সঙ্গে এটাও বলা দরকার মনে করি যে এটি একটি মারাত্মক ক্ষতিকর প্রপাগান্ডা।

বুয়েট আন্তর্জাতিকভাবে যথেষ্ট পরিচিত। এখানকার গ্র্যাজুয়েটরা বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ পান। বুয়েট গ্র্যাজুয়েটদের একটি বিরাট অংশ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ নানা দেশে কর্মরত। অনেকেই বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন এবং প্রকৌশল ও কারিগরি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। এটাও দেখার বিষয় যে বহুসংখ্যক বুয়েট গ্র্যাজুয়েট বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত এবং প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক বুয়েট গ্র্যাজুয়েট সেখানে যোগ দিচ্ছেন।

এখন যদি ক্রমাগতভাবে এ কথা বলা হতে থাকে যে বুয়েটে জঙ্গিবাদীরা মহা সক্রিয়, সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন পেছন থেকে তারা পরিচালনা করে, তাতে শুধু মিথ্যাই বলা হবে না, দীর্ঘ মেয়াদে আন্তর্জাতিকভাবে বুয়েটের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং দেশের জন্য তা ক্ষতিকর হবে। এ ধরনের প্রচারণা থেকে দেশে বা বিদেশে কারা লাভবান হবে, সেটা ভাবার বিষয়।

‘সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্ররাজনীতি বাস্তবে চালু আছে, সেটা ছাত্রদের স্বার্থরক্ষা করতে পারছে কি? ক্যাম্পাস কি নিরাপদ? শিক্ষার পরিবেশ, হলের পরিবেশের কী অবস্থা?’
প্রশ্ন

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালুর পক্ষে বর্তমান ক্যাম্পাস প্রশাসনকেও অভিযুক্ত করার বিষয়টি সামনে আসছে। আপনি কী মনে করেন?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: আমার মনে হয়েছে, বুয়েট কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে যে তারা ছাত্ররাজনীতি চালুর বিরুদ্ধে। তারা যদি প্রথমেই স্পষ্ট ও জোরালোভাবে বলত যে তারা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চায় না এবং এ জন্য যা যা করণীয় সব করবে; যদি দৃঢ়তার সঙ্গে এটা বলা হতো যে বুয়েটের অধ্যাদেশ অনুসারে এখানে দেশে প্রচলিত ছাত্রসংগঠনের কাঠামোতে তৎপরতা চালানোর কোনো সুযোগ নেই এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা বিধান তাদের প্রথম অগ্রাধিকার; পাশাপাশি একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভা ডেকে শিক্ষকদের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া হতো—অন্যান্য করণীয় যা হয়তো সব দৃশ্যমান নয়, সেসবের পাশাপাশি যদি এসব করা হতো, তাহলে সবাই তাদের আস্থায় নিতেন।

বরং বুয়েট কর্তৃপক্ষকে সময়–সময় হতোদ্যম এবং পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণকারী বলে মনে হয়েছে। অতীতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বিভিন্ন সময় নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছিল। এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যে হলের ভেতরে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা সম্ভব হয়েছিল। এ নিয়ে যে আত্মানুসন্ধান করা প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বিশেষ একাডেমিক কাউন্সিল সভার দাবি জানালেও তৎকালীন বা পরবর্তী উপাচার্য কেউই তা গ্রাহ্য করেননি। এই সব মিলিয়ে আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এটি পূরণের দায়িত্ব বুয়েট কর্তৃপক্ষের।

প্রশ্ন

দলীয় ছাত্ররাজনীতি না হয় বন্ধ থাকল, কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়েও তো সুষ্ঠু ছাত্ররাজনীতি চালু রাখা যায়, সেটি কেন হয়নি বা হচ্ছে না?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরই প্রথমত একমত হতে হবে যে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ প্রয়োজন। এই নির্বাচনের শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু এটা দরকার।

আমার প্রাথমিক প্রস্তাব, কোনো দলীয় পরিচয়ে এই নির্বাচন হবে না। কোনো পোস্টার, লিফলেট, মিছিল থাকবে না। বুয়েট প্রশাসন হল সংসদ ও কেন্দ্রীয় সংসদের প্রার্থীদের পরিচয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে, প্রার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজের বক্তব্য পেশ করবেন।

