বিশেষ সাক্ষাৎকার: আসিফ সালেহ

সমাজে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে আমরা ভূমিকা রেখেছি

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন ৯, ১০ ও ১১ ফেব্রুয়ারি হোপ ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে শেষ হচ্ছে। এ উৎসবের নানা দিক, ব্র্যাকের দীর্ঘ পথযাত্রা ও আগামীর সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

আসিফ সালেহ
প্রশ্ন

৫০ বছর পূর্তি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য দারুণ এক উদ্‌যাপনের উপলক্ষ। বছরব্যাপী সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন আপনারা শেষ করছেন ‘হোপ ফেস্টিভ্যাল’–এর মধ্য দিয়ে। এ হোপ বা আশা কিসের?

আসিফ সালেহ: আমরা যারা উন্নয়ন নিয়ে কাজ করি, তাদের নিরাশ হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ এই কথাটা সব সময় আমাদের বলতেন। আমরা সব সময়ই আশার মধ্যে থাকি, সুযোগগুলো কাজে লাগাতে চাই। আর আমাদের এই আশাবাদের ভিত্তি বাংলাদেশের মানুষ। এটা ঠিক যে আমাদের অনেক হতাশা আছে। দেশ হিসেবে আমরা ছোট, জনসংখ্যা বেশি, সেই তুলনায় সম্পদও কম। আমাদের এটা সবারই জানা যে বাংলাদেশ একসময় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি ছিল। সেই জায়গা থেকে কিন্তু আমরা উঠে এসেছি। বাংলাদেশের এই যে সাফল্য, এর নায়ক বাংলাদেশের মানুষ। এটাই আমাদের আশাবাদের জায়গা। আমাদের মানুষেরা যেমন উদ্যোগী, তেমনি অসম্ভব পরিশ্রমী। বিশেষ করে নারীরা।

আমরা দেখেছি, সুযোগের অভাবে অনেকে অনেক কিছু করতে পারে না। ব্র্যাকের উন্নয়ন মডেলে চ্যারিটি বলে কিছু নেই, আমরা এর বদলে সুযোগহীন মানুষের জন্য বিনিয়োগ করার নীতি নিয়েছি। আমাদের কাজ হচ্ছে দেশের উদ্যমী মানুষেরা যাতে সুযোগের অভাবে পিছিয়ে না পড়ে, সে জন্য তাদের কিছু টুলস দেওয়া। আমরা দেখেছি, আমাদের সমর্থন পেয়ে তারা নিজেরা পরিশ্রম করে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পেরেছে। আমাদের গত ৫০ বছরের যাত্রায় এই মানুষেরাই হচ্ছে আমাদের নায়ক ও নায়িকা। এই জায়গাটা থেকেই আমরা আশা নিতে পারি। এই স্পিরিটকে কাজে লাগিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। সামনের দিনের চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাপারে সবাইকে, বিশেষ করে তরুণসমাজকে যুক্ত করার লক্ষ্য নিয়েই এই হোপ ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করতে যাচ্ছি। আমাদের মানুষের ক্ষমতা আছে, গর্ব করার মতো সাফল্য আছে। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে আরও এগিয়ে যাওয়ার যে আশাবাদ, তা আমরা সবাইকে নিয়ে উদ্‌যাপন করতে চাই।

প্রশ্ন

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলতেন, মানুষ যখন তার ভেতরের শক্তিটাকে উপলব্ধি করতে পারে, তখন আশার আলো জ্বলে ওঠে। ব্র্যাক যে ৫০ বছর ধরে সামনে এগিয়ে চলেছে, সেই অগ্রযাত্রার মূলমন্ত্র কি এই উপলব্ধি?

আসিফ সালেহ: সমাজের সবার অবস্থা এক রকম নয়। কিছু কিছু গোষ্ঠী আছে, যাদের সাধারণ কিছু সহায়তা দেওয়া হলে পরিশ্রম করে নিজেদের ভাগ্যবদলের পথ তারা ধরতে পারে। কিন্তু এর বাইরে সমাজে একটা গোষ্ঠী আছে, যাদের আমরা হতদরিদ্র বলে চিহ্নিত করি। তাদের মধ্যে এ আত্মবিশ্বাস থাকে না যে তারা চেষ্টা করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সব সময় এই দিকটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনে করতেন, মানুষের ভেতরের শক্তিটি জাগিয়ে তুলতে পারলে এবং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগাতে পারলে পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। এই হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের কৌশল হচ্ছে শুরুতে এ পরিবারগুলোকে কিছু সম্পদ দেওয়া। সেটা হতে পারে গরু, জমি বা হাঁস-মুরগি।

