জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী
জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী

জিয়া ও মঞ্জুর হত্যার অনেক কিছু এখনো অজানা

জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী সিভিল সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা। স্বাধীনতার পর তিনি প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের বিশেষ সহকারী এবং পরবর্তী সময়ে শিল্পমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামানের একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ছিলেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার সময় তিনি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন। এ বছর প্রথমা প্রকাশন থেকে দুই জেনারেলের হত্যাকাণ্ড: ১৯৮১–র ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান নামে তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসানমনজুরুল ইসলাম

প্রশ্ন

জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আপনি একাধিক বই লিখেছেন। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত পরিচয় কীভাবে হয়েছিল?

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী: ১৯৬৮ সালে আমি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলাম। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের মাঝামাঝিতে আমি জাতীয় চার নেতার অন্যতম এবং ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামানের একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পাই। জিয়াউর রহমান তখন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান। যুদ্ধবিধ্বস্ত সেনানিবাসগুলোতে ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ নিয়ে কথা বলতে তিনি প্রায়ই মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। জিয়ার আমন্ত্রণে কামারুজ্জামান সাহেব বেশ কয়েকবার ঢাকা সেনানিবাসে গিয়েছিলেন।

জিয়া সচিবালয়ে এলে আমার সঙ্গে দেখা হতো। অনেক সময় মন্ত্রীর অপেক্ষায় তিনি আমার কক্ষে বসে থাকতেন। কামারুজ্জামান সাহেব জিয়াকে পছন্দ করতেন বলে আমার মনে হয়েছে। তাঁদের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। সেই সময় কামারুজ্জামান ছিলেন প্রবাসী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জিয়া ছিলেন একটি সেক্টরের কমান্ডার।

কামারুজ্জামানের সৌজন্যে জিয়ার সঙ্গে পরিচয় হলেও পরবর্তী সময়ে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট আমি নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পাই। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তখন দেশের পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।

৭ নভেম্বরের ঘটনাবলির পর জিয়া ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসেন। তিনি বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে দিয়ে প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই কাজের অংশ হিসেবে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ বেড়ে যায়। রাষ্ট্রপতি সরাসরি জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।

‘জেনারেল জিয়া ও জেনারেল মঞ্জুর—দুজনকেই আমি কাছ থেকে দেখেছি। তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল।’
প্রশ্ন

১৫ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন তোলা হয়। ১৫ আগস্টের পর তাঁকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি এ ঘটনার সুবিধাভোগী—এ কথাও বলা হয়। এ বিষয়গুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?

জিয়াউদ্দিন: ১৫ আগস্টের পর জিয়াকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল—এটা সত্যি। কিন্তু এ ঘটনার আগে–পরে তাঁকে খুব একটা সক্রিয় বা দৃশ্যমান মনে হয়নি। এ কারণে ১৫ আগস্টের ঘটনায় তাঁর জড়িত থাকা নিয়ে অনুমানভিত্তিক কিছু বলা যায় না।

আমার কাছে বরং মনে হয়েছে, জিয়া সব সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখেছেন। এ ক্ষেত্রে আমি দুটি উদাহরণ দিতে পারি।
এক. রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় জিয়া যখন দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন আমি নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক। তিনি তখন বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে নতুন দল গঠন নিয়ে কথাবার্তা বলা শুরু করেছেন। এ সময়ে একদিন নোয়াখালী সফরে এসে তিনি আমাকে সেখানকার আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যদের সঙ্গে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন।

তাঁরা (সাবেক সংসদ সদস্যরা) জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে রাজি হবেন কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান ছিলাম। সেটা তাঁকে জানালে তিনি বলেন, ‘তাঁদের তো আমার প্রতি বিরূপ হওয়ার কারণ নেই। তাঁরা কি জানেন না, খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলেছিলেন, আমি বঙ্গভবনে আবার বঙ্গবন্ধুর ছবি টানিয়েছি।’

দুই. সরকারি কাজের অংশ হিসেবে আমাকে জিয়ার সঙ্গে সরাসরি কথাবার্তা বলতে হয়েছে, সভা বা বৈঠকে অংশ নিতে হয়েছ, তাঁর সঙ্গে সফরে যেতে হয়েছে। এ সময় আমি তাঁকে একবারের জন্যও বঙ্গবন্ধুর কোনো সমালোচনা করতে শুনিনি। তিনি বাকশালের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কোনো সমালোচনা করেননি।

প্রশ্ন

১৫ আগস্টের আগে ও পরে বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে কোনো পার্থক্য লক্ষ করেছেন? জিয়াউর রহমানের আমলে প্রশাসন বা আমলাতন্ত্রের ভূমিকা কী ছিল?

