স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) প্রথম বাংলাদেশি নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ। তিনি মূলত পুষ্টি-গবেষক। বর্তমানে তিনি দেশের ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একাধিক পুষ্টি গবেষণায় যুক্ত। পুষ্টির ওপর কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কী প্রভাব পড়েছে, তা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়ল।
মহামারি এখনো শেষ হয়নি। বলা যায় শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। শুরুর দিকে যে ভয়-আতঙ্ক ছিল, তা আর নেই। কিন্তু মহামারির প্রভাব রয়ে গেছে। পুষ্টির ওপর এর কী বিরূপ প্রভাব ছিল বা আছে? কোনো ইঙ্গিত কী পাওয়া গেছে?
তাহমিদ আহমেদ: মহামারির শুরুতে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে। মানুষ যদি দীর্ঘ সময় খাদ্য নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে থাকে, তাহলে তার প্রভাব পড়ে পুষ্টির ওপর। অন্যান্য সময়ের চেয়ে মহামারির সময় আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে আসা শিশুদের মধ্যে তীব্র ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া বেশি দেখা গেছে। তাদের মধ্যে অপুষ্টি বেশি ছিল। শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি দেখা গেছে। এ নিয়ে আমরা গবেষণা প্রতিবেদনও প্রকাশ করি।
আন্তর্জাতিকভাবে বলা হয়েছিল, মহামারির কারণে পরিবারগুলোর আয় কমবে ৮ শতাংশ। শিশুদের মধ্যে ওয়েস্টিং বা শিশুদের শুকিয়ে যাওয়া বাড়বে ১৪ শতাংশ। বলা হয়েছিল, পরিবারের আয় কমে যাওয়া ও অপুষ্টির কারণে সারা বিশ্বে ১ লাখ ৩২ হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটবে। সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ওয়েস্টিং বা শিশুদের শুকিয়ে যাওয়ার হার বাড়ছে।
মহামারি শেষ না হতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়। বিশ্ববাণিজ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই যুদ্ধ বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এর কী প্রভাব পড়ছে পুষ্টিতে?
তাহমিদ আহমেদ: রাশিয়া, ইউক্রেন—এসব অঞ্চল খাদ্য উৎপাদনে প্রসিদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভাব ফেলেছে বিশ্ববাণিজ্যে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে খাদ্যের মূল্যের ওপর। খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাব আছে শিশুপুষ্টি ও মাতৃপুষ্টির ওপর। এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
তাহলে করোনা মহামারি ও যুদ্ধ যৌথভাবে পুষ্টি পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলেছে বলা যায়?
তাহমিদ আহমেদ: কোভিড-১৯ মহামারি ও যুদ্ধ গভীর প্রভাব ফেলেছে শিশুপুষ্টি ও মাতৃপুষ্টির ওপর। এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও গবেষণা হবে। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি।
মহামারির সময় সরকার চিকিৎসা ঠিক রাখার ব্যাপারে জোর দিয়েছে। কিন্তু পুষ্টি ঠিক রাখার কথা গত চার বছরে খুব কিছু শুনিনি। আপনার কী ধারণা?
তাহমিদ আহমেদ: মহামারির সময় সমূহ বিপদ মোকাবিলার ওপর সরকার বেশি জোর দিয়েছে। সেটাই ছিল সরকারের কাছে অগ্রাধিকার। এ কথা ঠিক যে মা ও শিশুপুষ্টি নিয়ে আলাদা উদ্যোগ, আলাদা কর্মসূচি আমাদের চোখে পড়েনি। জরুরি পরিস্থিতিতে মানুষের চিকিৎসা যেমন দরকার, তেমনি দরকার পুষ্টি। কারণ, অপুষ্টির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থেকে যায়, এর মূল্য বহু বছর ধরে দিয়ে যেতে হয়।
কোন কোন ক্ষেত্রে অপুষ্টি পরিস্থিতি সুনির্দিষ্টভাবে গবেষকদের চোখে পড়ছে?
তাহমিদ আহমেদ: জরিপ বলছে, দেশে পরিস্থিতি খুব আশাব্যঞ্জক নয়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ১১ শতাংশ ওয়েস্টিংয়ের(শিশুদের শুকিয়ে যাওয়া) শিকার। তাদের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। এই বয়সী শিশুদের ১ দশমিক ৮ শতাংশ তীব্র অপুষ্টির মধ্যে আছে, সংখ্যায় যা প্রায় তিন লাখ। তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের মৃত্যুঝুঁকি সাধারণ শিশুদের চেয়ে ১১-১২ গুণ বেশি । আমরা বলতে পারি, মহামারি, যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি শিশুদের অপুষ্টির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
শিশুদের আর কী ক্ষতি আপনারা দেখেছেন?
