অধ্যাপক এম শামসুল আলম। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি প্রকৌশল অনুষদের ডিন ও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় গঠিত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা। জ্বালানিসংকটের কারণ ও দায় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও রাফসান গালিব
প্রথম আলো: এই সরকারের আমলে জ্বালানি খাতের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপের পরও কেন সংকট দেখা দিল?
এম শামসুল আলম: এই সংকট দ্বিমুখী। একদিকে জ্বালানি ভোক্তাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের ভর্তুকি বেড়ে গেছে। সংকটটা চলে আসছিল আগে থেকেই। কয়েক মাস আগে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে যখন বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) গণশুনানির আহ্বান করল, আমরা সেখানে এর প্রতিবাদ করেছি। আমরা বলেছি, সংকট সমাধানে সরকার চাইলে সীমিত পর্যায়ে লোডশেডিং করতে পারে। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে চলতি বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮ হাজার ৪১৬ কোটি ইউনিট নির্ধারিত হয়েছে। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ উৎপাদন কমালেও তরল জ্বালানি ব্যয়ের একটি বড় সাশ্রয় হবে। আমরা বলেছি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হবে আত্মঘাতী।
এর জন্য কি কেবল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি দায়ী বলে মনে করেন?
এম শামসুল আলম: সরকারের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও এলএনজির মূল্যবৃদ্ধির কারণেই এ সংকট হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি, সরকারের ভুল নীতির কারণেই এটি হয়েছে। সরকার ইচ্ছা করেই দেশের গ্যাসসম্পদ নতুন করে অনুসন্ধান ও আহরণের চেষ্টা করেনি। একসময় বলা হতো দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। ২০১৬ সালের পর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলতে শুরু করলেন, মাটির নিচে গ্যাস নেই। দুটোই অসত্য। এখনো আমাদের বিদ্যুতের ৬০ শতাংশের বেশি আসে দেশীয় উৎস থেকে। সরকার যদি বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে না। দুর্ভাগ্য হলো সরকার পুরো বিষয়টি দেখছে রাজস্ব ঘাটতির দৃষ্টিভঙ্গিতে। ভোক্তার স্বার্থের কথা তারা ভাবছে না।
দাম না বাড়িয়ে সংকট সমাধানে আপনাদের বিকল্প প্রস্তাব কী?
এম শামসুল আলম: জ্বালানি খাতে এখন যে উন্নয়ন হচ্ছে, সেটি অসম এবং সামঞ্জস্যহীন। কিন্তু আমরা বলেছি, টেকসই উন্নয়ন হতে হবে। টেকসই উন্নয়ন হলে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়ই লাভবান হবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো ব্যয় বাড়াল। আবার এসব প্রতিষ্ঠানকে বলে দেওয়া হলো এত ভাগ লাভ করতে হবে। ফলে সেই লাভ ধরে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ানো হলো। ভোক্তা দুই দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ২০১০ সালে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নামে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ করে দেওয়া হলেও সেখানে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার সুযোগ ছিল না। বিশেষ গোষ্ঠী এ সুযোগ পেয়েছে। প্রথমে আইনটি করা হয়েছিল দুই বছরের জন্য। এরপর পাঁচ বছর বাড়ানো হয়। এখন বলা হচ্ছে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এ আইনের প্রয়োজন আছে। আবার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) আয় ও ব্যয়ের যে হিসাব দিচ্ছে, তা আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি এবং আন্তর্জাতিক অডিট ফার্ম অথবা মহা হিসাবরক্ষকের দপ্তরের মাধ্যমে নিরীক্ষা করার দাবি জানিয়েছি। জ্বালানি খাতে কী ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়, তার একটি উদাহরণ দিই। এলএনজি আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। এর জন্য আমদানিকারককে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হবে, তার অনুকূলে শতভাগ কাগজপত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটি দিয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক কৈফিয়ত চাইলে তারা বাকি ৫০ শতাংশ সেবা খাতে ব্যয় করার কথা জানিয়েছে। অথচ এমন এলসির অর্থ সেবা খাতে খরচ করার কোনো সুযোগ নেই।
আপনাদের আপত্তি উপেক্ষা করে যদি সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আবার বাড়ায়, জনজীবনের কী ধরনের প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে বলে মনে করেন?
