সালাহউদ্দিন এম. আমিনুজ্জামান
সালাহউদ্দিন এম. আমিনুজ্জামান

ভালো নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় ও বাস্তবানুগ সংস্কার করতে হবে

জুলাই-আগস্টের আন্দোলন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, নতুন সরকারের কর্মকাণ্ড, তাদের চ্যালেঞ্জ, স্থানীয় সরকার—এসব নানা বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম. আমিনুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

প্রশ্ন

একটা বড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান ঘটে গেল দেশে। এর আগে-পরের নানা ঘটনা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে, হয়তো আরও চলবে। এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে কিছু বলবেন?

সালাহউদ্দিন আমিনুজ্জামান: এই আন্দোলন এবং সরকারের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আমি যে খুব অবাক হয়েছি তা নয়। এটা খুব অপ্রত্যাশিতও ছিল না আমার কাছে। মনে হয় এমন একটা অবস্থার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ক্ষোভ, হতাশা, অনিশ্চয়তা ছিল। এসবের সমাধান চেয়েছিল মানুষ। তাই তারা আন্দোলন করেছে।

এখন প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এর কৃতিত্ব নিতে চাইবে বা কতটা নেবে আমি জানি না। কিন্তু আমি এর কৃতিত্ব দেব ছাত্র ও জনতাকে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে জনগণের সেই অংশগ্রহণ আমাদের আশাবাদী করে। কিন্তু একইভাবে আরেকটি দিকও আছে এই আন্দোলনের। এ দেশে যতগুলো গণ-আন্দোলন হয়েছে , সেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৬৯ এর গণ-আন্দোলন এরপর আরও গণ-আন্দোলন—সবখানে একটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল। এবারে কিন্তু তা ছিল না। এর ফলে আমি এ আন্দোলনের পর একটি অনিশ্চয়তার আশংকা দেখতে পাই। সাধারণের মানুষের অংশগ্রহণে যে বিপ্লব হয়নি, তা নয়। কিন্তু দৃশ্যমান নেতৃত্ব না থাকাটা একটি ভিন্ন অবস্থা। অনেকে বলছে, বিএনপি এই আন্দোলনের নেপথ্যে ছিল। এটা কেন ? বিএনপি কি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল যে তাদের নেপথ্যে থাকতে হবে?

প্রশ্ন

একটু আগে আপনি বলছিলেন, সর্বশেষ আন্দোলন অনিবার্য ছিল। এর পেছনে কী কী কারণ কাজ করেছে বলে আপনার মনে হয়।

সালাহউদ্দিন আমিনুজ্জামান: আগের সরকারের কয়েকটি বিষয় মানুষকে পথে নামতে উদ্দীপ্ত করেছে বলে মনে হয়। এর একটি কারণ হতে পারে দলীয়করণ। দলীয়করণের তথ্যগত প্রমাণ নেই। কিন্তু এর প্রতিফলন আমরা দেখেছি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে উঠেছিল। আরও একটি দিক ছিল ভোটারবিহীন নির্বাচন। এতে করে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিজেদের ওপর আত্মবিশ্বাসও কমে গিয়েছিল। বিএনপি আমলের শেষের দিকে এ ধরনের অবস্থা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ আমলে আমলাতন্ত্রের দৃশ্যমান আদর্শিক কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। পুলিশ
বাহিনীতেও দলীয়করণ হয়েছে, এর প্রভাব পড়েছে। একপর্যায়ে তা প্রায় দৃশ্যমান হয়ে পড়েছিল। এতে করে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থার জায়গা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

২০১৪ সাল থেকে যেসব নির্বাচন হয়েছে সেগুলোকে কোনোভাবেই সুষ্ঠু বলার কোনো অবকাশ নেই। এসব নির্বাচন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং কোনো উত্তেজনারও বিষয় ছিল না। যিনি শাসক দলের মনোনয়ন পেয়েছেন, তিনি নিশ্চিত ছিলেন তিনি জিতবেন। আর তাঁর সঙ্গের যেসব লোক ছিলেন, তাঁরা কিছুটা আনন্দ উল্লাস করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের চাহিদার দিকটা পুষ্ট হলো না, অস্পষ্ট হয়ে থাকল। আর এসব নির্বাচনে বিজয়ীরাও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না।

