বিশেষ সাক্ষাৎকার : হুমায়ুন কবির

গণতন্ত্রহীনতা রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়িয়ে দিয়েছে

ড. হুমায়ুন কবির। কানাডার থম্পসন রিভারস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম ধর্ম ও গণতন্ত্র, মুসলিম সমাজ, তাদের সংস্কৃতি ও রাজনীতি এবং মাদ্রাসাশিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশে এসব বিষয়ের প্রেক্ষাপট, অবস্থান ও প্রভাব নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব

ড. হুমায়ুন কবির
ড. হুমায়ুন কবির
প্রশ্ন

প্রথম আলো: নানা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্র থেকে আমরা একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করেছি। যার মূল ভিত্তির মধ্যে ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র। এর মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজে ধর্মভিত্তিক যে আত্মপরিচয় ছিল, তা কি সংকটে পড়েছে?

হুমায়ুন কবির: এখানে দেশ বিভাগসহ অনেক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে। সেগুলোকে তিনটি প্রকরণে আমরা ভাগ করতে পারি—সংহতিমূলক বা ইন্টেগ্রেটিভ প্যারাডাইম, অসংহতিমূলক বা ডিজইন্টেগ্রেটিভ প্যারাডাইম ও আলংকারিক একীভবন বা রেটোরিকাল ফিউশন প্যারাডাইম।

সংহতিমূলক প্যারাডাইম মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তখন মনে করা হয়েছিল, ব্রিটিশ উপনিবেশ ও হিন্দু আধিপত্যবাদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উপমহাদেশের অঞ্চলগত ও ভাষাগত বিভক্ত মুসলমানদের একীভূত করার জন্য প্রধানতম উপায় হচ্ছে ধর্ম। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠনের পর অসংহতিমূলক প্যারাডাইম আমরা দেখি। যেখানে সাংস্কৃতিক দূরত্ব প্রধান হয়ে ওঠে, যা উৎসারিত হয় মূলত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা থেকে। এর ফলে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কটা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে।

পাকিস্তানের সংবিধান রচনার সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতারা বলেছিলেন, ‘এ ধরনের ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে কি তোমরা আমাদের সাথে প্রতারণা করতে চাও?’ কিন্তু দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে থাকা এই প্যারাডাইমকে তখন সমাজের মানুষ কীভাবে দেখল? এখানে একটি শ্রেণির বিষয় আছে। জাতিরাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ ও আকাঙ্ক্ষা আসলে বাঙালি মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত ও শহুরে মানুষের মধ্যে শুরু হয়। ১৯৭০ সালের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, তখনো গ্রামের অনেক মানুষ নিজেদের পাকিস্তানি বলেই পরিচয় দিচ্ছে।

১৯৭০ সালে নির্বাচনেও ধর্মীয় শক্তির অংশগ্রহণ ছিল। যারা ১২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ফলে সত্তর দশকের শেষ পর্যন্ত ইসলামি রাজনৈতিক শক্তির কিছুটা হলেও অবস্থান ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরও সেটি একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। জিয়াউর রহমানের আমলে এখানে আলংকারিক একীভবন প্যারাডাইমটা ঘটে। যেখানে ধর্মীয় উপাদানগুলো সংবিধানে প্রবেশ করানো হয়। যদিও এগুলো রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে তখনো অতটা প্রভাবিত করতে পারেনি আইনগত অর্থে। মুক্তিযুদ্ধের পর ধর্মীয় আত্মপরিচয় কিছুটা স্তিমিত থাকলেও তা একেবারে হারিয়ে যায়নি। সাধারণ মানুষের কাছে ধর্ম সব সময় তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সেই আত্মপরিচয় স্তিমিত থাকার পর পরবর্তী সময়ে কীভাবে আমাদের রাজনীতি ও সমাজে এর আত্মপ্রকাশ ঘটল এবং এর কী লক্ষণ দেখা যাচ্ছে?