এম শামসুল আলম: আমরা সরকারকে চিঠি দিয়ে বলেছি, বিদ্যুতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭ শতাংশ। ইতিমধ্যে ১০ শতাংশ লোডশেডিং বেশি করা হচ্ছে। ফলে আগে যে দাম ধরা হয়েছে, সেটাই বেশি। এখন কমানোর জন্য গণশুনানি হোক। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জ্বালানি তেলের মূল্যহার বিইআরসি আইন লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর অবৈধ উপায়ে বৃদ্ধি করে আসছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ফের বাড়ানো হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও হ্রাস পাবে। সরকার জ্বালানি খাতে যে ঘাটতি দেখাচ্ছে, প্রকৃত ঘাটতি তার চেয়ে অনেক কম। গণশুনানি গেলে তা প্রমাণ হবে।
বিইআরসির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আপনারা বলছেন। কিন্তু বিইআরসি তো সরকারের নির্দেশেই চলে। সে ক্ষেত্রে ক্ষমতা বাড়ানো বা কমানো হলে ভোক্তার ওপর তার কী প্রভাব পড়বে?
এম শামসুল আলম: বিইআরসির ক্ষমতা আছে। প্রয়োগের সক্ষমতা নেই। আমরা চাইছি ক্ষমতা তারা প্রয়োগ করুক। যেমন এলপিজির দাম ইচ্ছেমতো মালিকেরা বাড়িয়ে নিতেন। আমরা আদালতে গিয়ে বলেছি, এটি তাঁরা করতে পারেন না। আইন অনুযায়ী সব ধরনের জ্বালানির দাম নির্ধারণ করবে বিইআরসি এবং তা গণশুনানি করে। এখন কিন্তু সেটিই হচ্ছে। তারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়াতে পারছে না।
জ্বালানি খাতে আপনারা সিস্টেম লস বা চুরি-অপচয়ের কথা বলেন। এ ব্যাপারে আপনাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে?
এম শামসুল আলম: হ্যাঁ, আছে। আমাদের হিসাব বলছে, ঢাকা শহরে বাসাবাড়িতে যে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, তাতে ৪০ শতাংশ গ্যাস চুরি হচ্ছে, অপচয় তো আছেই। এ চুরি ও অপচয় বন্ধ করতে প্রিপেইড মিটার চালু করা হলো। এখনো প্রায় ৮০ শতাংশ বাড়িতে সেই মিটার বসানো হয়নি। সেই মিটার দেয় বিতরণ কোম্পানি। তারা ভোক্তাদের নিম্নমানের মিটার গছিয়ে দেয়। ১০ ডলারের মিটারের দাম নেয় ২৫ ডলার। বিপরীতে বিলের সঙ্গে মাসে ভাড়া নেয় ১০০ টাকা। এখানে অনিয়ম বা লুণ্ঠন কি ঘটেনি?
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? আপনারা অভিযোগ করে যাবেন আর সরকার তার মতো কাজ করতে থাকবে?