আমি বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর কথা বলব। এখানে প্রত্যেকটা মানুষ প্রার্থীদের মতো নিজেরাও নির্বাচনের অংশীজন। ভোটের আনন্দ, আত্মপ্রত্যয়, আত্মসম্মান এসব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মানুষ পায়। সেখানে গণতন্ত্রের স্পৃহা তৈরি হয়। আমরা বলি, স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রের সূতিকাগার। আমরা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সে অবস্থা রাখিনি। এটা গত বিএনপি সরকারের শেষ দিক থেকে শুরু হয়েছে। গত ১৫ বছরের আরও বেড়েছে। ফলে গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে। এসব নির্বাচনে যেসব জনসেবক এসেছেন তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মূলত সুযোগসন্ধানী। স্থানীয় সরকারে মনোনয়ন কে পাচ্ছে সেটাই ছিল বড় বিষয়।

আগের সরকারের আরেকটি বিষয় ছিল দুর্নীতি। এখন এটি জাতীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। এটা নিয়ে কেউ লজ্জিতও নয় বলে মনে হয়।

প্রশ্ন

নতুন অন্তর্বর্তী সরকার কেমন হলো?

সালাহউদ্দিন আমিনুজ্জামান: যেসব ব্যক্তি সরকারে আছেন তাঁরা নিজ নিজ জায়গায় যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাদের সামাজিক একটি ইমেজ আছে। কিন্তু রাষ্ট্র চালানো বা সরকার চালানোর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অনেকেরই নেই। তবে সেটার জন্য খুব বেশি অসুবিধা নেই। তাঁরা নিশ্চয়ই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। তারা আমলাদের সঙ্গে কথা বলে প্রক্রিয়াগুলো বুঝে নেবেন। তবে বাইরে থাকা মানুষদের আমলাতন্ত্র নিয়ে একটি ক্রিটিক্যাল মনোভাব থাকে। আসলে এত ক্রিটিক্যাল না। নতুন যারা গেছেন তাঁদের আমলাতন্ত্র সম্পর্কে জানতে হবে। আমলাতন্ত্রকে এ বার্তা দিতে হবে, আমার কোনো স্বার্থ নেই, স্বার্থটা রাষ্ট্রের। আমলাতন্ত্র নিজের স্বার্থ এবং সরকারের স্বার্থ দেখে। তাদের সেই অবস্থান থেকে সরে আসতে বার্তা দিতে হবে। আইন ও নীতিমালার বাইরে আমলাতন্ত্রকে কোনো কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না। সরকারের কোনো নীতি নেই যা মানুষকে অত্যাচার বা বঞ্চিত করতে পারে।

প্রশ্ন

আপনার কথার অর্থ হলো আমলাতন্ত্রকে সঠিকভাবে পরিচালন করতে হবে?

সালাহউদ্দিন আমিনুজ্জামান: ঠিক তাই। এমন ভাঙাচোরা অবস্থায়ও  আমি আমলাতন্ত্রের মধ্যে সম্ভাবনা দেখি। দুটো কারণে দেখি। এক হলো, তাদের মেধা। আমাদের গড়পড়তা মানুষদের চেয়ে তাদের মেধা বেশি। দ্বিতীয়ত, তাদের শ্রেণি চরিত্র। এদের বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে এসেছে একেবারে গজদন্ত মিনার থেকে নয়। ভৃত্য-সেবা  দিয়ে পরিবেষ্টিত পরিবেশ থেকে তারা আসে সা। আমি আমার ছাত্রদের দেখেছি, অনেকেই অতি সাধারণ ঘর থেকে আসা। এই ছেলে বা মেয়েটি কার সঙ্গে  অন্যায় বা রুঢ় আচরণ করবে, বাবা-চাচার সঙ্গে? অনেকেই কৃষকের সন্তান। আমার এক শিক্ষক বলতেন, এক প্রজন্মের আমলারা কৃষকের সন্তান হবে। আসলে হয়েছেও তাই। কষ্ট করে তারা এসেছে।

প্রশ্ন

নতুন সরকারের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে বলবেন, কী হওয়া উচিত?

