ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ২৭ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খানকে। তিনি এমন একটি সময়ে দায়িত্ব নেন, যখন দেশের রাজনীতি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দুই মাস দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, ছাত্ররাজনীতি, নিজের রাজনৈতিক অবস্থান, বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার মান, মুক্তিযুদ্ধ, ’২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ইত্যাদি বিষয়ে ২২ অক্টোবর প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহমেদ ও রাফসান গালিব।
আপনি একটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পেয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে আপনার কি কোনো যোগাযোগ ছিল? আপনার নামটি কীভাবে এল?
নিয়াজ খান: উপাচার্য পদে শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে নির্দলীয় কাউকে চাইছিল। আমার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ শিক্ষার্থীরাই করে। পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়।
আপনি প্রায় দুই মাস হলো নিয়োগ পেয়েছেন। কী কী পরিবর্তন আনলেন? সবার সহযোগিতা কতটা পাচ্ছেন?
নিয়াজ খান: স্বাভাবিক অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রশাসন কিছু বিষয় ‘গ্রান্টেড’ হিসেবে পায়। একাডেমিক কার্যক্রম, অর্থাৎ ক্লাস ও পরীক্ষা চলমান থাকে, হলগুলো খোলা থাকে। কিন্তু আমরা দায়িত্ব নিয়েছি একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। সাড়ে তিন মাস ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ। প্রশাসন ভঙ্গুর। আমাদের সবকিছু শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। সেটা বেশ দ্রুত করতে পেরেছি। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার ২৪তম দিনে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হয়েছে, হল চালু হয়েছে। সবার সহযোগিতা আমাদের দরকার। বড় দাগে সেটা পেয়েছি। এটাও সত্যি যে এখনো অনেকের মধ্যে অনিশ্চয়তা আছে। ছাত্র ও শিক্ষক, ছাত্রদের অভ্যন্তরীণ এবং কোনো কোনো শিক্ষকের মধ্যেও দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি রয়েছে। মানসিক চাপ ও ট্রমা (আঘাত) আছে। সেগুলো দূর করতে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। ভালো ফল পাওয়া গেছে।
দ্বন্দ্ব নিরসনেও আমরা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। ফলে সেটা অনেকটাই কমেছে। শুরুতে ১৭টি বিভাগে অচলাবস্থা ছিল, এখন ২টিতে নেমে এসেছে। তা-ও ক্লাস শুরু হয়েছে। অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ এবং ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সহায়তায় এটা সম্ভব হয়েছে।
আরও দু-একটি দিক আমি বলব, তবে সেগুলোকে বড় সফলতা বলে দাবি করছি না। এর মধ্যে একটি হলো ভালো নিয়োগের ব্যবস্থা করা। আমরা উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ শুরু করেছি, যা ছিল পুরোপুরি উপাচার্যের এখতিয়ার। সার্চ কমিটিতে তিনজন করে সদস্য ছিলেন। তাঁরা প্রথিতযশা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তাঁদের এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই। তাঁরা নিয়োগের জন্য সবচেয়ে যোগ্য মানুষ খুঁজে বের করেছেন। এই পদ্ধতিটি শিক্ষক নিয়োগ ও অন্য ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
হলের আসনসংকট নিরসনে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমরা যা করছি, তা সবাইকে জানাচ্ছি। প্রতি সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজ ও অন্যান্য মাধ্যমে তা জানিয়ে দেওয়া হয়। কেউ আমাদের কাজ পছন্দ করবে, কেউ করবে না, কিন্তু সবাই জানুক—এটাই আমরা চাই। যেকোনো কাজ আমরা দলগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে করি। আগে উপাচার্য এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন। সেখানে একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা হিসেবে আমরা দিন শুরু করি আমার সহকর্মীদের কারও না কারও অফিস থেকে। কখনো সহ-উপাচার্য, কখনো কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়ে বৈঠক করে কাজ শুরু হয়।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছিল ছাত্রলীগের দখলে। এখন কি প্রশাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
