প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি করবে

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানী। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক বিরোধ, সুশাসন, মানবাধিকার ও অর্থনীতিতে এর অভিঘাত, বাংলাদেশকে ঘিরে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

হোসেন জিল্লুর রহমান
প্রশ্ন

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?

হোসেন জিল্লুর রহমান: জ্যোতিষীরা হয়তো এ প্রশ্নের উত্তর ভালো দিতে পারবেন। আমি তো জ্যোতিষী নই।

প্রশ্ন

অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে আপনার মতামত জানতে চাইছি; যেখানে এক পক্ষ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অন্য পক্ষ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে।

হোসেন জিল্লুর রহমান: রাজনীতির কুশীলব বা অ্যাক্টররা যেভাবে বিষয়টি দেখছেন, সেভাবে বিচার না করে দায়িত্বশীল কাজ হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আলোকে দেখা। আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। রাজনীতিকে অর্থনীতি থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। নির্বাচনকে যতই আনুষ্ঠানিক মোড়ক দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সেটি প্রতিযোগিতাহীন। এ ধরনের নির্বাচনের প্রতি ভোটাররা আকৃষ্ট হবেন কি না, তা–ও প্রশ্নের বিষয়। প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন হলে তাদের আস্থা পাওয়া যায়।

প্রশ্ন হলো, বর্তমানে দেশ যে আনুষ্ঠানিকতার নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে, সেখানে ভোটারদের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে কি না। দেশের ভেতরে ও বাইরে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার জন্যও প্রতিযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সাহসের সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখছি, উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি, অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্তরে পৌঁছাতে চাইছি—এসব আকাঙ্ক্ষা পূরণেও একটি প্রশ্নবিদ্ধ ও প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন

এ মুহূর্তে প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন কি?

হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থবহ, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন চাইলে সদিচ্ছার নিদর্শন দেখাতে হবে। বিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে সেই সদিচ্ছা দৃশ্যমান হতে হবে। নির্বাচনের তফসিল পুনর্বিন্যস্ত করা হতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন চাইলে প্রতিযোগীদের খেলার মাঠে আসার সুযোগ দিতে হবে। বিরোধী দলের অনেক নেতা জেলে আছেন। তাঁদের যে আইনি প্রক্রিয়ায় জেলে নেওয়া হয়েছে, তার যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এমনকি বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ত্বরিত বিচার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

মূল প্রতিযোগীদের কারারুদ্ধ করার কৌশল থেকে সরে এসে তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার আইনি পদক্ষেপ নিয়েও সরকার সদিচ্ছার নমুনা দেখাতে পারে। পূর্ববর্তী প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত এমন ব্যক্তিরা যদি নির্বাচন কমিশনে থাকেন, তঁাদের বাদ দিয়েও সদিচ্ছা দৃশ্যমান করা যেতে পারে।

প্রশ্ন

সে ক্ষেত্রে বিরোধী দল যে হরতাল-অবরোধ পালন করছে, তা থেকে তারা সরে আসবে কি না?

হোসেন জিল্লুর রহমান: তখন বিরোধী দলের ওপরও একটা নৈতিক চাপ তৈরি হবে। জনগণ বলবে, সরকার পক্ষ এই ছাড় দিয়েছে, তোমাদেরও ছাড় দিতে হবে। তবে তা নির্ভর করবে সরকারের পদক্ষেপগুলো কতটা আন্তরিক ও কী পরিবর্তনের বার্তা দিচ্ছে, তার ওপর। মূল কথা হলো সত্যিকার অর্থে একটি আস্থার জায়গা তৈরি করা।

প্রশ্ন

আমাদের দেশে পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়ে যায়। দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর প্রতিকার কী?

হোসেন জিল্লুর রহমান: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের যে কাঠামোগত ভিত্তি, সেটা এখানে উন্নত করা যায়নি। অন্যদিকে ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের মধ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখার মানসিকতা চলে আসে। নব্বইয়ের পর সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা ধারা তৈরি হয়েছিল, সেটাও আমরা ধরে রাখতে পারিনি। বিশেষ করে গত দুটি নির্বাচন নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার দুটি দিক আছে।

একটি হলো কারিগরি, অপরটি রাজনৈতিক। নির্বাচন কমিশন কারিগরি ব্যবস্থাপনাই দেখভাল করে। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকলে ওটাও কাজ করবে না। প্রথম আলোর খবরে দেখলাম, নির্বাচন কমিশনের যে আইনি ক্ষমতা আছে, তা প্রয়োগে তারা অনীহ। এটাকে আমি বলি স্বেচ্ছা নিষ্ক্রিয়তা। আপনার সামনে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে আপনি যদি নিষ্ক্রিয় থাকেন, সেটা তো দায়িত্ব পালন করা হলো না।