সালাহউদ্দিন আমিনুজ্জামান: প্রথম কাজ হবে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা। এই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, তাঁরা একটি ভালো নির্বাচন দেবেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করতে হবে এবং তা বাস্তবানুগ হতে হবে। সবাইকে জানিয়ে এসব সংস্কার করতে হবে, সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের নিজস্ব কোনো এজেন্ডা রাখা যাবে না, এজেন্ডাই হবে সুষ্ঠু নির্বাচন আর এর জন্য যতটা কাজ তা করতে হবে। আর অর্থনৈতিক যে বিপর্যয় আছে তা যথাযথভাবে সারানোর চেষ্টা করা। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চেষ্টা করতে হবে। দ্রব্য-মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে।  

আরেকটি বড় বিষয় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এর উন্নতি করতেই হবে। মানুষের আস্থা অর্জনের বড় দিক হতে পারে এটি।

প্রশ্ন

কী কী চ্যালেঞ্জ এই সরকারের সামনে, সেগুলো উত্তরণে তারা কতটুকু সফল হতে পারবে বলে মনে করেন?

সালাহউদ্দিন আমিনুজ্জামান: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মানুষের মধ্যে একটি বড় সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে যারা নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের জন্য সহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে মানুষের মধ্যে ভীতি এবং শঙ্কা আছে। পুলিশের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে। আবার অর্থনীতিও বেসামাল, রিজার্ভের সংকটের কথা সকলেই জানি। এর পাশাপাশি বলব, আমলাতান্ত্রিক সংকট। তারা এক ধরনের আত্মপরিচয়ের সংকটে আছে। যারা আওয়ামী মানসিকতার তারা ভয় পাচ্ছে, যদিও তাদের সক্ষমতার অভাব নেই। তারা তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনেও সে জন্য দ্বিধাগ্রস্ত থাকছে। যারা এই সরকারের পক্ষে আছে তারা হয়তো ক্ষমতা দেখাতে চাইছে। এ নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। এটা হয়তো এখনো প্রকট আকারে প্রকাশ পায়নি। কিন্তু অচিরেই তা প্রকাশ পেতে পারে বলে মনে হয়। সেটার নিরসনে সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে।

প্রশ্ন

আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো স্থানীয় সরকার নিয়ে। এ প্রসঙ্গে আসি শেষে। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর দেশের সব কটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের মেয়র, চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে। এ উদ্যোগকে কীভাবে দেখছেন?

সালাহউদ্দিন আমিনুজ্জামান: বিভিন্ন স্তরে একসঙ্গে এতগুলো স্থানীয় সরকার ভেঙে দেওয়া একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এতে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন ও পরিষেবা ব্যাহত হবে এবং অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া নানাবিধ দ্বন্দ্ব আর বিশ্বাস হীনতার পরিবেশ তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সামগ্রিকভাবে এর ফলে স্থানীয় সরকারের কার্যকারিতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং ইমেজের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়াও স্থানীয় জনগণের মধ্যে এক ধরনের হতাশা সৃষ্টি হতে পারে যা স্থানীয় সরকারের জন্য সুদূরপ্রসারী কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এই পদক্ষেপটি আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক বলা হয়তো ঠিক হবে না। তবে বিগত বেশ কিছু বছরের ঘটনাক্রমের কারণে এই পদক্ষেপটি অবশ্যম্ভাবী ছিল। সার্বিকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবের কারণে এমন একটি অনভিপ্রেত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।