হাসিন জাহান বাংলাদেশে ওয়াটার এইডের পরিচালক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, যুক্তরাজ্য থেকে স্নাতকোত্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি ও পানির কষ্টে ভোগা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ সাবিহা আলম
প্রথম আলো: ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ার কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। এবারের ডেঙ্গু কি তারই প্রমাণ?
হাসিন জাহান: জলবায়ু যে পরিবর্তন হচ্ছে, তার সহজ নির্দেশক হলো আগে যে সময়ে ঝড়-বৃষ্টি হতো, এখন আর সে সময়ে হচ্ছে না। আমরা আগে জানতাম কোন সময়ে বর্ষা আসবে, কোনে সময় কালবৈশাখী হবে। এখন এই ঋতুচক্রটা ভেঙে পড়েছে। অর্থাৎ আগে আমরা বছরের অল্প ও নির্দিষ্ট সময়ের কথা মাথায় রেখে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতাম। কিন্তু আমরা এখন কী দেখছি? দেখছি অল্প সময় ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, তাপমাত্রা বাড়ছে, পানি জমে থাকছে। অর্থাৎ ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য একদম সহায়ক একটা অবস্থা বিরাজ করছে। ফলে ডেঙ্গুর বিস্তারও ঘটছে দ্রুত এবং দীর্ঘ সময় রোগের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তবে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনকে এর জন্য দায়ী করলে চলবে না। আরও কিছু অন্তর্নিহিত বিষয় আছে।
প্রথম আলো: একটু বুঝিয়ে বলবেন?
হাসিন জাহান: আমি বাস্তুতন্ত্রের কথা বলতে চাইছি। ধরুন বাস্তুতন্ত্রে একটি প্রাণী অন্য প্রাণীকে খেয়ে ফেলে। এভাবে পরিবেশে ভারসাম্য তৈরি হয়। আগে ব্যাঙ ছিল, মশাও ছিল। ব্যাং মশাকে খেয়ে ফেলত। ধীরে ধীরে ব্যাঙ উধাও হয়ে গেল। কিন্তু মশা তো থেকে গেল। আমরা প্রকৃতিতে এমন এমন পরিবর্তন দেখছি যেটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হতে পারে, আবার মানুষের কাজের কারণেও হতে পারে। ব্যাঙ ধরে রপ্তানি করলে হয়তো আয় বাড়বে, কিন্তু মশা যে বাড়বে সেটা আমাদের মাথায় থাকছে না। আবার ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের জীবনচক্রের সঙ্গে তাপমাত্রার বিষয়টা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আগে আমরা আবহাওয়ার চক্রটা জানতাম। রোগের চেষ্টাও বুঝতাম। জানতাম কোন সময়ে জলবসন্ত হবে। সময়সীমাটা বদলে যাওয়ায় আমরা আর সেই প্রস্তুতিটা নিতে পারি না। আবার আপনার পারিপার্শ্বিক ওই রোগের জন্য কতটা সহায়ক, তা–ও বিবেচনার বিষয়। অনেক সময় জেনে অথবা না জেনে আমরাই সহায়ক পরিবেশ তৈরি করছি।
আমাদের এখন দরকার আবহাওয়ার চক্র আর রোগের চক্রটা মিলিয়ে গবেষণা করা। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে রোগ-শোক নিয়ে গবেষণা হলে আমরা আরেকটু ভালো প্রস্তুতি নিতে পারতাম।
প্রথম আলো: সরকার ডেঙ্গুর বিস্তারের দায় সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। তারা ব্যক্তি উদ্যোগের কথা বলছে কেবল। ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের নিজেদের এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে কী উদ্যোগ নেওয়া যেত?