পত্রিকায় দেখলাম ভোট দেওয়ার গোপনীয় স্থান, যেখানে ভোটার ছাড়া অন্য কারও উপস্থিত থাকার কথা নয়, সেখানেও বাইরের লোক এসে সিল মারে। এটা না দেখাও নিষ্ক্রিয়তা। নির্বাচনের কোথায় কোথায় ব্যত্যয় ঘটেছে, নাগরিক সমাজ তার একটা তালিকা তৈরি করতে পারে। তবে এখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটি হলো প্রতিযোগিতার মাঠটি তৈরি করা, সব প্রতিযোগী নির্বাচনে আসতে পারল কি না। অনেক দেশ আছে, যেখানে একসময় যারা অনেক জনপ্রিয় দল ছিল, পরবর্তীকালে সেটা ধরে রাখতে পারেনি, ফলে প্রতিপক্ষ দল বারবার জয়ী হয়ে এসেছে।

কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো দুটি বড় দলেরই (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) কাছাকাছি জনসমর্থন আছে। কিছুটা বেশি-কম হতে পারে। এর বাইরে ২০-২৫ শতাংশ ভোটার আছেন, যঁারা একেক সময় একেক দিকে ঝুঁকে যান। আরেকটি কথা, প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন হলে ভোটারদের একটা বড় অংশ প্রক্রিয়ার বাইরেই থেকে গেল। অর্থাৎ ভোটারদের রায়ের প্রতিফলন ঘটছে না। ওই ভোটারদের প্রতি অবিচার করা হলো। প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন হলে গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এতে আমরা দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়তে পারি।

প্রশ্ন

আপনি অর্থনীতিতে এই রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবের কথা বলেছিলেন, সেটা কী রকম?

হোসেন জিল্লুর রহমান: দেখুন, পশ্চিমা দেশের কেতাবি জবাবদিহি, যা বইপত্রে লেখা থাকে, সেটা আমাদের এখানে খুব কাজে লাগে না। এখানে প্রয়োজন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে একটা জবাবদিহি আদায় করা। এটা দুর্বল হলে কিংবা অনুপস্থিত থাকলে দলের মধ্যেও মেধাবী যোগ্যরা সামনে আসবেন না। তাঁরা বাদ পড়ে যাবেন। তাই দলের মধ্যে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির জন্য আর রাষ্ট্র পরিচালনায় জবাবদিহির জন্য প্রতিযোগিতা দরকার। প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন হলে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এই ধারণা হবে যে মনোনয়ন পেলেই জয় নিশ্চিত।

নির্বাচন প্রতিযোগিতাহীন হলে দুর্নীতিরও প্রসার ঘটে। যেমন ধরুন, টেন্ডারবাজি রোধ করতে সরকার ই-টেন্ডারের ব্যবস্থা করল। খুবই ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু সেখানেও দেখা যাচ্ছে, মাত্র একজন দাখিল করলেন। অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার দুটি স্তর—কারিগরি ও নীতিগত। অনেক সময় দেখা যায়, কারিগরি ব্যবস্থাপনার ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বেশি কাজ করে। যদি নির্বাচন প্রতিযোগিতাহীন হয়, নীতি পরিকল্পনাকেও তা প্রভাবিত করবে। রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাবে।

প্রশ্ন

সবারই প্রত্যাশা ছিল, এবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। সরকারি দলের নেতারাও বলেছিলেন, তাঁরা ২০১৪ ও ২০১৮-এর মতো নির্বাচন চান না। এরপরও আমরা সে ধরনের নির্বাচন পেলাম না কেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: এই না পাওয়ার দায় সবাইকে নিতে হবে। তবে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের দায়িত্বই বেশি। বিরোধী দলের কৌশলে কোনো ভুল ছিল কি না, সেটাও বিশ্লেষণ করা দরকার। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে একধরনের আকাঙ্ক্ষা ছিল, কোনো একটা উপায় বের হয়ে আসবে, ‘জিরো সাম গেম’ না করে। কিন্তু সেই সুযোগটা চলে গেল। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজেরও দায় আছে। তাদের তৎপরতার মধ্যে সার্বিকভাবে চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে বলা যাবে না।

প্রশ্ন

গত ২৮ অক্টোবরের ঘটনা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: ২৮ অক্টোবর অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটল। যা ঘটা উচিত ছিল না। ২৮ অক্টোবরের আগে জনগণের মধ্যে একধরনের আশা জেগেছিল, একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে। সরকারি দলের পক্ষ থেকেও নানাভাবে বলা হচ্ছিল, তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। অন্যদিকে বিরোধী দল অহিংস পথেই আন্দোলনটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তাদের দাবিদাওয়ার মধ্যে হয়তো একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পর পরিস্থিতি বদলে গেল।

প্রশ্ন

তাহলে কি দুই পক্ষ পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে গেল?