এরপর কীভাবে তারা এ সম্পদকে কাজে লাগাবে, সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিই। প্রতি সপ্তাহে তাদের বাসায় গিয়ে পরামর্শ দেওয়া ও উদ্বুদ্ধ করার কাজটি করি। সামান্য এই সম্পদ দেওয়ার পাশাপাশি আমরা আসলে যে কাজটি করি, তা হচ্ছে নিজের সক্ষমতার ওপর আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। প্রতিবছর আমরা এ রকম ১ লাখ পরিবার নিয়ে কাজ করি এবং ২০০২ সাল থেকে আমরা তা করে আসছি। এ কর্মসূচি শুরুর আগে একটি পরিবারের অবস্থা এবং পরের অবস্থার মধ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন আমরা লক্ষ করেছি। তারা হয়তো মনে করছে যে গরু বা সম্পদ দেওয়ায় তাদের ভাগ্যের বদল ঘটেছে, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়, মূল বিষয়টি হচ্ছে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা। আমাদের কর্মসূচিটি দুই বছরের, এরপর আমরা সরে যাই। দেখা গেছে আমরা সরে যাওয়ার পরও তারা নিজের শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের জোরেই তাদের ভাগ্যের বদল অব্যাহত রেখেছে।

প্রশ্ন

বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোনো সংগঠনের ৫০ বছর টিকে থাকাটা বেশ বড় ঘটনা। সেখানে আমরা দেখছি ব্র্যাক টিকে থাকার পাশাপাশি বহুমাত্রিকভাবে বিস্তৃত ও বিকশিত হয়েছে। এর পেছনে নিশ্চয়ই অনেক কারণ রয়েছে। মূল কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

আসিফ সালেহ: আমি বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেছি। ব্র্যাকের ক্ষেত্রে আমার যেটা মনে হয়েছে তা হচ্ছে এখানে সব সময়েই একটা পুশ করার প্রবণতা রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা যখন নেতৃত্বে ছিলেন, তিনি কখনো মনে করেননি যে ব্র্যাক অনেক বড় হয়েছে, এখন একটু বসে থাকি, একটু আরাম করি বা যেভাবে চলছে সেভাবে চলুক। কিন্তু তিনি ক্রমাগত পুশ করে গেছেন, থেমে থাকেননি। আমাদের কাজ হলো নতুন নতুন সামাজিক সমস্যার সমাধান বের করা। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান করা। একটা সমস্যার সঙ্গে আরেকটি সমস্যা জড়িত। এখন ধরুন আমাদের কাছ থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কেউ গরু কিনল ও দুধ উৎপাদন শুরু করল।

এখন তার গ্রামে যদি সেই দুধের বাজার না থাকে, যদি যথাযথ বিপণনব্যবস্থা না করা যায়, তবে দুধ উৎপাদন করে তিনি কোনো ফল পাবেন না। মানে দুধ উৎপাদন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, তা হচ্ছে এর জন্য বাজার তৈরি করা। এর সমাধান করতে গিয়ে আমরা ডেইরি করেছি। একইভাবে শিক্ষার সমস্যা দূর করতে আমরা স্কুল করেছি বা আমরা যে আড়ং করেছি, এগুলো সবই কিন্তু সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হিসেবে করা হয়েছে। আমাদের ব্যাংক শুরু হয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসাকে সহায়তা করার জন্য। তারপর মোবাইলে অর্থ লেনদেনের জন্য বিকাশ হলো। এই যে সামনে চলে আসা সমস্যাগুলোর ক্রমাগত সমাধানের চেষ্টা, এটাই ব্র্যাক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, অব্যাহতভাবে এর বহুমাত্রিক বিকাশ ঘটছে এবং প্রতিষ্ঠানকে প্রাসঙ্গিক রেখেছে।

এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক একটি দিক রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চাইতেন যেকোনো ব্যক্তির ওপর যাতে প্রতিষ্ঠান নির্ভর না করে। আমাদের কোনো সংগঠনই ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। অনেকেই মনে করেছিলেন যে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চলে যাওয়ার পর ব্র্যাকের কী হবে। কিন্তু যে রকম শক্ত ভিত্তির ওপর তিনি ব্র্যাককে রেখে গেছেন, তাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সেভাবেই আমরা চলতে পারছি। বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা সঠিক মূল্যবোধের মানুষ নিয়ে আসতে পেরেছি। এটাও আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের একটি বড় কারণ।

প্রশ্ন

অন্য এনজিওগুলো থেকে ব্র্যাক নিজেকে কতটা স্বতন্ত্র রাখতে পেরেছে? এনজিও বলতেই ত্রাণ ও ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির একটা ছবি ভেসে ওঠে। ব্র্যাক সেই ধারণা কতটা বদলাতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?