হাসিন জাহান: ডেঙ্গু আসবে আমরা জানতাম। কিন্তু কোনো প্রস্তুতি নিইনি। বরং ডেঙ্গু আসার পর আমরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করি। কোন ওষুধটা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করবে খোঁজখবর নিই, টেন্ডার দিই অথবা নতুন কোনো কিছুর সন্ধান পেলে ট্রায়াল করি। সার্বিক কোনো পরিকল্পনা নেই। এত বছর ধরে আমরা ডেঙ্গু মশা মারি, এত এত ওষুধ প্রয়োগ করি। কিন্তু আমরা কি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি কোন ধরনের ওষুধ কার্যকর হবে? আমাদের তো কোনো ধরনের বিশ্লেষণ নেই। যে যা বলে তাই দিয়ে চেষ্টা করি। একবার গাপ্পি মাছ ছাড়ল, একবার বলল ব্যাঙ ছাড়বে। আমি কীটতত্ত্ববিদ না। কিন্তু আমাদের তো কীটতত্ত্ববিদ আছেন। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কেন তাঁদের সঙ্গে বসছেন না? জলবায়ু পরিবর্তন একটা খুবই কারিগরি বিষয়, এর সঙ্গে রাজনীতি, মানুষ দুই-ই জড়িত। সুতরাং সবাইকে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে। যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁরা মনে করেন প্রশাসনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু এটা বৈজ্ঞানিকভাবে যুক্তিযুক্ত কি না, সেটাও যাচাই করা দরকার।
প্রথম আলো: জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এটা এখনো অনেকে মানতে চান না, এখনো জলবায়ু পরিবর্তনকে অনেক দূরের ইস্যু মনে করা হয়...
হাসিন জাহান: সাতক্ষীরায় শহরের দিকে পাকা বাড়ি আছে, অর্থশালীরা থাকেন। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সেখানেও পড়ছে। অনেক গুণ বেশি দামে পানি কিনতে হচ্ছে তাঁদেরও। ঢাকা শহরে আপনারা যে দামে পানি খান, পাইকগাছায় মানুষকে তার ৪০ গুণ বেশি টাকা দিয়ে পানি কিনে খেতে হয়। উপকূলীয় অঞ্চলে যে মানুষকে এত টাকা খরচ করে পানি কিনতে হচ্ছে, সেটাকে আমাদের অনেকেই কোনো সমস্যা মনে করেন না। আমাদের সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক, রাজনৈতিক নেতারা এখানে বসে সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা যখন গ্রামে যান, তখন নিশ্চয়ই বোতলের পানিই খান। তাঁদের পক্ষে স্থানীয় লোকজনের সমস্যা বা সুপেয় পানির সংকটের বিষয়টি বোঝা কঠিন।
প্রথম আলো: আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার কথা বলছি, আবার সেই সঙ্গে রাজশাহী এমনকি ঢাকাতেও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার খবর পাচ্ছি। এটা কেন?
হাসিন জাহান: জলবায়ু পরিবর্তনকে আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। সামগ্রিক যে পরিবর্তন, তার সঙ্গেই এটি সম্পৃক্ত। মাটির নিচে যে পানি আছে, এটার সঙ্গে নদী, খাল–বিল, বৃষ্টির পানি সবারই সম্পর্ক আছে। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে নদীর পানির একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে, আবার যদি উজানে বাঁধ থাকে, তাহলে সেই সম্পর্ক হবে আরেক রকম। এর মানে হলো হাইড্রোলজিক্যাল ইকোসিস্টেম (পানির বাস্তুতন্ত্র) নিয়ে যখন আমরা কথা বলছি, তখন জলবায়ু পরিবর্তন বা মানুষের তৈরি পরিবর্তন দুটো একসঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হচ্ছে, এখন যদি পানির প্রবাহ বাড়ে, তাহলে মাটির নিচে পানিতে এক ধরনের প্রভাব পড়বে। ধরুন, মাটির ভেতরে ১০০ মিটার লবণাক্ত পানি ঢুকবে। আবার বাঁধ দিয়ে যদি স্বাভাবিক জলস্রোত বন্ধ করে দিই, তাহলে সমপরিমাণ পানিপ্রবাহে হয়তো মাটির ভেতর ১০০০ মিটার পর্যন্ত লবণাক্ত পানি ঢুকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শত গুণ বাড়ে মানুষের কোনো কোনো কাজের কারণে।
প্রথম আলো: উদাহরণ দিতে পারেন?