নিয়াজ খান: এ ক্ষেত্রে একটু সন্তুষ্টি নিয়ে বলতে পারি, বিগত ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে এখন হলে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বেশি। মাত্রাগত কিছু পার্থক্য থাকতে পারে। কোনো হলে ১০০, কোনো হলে ৭০ শতাংশ। আসন বণ্টন মেধার ভিত্তিতে হচ্ছে। গণরুম বিলুপ্ত হয়েছে, ‘গেস্টরুম সংস্কৃতি’ (অতিথিকক্ষে ডেকে আদবকায়দা শেখানোর নামে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন) নেই। শিক্ষকেরা সক্রিয়।
সব হলে ১০০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ কেন নয়? গণ-অভ্যুত্থানের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক প্রত্যাশা তো এটাই ছিল।
নিয়াজ খান: দু-তিনটি বিষয় এখানে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যখন তিন মাস কার্যত অকার্যকর ছিল, তখন শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করে একটা ব্যবস্থা চালু করেছে। তারা এই সব ব্যবস্থার নাম দিয়েছিল মনিটরিং টিম (পর্যবেক্ষণ দল), পরিবেশ টিম ইত্যাদি। সেটা গণরুমের নিপীড়নের মতো ছিল না। আমরা এখন তাদের রেসপেক্ট (সম্মান) করছি। তবে চূড়ান্তভাবে হলের নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের হাতেই যাবে।
সেটা কত দিনে?
নিয়াজ খান: এখন স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেওয়ার পর্যায়ে থাকা ব্যাচটি বেরিয়ে গেলেই এটা হবে। তিন-চার মাস লাগতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। এটা শুধু সময়ের বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দেখেছি, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা হলের ভালো কক্ষগুলো দখল করে ‘রাজার হালে’ বাস করেন। এখন কী হচ্ছে?
নিয়াজ খান: এ ধরনের কিছু হলে ভেতর থেকে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। সেটাই আমাদের শক্তি। মাস্তানি করে কেউ কক্ষ দখল করতে পারবে না।
তাহলে আপনি বলছেন, বিশেষ সুবিধা কেউ পাচ্ছে না?
নিয়াজ খান: আমরা সে রকম কোনো ঘটনা পাইনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররাজনীতিমুক্ত থাকবে—সিন্ডিকেটের এমন একটি সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যমে এসেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি এখন ছাত্ররাজনীতিমুক্ত?
নিয়াজ খান: সাধারণ ছাত্রদের দাবি হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি যেন ফেরত না আসে। লেজুড়বৃত্তির ফলে যে নিপীড়ন হয় এবং অপরাজনীতির ধারা গড়ে ওঠে, সেটা যেন আর না হয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ ও সংবিধিবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে ছাত্র ও শিক্ষকের অধিকারভিত্তিক রাজনীতি রাখতে চাই। এটা নেতৃত্বের চর্চা ও গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য প্রয়োজন।
ছাত্ররাজনীতি নিয়ে দেশবরেণ্য মানুষদের নিয়ে একটি কমিটি করার পরামর্শ এসেছে, যেখানে স্বনামধন্য অধ্যাপক, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিসহ গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিরা থাকতে পারেন। ওই কমিটি ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতির স্বরূপ ও প্রকৃতি কী হবে, তা নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরামর্শ দেবে। সেই পরামর্শের ভিত্তিতে আমরা অংশীজনদের সঙ্গে মিলে এমন একটি ব্যবস্থা করতে চাই, যেটা সামাজিক চুক্তির মতো হবে।
আমাদের প্রাথমিক চিন্তা ছাত্ররাজনীতি হবে ডাকসুকেন্দ্রিক। ডাকসুকে আমরা পুনরুজ্জীবিত করতে চাই, সংস্কার প্রয়োজন হলে সেটা করতে চাই। এসব বিষয়ে সুপারিশ মূলত কমিটি করবে। কমিটি করতে সম্ভাব্য সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আলোচনার সময় শিক্ষকরাজনীতির প্রসঙ্গও এসে যায়। আমরা দেখেছি, শিক্ষকরাজনীতিতে দল ভারী করতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষকনেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদ পেতে নির্লজ্জভাবে দলকানা হয়ে ওঠেন। এটা ঠেকাবেন কী করে?