জিয়াউদ্দিন: ১৫ আগস্টের আগে দেশে একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় ছিল। সেই সময় ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য এবং নেতারা স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতেন—মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে এমনটা দেখা গেছে।

অন্যদিকে ১৫ আগস্টের পরে দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়। প্রথমে খন্দকার মোশতাক এবং পরে বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি  হন। এরপর জিয়া রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। জিয়া যখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন তাঁর কোনো দল ছিল না। তিনি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতেন। দল গঠন করার পরেও তিনি প্রায় একই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন।

জিয়ার ক্ষমতার মূলে ছিল তিনটি স্তম্ভ। প্রথমটি সেনাবাহিনী, দ্বিতীয়টি আমলাতন্ত্র আর তৃতীয়টি ছিল তাঁর নিজের তৈরি করা রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে তৃতীয়টির জন্ম হয় তাঁর ক্ষমতায় আসার অনেক পরে। সামরিক–বেসামরিক প্রশাসনকে দিয়েই তিনি মূলত দেশ চালিয়েছেন।

প্রশ্ন

জিয়াউর রহমানের দল গঠন নিয়ে আপনার কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?

জিয়াউদ্দিন: ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পথসভার মাধ্যমে জিয়া তাঁর জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের চেষ্টা চালান। তখন বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি থাকলেও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান হিসেবে জিয়াই ছিলেন মূল ক্ষমতাধর ব্যক্তি। জিয়ার পথসভাগুলোতে লোকসমাগম মন্দ হতো না। তাঁর প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখেই খুব সম্ভবত জিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক অভিলাষ তৈরি হয়েছিল।

জিয়া যখন বুঝতে পারলেন লোকজন তাঁর কথা শুনছে, তখন তিনি পথসভাগুলো আরও বড় ও গোছালোভাবে করার সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদিন পর তিনি পথসভার বদলে থানায় থানায় বড় জনসভা করতে শুরু করেন।

জিয়া কবে, কোথায় সভা করবেন—সেটা তাঁর সামরিক সচিব আগে থেকে জেলা প্রশাসকদের বলে দিতেন। জেলা প্রশাসকেরা আগে থেকে সেসব সভার আয়োজন করতেন। সেখানে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিত থাকতে বলা হতো। নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক হিসেবে আমাকে এ রকম ছয়–সাতটি সভার আয়োজন করতে হয়েছিল।

জিয়া নতুন দল গঠনের জন্য পুরোনো দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি প্রথমে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। কারণ, তখন আওয়ামী লীগ ছিল অন্য দলগুলোর তুলনায় সংগঠিত। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে তিনি অন্য দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

দলের জন্য নেতা বাছাই করার ক্ষেত্রে কে কোন আদর্শের অনুসারী জিয়া সে বিষয়টি বিবেচনায় নেননি। ডান, বাম, ইসলামপন্থী—সব ধরনের লোক নিয়েই তিনি তাঁর দল তৈরি করেন।

  • জিয়া নতুন দল গঠনের জন্য পুরোনো দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।

  • মঞ্জুরের ক্ষোভ ছিল সেনাপ্রধান এরশাদের প্রতি। তিনি এরশাদকে দুর্নীতিবাজ মনে করতেন।

  • মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগাত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ ছিল।

প্রশ্ন

জিয়াউর রহমানের আমলে একটি ‘হ্যাঁ-না’ বা গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ নির্বাচনে ভোট নিয়ে অনেক ধরনের বিতর্ক রয়েছে। সামরিক-বেসামরিক আমলারা এ নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন—এমন অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

জিয়াউদ্দিন: রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়ার বৈধতা অর্জনের জন্য এই গণভোট আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁর সামরিক উপদেষ্টা এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা। এতে বিপুল ভোটার অংশ নেবে—তাঁরা এ রকম আশ্বাস দিয়েছিলেন। এ ভোট এবং ভোটার উপস্থিতি সরকারের জন্য কতটা জরুরি, তাঁরা জেলায় জেলায় গিয়ে জেলা প্রশাসকদের সেটা বলেন।