হাসিন জাহান: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের লবণাক্ততা বাড়ছে। সেটা বাড়ে তখনই, যখন চিংড়িচাষি চিকন করে খাল কেটে মাটিটা লবণাক্ত করছেন। খাল কেটে আনা লবণাক্ত পানি আশপাশের মিষ্টি পানির উৎসকে লবণাক্ত করে। তার মানে জলবায়ু পরিবর্তনের যে পরিবর্তনটা হচ্ছে, সেটা বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে চিংড়িচাষিদের জন্য বা উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে। জলবায়ু পরিবর্তন আর মনুষ্যসৃষ্ট পরিবর্তনকে একইভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সেটা হচ্ছে না কারণ, চিংড়িচাষিরা গ্রামের মানুষ হলেও ঘেরের মালিকেরা প্রভাবশালী। নোবডি ইজ দেয়ার টু চ্যালেঞ্জ। (তাঁদের প্রতিহত করার মতো কেউ নেই)
প্রথম আলো: জলবায়ু পরিবর্তন পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার ওপর কী প্রভাব ফেলছে?
হাসিন জাহান: আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কথা যখন বলি, তখন এই ব্যবস্থাপনার কথা প্রায়ই ভুলে যাই। ধরুন একটা ঘূর্ণিঝড় হলো। সবাই সাইক্লোন সেন্টারে গেলেন। ফিরে এসে দেখলেন তাঁর টিউবওয়েল, টয়লেট (শৌচাগার) ভেঙে গেছে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় আগেও এমন হতো। কিন্তু তখন একটা ঝড়ের সঙ্গে আরেকটি ঝড়ের মাঝখানে পাঁচ–দশ বছরের মতো বিরতি ছিল। ফলে মানুষ ধীরে ধীরে টাকাপয়সা জমিয়ে ভাঙা শৌচাগার ঠিকঠাক করে নিত। এখন ঝড়ঝাপটা হচ্ছে এত ঘনঘন যে মানুষ আর শৌচাগার তৈরির জন্য টাকা জমানোর সুযোগ পাচ্ছে না। তার মানে গরিব আরও গরিব হচ্ছে। তা ছাড়া আগে সাইক্লোন সেন্টারে মানুষ কয়েক ঘণ্টার জন্য যেত। কিন্তু এখন মানুষকে বেশি সময় থাকতে হয়। অনেক সময় পানি নামতে সময় লাগে। বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায়। মেয়েদের কষ্ট তো আরও বেশি। তাদের মাসিক ব্যবস্থাপনা এমন পরিস্থিতিতে খুবই কঠিন। চাপের কারণে কেউ কেউ সময়ের আগে সন্তান প্রসব করে ফেলেন। এককথায় তাঁদের যেতে হয় একটা বিভীষিকার মধ্য দিয়ে।
প্রথম আলো: আম্পান, আইলা, সিডরে কীভাবে স্যানিটেশন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, আপনাদের মূল্যায়ন কী?
হাসিন জাহান: আইলার আগে ২০০৯–এর দিকে ওয়াটার এইড প্রায় শতভাগ স্যানিটেশন নিশ্চিত করেছিল। আইলার পর সেটা নেমে এল পঞ্চাশ ভাগের কিছু ওপরে। কয়েক ঘণ্টার ঝড়ে আমাদের এত দিনের যে বিনিয়োগ, সেটা নষ্ট হয়ে গেল। তখনো আমাদের দুর্যোগসহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণের ধারণা ছিল না। অবকাঠামো শতভাগ সহিষ্ণু হয়তো হয় না। আমরা আমাদের এখনকার কর্ম এলাকায় দুর্যোগ–সহিষ্ণু অবকাঠামো তৈরি করছি। এতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। মাত্র এক ডলার বিনিয়োগ বাড়ালে, পাঁচ ডলার লাভ পাওয়া যায়।
প্রথম আলো: একটা উদাহরণ দেবেন?