এম শামসুল আলম: উপায় তো আছেই। সরকারকে সবকিছু ব্যবসায়িক বিবেচনায় দেখলে হবে না। এসব প্রতিষ্ঠান যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁরা সরকারি কর্মচারী। তাহলে তাঁরা লভ্যাংশ কেন পাবেন? এসব প্রতিষ্ঠানে খরচ ও আয়—দুটিই বেশি দেখানো হয়। বেশি আয় দেখানো হলে কর ও ভ্যাটের পরিমাণও বেড়ে যায়। আর লভ্যাংশ, প্রফিট বোনাস ইত্যাদি নামে কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন।
আইনানুযায়ী জ্বালানি খাতের আপস্ট্রিম রেগুলেটর বিধায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা লাইসেন্সিদের পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান বা পরিচালক কোনো পদই গ্রহণ করতে পারেন না। অর্থাৎ তাঁরা লাইসেন্সি বা লাইসেন্সির প্রতিনিধি হতে পারেন না। অথচ তাঁরা লাইসেন্সিদের পরিচালনা বোর্ডে কেউ চেয়ারম্যান ও কেউ পরিচালক, অর্থাৎ লাইসেন্সি প্রশাসন পরিচালনায় শীর্ষ ব্যক্তিরা। ফলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ স্বার্থের সংঘাতে যুক্ত এবং লাইসেন্সিদের আপস্ট্রিম রেগুলেটর হিসেবে অকার্যকর। ভোক্তাস্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণে তাঁদের ভূমিকা সাংঘর্ষিক।
আমাদের প্রশ্ন হলো, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠানে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারেন না। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন খাত পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সংস্থা বা করপোরেশন করা হয়। এসব করপোরেশনের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন বা আছেন, তাঁদের কারও কারিগরি জ্ঞান নেই। অতিরিক্ত সচিব হলেই করপোরেশনের চেয়ারম্যান হন। যখন করপোরেশনগুলো ঠিকমতো চলছিল না, তখন পুনর্গঠনের নামে কোম্পানি করে দেওয়া হলো। যাঁরাই করপোরেশন চালাতেন, সেই মানুষগুলোই হয়ে গেলেন কোম্পানির হর্তাকর্তা। তাঁদেরই কোম্পানির মালিক বানিয়ে দেওয়া হলো। এতে তো জনগণের কোনো লাভ হয়নি। সেবার মানও বাড়েনি, হয়রানিও কমেনি। ফলে ভোক্তারা দুই দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত। এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। সরকার সরকারি কর্মচারীদের রাষ্ট্রের মালিক বানাতে পারে না।
জ্বালানি খাতের আমদানির ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কীভাবে ব্যয় কমানো যেত বলে মনে করেন?
এম শামসুল আলম: ব্যক্তি খাতের পরিবর্তে সমুদয় ফার্নেস তেল বিপিসির মাধ্যমে আমদানি করা হলে সাশ্রয় হতো প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। আমদানি পর্যায়ে ফার্নেস তেলে শুল্ক ও কর অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা না হলে সাশ্রয় হতো প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা। বিইআরসির মানদণ্ডমতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে মার্জিন বা মুনাফা ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। তা মানা হলে তাতে কত কোটি টাকা সাশ্রয় হতো, সে হিসাব নেই। যখনই জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় বাড়ে, তখন শুল্ক-ভ্যাট-করাদি এবং বিপিসির মুনাফার পরিমাণও বাড়ে। তা নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তাপর্যায়ে মূল্যহার বৃদ্ধি ন্যায্য ও যৌক্তিক করার মতো কোনো বিবেচনায় বিপিসি ও জ্বালানি বিভাগের বিবেচনায় থাকে না। অর্থাৎ মূল্যহার নির্ধারণে জনস্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষার মতো মৌলিক বিষয় উপেক্ষিত এবং সরকারের জনকল্যাণমূলক আদর্শের পরিপন্থী।
মহাহিসাবরক্ষকের অফিস থেকে নিরীক্ষণের কথা বলেছেন। এর নজির কি আছে?
এম শামসুল আলম: আছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসার আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে আপত্তি ওঠায় আদালতের নির্দেশে ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মহাহিসাবনিরীক্ষকের অফিস নিরীক্ষা করেছে।
ফার্নেস তেল ও এলএনজি গ্যাস আমদানি নিয়ে আপনাদের আপত্তি কোন জায়গায়?
