আ ন ম মুনীরুজ্জামান একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তাকাঠামো এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের দিক থেকে সম্ভাব্য নিরাপত্তাঝুঁকি এবং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সক্ষমতা ও সমন্বয় বাড়ানোর পথ নিয়ে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া ও মনোজ দে
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশ কার্যত পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। সব থানা ও ফাঁড়ি ছেড়ে পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যান। সেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। কিন্তু পুলিশ আগের জায়গায় ফিরতে পারেনি। লোকবল ও মনোবল—দুই দিক থেকেই দুর্বল অবস্থায় রয়েছে পুলিশ বাহিনী। দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতিকে কতটা উদ্বেগজনক বলে মনে করেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশ পুলিশবিহীন একটা আইনশৃঙ্খলাশূন্যতার ভেতরে প্রবেশ করে। এমন পরিস্থিতি যেকোনো সমাজ ও দেশের নিরাপত্তার জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ। তবে এটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে যেকোনো দেশেই বিপ্লব-উত্তর পরিস্থিতি সব সময় কিছুটা অস্থিতিশীল পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যায়। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতে হয় যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায় ভালো ছিল। বিশেষ করে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা যখন দেশ থেকে পালিয়ে যান, তখন থেকে শুধু পুলিশই তাদের দায়িত্ব থেকে বিরত ছিল না, প্রথম তিন দিন দেশে কোনো সরকারও ছিল না।
এ পরিস্থিতিতেও অন্যান্য বাহিনীকে নামিয়ে দেশকে শান্ত ও স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়। অভ্যুত্থানের এক মাস পর সেই পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হলেও আইনশৃঙ্খলার দিক থেকে আমরা এখনো বড় একটা ঝুঁকির মধ্যে আছি। যত দ্রুত সম্ভব এটা উত্তরণের জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে।
পুলিশে যে মাত্রায় দলীয়করণ হয়েছিল এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে তারা যে নৃশংসতা দেখিয়েছে, মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, তাতে বাহিনী হিসেবে তারা জনগণের আস্থা অনেকটাই হারিয়েছে। এই বাহিনী পুনর্গঠনের পথ কী? পুলিশের অনেক সদস্য কাজে যোগ দেননি। এই শূন্যতাই–বা দ্রুত পূরণের পথ কী?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশ পুলিশকে শুধু দলীয়করণই করেনি, বরং পুলিশকে তাদের দলের বাহিনীতে রূপান্তরিত করেছিল। শেখ হাসিনা তাঁর দলকে যেকোনো উপায়ে রাখার জন্য পুলিশকে সর্বাত্মকভাবে অপব্যবহার করার জন্য তৈরি করেছিল। যার ফলে আমরা দেখতে পাই যে আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে তারা সর্বাত্মকভাবে ছাত্র-জনতার ওপর নৃশংসভাবে আক্রমণ করে আন্দোলনকে দমন করার প্রচেষ্টা করেছিল। সেখানে শুধু মারণাস্ত্রই ব্যবহার করা হয়নি বরং অন্যান্য সব ধরনের হাতিয়ার, যেমন স্নাইপার রাইফেল, হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ, মৃতদের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলাসহ অনেক নৃশংস পন্থা তারা অবলম্বন করেছিল। এই বাহিনী এমন একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে জনগণের কাছ থেকে শুধু ঘৃণা নয়, বরং জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল।
আমরা জানি, পুলিশ ছাড়া কোনো রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন করতে হবে। এ জন্য বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রথমেই পুলিশের বর্তমান অবস্থার ওপর একটা সমীক্ষা করা প্রয়োজন। এর ওপর ভিত্তি করে পুলিশ সংস্কারের দিকে যেতে হবে। শুরুতেই পুলিশ আইন পরিবর্তন করে যুগোপযোগী করতে হবে। এ ছাড়া পুলিশ বাহিনীতে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করতে হবে। পুলিশ বাহিনীকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে করে তাদের মধ্যে মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে।
সর্বোপরি পুলিশের অভ্যন্তরীণ পরিচালনার ক্ষেত্রে সব পর্যায়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পালিয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের অনেকে কাজে যোগ না দেওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের জনবলের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এই শূন্যতাটা যত শিগগিরই সম্ভব পূরণ করতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর অবসরে যাওয়া সৈনিক, যঁারা রিজার্ভিস্ট হিসেবে থাকেন, তাঁদের মধ্য থেকে সক্ষম ব্যক্তিদের নিয়োগ করে পুলিশের জনবলের ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে।