হাসিন জাহান: ধরুন টিউবওয়েল (নলকূপ)। আমরা উঁচু স্তম্ভের ওপর নলকূপ বসিয়ে রড দিয়ে চারকোনায় আটকে দিতে পারি। এতে খরচ নেই খুব একটা।
প্রথম আলো: সরকার কি কিছু করছে? আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ কেমন?
হাসিন জাহান: যথেষ্ট ভালো। আমরা এই খাতের উদ্ভাবন সম্পর্কে তাঁদের জানানোর চেষ্টা করি। কতটা পরিবর্তন ঘটাতে পারছি, সেটা একটা প্রশ্ন। যাঁরা পরিকল্পনা করছেন তাঁরা হয়তো বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালো জানেন না। তবে এখন অনেক কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা অংশীজনদের অনুসৃত ভালো যে চর্চাগুলো আছে, সেগুলো নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিছু জায়গায় সমস্যা আছে। সরকার যখন কোনো নথি বানায়, তার একটা স্ট্যান্ডার্ড স্পেসিফিকেশন থাকে। যেমন একটা টিউবওয়েল বসাতে কী কী করতে হবে, তার শর্ত সারা দেশের সব এলাকার জন্যই এক। কেন্দ্র থেকেই এই সিদ্ধান্ত আসতে হবে যে অবকাঠামো জলবায়ু পরিবর্তন–সহিষ্ণু হবে। সরকারি ব্যবস্থাকেও একটু শিথিল হতে হবে। তৃতীয় পক্ষের সম্পৃক্ততা দরকার। শুধু সরকারকে দায়ী করলেই হবে না। আমরা যেসব ব্যবস্থা চালু করেছি, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের দিয়ে দেখিয়ে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেই জায়গাটায় একটা ঘাটতি দেখি আমরা। এখন সরকারের দিক থেকে ঘোষণা আসতে হবে যে তারা সর্বোত্তম যে ব্যবস্থা, সেটা অনুসরণ করতে চায়।
প্রথম আলো: মিষ্টি পানির সহজলভ্যতা কমে গেছে, পানি ও পয়োব্যবস্থা সঙিন, মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে উপকূলীয় অঞ্চলে?
হাসিন জাহান: এক কলসি বা এক জগ পানি—একটি বাড়িতে হয়তো ওইটুকুই সম্বল। ওটা শেষ করলে পানি আনতে আবার যেতে হবে অনেক দূরে। তো মানুষ পানি কম খায়। পানিটা যে প্রাণভরে খাবে, সে উপায়ও নেই। রেইনওয়াটার হারভেস্টিংয়ের (বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ) পানিতেও বোটকা গন্ধ। কারণ, ঠিকভাবে হয়তো পানিটা সংরক্ষণ করতে পারছে না মানুষ। আমি গিয়েছি এক বাড়িতে। আমাকে বলল, আমাদের পুকুরের পানি যে টলটলে, খেলে মন জুড়িয়ে যাবে। বিস্কুট, চানাচুরের সঙ্গে যখন পানি নিয়ে এসেছে, দেখি ঘোলা পানি। এটাই টলটলে স্বাদুপানি। ওরা হয়তো জানেই না স্বাদুপানির স্বাদ কেমন। পুকুরের মালিকানাও খুব একটা জটিল বিষয়। হয়তো কয়েক ভাই একটি পুকুরের শরিক। কেউ চায় মাছ চাষ করতে, কারণ তাতে লাভ আছে। সরকার খাস পুকুরগুলোর ক্ষেত্রে অন্তত নির্দেশনা জারি করে বলতে পারে মাছের জন্য লিজ দেওয়া হবে না। সেটা হচ্ছে না।
প্রথম আলো: বৃষ্টির পানি ধরে রাখার কৌশল তো স্বীকৃত, এটা পানির অভাব কতটা পূরণ করছে?