এম শামসুল আলম: কথা হচ্ছে ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গত বছরে ২০০ বা ১৫০ শতাংশ ফার্নেস তেল ব্যবহার করা হলো কেন? বিপিসি ফার্নেস তেলের দাম বাড়িয়ে বাড়িয়ে এ জায়গাটায় নিয়ে গেছে। এরপর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, ফার্নেস তেল আমদানি করা হচ্ছে ৫০ লাখ টন, তার ৪৫ লাখ টনই বেসরকারি খাতে আমদানি করা হচ্ছে। যার দাম দেওয়া হচ্ছে লিটারে ৯২ টাকা করে। চিন্তা করতে পারছেন ভূতটা কোথায় লুকিয়ে আছে? রেন্টাল বিদ্যুৎ নিয়েও দেশবাসী এখন বুঝে গেছে, বিশেষভাবে বিশেষ কিছু মানুষের পকেটে এ প্রক্রিয়ায় টাকা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এই যে ফার্নেস তেল আমদানি করার জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করে লিটারপ্রতি ৯২ টাকা দিয়ে কেনায় বছরে আপনি আট হাজার কোটি টাকার বেশি দিচ্ছেন। আবার বিপিসি কত বেশি নিচ্ছে আমরা জানি না। তারা যদি গণশুনানিতে আসত, তাহলে সেটি জানা সম্ভব হতো। নিজস্ব সম্পদ না বাড়িয়ে এলএনজি গ্যাস আমদানি করা হলো। এর ফলে ১ টাকা ৩ পয়সা দামে যে ১ ঘনমিটার গ্যাস আমরা পেতে পারতাম, সেটি স্পট মার্কেট থেকে কিনতে গিয়ে খরচ হচ্ছে ৮৩ টাকা। একটুও বিবেকে বাধল না তাদের। যে গ্যাস দেশীয় কোম্পানি বা বাপেক্সের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে ১ টাকা ৩ পয়সায় কিনতে পাওয়া যায়, সেই গ্যাস এলএনজি হিসেবে আনতে গিয়ে এলএনজি টার্মিনালে সেবা হিসেবে ২ টাকা ১৫ পয়সা চার্জও দেওয়া হচ্ছে। অথচ এর অর্ধেক টাকা খরচ করে এই গ্যাস দেশেই পাওয়া যেত। এ টাকা সরকারকেও খরচ করা লাগত না।
কিন্তু সরকার সেটি করল না কেন?
এম শামসুল আলম: দেশীয় কোম্পানির গ্যাস উৎপাদনের জন্য টাকা নেই বলা হলে গ্যাসের দামের সঙ্গে বাড়তি টাকা দিয়ে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকা সরকারকে দেওয়া হলো, প্রতি মাসে এখনো সেটি দেওয়া হচ্ছে। সেই টাকার মাত্র ৩৫ শতাংশ খরচ করা হয়েছে, বাকিটা খরচ করা হয়নি, যা জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলায় আছে। এ টাকা খরচ করে দেশীয় কোম্পানির গ্যাস উৎপাদন কতটা বাড়াতে পেরেছে, সেই হিসাবও তারা দিতে পারেনি। সে টাকা থেকে তিন হাজার কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে। এখন অব্যবহৃত টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য বিইআরসি সরকারকে চিঠি দিয়েছে। একটি কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করে বিইআরসি থেকে অনুমোদন নিয়ে সেই টাকা খরচ করার কথা। কিন্তু তারা কিছুই করেনি। জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা এ পরিস্থিতি তৈরি করল।
২০১৬ সালে জ্বালানি নিয়ে মাস্টারপ্ল্যানে তো আমদানিনির্ভর নীতি গ্রহণ করা হয়।
এম শামসুল আলম: মাস্টারপ্ল্যান তো আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয় নয়। সেটা তো ইচ্ছেমতো বানানো যায়। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা যদি সেখানে কাজ না করে, তাহলে এ নিয়ে আমরা হইচই করেও কিছু হবে না। ২০১৬ সালের মাস্টারপ্ল্যান ২০২২ সালে এসে বর্ধিত হচ্ছে এবং এর আগে ২০১০ সালে যে প্ল্যান হয়েছিল, সবই একই ধারাবাহিকতায়। প্রতি প্ল্যানে ছিল যে প্রতিযোগিতা, লিস্ট কস্ট জ্বালানি সাপ্লাই এসব নিশ্চিত করা, এর কোনোটাই করা হয়নি। আবার যেগুলো করা ক্ষতিকারক, সেগুলোই করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যে ক্ষতিটা প্রশমিত করা যেত, সেটি করা হয়নি। লিস্ট কস্ট জ্বালানি সাপ্লাইয়ের বিষয়টি যদি নিশ্চিত করা যেত, তাহলে এভাবে ফার্নেস তেল আনতে হতো না। এতে করে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হতো না, যেটি কিছু মানুষের পকেটে চলে যাচ্ছে।
গ্যাস উত্তোলন না করা নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা নিয়ে আপনি কী বলবেন?