আমরা দেখছি এরই মধ্যে অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগার থেকে বের হয়ে গেছেন। থানাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্র লুট হয়েছে। এসব ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: আন্দোলনের সময় দেশের কয়েকটি কারাগার ভেঙে বেশ কিছু কয়েদি পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত থাকা দণ্ডিতেরাও ছিলেন। পত্রিকার খবরে দেখেছি, গত কয়েক দিনে কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগার থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। এটা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় একটা ঝুঁকি। তাঁরা জেল থেকে বেরিয়ে গিয়ে নানা ধরনের সমাজবিরোধী ও আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাটা বেশি থাকবে। বিভিন্ন থানা এবং কারাগার থেকে বেশ কিছুসংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ চুরি ও লুট হয়েছে।
সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত হারিয়ে যাওয়া ১ হাজার ৮৮৫টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদও উদ্ধার করা যায়নি। এ সবকিছুর বাইরে আমরা পত্রিকার খবরে জানতে পেরেছি, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা এসএসএফ যে ধরনের বিশেষায়িত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ও অন্যান্য যোগাযোগ সরঞ্জাম ব্যবহার করে, তার একটা অংশ লুট হয়ে গেছে। এ ধরনের অস্ত্র ও সরঞ্জাম এই বিশেষ বাহিনী ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করে না। এটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাঝুঁকিটাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সার্বিকভাবে আমরা একটা বড় নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে আছি। যত শিগগির সম্ভব খোয়া যাওয়া অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
অভ্যন্তরীণ বা বাইরের দিক থেকে নিরাপত্তা, যা–ই হোক না কেন—সব ক্ষেত্রেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ও তাদের তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। বিগত সরকারের আমলে সংস্থাগুলোকে দলীয় কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের সামগ্রিক গোয়েন্দা কার্যক্রম ও সংস্থাগুলো কতটা কার্যকর রয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: যেকোনো দেশের নিরাপত্তার জন্য অভ্যন্তরীণ এবং বহির্বিশ্বের কার্যক্রমের জন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটা বিরাট ভূমিকা থাকে। তাদের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ওপরেই সরকার যেকোনো ধরনের নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির আগাম সংবাদ পায় এবং সেগুলো প্রতিহতের জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে। বাংলাদেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে একটা এনএসআই। এই সংস্থার অনেকেই সরকার পতনের পর আর কর্মস্থলে আসেননি। ফলে এ সংস্থার কর্মক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক গুণ কমে গেছে।
এ ছাড়া অন্যান্য যে গোয়েন্দা সংস্থা, যেমন ডিজিএফআই ও এসবির ক্ষেত্রেও আগের সরকারের আমলের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে কাজ করার ব্যাপারে একটা বড় চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। তাদের কার্যক্রমের মধ্যেও একধরনের স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যাতে দ্রুত তাদের কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করতে পারে, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। এখানে কোনো ধরনের ঘাটতি রাখা একেবারেই সমীচীন হবে না।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। বিতর্কিত ও একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বিগত সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা ছিল অনেকটাই প্রকাশ্য। বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনকে ভারত ভালোভাবে নেয়নি বলে মনে হয়। আপনার মন্তব্য কী?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আমরা লক্ষ করেছি, বাংলাদেশ নিয়ে ভারত গত ১৬ বছর যে নীতি অবলম্বন করে আসছিল, তাতে একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। এককথায় বলা যায়, ভারতের বাংলাদেশ নীতি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভারতে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে, যেটা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে একধরনের অপতথ্য ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করে যাচ্ছেন।
আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং আমরা সব সময় চাইব যে প্রতিবেশী হিসেবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব। সে কারণে আমরা আশা করতে পারি, ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সঠিকভাবে অনুধাবন করা হবে। বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের নীতিমালা যাতে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে থাকে এবং দুই দেশের সম্পর্কের কাঠামো যাতে পুনর্গঠন করা হয়, সেদিকে আমরা প্রতীক্ষা করব।
সম্প্রতি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং তাঁর দেশের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধপ্রস্তুতি নেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেছেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্যকে কীভাবে দেখছেন?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: সম্প্রতি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং একটা উচ্চপর্যায়ের সভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন, এসব পরিস্থিতিতে যেকোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্য যাতে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী প্রস্তুত থাকে। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে কোনো যুক্তিতেই বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যান্য সংঘাতের সঙ্গে এক কাতারে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
বাংলাদেশ একটা শান্তপ্রিয় ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র। এখানে কোনো সংঘাত নেই। কাজেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেহেতু তিনি একটা উচ্চপর্যায়ের সভায় এই মন্তব্য করেছেন, আমাদের গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে, কেন এ ধরনের উক্তি বাংলাদেশের ব্যাপারে এল। প্রয়োজনে কূটনৈতিক মাধ্যমে এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে পারি। তবে সার্বিকভাবে বলতে চাই, এ ধরনের মন্তব্য কোনোভাবেই সমীচীন হয়নি।
বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে আছে বলে মনে করেন? সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে ভারত বা বাংলাদেশের তরফে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন কি?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটা বড় ধরনের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ব্যাপারে যে ধরনের মন্তব্য ও উক্তি করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সেটা সহায়ক নয়। এ পরিস্থিতির দ্রুতই অবসান প্রয়োজন। দুই দেশের ভেতরে স্বাভাবিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের জন্য সবচেয়ে ভালো পথ হতে পারে ঢাকায় বিশেষ দূত পাঠিয়ে বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে বিশদভাবে আলোচনা করে যৌথভাবে একটা পথ খুঁজে বের করা। আমরা যেন প্রতিবেশী হিসেবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে বাংলাদেশি হিসেবে আমরা মনে রাখব, যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেন বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদার বিষয়টি সব সময় বজায় থাকে।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মির দখলে চলে যাওয়ার পথে। নতুন সরকার এ পরিবর্তিত পরিস্থিতির দিকে কতটা নজর রাখতে পারছে বলে মনে করেন? এখানে করণীয় কিছু আছে বলে মনে করেন কি?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: মিয়ানমারের ভেতরে এখন যে গৃহযুদ্ধ চলছে, তার কারণে পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী রাখাইন রাজ্যে একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। রাখাইনে বর্তমানে প্রায় ৯০ শতাংশ জায়গা আরাকান আর্মির দখলে চলে এসেছে। একমাত্র প্রাদেশিক রাজধানী সিত্তে ছাড়া সেখানকার সব বড় শহর ও গ্রামাঞ্চল কার্যত আরাকান আর্মির দখলে আছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাখাইনের সঙ্গে বাংলাদেশের কী সম্পর্ক হবে, সেটা নতুন করে আমাদের ভেবে দেখতে হবে। রাখাইনের সঙ্গে আমাদের সীমান্তে অবস্থিত চিন প্রদেশেও বেশ কিছু পরিবর্তন আসছে। রাখাইন ও চিন রাজ্যে নতুন নিয়ন্ত্রণকারী যে দল বা সংস্থা, তাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে কি না, সেটা আমাদের নতুন করে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাখাইনের সঙ্গে আমাদের যে সীমান্ত আছে, সেটা যেকোনো সময় অস্থিতিশীল হয়ে যেতে পারে। সীমান্তের সুরক্ষার জন্য আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে।
