রাশেদা কে চৌধূরী গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। দুই দশক ধরে গণসাক্ষরতা অভিযান বা ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন (ক্যাম্পে) বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আসছে। সংস্থাটি সম্প্রতি কোভিড–পরবর্তী শিখন পরিস্থিতির ওপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনের ফলাফল নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ সাবিহা আলম
প্রথম আলো: ক্যাম্পে তো দুই দশক ধরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আসছে। সম্প্রতি আপনাদের আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এর বিশেষত্ব কী?
রাশেদা কে চৌধূরী: বাংলাদেশে শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির কথা অনেক দিন ধরেই আমরা বলে আসছি। ২০২০ সাল থেকে পরপর তিনটি জরিপে আমরা দেখার চেষ্টা করেছি ক্রমাবনতিশীল শিক্ষাব্যবস্থায় করোনার প্রভাব কতটা পড়েছে। সারা বিশ্বের মতো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও করোনায় হোঁচট খেয়েছে।
প্রথম আলো: জরিপ তিনটির ফল কী? আপনারা কী দেখতে পেলেন?
রাশেদা কে চৌধূরী: শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে সরকার টেলিভিশন ও অনলাইনে ক্লাস অব্যাহত রাখে। কিন্তু অভিভাবক, শিক্ষক, প্রশাসন—সবাই একবাক্যে বলেছে, এ উদ্যোগ শতভাগ সফল হয়নি। বৈষম্য সব ক্ষেত্রে আছে। আমাদের জরিপে ছেলে-মেয়ে ও গ্রাম-শহরের বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে ব্যানবেইসের (বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো) গবেষণায়। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সবাই করতে পারেনি। কারণ, কানেক্টিভিটির সমস্যা ছিল, ওয়াই–ফাই যুক্ত করতে পারেনি অনেকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে তো নেটওয়ার্কের খুবই অসুবিধা। সব জায়গায় অবকাঠামোও নেই। শিক্ষকেরাও যথেষ্ট প্রশিক্ষণ পাননি।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, করোনা–সংক্রান্ত কারিগরি কমিটি রোগের ঘনত্ব/প্রকোপ অনুসারে একটা ম্যাপিং করেছিল। আমরা এই ম্যাপ ধরে করোনা–সংক্রান্ত কারিগরি কমিটিকে ধাপে ধাপে স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছিলাম। আমাদের আরেকটি সুপারিশ ছিল—সিলেবাসটা একটু কমিয়ে এনে শিক্ষার্থীদের দ্রুত ক্লাসে ফেরানো, যেন তাদের জড়তা কাটে। সরকার আমাদের সুপারিশ আমলে নিয়েছিল।
২০২১ সালের দ্বিতীয় জরিপে আমরা দেখতে পাই, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার প্রভাব পড়েছে। শিক্ষার গতি কমে এসেছে। আমরা ক্ষতির জায়গাগুলো এবং শিখনে কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা শনাক্ত করি এবং কিছু পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনাও দিই। সরকারও পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করেছিল, আমাদের সুপারিশও তারা আমলে নেয়। বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে, তা নিয়ে কথা হতে পারে।
প্রথম আলো: ছাত্রছাত্রীদের শিখনক্ষতি যাচাইয়ের প্রক্রিয়াটা কী ছিল?
রাশেদা কে চৌধূরী: আমরা মতামত ও জরিপের ভিত্তিতে যাচাই করেছি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে পরীক্ষা নিই। এর বাইরেও শিক্ষক, অভিভাবক, ছাত্রছাত্রীসহ অংশীজনদের সবার মতামত নেওয়ার চেষ্টা করেছি।
প্রথম আলো: শিক্ষার্থীরা এই পরীক্ষায় কেমন করেছে?
রাশেদা কে চৌধূরী: আমরা দেখলাম, মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি ও গণিতে দুই–তৃতীয়াংশ ছেলেমেয়ে পাস করেনি। এই ছেলেমেয়েরা অষ্টম শ্রেণি এবং তার ওপরের ক্লাসের। তবে এখানেও একটা বিষয় লক্ষণীয়, আমরা সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন দেখেছি যে মেয়েরা এগিয়ে আছে, আমাদের জরিপের ফলাফলেও তা–ই দেখি। আবার এলাকাভেদেও ছাত্রছাত্রীদের ফলাফলে তারতম্য দেখা যায়। জরিপভুক্ত কোনো কোনো এলাকা ভালো করেছে, আবার কোনো এলাকা ভালো করেনি।
প্রথম আলো: এই যে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি ও অঙ্কে এত খারাপ ফলাফল নিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের দিকে এগোচ্ছে, এর দীর্ঘমেয়াদি ফল কী হতে পারে?