এম শামসুল আলম: গ্যাস উত্তোলনের চেষ্টা না করার বিষয়টি মানুষের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু এর বাইরে কিছু অস্পষ্ট বিষয় আছে, যেগুলো সাধারণ মানুষ দেখছে না। সিঙ্গেল সাইকেলের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা কম, গ্যাস খরচ হয় বেশি, বিদ্যুৎ কম দেয় আর কম্বাইন্ড সাইকেলে গ্যাস কম খরচ হয়, বিদ্যুৎ বেশি দেয়। সিঙ্গেল সাইকেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসে ব্যয় হয় দেড় টাকা করে, আর কম্বাইন্ড সাইকেলে সেই খরচ ১ টাকা ১০ পয়সা। যে গ্যাস সিঙ্গেল সাইকেলে ব্যয় করা হচ্ছে, তা যদি কম্বাইন্ড সাইকেলে ব্যয় করা হতো, তাহলে দেড় গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো। এখন পিডিবির যে কম্বাইন্ড সাইকেলের বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার খরচ অনেক কম, সেগুলোর সক্ষমতার মাত্র ৩৬ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। ভোলার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে সবচেয়ে কম খরচ হয়, অথচ সেটির ক্ষমতা ব্যবহার হয় মাত্র ৩৮ শতাংশ। এখন সেটি যদি
৭৪-৭৫ শতাংশ করা যায়, তাহলে গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ২ টাকার নিচে নেমে আসে। ভোলার কম্বাইন্ড সাইকেলের সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নাকি গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে। করোনার আগে ভোলায় ঘুরতে গিয়ে এর কারণ আমি জানতে পারলাম। রাত ১২টায় ফোন আসে, বলা হয়, এই ইউনিট বন্ধ করো, এখন রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ নিতে হবে। এই হচ্ছে ব্যাপার। নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে বেশি ব্যয়ের বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। এভাবে নানা ধরনের সমীকরণ এখানে ঘটেছে। কারণ, সরকার ব্যবসা করার মডেলে ঢুকে গেছে, যাতে মানুষেরই সর্বনাশ ঘটছে।
আপনার ভাষ্য অনুযায়ী, এখানে সরকারের ব্যবসা করা, করপোরেট কালচার তৈরি করে কর্মকর্তাদের সুবিধা গ্রহণ আর কিছু মানুষের পকেট ভারী করা—এ তিন কারণেই মূলত বর্তমান জ্বালানিসংকট। কিন্তু সরকার তো ইউক্রেন যুদ্ধকে এর জন্য দায়ী করছে।
এম শামসুল আলম: অবশ্যই ইউক্রেন যুদ্ধ এখানে মুখ্য নয়। সেটির প্রভাবও অস্বীকার করা যাবে না। তারপরও আমাদের যে নিজস্ব জ্বালানি আছে, তা দিয়ে এখনো আমরা এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারি। জ্বালানি খাতের বিশৃঙ্খলার জন্য যে কারণগুলোর কথা আমি বললাম, সেগুলো না থাকলে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব আমরা এড়াতে সক্ষম।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
এম শামসুল আলম: আপনাদেরও ধন্যবাদ।