আবুল কাসেম ফজলুল হক। শিক্ষাবিদ ও চিন্তক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন এত সহিংস রূপ নিল, বাংলাদেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি, নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনোজ দে
[কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। এ কয়দিনের সম্পাদকীয়, লেখা ও সাক্ষাৎকার ধাপে ধাপে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে। রোববার (২১ জুলাই ২০২৪) প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় এ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।]
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনটি কীভাবে দেখছেন।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলনটা করছে, তাদের ইস্যুটা সঠিক। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা বিলুপ্ত করা উচিত। যদি রাখতেই হয়, সেটা একেবারে কমিয়ে রাখতে হবে, যাতে ধাপে ধাপে এটা বিলুপ্ত করা হয়। তবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, প্রতিবন্ধী, নারীসহ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য যৌক্তিক পর্যায়ে কোটা সংরক্ষণ করা উচিত বলে মনে করি।
বিতর্কটা উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। ২০১৮ সালে যেটি সরকার পরিপত্র জারি করে বাতিল করেছিল।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: সরকার মনে করছে, মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছেন। তাঁদের উত্তরাধিকারীরা সব সময় কোটার সুবিধা পাবেন। দেখা যাচ্ছে, সরকারের এ অবস্থান দেশের বেশির ভাগ মানুষ সমর্থন করে না। মুক্তিযোদ্ধা ও তঁাদের সন্তান পর্যন্ত ঠিক আছে; কিন্তু অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের নাতি-পুতিদের জন্য কেন কোটা সুবিধা থাকবে? আমার বিশ্বাস, আওয়ামী লীগেরও বেশির ভাগ লোক এটা সমর্থন করেন না।
রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির বিতর্কটা চলে আসছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা থেকে তো আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি, এভাবে জনগণকে ভাগ করা ভোটের রাজনীতির জন্য দরকার, এ ছাড়া অন্য কোনো কারণ নেই। দেশের নাগরিক মানেই তো দেশের প্রতি তার আনুগত্য থাকবে। রাষ্ট্রের ভালো–মন্দের সঙ্গে নাগরিকদের ভালো–মন্দ জড়িত।
কোটা সংস্কার আন্দোলন তো সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলন। যাঁরা এই আন্দোলন করছেন, তাঁরা তো সাধারণ শিক্ষার্থী।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০১৬ সালে প্রথম শুরু হয়েছিল। প্রথম দিকে আন্দোলনকারীরা বিবৃতি দিয়ে সরকারের কাছে কোটা সংস্কারের আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সরকার তাদের সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন করেনি। পরে ২০১৮ সালে ছাত্ররা যখন ধর্মঘট-অবরোধের মতো কর্মসূচি দেন, সরকার হঠাৎ করেই কোটা বাতিল করে দেয়।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা তো কোটা বাতিল চাননি। সংস্কার চেয়েছিলেন।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: ছাত্ররা কোটা সংস্কার চেয়েছিলেন, বাতিল চাননি। তবে সরকার কোটা বাতিল করায় সে সময় আন্দোলন বন্ধ হয়েছিল। এবার হাইকোর্টে একজন মামলা করায় আদালত রায় দেন, সরকারের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তটি সঠিক নয়। এরপরই ছাত্ররা আন্দোলনে গেলেন। সরকারের ধারণা ছিল, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে হয়তো ছাত্ররা আন্দোলনে যাবেন না। কিন্তু ছাত্ররা আন্দোলনে গেলেন। এর কারণ হলো, সরকারের কাছে ছাত্ররা একটা সিদ্ধান্ত চেয়েছেন।