হোসেন জিল্লুর রহমান: পয়েন্ট অব নো রিটার্ন শব্দটি পাথরে খোদাই হয়ে গেছে, সেটি আমি মনে করি না। মানুষের স্বার্থে, নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শব্দটি আমাদের পরিহার করা উচিত। আমি মনে করি, এই মুহূর্তে একটা সদিচ্ছার জাগরণ দরকার। ২৮ অক্টোবর আসলে কী ঘটেছিল, তার নিরপেক্ষ তদন্ত দরকার। আবার ওই দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের যেভাবে জেলে পুরল, তার আইনগত ব্যাখ্যাগুলো সন্তোষজনক ও গ্রহণযোগ্য বলা যাবে না। আইনের দোহাই দিয়ে অনেককে সাজা দেওয়া হয়েছে।

আইনের একটা হলো কাগজপত্রের বিষয়, আরেকটি মর্মার্থ। ২৮ অক্টোবরের পর একতরফা নির্বাচন করার মানসিকতা জোরদার হয়েছে এবং সেটাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। বিরোধী পক্ষ কিছু কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু তারাও একধরনের বেকায়দায় আছে। তারা এত দিন অহিংস আন্দোলনের কথা বলে আসছিল। আন্দোলনের কৌশল নিয়ে তাদেরও চিন্তা করতে হবে। আমি বলব, বাংলাদেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে, ভবিষ্যতের স্বার্থে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি ও নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতে হবে। এ কারণেই আমি সদিচ্ছার জাগরণের কথা বলছি।

প্রশ্ন

অর্থনীতি নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে বিতর্ক আছে। সরকারের দাবি, তারা দেশের ব্যাপক উন্নতি করেছে। বিরোধী দল বলছে, অর্থনীতি খাদের কিনারে এসে ঠেকেছে। অর্থনীতিবিদ হিসেবে আপনার বিশ্লেষণ জানতে চাইছি।

হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থনীতি নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, সবাই খণ্ডিত সূচক নিয়ে কথা বলেন। সরকার একটা সূচক নিয়ে কথা বলে। বিরোধী দল বা অর্থনীতিবিদেরা অন্য সূচক নিয়ে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন সার্বিক সূচক নিয়ে কথা বলা। এ কথা সত্য যে আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, অর্থনীতির আকার বেড়েছে। কিন্তু আকার ও মান তো এক কথা নয়। ২০২৩ সালে এসে যদি আমরা শিক্ষার হার কত বেড়েছে, সেটাকে উন্নয়নের মাপকাঠি করি, তা ঠিক হবে না।

আমাদের দেখতে হবে, শিক্ষার অর্জনটা কী? ১১ বছর স্কুলে থেকে যদি কোনো শিক্ষার্থী পাঁচ বছরের শিক্ষা লাভ করে, সেটি হবে খণ্ডিত সূচক। স্বাস্থ্য খাতের কথা চিন্তা করুন। সরকার ২০১২ সালে ঠিক করেছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির ব্যয় ৬৫ থেকে কমিয়ে ৩২ শতাংশে নিয়ে আসবে। কিন্তু সেটা আরও বেড়েছে। ৭২ শতাংশ হয়েছে। আমরা করোনা মোকাবিলায় ভালো করেছি। কিন্তু ডেঙ্গু তো সামাল দিতে পারিনি।

আমি যদি সামগ্রিক অর্থনীতির বিশ্লেষণ করি, সেখানেই কয়েকটি সূচক আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে এসেছে। যেমন সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা, ডলার-সংকট ও বিদেশি ঋণের বোঝা। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সম্পদ কম থাকায় ব্যয়ের দক্ষতা দেখাতে হবে। ব্যয় অদক্ষতার কারণে উন্নয়ন ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। অন্যদিকে ব্যক্তিপর্যায়ে অর্থনীতির সূচকগুলো দেখুন। টিসিবির ট্রাকের সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি কী প্রমাণ করে। সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। শঙ্কার বিষয় হলো, রাজনীতির মতো অর্থনীতির মাঠেও প্রতিযোগিতা নেই। একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিটা টিকিয়ে রেখেছে সাধারণ মানুষ। তারা চেষ্টা করছে ভাগ্য গড়ার। অথচ রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতি—কেউ তাদের সম্মান জানাচ্ছে না। আমাদের অর্থনীতির নীতি পরিকল্পনায় তারা অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। অগ্রাধিকার পাচ্ছে সুবিধাভোগী শ্রেণি। অনেক ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আগে ব্যাংকের পরিচালক পদে এক পরিবার থেকে একজন সদস্য থাকতে পারতেন, এখন তিনের অধিক করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পরিশ্রমী উদ্যোক্তাদের বার্তা দেওয়া হয়েছে যে তোমরা যত পরিশ্রমই করো না কেন, ক্ষমতাবলয়ের ব্যক্তিদের প্রতিই বেশি মনোযোগ থাকবে। এ অবস্থায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আকৃষ্ট হবেন না। আরেকটি কথা, আমাদের নীতি প্রণয়নকারীরা সস্তা শ্রমের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। সস্তা শ্রমের আসক্তি থেকে যদি বেরিয়ে আসতে না পারেন, তাহলে সস্তা শ্রমিক দিয়েই বাংলাদেশ চলবে।