এ রকম অবস্থায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করেছিলেন, স্বল্প ভোটার উপস্থিতি তাঁদের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। তাই ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বতোভাবে কাজে লাগান। কিন্তু এ ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে তখন তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। ফলে ভোটকেন্দ্রে মানুষের ভিড় দেখা যায়নি।

এই গণভোটে বিভিন্ন কেন্দ্রে ২৫-৩০ ভাগ ভোট পড়লেও গড়ে ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে  বলে দেখানো হয়েছিল। কোনো কোনো জেলায় ৯৯ শতাংশ ভোটের নজিরও ছিল, এর মধ্যে ‘হ্যাঁ’ ভোট শতকরা ৯৫ ভাগ ছিল। এই বিপুল ভোট সারা দেশের মানুষকে অবাক করার পাশাপাশি জিয়াকেও বিব্রত করেছিল। জেলা প্রশাসক সম্মেলনে তিনি এ ঘটনাকে আমলাদের অতিরিক্ত উৎসাহের ফল হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

বাংলাদেশের মতো দেশে সরকারের বা উপরমহলকে সন্তুষ্ট করতে আমলারা অনেক সময়ই বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। এটা তখন যেমন সত্যিই ছিল, এখনো একই রকম সত্যি।

প্রশ্ন

জিয়াউর রহমানের রাজনীতি এবং ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

জিয়াউদ্দিন: রাজনীতিতে জিয়ার আগমন কতটা তাঁর স্বভাবজাত আর কতটা সময়ের প্রয়োজনে, তা বলা কঠিন। ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি তাঁকে ক্ষমতার শীর্ষে নিয়ে আসে। এরপর তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে নানা কৌশল অবলম্বন করেন। এসব নিয়ে নানা আলোচনা–সমালোচনা রয়েছে।

ব্যক্তি হিসেবে জিয়া সৎ ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাঁর শাসনামলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি ব্যবসা–বাণিজ্য, বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর ফলে দেশের অর্থনীতির উন্নতি হয়েছিল।

প্রশ্ন

জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের সময় আপনি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন। চট্টগ্রাম সফরে গিয়েই তিনি নিহত হলেন। সে সময়ের পরিস্থিতি কেমন ছিল?

জিয়াউদ্দিন: ১৯৮১ সালের ৩০ মে ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক ও আতঙ্কের একটা দিন। আগের দিন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মাত্র ৪৮ ঘণ্টার নোটিশে চট্টগ্রামে আসেন। তাঁর সামরিক সচিব আমাকে হঠাৎ ফোন করে জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি জরুরি রাজনৈতিক কারণে আসছেন, থাকবেন মাত্র এক দিন। যেহেতু রাজনৈতিক সফর, তাই কোনো সরকারি কর্মসূচি ছিল না। এরপরও আমাকে ও  চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারকে কাছাকাছি থাকতে হবে, যদি তাঁর কোনো প্রয়োজন পড়ে।

আমি ২৯ মে সকালে রাষ্ট্রপতিকে অভ্যর্থনা জানাতে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলাম। বিভাগীয় কমিশনারসহ বেশ কিছু সরকারি কর্মকর্তা এবং চট্টগ্রাম বিএনপির কয়েকজন নেতাও সেদিন সেখানে ছিলেন। সেদিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা ছাড়াও একই বিমানে এসেছিলেন তৎকালীন বিএনপি নেতা ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. আমিনা রহমান আর মাঈদুল ইসলাম। সেদিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একই গাড়িতে আমি সার্কিট হাউসে যাই। সেখানে দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক ছিল। তিনি কিছু না বললেও আমি জানতাম, চট্টগ্রাম বিএনপির মধ্যে বিরোধ ও কোন্দল মেটাতেই এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল।

সেদিন রাত নয়টার কিছু বেশি সময় পর্যন্ত আমি এবং বিভাগীয় কমিশনার সাইফুদ্দিন সার্কিট হাউসে উপস্থিত ছিলাম। তখনো রাষ্ট্রপতি তাঁর দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। সেদিনই ছিল তাঁর সঙ্গে আমাদের শেষ দেখা।