নিয়াজ খান: ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী—সব ক্ষেত্রেই রাজনীতি যেন বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক হয়, সেটা নিয়ে বড় পরিসরে বিবেচনার বিষয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় একটি সমন্বিত ব্যবস্থা, সেখানে শুধু একটি অংশে আলাদাভাবে হাত দেওয়ার সুযোগ কম।
দলীয় বিবেচনা বা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ইতিমধ্যে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের নিয়ে কি কোনো পর্যালোচনার চিন্তা আছে?
নিয়াজ খান: কিছু কিছু অভিযোগ এসেছে। সেগুলোর ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা ধাপে ধাপে কাজ করছি। এসব ভবিষ্যতে বড় পরিসরে বিবেচনা করা যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদ ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। নতুন পরিস্থিতিতে কী হবে?
নিয়াজ খান: ক্যাম্পাসে যাঁরা সক্রিয় রাজনীতি করেন, যেকোনো ব্যানারে, তাঁরা যদি বিধিবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে থাকেন, যদি আরেকজনের বিপদের কারণ না হন, তাহলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি আছি। তবে সেটি একটি বৃহত্তর সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে হওয়া উচিত। নব্বইয়ের বাস্তবতায় পরিবেশ পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আজকের বাস্তবতায় ছাত্রকেন্দ্রিক সংগঠনগুলোর নিজেদের দায়িত্ব নিতে হবে। তারা কথা বলে বিশেষজ্ঞ কমিটিকে বলুক। সেখান থেকে আমাদের কাছে আসুক।
শিক্ষকদের একটি অংশকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলা হচ্ছে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। তাদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা কী হবে?
নিয়াজ খান: কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা নির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করছি। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (তথ্যানুসন্ধান) কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তারা সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে। কিছু ক্ষেত্রে মোটামুটি সমঝোতা হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়নি। সে ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি ও অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া শুরু হবে। একটা বিষয় পরিষ্কার, যারা গুরুতর অপরাধে জড়িত, তাদের আইন অনুযায়ী বিচার হবে। যেসব জায়গায় দ্বন্দ্ব নিরসনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপন সম্ভব, সেখানে সেটাই করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত একটি জনপরিসর। অন্যদিকে বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে না দেওয়ার বিষয়েও কথা আছে। কর্তৃপক্ষের অবস্থান কী হবে?
নিয়াজ খান: প্রথম কথা হচ্ছে সামর্থ্যের চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব অনেক বেশি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তরিকভাবে জনপরিসর হিসেবে বিবেচনা করি। এটা সর্বজনতার বিশ্ববিদ্যালয়। সারা দেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। কিন্তু এটার যে কঠিন দায় ও চাপ, তার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও জনবল আমাদের নেই। সবাইকে জায়গা দিতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা একটা বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা দুয়ের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করছি। আমরা কোনোভাবেই মনে করি না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা আসতে পারবেন না, অভিভাবকেরা আসতে পারবেন না, সাধারণ মানুষ আসতে পারবে না। তবে বাস্তবতা বুঝতে হবে, কিছু নিয়মকানুন থাকা দরকার।
২০২০ সালের অক্টোবরে প্রথম আলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, ‘কলেবরে বিশাল, গুণমানে নিচে’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত দুই দশকে বিভাগ ৪৭টি থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৪টি। ২২ হাজার থেকে শিক্ষার্থীসংখ্যা ৩৭ হাজার ছাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনার কোনো ভাবনা আছে?