আসিফ সালেহ: আমরা যে কাজগুলো করি, তা মূলত গ্রামমুখী। তাই শহরের অনেকেই বুঝতে পারেন না যে আমরা আসলে কী কী কাজ করছি। ত্রাণ ও ক্ষুদ্রঋণের বাইরে আমাদের অনেক কাজ রয়েছে। যেমন ব্র্যাক থেকে আমরা একসময় ৬৪ হাজার স্কুল চালিয়েছি। কোভিডের সময় কাজ করেছি। আশির দশকে যখন ওরাল স্যালাইনের প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছিল, সেখানে আমাদের ভূমিকা ছিল। আমরা পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছি। আমরা স্যানিটেশন নিয়ে কাজ করেছি। নারীদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছি। বর্তমানে আমাদের সমাজ যেখানে এসে দাঁড়িয়ে, তা কিন্তু এক দিনে হয়নি। সমাজে একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে আমরা ভূমিকা রেখেছি। যার সুফল কিন্তু আমাদের সমাজ পাচ্ছে।

প্রশ্ন

এনজিওর ক্ষেত্রে আমরা পশ্চিমা মডেলের আধিপত্য দেখি। আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বৈশ্বিক উন্নয়ন ধারণায় ডিকলোনাইজেশন ঘটিয়েছে ব্র্যাক। ব্র্যাকের উন্নয়ন দর্শন বা মডেল পশ্চিমা থেকে কতটা আলাদা? পশ্চিমা মডেলের সমস্যা কোথায় বলে মনে করেন?

আসিফ সালেহ: পশ্চিমা মডেলের উন্নয়ন ধারণায় সমস্যা সমাধানে তাদের নিজস্ব কিছু প্রেসক্রিপশন থাকে। পশ্চিমা এনজিওগুলো তাদের স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করে। এই ধারণাগুলোর সঙ্গে অনেক সময় স্থানীয় বাস্তবতার মিল না থাকলেও দাতাদের শর্ত মেনে ও তাদের খুশি করতে স্থানীয় সহযোগীদের তা করতে হয়। কাজ হচ্ছে কি না, সেটা আসলে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। স্থানীয় সহযোগীদের লক্ষ্য থাকে তহবিল যথাসময়ে খরচ করে প্রকল্প শেষ করা। বিদেশি বা পশ্চিমা দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়া নিয়ে সমস্যা নেই, কিন্তু কাজ করা উচিত আমাদের বাস্তবতা, আমাদের অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে।

সবচেয়ে বড় কথা, পশ্চিমাদের তহবিল সহায়তাগুলো থাকে প্রকল্পভিত্তিক। তিন বা পাঁচ বছর পর প্রকল্প শেষ হলে সবকিছুই শেষ। এর কোনো ফলোআপ হয় না। ব্র্যাক এ ধরনের শর্টকাট চিন্তাভাবনা থেকে কিছু করে না, করতে চায় না। এ জন্য অবশ্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে প্রকল্পই নিই না কেন, তা আমাদের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এবং স্থানীয়ভাবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে নিয়ে থাকি। বলা যায় আমাদের প্রকল্পগুলো সবই হোমগ্রোন।

প্রশ্ন

ব্র্যাকের প্রকল্পগুলোকে আপনি হোমগ্রোন বললেন, কিন্তু ব্র্যাক তো এখন বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সরকারের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। প্রতিটি দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা ও সংস্কৃতির ভিন্নতা আছে। বাংলাদেশের স্থানীয় মডেলকে অন্য দেশের বাস্তবতায় আপনারা কীভাবে বাস্তবায়ন করছেন?

আসিফ সালেহ: আমরা এ ব্যাপারে খুবই সচেতন থাকি। যেমন উগান্ডায় আমাদের কার্যক্রম রয়েছে। সেখানে ৯৯ ভাগের বেশি জনবল স্থানীয়। পশ্চিমা এনজিওগুলোর ক্ষেত্রে দেখবেন নেতৃস্থানীয় পদে তারা নিজেদের লোক বসায়, কিন্তু আমরা স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করি। নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে তাঁরা থাকেন। আমরা স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করি এবং আমাদের অভিজ্ঞতা ও অ্যাপ্রোচ তাদের জানাই, বাকিটা তারা নিজেরা ঠিক করে। আমরা বাংলাদেশে যে ওয়ানরুম স্কুল কার্যক্রম চালিয়েছি, উগান্ডায় ঠিক একইভাবে তা করা যাবে না। সেখানকার সমস্যার দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে ভিন্ন মডেল তৈরি করতে হবে। যেমন সেখানে আমরা অ্যাডোলোসেন্ট ক্লাব করেছি। কারণ, সেখানে অকালমাতৃত্ব বেশি। বাংলাদেশের জন্য আবার এটা খুব প্রাসঙ্গিক নয়। আমরা মনে করি, সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থানীয় বিষয় বিবেচনায় নিয়েই করতে হবে। বিদেশে আমরা সেভাবেই কাজ করি।