তাহমিদ আহমেদ: শিশু যদি দীর্ঘদিন অপুষ্টির মধ্যে থাকে, তবে তার প্রভাব আমরা দেখি তার উচ্চতায়। এতে তাদের উচ্চতা বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা বলি খর্বকায় শিশু। পুষ্টিবিদেরা এই শিশুদের কথা বলেন এই কারণে যে তাদের মৃত্যুঝুঁকি তিন-চার গুণ বেশি। যারা বেঁচে যায়, তাদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ কম হয়।
এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ কী আছে আপনাদের হাতে?
তাহমিদ আহমেদ: সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি, মানুষের মস্তিষ্কে দুই ধরনের পদার্থ থাকে: ধূসর পদার্থ বা গ্রে ম্যাটার ও সাদা পদার্থ বা হোয়াইট ম্যাটার। মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থ হচ্ছে স্নায়ুকোষের সমষ্টি। আর সাদা পদার্থ হচ্ছে স্নায়ুকোষগুলো সংযুক্তকারী তারের সমষ্টি। এই তারের মাধ্যমে তথ্য এক কোষ থেকে অন্য কোষে যায়।
গবেষণার অংশ হিসেবে আমরা বস্তি এলাকায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের এমআরআই করে দেখেছি, তাদের মস্তিষ্কে এই সাদা পদার্থ তুলনামূলকভাবে কম।
এই ক্ষেত্রে তো আমাদের অগ্রগতি ছিল? আমরা কী পিছিয়ে পড়ছি?
তাহমিদ আহমেদ: পিছিয়ে পড়ছি, এটা বলা ঠিক হবে না। বরং বলা ভালো, আমাদের বিষয়টির প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া দরকার। দেখা দরকার, আমরা কোথায় আছি, আর আমাদের কোথায় যাওয়ার কথা ছিল।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শিশু ছিল খর্বকায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জরিপ বলছে, প্রায় ২৪ শতাংশ শিশু খর্বকায়। অর্থাৎ প্রতি চার শিশুর একটির উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। তাদের সংখ্যা প্রায় ৩৭ লাখ। তাদের ব্যাপারে যত্নবান না হলে তাদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে না, স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত হবে।
এসব ব্যাপারে কিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা থেকে কত দূরে?
তাহমিদ আহমেদ: আন্তর্জাতিক দুটি লক্ষ্যমাত্রা আছে। একটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেমব্লিতে নেওয়া। অন্যটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি), যা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে। এসডিজির ২ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় পুষ্টির বিষয়টি রয়েছে। এতে জন্ম-ওজন কম নিয়ে শিশুর সংখ্যা কমানো, শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার বাড়ানো এবং অপুষ্টিতে ভুগছে, এমন শিশুর হার কমানোর প্রতিশ্রুতি আছে।
লক্ষ্যমাত্রায় বলা আছে, ২০১২ সালে খর্বকায় শিশু যা ছিল, তার ৪০ শতাংশ কমাতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। বছরে আমাদের খর্বকায় শিশু কমছে গড়ে প্রায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। এই হারে কমতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ এ ধরনের শিশু থাকবে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে আমরা কোনো রকমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করব। কিন্তু খাদ্যনিরাপত্তা, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি—এই বিষয়গুলো লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঝুঁকি হয়ে থাকবে।
মাঠপর্যায়ে কী ঘটছে, তার দু-একটি উদাহরণ আমরা জানতে পারি?