এসব বক্তব্য অনলাইনে প্রচারিত হবে এবং স্থায়ীভাবে থাকবে। এ ছাড়া যদি জাতীয় কোনো পরিস্থিতিতে কোনো ভূমিকা পালনের প্রয়োজন হয়, তা উন্মুক্ত সভার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নির্ধারণ করবেন। এসবের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা, সহনশীলতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হবে। তাঁরা হয়ে উঠবেন সমগ্র জনগণের সন্তান।

প্রশ্ন

ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে বুয়েটের আলাদা গুরুত্ব নিয়েও একটি আলোচনা আমরা দেখতে পাই। সেটি আসলে কেমন? মানে বুয়েট কেন আলাদা?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: ‘বুয়েটের আলাদা গুরুত্ব’ আছে, তাই এখানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে—এ হলো অহমিকাপূর্ণ কথাবার্তা। বুয়েটের কেউ এমন কিছু বলেছেন বলে আমি শুনিনি।

এটা ঠিক যে বুয়েটের বিশিষ্টতা আছে। তবে সেটাও অভূতপূর্ব কিছু নয়। পৃথিবীর সব দেশেই আপনি এমন সব বিশ্ববিদ্যালয় পাবেন, যেগুলো সে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় গুণে-মানে-উৎকর্ষে অনেক উঁচুতে। বুয়েট এই কাতারের বিশ্ববিদ্যালয়। এটা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এটা হঠাৎ করে হয়নি, অর্জন করতে হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্জন করতে হয়েছে।

এটা ঠিক যে বুয়েটের ছাত্রদের আবাসিক ব্যবস্থাপনায় সিরিয়াস সমস্যা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তা ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু একাডেমিক ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে এবং নিয়মিতভাবে তার সংশোধন ও উন্নয়ন করা হয়। এমনকি উপাচার্য চাইলেও সেখানে হাত দিতে পারবেন না। বাংলাদেশের প্রকৌশল শিক্ষার ওপর বুয়েটের এই একাডেমিক উৎকর্ষের প্রভাব গভীর ও ব্যাপক।

প্রশ্ন

অনেকে সমালোচনা করেন, বুয়েটে পড়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বাইরে চলে যান। আপনি কী বলবেন?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানি খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ১৩ লাখ শ্রমিক বিদেশে গেছেন, এর আগের বছর গেছেন ১১ লাখের বেশি। এটা যে কারণে হচ্ছে, সেই একই কারণে বুয়েটের গ্র্যাজুয়েটরা বাইরে চলে যাচ্ছেন। সংখ্যাটা হয়তো তুলনামূলকভাবে বেশি। কেননা তাঁদের জন্য বাইরে যাওয়াটা তুলনায় সহজ। এই যে ব্যাপক হারে জনশক্তি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, তার কারণ এখানে প্রকৃতপক্ষে কোনো শিল্পায়ন হয়নি। অনেক কলকারখানা হয়েছে, কিন্তু শিল্পায়ন হয়নি।

দেশের ভেতরে মানুষের বিপুল শ্রমশক্তিকে উৎপাদনশীল কর্মে নিয়োজিত করা যাচ্ছে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকার বেশি, সেখানে শিল্প খাতের উন্নয়নে শিল্প মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ তিন হাজার কোটি টাকার সামান্য বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫২১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এই হলো অবস্থা‌। সুতরাং লাখ লাখ শ্রমিক বিদেশে চলে যাচ্ছেন, বুয়েট গ্র্যাজুয়েটরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশে প্রকৃত শিল্পায়ন হলে এই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।

প্রশ্ন

বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অনেকে বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে যুক্ত হন। নিজস্ব পেশাগত জায়গা ছেড়ে এভাবে সরকারি চাকরিমুখী হওয়া নিয়ে অনেকে সমালোচনা করে থাকেন। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: যাঁরা দেশে থাকছেন এবং পেশাগতভাবে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন, তাঁরা দেখছেন তাঁদের তুলনায় যাঁরা বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে যুক্ত হচ্ছেন, তাঁরা সুযোগ–সুবিধায় অনেক এগিয়ে থাকেন। এখন কথা হচ্ছে, কে পিছিয়ে থাকতে চায়।