শুরুতে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। হঠাৎ করেই কেন সহিংস রূপ নিল?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: প্রথম দিকে আন্দোলনটা শান্তিপূর্ণ ছিল। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছ থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অবস্থান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়াবাড়ি রকম বল প্রয়োগ করার কারণে আন্দোলনটি সহিংস রূপ নেয়।
শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক আন্দোলনের ওপর ভর করে কি তৃতীয় কোনো শক্তি তাদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: যাঁরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করছেন, তাঁদের মধ্যে স্বার্থবুদ্ধি কাজ করছে বলে মনে করি না। তাঁরা সরকারি চাকরিতে কোটা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন।
তিন দিনের সহিংসতায় শতাধিক মানুষ মারা গেলেন, কারফিউ দিতে হলো, এই পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: পরিস্থিতি কেন এমন হলো, সেটা একটা রহস্য। এটার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো সংগঠিত শক্তি আছে, যেটা দৃশ্যমান নয়। কিছুদিন পরে হয়তো সেই রহস্যটা বেরিয়ে আসবে। এখন সারা দেশে কারফিউ জারি করেছে সরকার। কারফিউ তো শেষ অস্ত্র। বেসামরিক সরকারের আমলে এমন নজির খুব বেশি নেই।
যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, তা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: উত্তরণ একেবারে হবে বলে মনে হয় না। পর্যায়ক্রমে সেটা হবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এরপর সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করতে হবে। অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া, ছাত্রদের হলে ফিরে আসার ব্যবস্থা করা উচিত। ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখায় গুজব ও অপতথ্য ছড়াচ্ছে। সেটা বন্ধ করতে হলে দ্রুত ইন্টারনেট চালু করা প্রয়োজন।
কোটা নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিয়েছে, এর সমাধান কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান চাইলে, রাজনৈতিকভাবেই সমাধান খুঁজতে হবে। বলপ্রয়োগে নয়। গণতান্ত্রিকভাবে দল গঠন ও পরিচালনা রাজনীতির একটা অপরিহার্য অংশ। সংকট উত্তরণের পথ হলো নতুন রাজনীতি, ভালো রাজনীতি।
এর অর্থ দেশে এখন ভালো রাজনীতি নেই?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: রাজনৈতিক দল ও আদর্শ অবলম্বন করে দেশে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকে থাকে, সেটা এখন অনেকটা অনুপস্থিত। রাজনীতির জন্য জ্ঞান ও শৃঙ্খলাবোধ দরকার। এ বিষয়গুলো কোনো দলে নেই। বিভিন্ন দলের নামে এখন যাঁরা রাজনীতি করছেন, বিশেষ করে তরুণেরা কিছু না বুঝেই স্লোগানের ভিত্তিতে রাজনীতি করছেন। একটি রাজনৈতিক দলের ভেতরে কী কী থাকা দরকার, সেটা আগে ঠিক করতে হবে। সব প্রশ্নের মীমাংসা এখন পাওয়া যাবে, সেটা নয়। তবে ভালো রাজনীতির জন্য অন্তত বছর দশেকের প্রস্তুতি লাগবে।
আপনি সব সময় শুভচিন্তা ও মানুষের কল্যাণের কথা বলে আসছেন। বাংলাদেশ এখন যে ধারায় চলছে, সেখান থেকে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু গত তিন-চারটা জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মানুষের আস্থা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা ভোট দেননি, এমন লোকের সংখ্যাই বেশি। যাঁরা ভোট দেননি, তাঁদের সবাই বিএনপির নেতা–কর্মী ও সমর্থক নন। সাধারণ মানুষের সংখ্যা তাদের চেয়ে বেশি। তঁারা তো দেখছেনই কীভাবে ভোট হয়, নির্বাচনের পরে কীভাবে সরকার গঠন হয়। এই প্রক্রিয়াটা গণতান্ত্রিক নয়।