আবার মাথাপিছু গড় আয় দেখাচ্ছেন আড়াই হাজার ডলার। কিন্তু মিডিয়াম আয় কত, সেটাই বলছেন না। আয় বাড়ার ওপরের ৪০ শতাংশ নিয়ে আপনি হইচই করছেন। কিন্তু নিচের ৪০ শতাংশ সম্পর্কে কিছু বলছেন না। সরকারের প্রতিনিধি হয়ে যাঁরা আসেন, তাঁদের জবাবদিহি নেই। উন্নত বাংলাদেশ ও মধ্য আয়ের বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে হলেও একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রয়োজন।

প্রশ্ন

মার্কিন ভিসা নীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপ, দেশে নাগরিক সমাজের তাগিদ সত্ত্বেও আমরা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন পেলাম না। এর কারণ কি ভূরাজনীতি? দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ; অন্যদিকে চীন, ভারত, রাশিয়া।

হোসেন জিল্লুর রহমান: দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ আয়তনে একটি ছোট দেশ হলেও এখানে ১৭ কোটি মানুষ আছে। বাংলাদেশকে ভূরাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কোনো মহল চিন্তা করতে পারে। আমি বলব, বেশি চিন্তা করা দরকার ভূ-অর্থনীতি। বাংলাদেশের সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনীতির যে সংযুক্তি, সেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকাই বেশি। আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। যদি ভূরাজনীতির সুযোগ নিয়ে আমরা তাৎক্ষণিক পার পেয়ে যাই, দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যা থেকে যাবে। আমরা কিন্তু সাধারণভাবে চিন্তা করি, ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের কিন্তু অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক নীতি পরিকল্পনা সঠিক হলে আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ আশা করতে পরি। অন্যদিকে ভূরাজনীতির চিন্তাগুলো অনড় নয়। বদলে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে দেখুন। ভূরাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতি—দুই ক্ষেত্রেই ভারসাম্য থাকতে হবে।

প্রশ্ন

আমাদের তরুণদের অনেকে গত দুই নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। এবারও নির্বাচনটি প্রতিযোগিতামূলক না হলে তাঁরা ভোট দিতে পারবেন না।

হোসেন জিল্লুর রহমান: কয়েক দিন আগে এক তরুণ এসে আমাকে বললেন, আমরা তো ভোটের স্বাদ পেলাম না। তিনি যে খুব রাজনীতিসচেতন, তা নয়। আমি বলব, তরুণদের প্রতি আমরা সার্বিকভাবে অবিচার করছি। যাঁরা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দায়িত্বে আছেন, তাঁরা সবাই এর জন্য দায়ী। আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত তরুণদের সক্ষম করে তোলা। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা একটা গ্যাঁড়াকলে ফেলে দিয়েছি, ভর্তির হার ও পাসের হার নিয়ে চিন্তা করছি। তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি না। তরুণেরা বাড়তি কিছু চাইছেন না। তাঁরা বলছেন, আমরা পরিশ্রম করব, ভাগ্য পরিবর্তন করব। কিন্তু নিয়মকানুনগুলো ঠিক করুন। অনিয়মগুলো দূর করুন। পরিশ্রমের ফসল যাতে ঘরে তুলতে পারি, সেই ব্যবস্থা করুন।

সম্প্রতি একটি খবরে দেখলাম, ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে যেসব তরুণ ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন, তার মধ্যে সিরিয়ার পর বাংলাদেশিদের সংখ্যাই বেশি। আমাদের তরুণেরা কেন ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা যাবেন? এ কারণেই আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির নীতি পরিকল্পনা এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে তরুণদের মধ্যে আশা জাগে, তাঁরা নিজেদের ভাগ্য ও দেশের উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার সুযোগ পান।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

হোসেন জিল্লুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।