শুধু বুয়েট না; দেশের আরও সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করে গ্র্যাজুয়েটরা বের হচ্ছেন। এখানে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণের মান যথেষ্ট ভালো। অনেকে বাইরে গিয়ে গবেষণা ও উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করছেন। এই পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ দেশে প্রয়োগের সুযোগ সীমিত।

একটি উদাহরণ দিই, দেশের বিদ্যুৎ খাতে মাস্টারপ্ল্যান করে জাপানিরা। একটি দেশের বয়স ৫০ বছর হয়ে গেছে, সে দেশের একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হচ্ছে বাইরের বিশেষজ্ঞ দিয়ে, এটি কি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য? এ মাস্টারপ্ল্যান করার সক্ষমতা আমাদের প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের আছে। কিন্তু তাঁদের দিয়ে তা করানো হয় না। কারণ, এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।

ফলে অনেকে দেশের বাইরে চলে যান, অনেকে বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে যুক্ত হয়ে বস্তুগতভাবে লাভবান হচ্ছেন। এখন প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতে পারা বা পারা নিয়ে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি ভিন্ন বিষয়।

অন্য আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, একজন প্রকৌশলী চাইলে ভালো একজন অর্থনীতিবিদ হতে পারবেন; কিন্তু একজন অর্থনীতিবিদ ভালো একজন প্রকৌশলী হবেন, এটি সম্ভব নয়। গণিতনির্ভর কাঠামোবদ্ধ প্রকৌশলশিক্ষায় একজন শিক্ষার্থী যা শেখে, তা সামাজিক ক্ষেত্রেও ভালোমতো প্রয়োগ করা যায়। সেদিক দিয়ে বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী প্রশাসনে গেলে সম্পদের অপচয় হয়তো হয়, তবে ক্ষতি হয় না।

প্রশ্ন

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। দেশের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসি (পাস) সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। ইতিমধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করে এ-সংক্রান্ত একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়েছে। এটি আসলে কতটা বাস্তবসম্মত?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের বিএসসি (পাস) সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। এই কোর্সের সুনির্দিষ্ট কোর্স কারিকুলাম আছে। এই বিএসসি (পাস) একটি একাডেমিক ডিগ্রি। এর সঙ্গে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কোর্স কারিকুলাম মেলে না। কর্মক্ষেত্রে দুই বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা থাকলে তার বিনিময়ে এমন একাডেমিক ডিগ্রি দেওয়ার বিষয়টি একেবারেই সামঞ্জস্যহীন।

এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই নজিরবিহীন। বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষাক্ষেত্রে তো বটেই, এটা সাধারণভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য বৃদ্ধি করবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, তা ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রশ্ন

বিএসসি (পাস) ইঞ্জিনিয়ার—এটি কেমন ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট? এটি পেলে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা কী সুফল পাবেন? তা ছাড়া তাঁদের সঙ্গে আপনাদের পেশাগত দ্বন্দ্ব তৈরি হবে কি না?

আবদুল হাসিব চৌধুরী: বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী বিএসসি (পাস) ইঞ্জিনিয়ার কোনো ডিগ্রি নয় বা এটি কোনো সার্টিফিকেটও নয়। আসলে এটা স্বীকৃত কোনো কিছুই নয়।

ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নানান দাবিদাওয়ার মধ্যে বিএসসি (পাস) কখনো ছিল না বা তাঁরা কখনো এই ডিগ্রি চাননি। এই ডিগ্রি ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের দেওয়া হলে তাঁরা নিজেদের বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারের সমমানের দাবি করবেন।

এর ফলে ডিগ্রি প্রকৌশলীদের সঙ্গে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নতুন করে পেশাগত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে। প্রকৌশল পেশার ক্ষেত্রে এটা নৈরাজ্য বৃদ্ধি করবে। হয় এটা অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত, নয়তো সুচিন্তিতভাবে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

আবদুল হাসিব চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।