পরের দিন ভোরে গোলাগুলির অবিরাম আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমার বাসার একজন প্রহরী এসে জানালেন, সার্কিট হাউসের দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসছে। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করলে সেখান থেকে বলা হলো, তারা শুনেছে যে কিছু সেনাসদস্য সার্কিট হাউসে আক্রমণ করেছে। কিছু সময় পর সাইফুদ্দিন ফোন করে জানালেন, রাষ্ট্রপতি জিয়া আততায়ীদের হাতে নিহত হয়েছেন। রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহফুজ তাঁকে এ কথা জানিয়েছেন।

কমিশনার সাইফুদ্দিনকে নিয়ে সার্কিট হাউসে পৌঁছে দেখি সেটা তখন প্রায় একটা পরিত্যক্ত ভবন। সার্কিট হাউসের প্রধান ফটক খোলা, কোনো প্রহরী নেই। আগেই সেখানে উপস্থিত হওয়া পুলিশের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে সার্কিট হাউসের ওপরতলায় গিয়ে দেখি রাষ্ট্রপতির কামরার পাশে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি মৃতদেহ। সেই কর্মকর্তা কাপড় উঠাতেই দেখি সেটা রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশ। গুলির আঘাতে তাঁর মুখের একপাশ উড়ে গিয়েছিল।

প্রশ্ন

‘দুই জেনারেলের হত্যাকাণ্ড: ১৯৮১–র ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান’  বইয়ে আপনি লিখেছেন, জিয়া হত্যার সঙ্গে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মনজুর মঞ্জুর জড়িত ছিল বলে আপনার কাছে মনে হয়নি। কেন এ রকম মনে হয়েছে?

জিয়াউদ্দিন: জেনারেল জিয়া ও জেনারেল মঞ্জুর—দুজনকেই আমি কাছ থেকে দেখেছি। তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বদলি করার জন্য মঞ্জুর কিছুটা অসন্তুষ্ট  ছিলেন। এরপরও জিয়ার সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সম্পর্কের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছি। তাঁরা দুজনই মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ছিলেন।

মঞ্জুরের ক্ষোভ ছিল সেনাপ্রধান এরশাদের প্রতি। তিনি এরশাদকে দুর্নীতিবাজ মনে করতেন। এরশাদ ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগাত সেনা কর্মকর্তা। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগাত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ চলছিল।

৩০ মের পরে মঞ্জুরের সঙ্গে আমার একাধিকবার দেখা হয়েছে। তাঁকে যেভাবে দেখেছি, তাতে মনে হয়নি তিনি সেই ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমার কাছে মনে হয়েছে জিয়ার হত্যার সঙ্গে মঞ্জুর জড়িত ছিলেন না। দুই জেনারেলের হত্যাকাণ্ড: ১৯৮১–র ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান বইয়ে আমি এ বিষয়ে আলোচনা করেছি।

প্রশ্ন

পুলিশ জেনারেল মঞ্জুরকে গ্রেপ্তার করেছিল। কিন্তু তাঁকে পুলিশি হেফাজত থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তিনি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হলেন। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

জিয়াউদ্দিন: এ বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এটা নিয়ে আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তখন সবকিছু চলছিল সেনাবাহিনী তথা সেনাপ্রধান এরশাদের নির্দেশ মোতাবেক। সেখানে বেসামরিক প্রশাসনের তেমন কিছু করার ছিল না।

প্রশ্ন

জিয়া ও মঞ্জুর হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে আপনার মতামত কী?

জিয়াউদ্দিন: জিয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি এবং আরেকটি সামরিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। দুটি কমিটিই আমাকে ডেকেছিল। আমি তাদের কাছে আমরা বক্তব্য পেশ করি।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। অপর দিকে সামরিক আদালতে বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁদের সাজা কার্যকর করা হয়। তবে জিয়া হত্যায় কার কতটুকু দায়, কে নির্দেশদাতা—এ বিষয়গুলো বিস্তারিত জানা যায়নি।

অপর দিকে মঞ্জুর হত্যার তদন্ত বা বিচার নিয়ে সামরিক বাহিনীর তরফ থেকে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ ছিল না। বহুদিন পর তাঁর ভাই প্রচলিত আদালতে মামলা করেন। তবে সেই মামলার প্রধান আসামি সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান এরশাদ এরই মধ্যে মারা গেছেন।

জিয়া ও মঞ্জুর হত্যার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করা উচিত ছিল। কিন্তু কোনো সরকারই সেটা করেনি। এর ফলে এসব হত্যাকাণ্ডের অনেক কিছু এখনো অজানাই রয়ে গেছে।