মিয়ানমারের রাখাইন ও চিন প্রদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে ধরনের গভীর দৃষ্টি ও বিশ্লেষণ থাকা দরকার, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে অনেকটাই ঘাটতি আছে। এটার কারণে যেকোনো সময়, যেকোনো ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকি আসতে পারে। যত শিগগির সম্ভব এ পরিস্থিতির ওপর বিশ্লেষণ করে আমাদের নতুন কী পদক্ষেপ, সেটা নির্ধারণ করে সে পথেই এগোতে হবে।
দেখা যাচ্ছে এ পরিস্থিতিতে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে ঢুকছে। এতে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এ দিকটিতে নজর দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট বহু বছর ধরে চলে আসছে। এর কোনো আশু সমাধান আছে বলে তেমনটা মনে হয় না। রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ যদি পুরোপুরিভাবে আরাকান আর্মির হাতে চলে যায়, তখন হয়তো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে নতুন করে কৌশল নেওয়ার প্রয়োজন হবে। এখানে একটা উদ্বেগের বিষয় হলো, গত কয়েক মাসে নতুন করে আট হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। আরও অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের উচিত হবে, নতুন কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী যাতে বাংলাদেশে না আসে, সেই পদক্ষেপ নেওয়া।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যাটা এখন মানবিক সমস্যা ছাপিয়ে নিরাপত্তা সমস্যার দিকে মোড় নিয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও তারা বড় হুমকি হিসেবে আসছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড হচ্ছে। তা ছাড়া আরসা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে রিক্রুটমেন্ট করে শরণার্থীদের সৈনিক হিসেবে কাজ করাচ্ছে। সবকিছু মিলে রোহিঙ্গা সংকট এখন জটিল নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যত শিগগির সম্ভব এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।
সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম, ক্ষুদ্র অস্ত্র, মাদক পাচার রোধসহ নানা ইস্যুতে অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি রয়েছে। এসব বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ ও তথ্যবিনিময়ের প্রয়োজন হয়। দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই প্রক্রিয়ায় কোনো ছেদ পড়েছে কি?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন ধরনের চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর আছে। এর মধ্যে সন্ত্রাস দমন, মাদক ও ক্ষুদ্রাস্ত্র পাচার প্রতিরোধের মতো চুক্তি আছে। এগুলোর বিষয়ে সার্বিকভাবে যে সমন্বয় করা দরকার, সেখানে একটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এর কারণে নতুন নতুন নিরাপত্তার হুমকি তৈরি হচ্ছে। যেমন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বেশ কিছু ক্ষুদ্রাস্ত্র চালান করার প্রবণতা দেখা গেছে। এসব বিষয়ে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যে ধরনের যোগাযোগ বা বিনিময় থাকা দরকার, সেগুলো আবার নতুন করে জোর দিয়ে চালু করতে হবে। যেখানে যেখানে সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, সেগুলোকে যত শিগগির সম্ভব পূরণ করতে হবে।
সামগ্রিকভাবে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: দেশে বিপ্লবোত্তর যে পরিস্থিতি, সেখানে নতুন করে নিরাপত্তার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে যে ধরনের সমন্বয়, বিশ্লেষণ ও নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রয়োজন—সেসব ক্ষেত্রে বেশ কিছু দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। নতুন এই চাপ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সক্ষমতার ঘাটতি লক্ষণীয়। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সরকারের একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ করা গেলে তার মাধ্যমে এসব বিষয় সঠিকভাবে সমন্বয় ও তদারক করা সম্ভব হবে।
জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সক্ষমতা ও সমন্বয়—দুটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার অধীনে একটি জাতীয় নিরাপত্তা সমন্বয় সংস্থা গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা গঠন করা গেলে চিরাচরিত নিরাপত্তার যে দিকগুলো আছে, তার সঙ্গে নতুন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো যেমন সাইবার নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ, সমুদ্র অঞ্চলের নিরাপত্তা, জলবায়ু নিরাপত্তা—সবকিছুই মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। বিশ্বের সব আধুনিক রাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত এ ধরনের সংস্থা অনেক আগেই তৈরি করেছে। আমাদের উচিত হবে তাদের অভিজ্ঞতাগুলো যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের উপযোগী একটা কাঠামো তৈরি করা।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ।