জ্বালানির কথা না ভেবেই বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানো হয়েছে

ড. ইজাজ হোসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক। জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশের চলমান জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-সংকটের প্রেক্ষাপট, কারণ ও করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন
প্রশ্ন

প্রথম আলো: মার্চ মাসে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেওয়ার চার মাসের মাথায় কেন ‘পরিকল্পিত’ লোডশেডিং দিতে হলো?

ইজাজ হোসেন: শতভাগ বিদ্যুতায়ন জোর করে করা একটা ব্যাপার। শতভাগ বিদ্যুতায়নের সক্ষমতা আমাদের নেই। তড়িঘড়ি করে শতভাগ বিদ্যুতায়নের দিকে যাওয়ায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে তাদের পুরো সম্পদ ও মনোযোগ সেদিকেই রাখতে হয়েছে। ফলে সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন তখনই হবে, যখন আমরা উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের ক্ষেত্রে শতভাগ প্রস্তুত হতে পারব। গ্রামের মানুষেরা তো শহরের মানুষের তুলনায় অনেক পরে বিদ্যুৎ পেয়েছেন। আরও কিছুদিন অপেক্ষা তো তাঁরা করতেই পারতেন। আমরা যদি পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করতাম, তাহলে কি ক্ষতি হতো? এখন তো সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলো।

জ্বালানি ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে আমরা আগে থেকেই নাজুক অবস্থায় ছিলাম। আমরা যদি বিদ্যুতায়নটা যা হওয়ার কথা সেটাতেই রাখতে পারতাম, তাহলে চাহিদাটা অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেড়ে যেত না। তাতে এখনকার সংকট হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবে উতরে যাওয়া যেত। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে পরিকল্পনাহীনতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত হলো, এখন জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের ৫৫ শতাংশ গৃহস্থালি বা বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত হয়। গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ ভোগের বৃদ্ধিটা মূলত গৃহস্থালিতেই বেড়েছে। ১০ বছর আগে শিল্প ও গৃহস্থালিতে ব্যবহার প্রায় সমান (২৭ শতাংশের মতো) ছিল। এখন শিল্প খাতে এর হিস্যা ৩০ শতাংশ।

আবার অপরিকল্পিত বিদ্যুতায়নের কারণে আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির খুব সফল যে সোলার হোম সিস্টেম ছিল, সেটাও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারা দেশে প্রায় ৬৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম ছিল, সেগুলোর অর্ধেকের বেশি এখন পরিত্যক্ত। আমরা আসলে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মূল বিষয় হচ্ছে, আমরা শুধু পাওয়ার প্ল্যান্ট করে গেছি। কিন্তু পাওয়ার প্ল্যান্ট তো আর বিদ্যুৎ নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনযন্ত্র, তাতে তো জ্বালানি জোগাতে হবে। কিন্তু সেই জ্বালানি কোথা থেকে আসবে সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। এ কারণে আজ আমরা এমন বিপদে পড়েছি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: করোনা–পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে জ্বালানির যে উচ্চ মূল্য, তা বিদ্যুতের বর্তমান সংকটের কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এ সংকটে আমাদের জ্বালানিনীতির দায় কতটা?

ইজাজ হোসেন: কোভিড মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের আগেও আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সচল রাখার জন্য জ্বালানি জোগানোর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় ছিল। সংকটগুলো নানাভাবে ঢাকা দেওয়া ছিল। কোভিড আর ইউক্রেন যুদ্ধ না এলে মোটামুটি সেভাবেই চলত, কেউ বুঝতে পারত না। এখন এক ধাক্কাতেই চরম বিপদটা সামনে বেরিয়ে এল। আমাদের পেট্রোবাংলা ও পিডিবির (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) মধ্যে কোনোরকম সমন্বয় নেই এবং পিডিবি যে পেট্রোবাংলাকে তোয়াক্কাও করে না—এটাই বর্তমান সংকটের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রকৃতপক্ষে আমাদের কোনো নীতি নেই, কোনো পরিকল্পনা নেই। দিন আনি দিন খাই পরিকল্পনায় আমরা চলছি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: জ্বালানি সাশ্রয়ে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে? বিদ্যুৎকেন্দ্রে সাশ্রয় হলে লোডশেডিংয়ের কারণে বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় ডিজেলের ব্যবহার বেড়ে যাবে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।

ইজাজ হোসেন: সরকার সব ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করেনি। সরকারের নিজস্ব মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন কেন্দ্র বন্ধ হয়েছে। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি। ডিজেলভিত্তিক সব কেন্দ্র বন্ধ রাখলে ডিজেল সাশ্রয় হতো, কিন্তু তাতে লোডশেডিং অনেক বেড়ে যেত। বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে সরকার এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের সাশ্রয়ের কথা বলেছে। আমার ধারণা, শতভাগ সাশ্রয় হবে না। এর ৫০ শতাংশ সাশ্রয় হতে পারে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকটটা কতটা গভীর? সরকার বলছে এটা সাময়িক সংকট। বাস্তবতা কী বলছে?

ইজাজ হোসেন: সংকটটা আরও অনেক গভীর হতে পারে। সরকার বলছে আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসবে, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আসবে, তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন তো অনেক আগেই শুরু হওয়ার কথা। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালুর পরও সঞ্চালন লাইনের কারণে পুরো বিদ্যুৎ আমরা পাচ্ছি না। সঞ্চালন লাইন ডিসেম্বরের পরে চালু হওয়ার কথা রয়েছে। রামপালের বিদ্যুৎও এই সঞ্চালন লাইন দিয়ে আসবে। ফলে সঞ্চালন লাইন আগে করা না গেলে নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা সম্ভব নয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শুধু তেল-গ্যাস নয়, বিশ্বে কয়লার দামও বেড়ে গেছে। এখন যদি সরকার বলে কয়লার দাম বেড়ে গেছে, আমরা তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে পারছি না, তাহলে লাভটা কী হলো? ফার্নেস অয়েল আর কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ যদি কাছাকাছি থাকে, তাহলে সংকট তো রয়েই যাবে। কেননা, ডলারের সংকটের কারণেই তেল-গ্যাস আমদানি কমিয়ে দিতে হয়েছে।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রত্যাশিত বিদ্যুৎ পেতে গেলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ঠিক সময়ে ও ঠিকমতো উৎপাদনে আসতে হবে। সঞ্চালন সুবিধাগুলো ঠিকমতো থাকতে হবে। কয়লার দামও সহনীয় পর্যায়ে থাকতে হবে। এই তিন শর্ত পূরণের ওপর নির্ভর করছে বর্তমান সংকটটা কতটা গভীর হবে। আবহাওয়া ঠান্ডা থাকায় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমে যাবে। কিন্তু মার্চ থেকে গরম শুরু হবে। তখন ওপরের তিনটি শর্ত পূরণ না হলে অনেক বড় সমস্যায় পড়তে হবে।

আবার আমাদের গ্যাসের সমস্যা রয়েই গেছে। প্রতিবছর গ্যাসের চাহিদাও বাড়ছে। সরকার এখন সংকটে পড়ে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সেটা করতেও সময় লাগবে। আবার স্পট মার্কেটে এলএনজির এখন আকাশছোঁয়া দাম, আমদানি সম্ভব হবে না। কাজেই লোডশেডিং থেকে শিগগির মুক্তি মিলছে না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ডলার–সংকটে জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বিপদ একেবারে ঘাড়ের ওপর চেপে বসার পরই কেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের সিদ্ধান্তটা নেওয়া হলো?

ইজাজ হোসেন: লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্তটা আগেই নেওয়ার দরকার ছিল। কেননা, দেশের সামগ্রিক স্বার্থের সঙ্গে এটা সম্পর্কিত। আমাদের আমদানির বড় অংশই জ্বালানি। আগে সিদ্ধান্ত নিলে ডলারের ওপর চাপ কম পড়ত। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে সরকার লোডশেডিং থামিয়ে রেখেছিল। ডিজেল থেকে এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা খরচ হয়। এত দামি বিদ্যুৎ দিয়ে লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে রাখা কতটা যৌক্তিক। সরকার কিছুদিন আগে ঘোষণা দিয়েছে, শতভাগ বিদ্যুতায়ন ও উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট, সেই ভাবমূর্তিটা যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্যই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে। এখন পরিস্থিতি অসহনীয় অবস্থায় চলে এসেছে। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি থেকেও শিক্ষা নিয়েছে। সব মিলিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, আর নয়, এবার সংযমী হওয়ার সময় এসেছে।

বিপিসি কয়েক দিন আগে জানিয়েছে, তাদের কাছে ৪৫ দিনের ডিজেল মজুত আছে। এখন সাশ্রয়ী কর্মসূচি না নিলে মজুত ডিজেল তো ৪৫ দিনেই ফুরিয়ে যাবে। বিপিসি চেষ্টা করেছে জ্বালানি তেল কিনতে। ব্যাংকগুলোতে চেষ্টা করেও এলসি খুলতে পারেনি। বিপিসির পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার পরই সরকার জ্বালানি সাশ্রয় ও লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা স্পষ্ট যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট সামগ্রিক সংকটের অংশ। জাতীয় স্বার্থে এই সাশ্রয় আরও আগে থেকে করা যেত।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। মিয়ানমার যেখানে গভীর সমুদ্রে তাদের সীমানায় গ্যাস উত্তোলন করছে, সেখানে আমরা জরিপ ও অনুসন্ধানই করতে পারলাম না। এর কারণ কী বলে মনে করেন?

ইজাজ হোসেন: এটা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলার একটা বড় ব্যর্থতা। তবে তারা যে একেবারে উদ্যোগ নেয়নি, সেটা বলব না। এটা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, আন্তর্জাতিক দর-কষাকষির মতো খুবই বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন বিষয়। পুরো বিষয়টাকে বুঝে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এখানে আনার কাজটা তারা ঠিকমতো করতে পারেনি। সেটার মাশুল আমাদের আজ গুনতে হচ্ছে। গভীর সমুদ্রে আমাদের সীমানায় পূর্ণ জরিপ ও অনুসন্ধানের দরকার ছিল। মিয়ানমার সেটা করেছে। তারা সেখানে গ্যাসও পেয়েছে। বাংলাদেশে অনেকে বলার চেষ্টা করেন, গভীর সমুদ্রে তেমন কোনো গ্যাস নেই। সেটা তো মুখে বললে হবে না। আমাদের তো দেখাতে হবে আমরা চেষ্টা করেছি, ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু আমরা ব্যর্থ হয়েছি কিসে? চেষ্টা করতেই ব্যর্থ হয়েছি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধানের বদলে সরকার আমদানিনির্ভর এলএনজির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আমাদের নিজস্ব গ্যাস তো জ্বালানিনিরাপত্তার সঙ্গেও যুক্ত...

ইজাজ হোসেন: সরকার আমাদের নিজস্ব গ্যাস আহরণ করে দেশের জ্বালানিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ততটা মনোযোগী নয়। সরকার ভেবেছে, যেহেতু বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কম, আমাদের নিজস্ব টাকা খরচ করে গ্যাস অনুসন্ধানের ঝুঁকি নেব কেন? গ্যাস আমদানি করে আনব, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দিয়ে দেব। যা দাম হবে, জনগণ দিয়ে দেবে। কিন্তু স্পট মার্কেটে গ্যাসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এখন অনেকে বলছে, এলএনজি আমদানিতে কেন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা হলো না? তখন কিন্তু আবার অনেকে উল্টো কথা বলেছেন।

এখন প্রশ্ন হলো, সরকার নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণ বাড়ায়নি কেন? এর কারণ হলো মানসিকতা। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অনেকে বলেন, ছোটখাটো গ্যাসক্ষেত্রের জন্য যা টাকা খরচ হয়, তাতে পোষায় না। প্রশ্ন হলো, আমরা যদি ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ১০ হাজার কোটি টাকার গ্যাস পাই, সেটাও তো আমাদের জন্য ভালো। দেশের গ্যাস দেশেই পাচ্ছি। আমাদের গ্যাসের নিরাপত্তা আমাদের হাতেই থাকল। আমাদের মাটির নিচে, সমুদ্রের নিচে প্রচুর গ্যাস আছে, সেটা আমারও মনে হয় না। কিন্তু যতটা আছে, সেটা যদি ঠিকঠাক অনুসন্ধান ও আহরণ করা হতো, তাহলে আজকের এ সংকটে পড়তে হতো না।

সরকার তো এখন বলছে, তারা গ্যাসের উৎপাদন বাড়াবে। প্রশ্নটা হলো, দুই বছর আগে সেটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল না কেন? সরকারের মনোভাব ছিল আমরা আমাদের নিজস্ব টাকা দিয়ে অনুসন্ধান করব কেন, বিদেশিরা এসে করলে করুক। আমরা এলএনজি আমদানি করব, ঘাটতিটা মেটাব। লিখিত না হলেও জ্বালানি খাতের এটাই প্রচলিত নীতি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বিদ্যুৎ-সংকট সমাধানে সাময়িক সমাধান হিসেবে একসময় ‘কুইক রেন্টাল’ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করে সরকার। এত দিন পরও এত ভর্তুকি দিয়ে, এত উচ্চ মূল্যের কুইক রেন্টাল রাখার যৌক্তিকতা কতটা?

ইজাজ হোসেন: আমি কুইক রেন্টাল শব্দটা পছন্দ করি না, এটা একটা প্রশাসনিক শব্দ। আমরা একসময় ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছিলাম। কারণ, আমাদের দ্রুত বিদ্যুৎ দরকার ছিল। কিন্তু সেগুলো তো তিন বছর ব্যবহার করার কথা ছিল। যে কারণে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে হলো, প্রথম তিন বছরে আমরা তার সমাধান করতে পারিনি। সে জন্য না হয় আরও তিন বছর গেল। এরপর আমরা এগুলোকে প্রায় অনির্দিষ্ট সময়ের মতো করে দিয়ে রেখে দিয়েছি। এর মানে হচ্ছে, এক যুগ আগে আমাদের বিদ্যুৎ খাতে যে সমস্যা ছিল, তার সমাধান আমরা এখনো করতে পারিনি। ২০০৯-১০ সালে আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল না, জ্বালানিও ছিল না। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, ‘এক্সপেনসিভ ইলেকট্রিসিটি ইজ বেটার দ্যান নো ইলেকট্রিসিটি’। কেননা কোনো বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদের শিল্প ও অর্থনীতিতে যে বহুমাত্রিক ক্ষতি হবে। সেই যুক্তি আমরা মানলাম। কিন্তু অনন্তকাল ধরে সেটা তো মানা যায় না। জ্বালানি খাতকে যদি টেকসই খাতে পরিণত করতে পারত সরকার, তাহলে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের অস্তিত্বই থাকার কথা নয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বিদ্যুতের ক্ষেত্রে আলোচিত একটি বিষয় সিস্টেম লস। এখন গ্যাসের ক্ষেত্রেও বড় সিস্টেম লস হচ্ছে। অনেকে বলছেন, এটা যতটা সিস্টেম লস, তার চেয়ে বেশি চুরি। সিস্টেম লস বন্ধ করলে জ্বালানির অনেকটাই সাশ্রয় হবে।

ইজাজ হোসেন: একসময় বিদ্যুতে সিস্টেম লস অনেক বেশি ছিল। সরকার অনেকখানি কমিয়েছে। তবে সিস্টেম লসের ব্যাপারে একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। সরকার যে তথ্য দেয়, সেটা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে সিস্টেম লস আরও বেশি। বিদ্যুতের সিস্টেম লসের চেয়েও গ্যাসের সিস্টেম লস এখন অনেক বেশি মাথাব্যথার কারণ। এটার পরিমাণ ৮ থেকে ৯ শতাংশ। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে বিজ্ঞানসম্মতভাবেই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ লস হবেই। এটাকে কখনোই শূন্যতে নামিয়ে আনা যাবে না। তেলের ক্ষেত্রেও সেটা হয়। কিন্তু সরবরাহ লাইনে লিক না থাকলে গ্যাসে কোনো লস হওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং, গ্যাসের সিস্টেম লসটা পুরোপুরি চুরি। সরকার নিজেও তা জানে, তিতাসও জানে। আমাদের জাতীয় সম্পদ এভাবে চুরি হয়ে যাচ্ছে। আর এখন তো আমরা অনেকটা সোনার দামে এলএনজি কিনে নিয়ে আসছি। জাতীয় স্বার্থে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে গ্যাসের এই চুরি বন্ধ করতে হবে। এই চুরি হওয়া গ্যাস দিয়ে কমপক্ষে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: শহরের তুলনায় গ্রামে অনেক বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে আমন চাষে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। করণীয় কী?

ইজাজ হোসেন: সারা দেশে সমানভাবে লোডশেডিং করা হবে—বলার পরও সেটা মানা হচ্ছে না। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কৃষি এখন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিতে বিদ্যুতের ব্যবহার মোট ব্যবহারের খুব কম। সরকার চাইলে সেখানে বিদ্যুৎ দিতে পারে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের করণীয় কী?

ইজাজ হোসেন: স্বল্প মেয়াদে করণীয়র মধ্যে সরকার জ্বালানি সাশ্রয়ে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো আরও পরিকল্পিত ও জোরদারভাবে করতে হবে। সরকারি গাড়ি ব্যবহারে ২০ শতাংশ সাশ্রয়ের কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্তত ৫০ শতাংশ সাশ্রয়ী হওয়ার সুযোগ আছে। তবে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য যত খাতের কথা বলা হয়েছে, সবই বাণিজ্যিক খাত। সব মিলিয়ে এগুলোতে বিদ্যুৎ ব্যবহার ৫ শতাংশের মতো। তাই এ খাতে বেশি সাশ্রয় হওয়ার সুযোগ কম। শিল্পে সাশ্রয় করতে গেলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে। প্রকৃত সাশ্রয় করতে গেলে গৃহস্থালির দিকে নজর দিতে হবে, সেখানে লোডশেডিং বাড়ানোর সুযোগ আছে। বাসাবাড়িতে কীভাবে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো যায়, সেটার পরামর্শ সরকারকে দিতে হবে। এসি ও ফ্রিজের তাপমাত্রা কত রাখতে হবে—এ ধরনের পরামর্শ ব্যাপকভাবে দিতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে, তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যদি সম্ভব হয় শহরে সপ্তাহে এক দিন যান্ত্রিক যানবাহন বন্ধ রাখতে হবে। মানুষের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের একটা সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি করণীয় হচ্ছে জ্বালানিনীতির পরিবর্তন। আমাদের জ্বালানিনীতি সাধারণত বিদেশিরা এসে করে দেয়। দেশি বিশেষজ্ঞদের মোটেই যুক্ত করা হয় না। রাজনৈতিক দল কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থ নয়; দেশের ও মানুষের স্বার্থে যেটা ভালো হবে, সেটাই করতে হবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

ইজাজ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।