আজ ২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ইতিহাসের এই পরিক্রমায় নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে দলটি। আওয়ামী লীগের সফলতা-ব্যর্থতা এবং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন-অর-রশিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে
পঁচাত্তর বছরে আওয়ামী লীগ। যেকোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বড় মাইলফলক। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় আওয়ামী লীগের প্রধান প্রধান অর্জন কী বলে মনে করেন?
হারুন-অর-রশিদ: উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন, বৃহৎ, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করার জন্য আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয়নি।
বাঙালির জাতীয় মুক্তির আন্দোলন, সংগ্রাম ও স্বপ্ন, তা পূরণের লক্ষ্য নিয়েই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ষাটের দশকে বাঙালির জাতীয় মুক্তির মঞ্চে পরিণত হয়।
বলা চলে, সমগ্র বাঙালি জাতি আওয়ামী লীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়, যা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটে। আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের যে পথচলা, এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হলো বাঙালির জন্য একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
আওয়ামী লীগের যদি আর কোনো অর্জন না–ও থাকে, শুধু এই একটা অর্জনের কারণে বাঙালি জাতির ইতিহাসে দলটির স্থায়ী অবস্থান থাকবে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার মাত্র সাড়ে তিন বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের সময় পেয়েছিল। এই সাড়ে তিন বছরে আমাদের সমাজ, রাজনীতি, প্রশাসন, রাষ্ট্রব্যবস্থার এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে প্রতিষ্ঠানকাঠামো রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবার নির্মমভাবে যদি হত্যা না করা হতো, বিশ্বে অনেক আগেই উন্নত, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করত।
১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড যারা সংঘটিত করেছিল, তাদের লক্ষ্য ছিল সদ্য জন্ম নেওয়া অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটিকে আবার পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়া।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা দম্ভ করে বলেছিল, আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। কিন্তু তাদের সেই দম্ভোক্তিকে মিথ্যা প্রমাণিত করে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে প্রমাণ করেছিল ইতিহাসের গতিকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় না।
এরপর ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত পরপর চার মেয়াদে সরকার পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ একসময় বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর দেশ ছিল।
কিন্তু আজকে ভারত বলি, চীন বলি, যুক্তরাষ্ট্র বলি আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলি, সবাই কিন্তু বাংলাদেশকে হিসাবে নেয়।
ব্যর্থতার ফিরিস্তিও তো কম নয়। বিশেষ করে গত তিনটা জাতীয় নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হলো, কিংবা সম্প্রতি ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থাকা লোকদের দুর্নীতির যে ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখছি...
হারুন-অর-রশিদ: বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। সেই স্বপ্নপূরণ বহুলাংশে অপূর্ণ রয়ে গেছে। একটা নির্ভেজাল, প্রশ্নহীন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন আমরা এখন পর্যন্ত করতে পারিনি।
বিরোধী দল গুরুত্বপূর্ণ ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে, সে রকম একটা সক্রিয় জাতীয় সংসদ আমরা এখনো প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে। কিন্তু সেই দুর্নীতি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি।
আজকে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে, সেটা দিবালোকের মতো সত্যি। দুর্নীতি সমাজ ও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে, এটা প্রত্যেকেই স্বীকার করতে বাধ্য।
আওয়ামী লীগ তো পরপর চারবার সরকারে। তারপরও কেন এই অবস্থা?
হারুন-অর-রশিদ: বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে দুই জেনারেল ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাঁরা রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিকভাবে দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁরা সেটা করেছিলেন নিজেদের শাসনকে পাকাপোক্ত করার জন্য।
রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ও রাষ্ট্রের অর্থে তাঁরা রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করেছিলেন। নির্বাচনব্যবস্থাকে তাঁরা ভেঙে দিয়েছেন। কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যাতে না গড়ে উঠতে পারে, সেই ব্যবস্থা করেছেন।
‘নীলনকশার নির্বাচন’ ও ‘মিডিয়া ক্যু’ এই শব্দগুলোও আবিষ্কৃত হয়েছে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের নির্বাচনের সময়।
অনেকে সমালোচনা করেন, ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে আর সেভাবে ক্রিয়াশীল নয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল।
হারুন-অর-রশিদ: ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত না থাকলে কারও পক্ষে বড় ধরনের দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা শুধু যে ক্ষমতাসীন দলের, তা কিন্তু নয়। বিরোধী দলের অনেকেরও ক্ষমতাসীন দলের লোকদের সঙ্গে যৌথ ব্যবসা–বাণিজ্য রয়েছে।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানে ক্ষমতাসীন দল ও ক্ষমতাবহির্ভূত রজনৈতিক দলের নেতা মিলিয়ে একটা রুলিং ক্লাস তৈরি হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত।
একটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ধারা। আর এর বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত ধারা। দুই ধারার রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্কটা হচ্ছে সাংঘর্ষিক।
এই সাংঘর্ষিক রাজনীতির কারণে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল চায় সব সময় ক্ষমতায় থাকতে। ক্ষমতায় থাকতে হলে ক্ষমতার ক্ষেত্রে যারা ম্যাটার, তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়।
এ কারণেই বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে এখন ব্যবসায়ী, প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, পুলিশ, সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তারা আবার সেই সুযোগটাও নিচ্ছে।
মূলত সাংঘর্ষিক রাজনীতির কারণেই আওয়ামী লীগকে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকগুলোর দুরবস্থা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা দুর্নীতিতে যুক্ত হচ্ছে, তার মূল কারণ হলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে।
বলা চলে, সামগ্রিক রাজনীতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতিও একটা ফাঁদে আটকা পড়েছে।
এই ফাঁদ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি বেরিয়ে আসার পথ কি দেখছেন?
হারুন-অর-রশিদ: সাংঘর্ষিক রাজনীতি থেকে আমরা যত দিন না বেরিয়ে আসতে পারব, তত দিন আমাদের মুক্তি নেই। আজকে বিএনপি যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারত, তাহলে বাংলাদেশেও একটা সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা বিকশিত হতো।
আওয়ামী লীগ নেতাদের কারও কারও মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিচ্যুতি ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূলে ছিল যেখানে জনসেবা, জাতি ও জনগণের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ, সেখানে তাঁরা ভোগের রাজনীতি এবং সম্পদ-বিত্ত সৃষ্টির পেছনে ছুটছেন।
আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দুদককে শক্তিশালী করা এবং একটা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক জবাবদিহিমূলক ও ভারসাম্যমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনীতি এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করে নিতে পারে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
হারুন-অর-রশিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।