তাহমিদ আহমেদ: ভিটামিন ‘এ’ কর্মসূচি চলছে দেশজুড়ে। এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়ানোর কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা পুরোপুরি হচ্ছে না।
আমরা গাইবান্ধায় একটি গবেষণায় দেখেছি, ৫০ শতাংশ কিশোরী আয়োডিন-স্বল্পতায় ভুগছে। আমরা অনুসন্ধানে দেখেছি, বাজারে প্যাকেটজাত লবণ ও খোলা লবণ বিক্রি হয়। প্যাকেটজাত লবণে আয়োডিন থাকে, খোলা লবণে থাকে না। প্যাকেটজাত লবণ এক কেজির দাম ৩৫-৪০ টাকা। খোলা লবণের কেজি ২০-২৫ টাকা। মানুষ খোলা লবণই কিনছে বেশি।
মনে রাখতে হবে, আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড রোগ হয়, থাইরয়েড গ্রন্থিতে সমস্যা দেখা দেয়। আমরা আয়োডিনের মতো বেশ কিছু অণুপুষ্টি কণার (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট) ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি।
মাতৃপুষ্টির বিষয়টিও আলোচনার আড়ালে চলে গেছে? সেদিকে কি যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে?
তাহমিদ আহমেদ: শিশুপুষ্টির অনেকটাই নির্ধারিত হয়ে যায় মায়ের পুষ্টি মাধ্যমে। আলোচনাটি গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করা যেতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায়, গর্ভবতী মায়ের ওজন ১৫-১৬ কেজি বাড়ে। আমাদের দেশে প্রায় ৫৬ শতাংশ মায়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় তাঁদের ৮-৯ কেজি ওজন বাড়ে। শেষ তিন মাসে বাংলাদেশের মায়েদের ওজন আনুমানিক ৪ কেজি বাড়া উচিত। অপুষ্টির কারণে মায়েদের ওজন বেশি বাড়ে না।
অপুষ্টিতে ভোগা মায়েদের শিশুর জন্ম-ওজন (লো বার্থ ওয়েট) কম হয়। জন্ম-ওজন কম হওয়া শিশুদের খর্বকায় হওয়ার ঝুঁকি বেশি। যেসব দেশে এ ধরনের শিশু বেশি জন্মায়, এমন তালিকার ওপরের দিকে বাংলাদেশের অবস্থান।
সামাজিক বিষয়ও অপুষ্টির কারণ হতে পারে। দেশে বাল্যবিবাহ বেশি। বাল্যবিবাহের কারণে অল্প বয়সে একটি মা শিশুর জন্ম দিচ্ছে। কম জন্ম-ওজন বা খর্বকায় শিশুর পেছনে আছে এই বাল্যবিবাহ। যেসব দেশে বাল্যবিবাহ বেশি, বাংলাদেশ তার অন্যতম।
অপুষ্টির পেছনের গল্প আরও লম্বা হতে পারে। কিন্তু সরকারের কোন দিকে নজর দেওয়া উচিত বলে গবেষকেরা মনে করছেন?
তাহমিদ আহমেদ: আমাদের দেশে জনঘনত্ব অনেক বেশি। আছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। প্রতিবছর কৃষিজমি কমছে। কৃষিজমি কমার কারণে কৃষি উৎপাদন কম হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা বাড়াতে হবে। মাটির উর্বরতা ঠিক রেখে উচ্চ ফলনশীল জাতের ব্যাপারে আরও মনোযোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সফলতার ইতিহাস আছে।
জাপানে কম দামে ডিম পাওয়া যায়, যেটি শিশুর পুষ্টির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎস। আমাদের দেশে ডিম উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং সুলভ মূল্যে ডিমপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। সর্বজনীন হাত ধোয়া অভ্যাস নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে শিশুদের ক্ষুদ্রান্ত্রে জীবাণু বাসা বাঁধে। ফলে ক্ষুদ্রান্ত্রের সাধারণ কার্যকলাপ ব্যাহত হয়। খাবার থেকে পুষ্টি আহরণ কমে যায় এবং ফলে শিশুর অপুষ্টি দেখা দেয়। আমাদের পুষ্টি গবেষণা বাড়াতে হবে। বস্তিবাসী, চর এলাকা বা দুর্গম এলাকার মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট পুষ্টি কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা সম্ভব।
মহামারি ও যুদ্ধ থেকে আমরা কি নতুন কিছু শিখলাম?
তাহমিদ আহমেদ: মহামারি ও যুদ্ধ বিশ্ববাসীকে মহাসংকটে ফেলেছে। এ সংকটে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে প্রথমেই খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে আসে। দেশে খাদ্যঘাটতির ঝুঁকি আছে, সেই ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের দেশে খাদ্যের অপচয় অনেক বেশি। এই অপচয় বন্ধ করতে হবে এবং ‘আউট অব দ্য বক্স’, অর্থাৎ গতানুগতিক ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে চিন্তা করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
তাহমিদ আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।