এরশাদ আমলেও আমরা দেখেছি ছাত্ররা যখন মার খেয়েছেন, শিক্ষকেরা তঁাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের ন্যায্য দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এবারের আন্দোলনে দেখলাম ছাত্ররা যখন মার খাচ্ছেন, তখন হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বেশির ভাগই নীরব। একজন শিক্ষক হিসেবে আপনি বলবেন এর কারণ কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: মানুষ যখন বিপদে পড়ে, তখন তার পরিচিত, অপরিচিত সবার দায়িত্ব পড়ে সেই বিপন্ন মানুষটিকে উদ্ধার করা। এটা মানবিক দায়িত্ব। এটাই সভ্য সমাজের রীতি। যে সমাজে এই মানবিক বোধ কমে যায় এবং নানা রকম অনাচার বাড়ে, সেই সমাজকে সুস্থ, স্বাভাবিক বলা যায় না। আমরা সে রকম একটা অসুস্থ সমাজে আছি। বিজ্ঞানের কল্যাণে অর্থনীতির ব্যাপক যে উন্নতি হয়েছে, সেখানে এখন পৃথিবীর যেখানেই হোক, খেয়ে–পরে বাঁচার মতো একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মানবিক গুণাবলি ও মূল্যবোধ অনেকটাই লোপ পেয়েছে। উন্নত ও অনুন্নত সব দেশের জন্যই এটা প্রযোজ্য।
গত দুই দিনের আন্দোলনে দেখা গেল, ছাত্রদের চেয়ে সমাজের অন্য অংশের অংশগ্রহণ বেশি। এর কারণ কী বলে মনে করছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আরও তথ্য সামনে না আসা পর্যন্ত বলা যাবে না এর কারণ কী। তবে যেভাবে লোকজন এসেছে তাতে মনে হয় যে তাদেরকে কেউ জোর করে বা অনুরোধ করে আনছে না। একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লোক আসছে। এটা অবশ্য ঠিক যে ন্যায্য আন্দোলন হলে, দেশের সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ সেটাকে সমর্থন দেন। আরেকটি বিষয়, অনেক দিন ধরেই দেশে সে রকম কোনো আন্দোলন ছিল না। বিএনপি আন্দোলন করেছে। কিন্তু তাতে তাদের নেতা–কর্মীদের বাইরে সাধারণ মানুষকে তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে এবারের আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা সরকারের কাছে আট দফা দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: ছাত্ররা যে আট দফা দিয়েছেন, তার মধ্যে কিছু দফা আছে, যেগুলো সরকার সরাসরি মানতে পারে। আর কিছু দফা আছে, যেগুলো আলোচনা করে, কিছুটা যোগ-বিয়োগ করে মানতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। জনগণের একটা অংশ যখন দাবি তোলে, সরকারের অবশ্যই উচিত সেটা আলাপ-আলোচনা করে তার যৌক্তিক সমাধান দেওয়া। কিন্তু এ পর্যন্ত যা ঘটনাপ্রবাহ, তাতে সরকার সেই কাজটা করছে বলে মনে হয় না।
এই মুহূর্তে সরকার ও আন্দোলনকারীদের কাছে আপনার আহ্বান কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: সহিংসতা, প্রাণহানি, কারফিউ—এই অস্বাভাবিক অবস্থার দ্রুত অবসান হওয়া দরকার। আশা করি, সব পক্ষের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগবে। আমাদের জনগণের মধ্যে একটা জাগরণ দরকার। বঙ্গভঙ্গ থেকে মুক্তিযুদ্ধ—গত সোয়া শ বছরে যা কিছু অর্জন, সেটা সম্ভব হয়েছে গণজাগরণের মধ্য দিয়ে। অতীতে এসব গণজাগরণে লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকেরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এখন তাঁরা সেই ভূমিকা নিতে পারছেন না। এখন সত্য বলার মতো বুদ্ধিজীবী অনেক কমে গেছে। সেটা যেমন ভয়ে, আবার প্রলোভনের কারণেও। আবার আমাদের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এনজিওনির্ভর হয়ে উঠেছেন। তঁাদের ভূমিকা অনেক সময় আমাদের খারাপের দিকে নিয়ে যায়।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আপনাদেরও ধন্যবাদ।