রাশেদা কে চৌধূরী: আমি বলব, ছাত্রছাত্রীদের এই দুর্বলতা চলমান বৈষম্যের ফল। আমাদের সিস্টেম থেকে জিপিএ–৫ পেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীরা পাস করতে পারছে না। বৈষম্যের জায়গাগুলো সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানই চিহ্নিত করেছে। কিন্তু কেন এই সমস্যা থেকে যাচ্ছে, সেটা আমরা খোঁজ করিনি। মূল সমস্যা হলো, শিক্ষা এখন বহুলাংশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে চলে এসেছে। সম্প্রতি ইউনেসকো বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশের ওপর গবেষণা করেছে। সেখানে তারা বলেছে, বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ শতাংশ পরিবারকে বহন করতে হয়। আমাদের এই মাঠ জরিপেও কোচিং ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরতার বিষয়টি উঠে এসেছে। এ কারণে পড়ালেখাটা ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সব নাগরিকের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা। যত দিন আমরা তা নিশ্চিত করতে পারব না, তত দিন বৈষম্য দূর হবে না।
প্রথম আলো: আপনাদের প্রতিবেদনে দেখছি, শিক্ষকেরা বলেছেন শিক্ষার্থীদের মনোযোগ কমে গেছে...
রাশেদা কে চৌধূরী: কোভিডের পর যেসব পরিবারে সচ্ছলতা ও সুযোগ আছে, সেসব পরিবারের শিশুদের মুঠোফোনে তীব্র আসক্তি দেখা গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ছেলেমেয়েদের এই আসক্তি নিয়ন্ত্রণে মায়েদের বা পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষকেরা যেভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করবেন, সব পরিবারের সেভাবে করার সুযোগ নেই। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ মাসের শুরুতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা বলেছে, চারজনে একজন শিক্ষার আলোয় আসেনি। তো এই ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে তাদের মা–বাবা সাহায্য করবে—এ আশা করা অনুচিত। এখানেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, শিক্ষকদের এগিয়ে আসা দরকার। তবে শিক্ষকদের ওপর আমরা দায় চাপাব, কিন্তু তাঁদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদার কথাও ভাবব না, তা তো হয় না।
প্রথম আলো: করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে আমরা শুনে আসছিলাম। সামগ্রিক বিবেচনায় শিখনক্ষতির বাইরে আর কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে?
রাশেদা কে চৌধূরী: আমাদের চারটি আশঙ্কা ছিল—শিক্ষায় ঝরে পড়া বাড়বে, শিখনক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে, শিশুশ্রম ও অপুষ্টি বাড়বে এবং বাল্যবিবাহের সংখ্যা বাড়বে। প্রথম আলো পত্রিকাতেই আমরা দেখেছি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে যে মেয়ে হ্যাটট্রিক করেছে, সে বাল্যবিবাহের শিকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশুশ্রম জরিপে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। শিশুদের স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করার কথা আমরা বলছি। কিন্তু জরিপের কাজে সরকারের লোকজন স্কুলে গিয়ে দেখেছেন, অনেকেই অনুপস্থিত। এর অর্থ শিশুরা হয় শ্রমে গেছে, না হলে স্কুল তাদের কাছে আকর্ষণীয় নয়।
প্রথম আলো: এই শিশুদের জন্য কী করা যায়? কীভাবে তাদের আবারও মূলধারায় ফেরানো যায়?
রাশেদা কে চৌধূরী: আমরা বলেছিলাম বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের ফেরাতে হলে তাদের উপবৃত্তিটা অব্যাহত রাখা জরুরি। কিন্তু আমরা খোঁজ নিয়ে জানলাম, সেটা হয়নি। ঝরে পড়া অন্য শিশুদের বেলাতেও উপবৃত্তি কাজে আসবে। মিড ডে মিল নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে শিশুদের স্কুলে ফেরানো সহজ হবে।
প্রথম আলো: শিক্ষকদেরও আয় কমেছে, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এর কোনো প্রভাব কি আপনারা দেখতে পেলেন?
রাশেদা কে চৌধূরী: এর প্রভাব প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বেসরকারি অর্থায়নে পরিচালিত। বেসরকারি বা এমপিওভুক্ত স্কুলগুলোয় শিক্ষকেরা নানা জটিলতায় আশানুরূপ বেতন পান না, যথাসময়েও পান না। আমরা তো এটাও জানি, করোনার সময় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকদের অনেকে পেশা ছেড়ে মুদিদোকান চালিয়েছেন। এ জন্য শিক্ষকের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আমরা মানসম্মত শিক্ষার কথা বলব আর তাঁদের সক্ষমতা বাড়ানোর কথা ভাবব না, তা তো হয় না!
প্রথম আলো: বুঝতে পারছি, পিছিয়ে পড়া শিক্ষাব্যবস্থা ভালো রকম হোঁচট খেয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী?
রাশেদা কে চৌধূরী: সরকার বড় একটা কাজ করেছে। তারা নতুন একটি শিক্ষাক্রম চালু করেছে। এই শিক্ষাক্রমে শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, হাতে–কলমে শেখা, জ্ঞানার্জন করা এবং পরীক্ষানির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসার একটা চেষ্টা আছে—এটা একটা ভালো দিক। অনেক প্রশিক্ষণ শিক্ষকদের দেওয়া হয়েছে। বড় চ্যালেঞ্জ—এ প্রশিক্ষণ তাঁরা শ্রেণিকক্ষে কতটা ব্যবহার করছেন! আমি জোর সুপারিশ করব বৈষম্য কমিয়ে আনার ব্যাপারে। আর সে জন্য দরকার বিনিয়োগ। এ বছর জাতীয় বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আমাদের শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিনিয়োগ না বাড়লে উত্তরণের পথ পাওয়া যাবে না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদা কে চৌধূরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।