প্রশ্ন

দেশে বর্তমানে তরুণ জনগোষ্ঠীর যে সংখ্যা, তার সুফল পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। কিন্তু তরুণদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের যেসব পরিসংখ্যান আমরা পাই, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। তরুণ জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নধারায় সম্পৃক্ত করা নিয়ে ব্র্যাকের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

আসিফ সালেহ: তরুণদের নিয়ে আমাদের নানা ধরনের কার্যক্রম চলছে এবং সামনে তার সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। শুরুতে আমরা ভোকেশনাল ট্রেনিং কর্মসূচি দিয়ে শুরু করেছিলাম। এটা ছিল মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। এটা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নয় বরং ওস্তাদ-শাগরেদ ধরনের যে প্রশিক্ষণব্যবস্থা আমাদের সমাজে কার্যকর রয়েছে, তাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। এটাও একটা হোমগ্রোন মডেল। কিন্তু দেখা গেল শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠী নয় বরং সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের তরুণদের মধ্যেই কর্মসংস্থান নিয়ে চরম হতাশা কাজ করছে। একটা বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা থেকে বের হচ্ছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলো থেকেও শিক্ষিত তরুণদের একটি অংশ বের হচ্ছে, তারা কোনো চাকরি পাচ্ছে না। চাকরির চাহিদা যেমন বেশি, তেমনি মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন। ইংলিশ মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, শহর, গ্রাম—প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা চাহিদা।

ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি আমরা এখন ডিজিটাল শিক্ষার জন্য কেন্দ্র তৈরি করেছি। স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার করেছি। এর বাইরে আমরা ক্যারিয়ার হাব করেছি, যেটা মূলত চাকরির ব্যবস্থা করার জন্য এমপ্লয়মেন্ট সেন্টার। যে কেউ রেজিস্ট্রেশন করে নিজের যোগ্যতা মূল্যায়ন করতে পারেন। ঘাটতি থেকে থাকলে সেগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এক–দুই মাসের গ্রুমিংয়ে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ঘাটতিগুলো ভয়াবহ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্য কতটা প্রকট, তা আমরা টের পাচ্ছি। আমাদের চাকরিপ্রার্থীদের একটি সমস্যা হচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু কাজের বাইরে তারা কাজ করতে চায় না। সব ধরনের কাজ করার ব্যাপারে তাদের মানসিকতা বদলের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ ছাড়া চাকরিদাতাদের চাহিদা মূল্যায়ন করে সে অনুযায়ী তাদের ঘাটতিগুলো দূর করার চেষ্টা করছি। তরুণদের ও তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে আমাদের আরও কিছু নতুন নতুন কর্মসূচি আসছে। দক্ষ শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে কথা হচ্ছে।

প্রশ্ন

আরও ৫০ বছর পর ব্র্যাক কোথায় যাবে বলে মনে করেন?

আসিফ সালেহ: সামনে পথচলার ক্ষেত্রে গাইডলাইনগুলো আমাদের কাছে খুব পরিষ্কার। আমাদের সব সময় খুব প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে। সমাজ বদল হচ্ছে, সামাজিক সমস্যাগুলোও বদলে যাচ্ছে। সেসব বিবেচনায় নিয়ে আমাদের সব সময় সমসাময়িক থাকতে হবে। এই যে আমি বললাম এখন তরুণদের সমস্যাগুলো আমাদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে, সেটা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। নতুন নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করছি। সামনে আরও নতুন নতুন সমস্যা আসবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সামনে আরও বড় হয়ে দেখা দেবে। সেটা আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

চিকিৎসা বা শিক্ষার জন্য আমরা যে অর্থ খরচ করছি, সে অনুযায়ী মানসম্মত চিকিৎসাসেবা বা শিক্ষা পাচ্ছি না। এসব নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। নগরায়ণ বাড়ছে, মধ্যবিত্ত বাড়ছে, বৈষম্য বাড়ছে—এগুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা বলতেন নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়টি তাঁর আনফিনিশড অ্যাজেন্ডা। এ নিয়ে আমাদের কাজ অব্যাহত থাকবে, হয়তো একইভাবে নয়, নতুন কৌশলে। হোপ ফেস্টিভ্যালে আমাদের সামনের দিনের নানা কর্মসূচি আমরা মানুষের সামনে তুলে ধরব। পাশাপাশি আমাদের সহযোগী সংস্থাগুলো যেমন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ব্যাংক, আইপিডিসি, অব্যাহতভাবে উদ্ভাবনের মধ্যে রয়েছে। আরেকটি আশাবাদের কথা বলি, বাংলাদেশের পাশাপাশি সামনে ব্র্যাকের বিস্তার বাইরের দুনিয়ায় আরও বেশি ঘটবে। 

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

আসিফ সালেহ: আপনাকেও ধন্যবাদ।