হাসিন জাহান: সরকার বেশ চেষ্টা করছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের আওতায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এই খাতে যে বিনিয়োগ, তা পর্যাপ্ত নয়। হতদরিদ্রদের সবাই সেই সুযোগ পাচ্ছে না। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হলো নির্মাণ ত্রুটি।
প্রথম আলো: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় তহবিলের কী অবস্থা? সরকার ঠিকঠাক এই তহবিল কি খরচ করতে পারছে?
হাসিন জাহান: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে যে টাকাটা আমরা পেয়ে থাকি, সেটা সামান্যই। বিদেশিরা জ্বালানি কম খরচ হয় এমন প্রযুক্তি বিনিময়ে বেশি আগ্রহী। তারা অ্যাডাপটেশন (অভিযোজন) খাতে বিনিয়োগ করতে চায় না, তারা মিটিগেশন (প্রশমনে) তহবিল দিতে আগ্রহী। ব্যাখ্যা করে বলি, গাড়িকে কার্বনমুক্ত করতে তারা টাকা দিতে চায়। কিন্তু আমাদের দরকার পানি পরিশোধনে সহায়তা। এটা অ্যাডাপটেশন বা অভিযোজনের অংশ। আমার দরকার পানি, ওরা দিতে চাইছে বৈদ্যুতিক গাড়ি। আমাদের চাহিদার সঙ্গে ওদের মিলছে না। আবার আমরা যে আমাদের চাহিদার তথ্যও ঠিকঠাক দিতে পারছি সব সময়, তা–ও নয়। পানির খাতে গ্লোবাল ক্লাইমেট ফাইন্যান্সের ব্যয় মাত্র ৩ শতাংশ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের বড় আঘাতটাই পড়ছে পানির ওপর।
তহবিল খরচের ক্ষেত্রে সরকার ঠিকভাবে কাজ করছে বলেই মনে হয়। আমরা যেটুকু সহযোগিতা পাচ্ছি, তা কম। সরকার ২৩৫ বিলিয়ন ডলার চেয়েছিল, পায়নি।
প্রথম আলো: উপকূলের নারীদের কথা বলুন। যেকোনো দুর্যোগে নারীদের ঝুঁকি বেশি...
হাসিন জাহান: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারণ, দুর্যোগের শেষ পর্যন্ত নারী বাসায় থাকেন। প্রথমে ইট দিয়ে খাট উঁচু করেন, প্রয়োজনে চালের ওপর বসে থাকেন। এ সময় কীভাবে তিনি টয়লেট করেন ভাবেন তো। এর মধ্যে ভেজা গায়ে নৌকা চালিয়ে পানি, ত্রাণ আনতে যান। সাইক্লোন সেন্টারেও সমস্যা আছে। অনেক সময় তাঁরা হয়রানির শিকার হন। এ অঞ্চলে দুই-তিন ঘণ্টা লাগে শুধু পানি সংগ্রহ করতে। এতে রান্না দেরি হয়, স্বামী নির্যাতন করে। ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করে মেয়ে। মা অসুস্থ হলে মেয়ে যায় পানি আনতে। এসব কারণে অনেক মেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। গ্রামের নারীরা এখনো স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে না। কাপড় ধুয়ে ব্যবহার করে। লোনা পানিতে কাপড় ধোয়ায় তাদের যৌনাঙ্গের আশপাশে চুলকানি হয়। এসব সমস্যার কথা তারা কাউকে বলতেও পারে না। হেলথ কেয়ার সেন্টারে হয়তো যায়, গিয়ে দেখে সেখানেও পানি নেই। কারণ, পানির বিল সরকার দেয় না। ধরে নেওয়া হয় হাসপাতালে টিউবওয়েল থেকে পানি পাওয়া যাবে। কিন্তু ওই অঞ্চলে তো পানিই নেই। লোনা পানি পান করার জন্য এক্লাম্পশিয়া হচ্ছে বাচ্চা হওয়ার সময় বহু নারীর, গর্ভপাতের সংখ্যাও অনেক। মোটের ওপর তাদের জীবন দুর্বিষহ।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
হাসিন জাহান: আপনাকেও ধন্যবাদ।