হুমায়ুন কবির: বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করতে, আবার একই সঙ্গে এ–ও বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তার মানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ধর্মের প্রভাবকে তিনি অস্বীকার করেননি। ধর্মের ভিত্তিতে গড়া পাকিস্তান রাষ্ট্র যেভাবে মানুষকে শোষণ করেছে ও প্রান্তিকীকরণ করেছে, তেমনটা তিনি চাননি। পরবর্তী সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরিয়ে ফেলার প্রবণতা, সামরিক রাজনীতির উত্থান এবং ইসলামি রাজনীতির উত্থান—এ তিন বিষয় যূথবদ্ধভাবে এগিয়েছে। এ সময় ধর্মীয় রাজনীতি এখানে বৈধতা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী ভূমিকার কারণে জামায়াতে ইসলামী অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। তখন ইসলামি রাজনীতির শূন্যতা পূরণে এগিয়ে এল কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক আলেম-ওলামারা। যারা দেশ বিভাগের সময় দ্বিধাবিভক্ত ছিল, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও। কওমিদের এই উত্থানে মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের কথা বলতেই হয়, যিনি বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।

তাঁর নেতৃত্বে ট্র্যাডিশনাল মুসলিম সমাজ এবং শর্ষিনা ও জাকের মঞ্জিলের মতো পীরবাদীরাও আকৃষ্ট হন। জামায়াতও ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তাঁর সঙ্গে ছিল। আমরা দেখতে পাচ্ছি, জিয়াউর রহমান যখন ধর্মীয় উপাদান সংবিধানে প্রবেশ করাচ্ছেন, তাঁকে হাফেজ্জী হুজুর চিঠি লিখে প্রশংসা করেছিলেন। তিনি দুবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও করেন। তাঁর গড়া প্ল্যাটফর্মটি পরবর্তী সময়ে নানাভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেখানে শায়খুল হাদিসের ইসলামী ঐক্যজোটসহ আরও অন্যান্য দল আমরা গড়ে উঠতে দেখি এবং প্রভাব বিস্তার করতে দেখি। সেই ধর্মীয় রাজনীতির কারণে জামায়াতও আগের মতো সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেল। বলা যায়, গণতন্ত্রহীনতার সময়ে সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়ে, যেটি এখনো আমরা দেখতে পাচ্ছি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ১৯৮০–এর দশক পর্যন্ত মূলধারা রাজনীতিতে দুটি মধ্যপন্থী দলের বাইরে বামপন্থীদের ভালো একটি প্রভাব ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বামপন্থীদের সেই জায়গাটায় প্রধান হয়ে উঠল ডানপন্থী বা ইসলামি দলগুলো। এই পালাবাদলটা কীভাবে ঘটল?

হুমায়ুন কবির: জাতিরাষ্ট্র গঠনের পথে ষাটের দশক থেকে এখানকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোতে বড় ভূমিকা ছিল বামপন্থীদের। রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে তঁারা সম্মিলন ঘটাতে পেরেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে সেই বামপন্থীরা কি ম্রিয়মাণ হয়ে গেলেন? এখানে কিছু বাস্তবতা আছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে অনেক সমস্যা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল। আবার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমেরিকার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থীদের পক্ষাবলম্বন করছিল। আবার বামপন্থীরা ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলননির্ভর ছিল, যা মূলত মধ্যবিত্ত শহুরে শিক্ষিত মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সাধারণ মুসলিম সমাজের যে প্রত্যাশা এবং সেখানে যে নানা বদল ঘটেছে, তা বামপন্থীরা কতটা আন্তরিকভাবে বুঝতে চেষ্টা করেছেন, সে প্রশ্নও আছে। মাওলানা ভাসানীর মধ্যে সেটি দেখা গিয়েছিল, তিনি একই সঙ্গে বামপন্থী ও ইসলামি চেতনার সম্মিলন ঘটালেও পরবর্তী সময়ে সেই ধারা আর টিকে থাকেনি।

অন্যদিকে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক বড় কাঠামোর কারণে মুসলিম সমাজের ওপর ইসলামপন্থীদের সব সময় একটি প্রভাব ছিল। গ্রামীণ ও নানাভাবে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মাদ্রাসাগুলো সম্পর্কিত ছিল। বর্তমান সময়ে হেফাজতে ইসলামের ক্ষেত্রেও সেটি আমরা দেখি। গ্রামগঞ্জের ট্র্যাডিশনাল মুসলিম সমাজকে ইসলামপন্থীরা যেভাবে সংগঠিত ও আকৃষ্ট করতে পেরেছেন, বামপন্থীরা সাংস্কৃতিকনির্ভর আন্দোলন দিয়ে তা করতে পারেননি। আবার ক্রমাগত প্রো-ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি ও যোগাযোগ গড়ে ওঠার বিষয়টিও এখানে প্রভাব ফেলে। রাষ্ট্রের বাইরে ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক শক্তিগুলোকে নানা সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা সরকারের সঙ্গে একধরনের পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবেও দেখা যায়। ফলে তাদের প্রতি জনগণের একধরনের আস্থাহীনতা কাজ করে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য বলে ইসলামের সঙ্গে এ অঞ্চলের কৃষ্টি-কালচারের একটি সমন্বয় ঘটেছে। এটি কি এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল?

হুমায়ুন কবির: সমন্বয় বা সম্মিলন করার যে প্রবণতা, তার মধ্য দিয়েই এখানকার বাঙালি মুসলিম সমাজে একধরনের আত্মপরিচয় গড়ে উঠেছিল গত কয়েক শতকে। সেখানে নানা ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরিবর্তন যেহেতু একটি চলমান প্রক্রিয়া, এই সম্মিলনেও নানা পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটে চলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন এর ফলে কি আগের সহিষ্ণু অবস্থানটা থাকছে না? দুই দিন আগেও আমি গবেষণার কাজে পুরান ঢাকায় শিয়াদের ইমামবাড়ায় যাই। সেখানে অনেক সুন্নিও এসেছেন নামাজ পড়তে, তবারক দিচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে দেখলাম মনমোহন দত্ত নামে এক সাধুর আস্তানাতেও হিন্দু-মুসলিম সবাই যাচ্ছে। মসজিদ আর মাজারের সঙ্গেও অন্যদের সেই সম্পর্ক ছিল।

এখন সেই সহাবস্থান কমে আসছে। আমার গ্রামে যে হিন্দুদের মেলা হতো, তা–ও এখন দেখা যায় না। আমি এবার ও আগেও দেশে এসে গ্রামের মসজিদে প্রয়াত বাবার জন্য মিলাদ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আগের সেই মিলাদের ধরন নেই, বদলে গেছে। এখানে নতুন নতুন ইসলামি মতবাদ বা ধারণা আসছে বা প্রভাব বিস্তার করছে, যা আগে আমাদের মুসলিম সমাজগুলোতে ছিল না। এর ফলে দীর্ঘ ঐতিহ্যের সমন্বয় বা সম্মিলিত মুসলিম সমাজে নতুন একটি সংকট প্রকট হয়ে উঠছে। এতে আমাদের মুসলিম সমাজ আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে পারে ও গ্রহণ করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: মধ্যপন্থী দলগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তারা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নানা উপাদান তাদের ভেতরে নিয়ে নিচ্ছে। সমাজে ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে কি বিষয়টি ঘটছে?

হুমায়ুন কবির: এখানকার যে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দলগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার যে ধারণা পোষণ করে, তা ইউরোপের ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে অনেকটা আলাদা। আমরা দেখতে পাই রাষ্ট্র গঠনের শুরু থেকেই এ ধরনের দলগুলো ধর্মীয় নানা উপাদান নিজেদের ভেতরে নেওয়া শুরু করেছে। তুরস্ক, মালয়েশিয়া এমনকি পাকিস্তানেও এ ধরনের দলগুলোর মধ্যে সেই প্রবণতা আমরা দেখি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হওয়ায় নির্বাচনে তাদের কাছ থেকে বেশি সমর্থন আদায়ের আশায় এটি করা হয়। এর ফলে আরেকটি জিনিস আমরা দেখতে পাই, ওলামা সমাজ ও ইসলামপন্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক একটি এলিট শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা মূলধারার রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। এখন এই মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উদারবাদী গণতান্ত্রিক দলগুলোর চরিত্র বা আদর্শগত স্থান বদলে যাচ্ছে। তারা ক্রমে সংখ্যাগরিষ্ঠাবাদী আদর্শ বা চেতনাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। তারা এমন ঘোষণাও দিয়ে থাকে, ক্ষমতা গেলে কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন করা হবে না। এর মধ্য দিয়ে এসব দলের ভেতরে ধর্মনিরপেক্ষতা বা গণতান্ত্রিক চেতনা ক্রমে লোপ পাচ্ছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এখন ধর্মীয় আত্মপরিচয়কে সঙ্গে করে আমাদের পক্ষে একটি অসাম্প্রদায়িক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কি না? পশ্চিমের দেশগুলো তো ধর্মীয় আত্মপরিচয়কে আত্মস্থ করে সেই জায়গা তৈরি করতে পেরেছে।

হুমায়ুন কবির: আসলে রাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্কটা আমাদের বুঝতে হবে। বিশেষ করে ইতিহাসে এর কেমন বোঝাপড়া হয়েছে। রাষ্ট্র গঠন ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত বিষয়গুলো মূলত ইউরোপের ধারণা। এখন এই ধারণাগুলো কি শুধু ইউরোপের জন্য প্রযোজ্য নাকি সব দেশের ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করা সম্ভব। অনেক ইতিহাসবিদ বলছেন যে ইউরোপ সমাজ থেকে উৎসারিত এই ব্যবস্থা সব সমাজে সমানভাবে প্রযোজ্য না–ও হতে পারে। এরপরও ইউরোপীয় রাষ্ট্র গঠনের এই মডেলের কথাই বেশি বলা হয়ে থাকে। কারণ, এটিই এখন পর্যন্ত সব ধরনের আত্মপরিচয়ের মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পেরেছে। তবে ইউরোপ আসলে ধর্মীয় আত্মপরিচয়কে আত্মস্থ করেনি, তারা বরং ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করতে পেরেছে। এর জন্য অনেক কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে। সেগুলোর সঙ্গে ধর্মের হয়তো দূরতম সম্পর্ক আছে।

সেখানে যে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রাধান্য বিস্তার করেছে ও নানা কাঠামোগত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা আমাদের জন্য এখনো দুরূহ ব্যাপার। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়টি যুক্ত হয়েছে ১৯৭৬ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমে। শুরুতে নেহরু ও আম্বেদকাররা সংবিধানে সেটি আনতে চাননি। তঁারা হয়তো মনে করেছিলেন, এখানকার মানুষের জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে আকাঙ্ক্ষা, তা ইউরোপীয় মডেলের সঙ্গে যুক্ত নয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির শক্তিবৃদ্ধিতে ভূরাজনৈতিক বা আঞ্চলিক রাজনীতি উপাদানগুলো কীভাবে কাজ করছে? অনেকে মনে করেন, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব বৃদ্ধির পেছনে ভারতে ধর্মীয় উগ্রবাদী রাজনীতির উত্থানের একটা যোগসূত্র রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?

হুমায়ুন কবির: এ দেশের ধর্মভিত্তিক সমাজ বা রাজনীতি কখনো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাববলয়মুক্ত ছিল না। এখানকার দেওবন্দী কওমি ঘরানার মাদ্রাসাগুলো সব সময় কোনো না কোনো ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গেছে। পাকিস্তানে দেওবন্দীরা যেভাবে তাহাফ্ফুজে খতমে নবুয়ত আন্দোলন গড়ে তোলে, এখানেও তা দেখা গেছে। যার ফলে এখানকার আহমদিয়া সংখ্যালঘুরা একধরনের হুমকির মধ্যে আছে। পাকিস্তানের মতো এখানেও ব্লাসফেমি আইন করার একটা দাবি করে আসছে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো।

অন্যদিকে ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানের কিছুটা হলেও প্রভাব এখানেও পড়েছে, তবে ভারতে তারা যেভাবে অপেক্ষাকৃত দ্রুত সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় চলে গেছে, এখানকার ধর্মীয় শক্তি সেটি পারবে কি না, তা আমার মধ্যে সংশয় আছে। ভারতের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় ধর্মীয় শক্তি এখানকার সমাজে গৃহীত হবে বলে আমার মনে হয় না। তারা মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি রাজনীতিই করে যাবে। এখানকার দীর্ঘ সাংস্কৃতিক যে ঐতিহ্য ও শক্তি, সেটিও বাধা হয়ে থাকবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এখানে বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যমান—বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম ও ধর্মীয় মাধ্যম। অনেকে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়ে দাবি তোলেন। এটিকে কীভাবে দেখছেন?

হুমায়ুন কবির: একটি রাষ্ট্রে তো বহুমুখী শিক্ষা থাকতেই পারে। তবে সেটি জাতীয় ঐকমত্যের সঙ্গেই হতে হবে। সেই বহুমুখিতায় থাকবে ডাইভার্সিটি বা বৈচিত্র্য, বিভক্তি নয়। কানাডায় ক্যাথলিক খ্রিষ্টান এডুকেশন শিক্ষা বোর্ড আছে। সেখানেও ধর্মীয় শিক্ষা হয়, কিন্তু মূলধারা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন নয়। আমাদের দেশে বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একধরনের শ্রেণিগত পার্থক্যও আছে। এই পার্থক্য রাষ্ট্রকেই ঘোচাতে হবে, ঐকমত্যের জায়গাটি তৈরি করতে হবে। গবেষণার কাজে আমি কিছু কওমি মাদ্রাসায় গিয়ে দেখেছি, সেখানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন বা জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। এ বিষয়গুলো তো আছেই। ইংরেজি মাধ্যম নিয়েও নানা সমালোচনা আছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: দেশের মাদ্রাসাশিক্ষাব্যবস্থাও নানাভাবে বিভক্ত। ভিন্ন সিলেবাস ও বোর্ডে পরিচালিত। কিন্তু সমাজের মূলধারা বা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জায়গা করে নেওয়ার মধ্যে বাধা কোথায়?

হুমায়ুন কবির: অনেকে মনে করেন, কওমি মাদ্রাসায় কোনো পরিবর্তন হয় না, এটি স্থির বা পুরোনো ধ্যানধারণায় পরিচালিত হয়, এই ধারণাটা অনেকাংশে ভুল। ১০০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখানে ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটেছে, যেটি মূলত সেলফ রিফরমেশন। একই সঙ্গে এটিও বুঝতে হবে, কওমি আর আলিয়া মাদ্রাসাব্যবস্থা কেন আলাদা? মাদ্রাসাব্যবস্থা তো একটিই হতে পারত। ব্রিটিশরাই আসলে সেই ভাগটা করে দিয়েছে। আলিয়া মাদ্রাসাব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে তারা মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের মূলধারায় নিয়ে আসতে চেয়েছে, যেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাও সহজ হবে। কিন্তু দেওবন্দ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক কওমিদের সেখানে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তাদের একটি অংশ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। উত্তর-উপনিবেশ সময়ে এসেও তারা আসলে রাষ্ট্র বা ক্ষমতাকে এখনো সন্দেহের চোখে দেখে, সেখানে বড় ধরনের আস্থার সংকট থেকে গেছে।

ভারতে কিন্তু কিছু কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় বা জামেয়া মিলিয়ার মতো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। এখানকার কওমি শিক্ষাব্যবস্থা বরং আলিয়াই স্বীকৃতি দিতে চায় না। তারা নিজেদের মূল ইসলামের অনুসারী বা ধারক–বাহক হিসেবে মনে করে থাকেন। কওমি মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে নানা স্তরবিন্যাস আছে, সেসব পরিচালনায় তাদের নেতৃত্বের মধ্যে একধরনের হায়ারার্কিও আমরা দেখি। এসব নেতৃত্ব মনে করে রাষ্ট্রীয় আবার কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সেটির সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি এখানে কাজ করেছে। সেই স্বীকৃতিতে এখনো অনেক অস্পষ্টতা বা অনিশ্চয়তা থেকে গেছে। অন্যদিকে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সহজে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পেলেও কিছু বিষয়ে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে বৈষম্যের শিকার হওয়ার ঘটনাও আমরা দেখে থাকি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

হুমায়ুন কবির: আপনাকেও ধন্যবাদ।