নিয়াজ খান: কোনো বিভাগ বা অনুষদ নয়, সামগ্রিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো পর্যালোচনার কথা মহাপরিকল্পনায় বলা আছে। শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন মহল থেকে কিছু দাবি ও পরামর্শও আছে। আমরা একটু থিতু হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করব। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আপনি দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, পড়িয়েছেন। সে তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিয়ে কী বলবেন? মনে করিয়ে দিই, বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পিছিয়ে।
নিয়াজ খান: এই প্রশ্নের উত্তর সরলভাবে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ও মাপকাঠি এক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একাডেমিক কাজের বাইরে সমাজের অনেক দায় পূরণ করতে হয়। এ কারণে পুরো জোর শিক্ষাদান ও গবেষণায় দেওয়া সম্ভব হয় না। আপনি যদি এবারের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিষয়টি বিবেচনায় নেন, তাহলে দেখবেন, এটারও সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বড় ভূমিকায় ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। সমাজের স্বার্থে, সমাজকে সঙ্গে নিয়ে যে বিনিয়োগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় করল, র্যাঙ্কিংয়ে কিন্তু সেটার মূল্য নেই। এটা অবশ্য আমি দায় এড়ানোর জন্য বলছি না। আমি বলব, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান অত্যন্ত উচ্চ।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও নেদারল্যান্ডসভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘এলসেভিয়ার’ সম্প্রতি সেরা গবেষকদের একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষক স্থান পেয়েছেন। আমরা এই মান সব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে পারছি না। শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত, গবেষণার সরঞ্জাম, পরীক্ষাগারসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে লাইন ধরে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীরা বিসিএসের পড়া পড়ে। বিভিন্ন বিভাগ আছে, সেগুলোর চাকরির বাজার নেই।
নিয়াজ খান: চাকরির জন্য পড়া দোষের নয়। কেউ চাকরিতে যাবে, কেউ গবেষণা ও শিক্ষকতায়। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু চাকরির জন্য পড়াবে, সেটাও ঠিক নয়। মৌলিক জ্ঞান তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে আমরা এসব বিষয়েও সুপারিশ চাইব।
আপনার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে দু-একটি প্রশ্ন করি। ব্যক্তিজীবনে আপনি ধার্মিক। আপনার কোনো রাজনৈতিক অবস্থান আছে কি?
নিয়াজ খান: আমি আমার সারা জীবনে বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। কিছু কথা বলা হচ্ছে, যা নির্জলা মিথ্যা কথা—এটা আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি। আমি এ বিষয়ে সবাইকে জবাব দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করি না। আপনি জিজ্ঞেস করলেন, তাই বললাম।
আপনি পিংক ফ্লয়েডের গান শোনেন। আপনি কি ধর্মচর্চা ও গান শোনার মধ্যে বিপরীতমুখী কোনো অবস্থান খুঁজে পান?
নিয়াজ খান: পিংক ফ্লয়েড, বব ডিলানদের প্রভাব আমাদের তারুণ্যে ছিল। তাঁরা মানুষের অধিকার রক্ষা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, ব্যক্তির চেয়ে সমাজজীবনের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাঁরা বলেছেন, মানুষের সেবা করাই স্রষ্টার সেবা করা। ধর্ম তো এর বিপরীত কিছু বলে না। তাই আমি বৈপরীত্যও দেখি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজ পড়ার ছবি নিয়ে আপনি আমার সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভজন আয়োজন করা হলে আপনি সেখানেও যাবেন। বিষয়টি নিয়ে পাঠকের উদ্দেশে কিছু বলবেন কি?
নিয়াজ খান: এবার শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসবে আমরা প্রশাসনের তরফ থেকে সার্বক্ষণিক তাঁদের সঙ্গে ছিলাম। আমি ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ধর্মাবলম্বী যত শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছেন, তাঁদের পুরোপুরি সুরক্ষা দেওয়া, তাঁদের সহায়তা করা, সহায়তা পেতে তাঁদের কাছে যাওয়ার জন্যই তো আমরা এখানে এসেছি। শিক্ষকের ধর্ম ও ব্যক্তিগত মত থাকতে পারে, কিন্তু সেটা তাঁর শিক্ষকতা পেশাকে প্রভাবিত করতে পারে না। তাহলে তিনি শিক্ষক থাকেন না।
আপনার ফেসবুক পেজে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে তোলা ছবি আছে। সেটা দেখে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নিয়ে আপনি কী বলবেন?
নিয়াজ খান: বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বড় বড় আন্দোলনের ধারাবাহিকতার মাধ্যমে হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আমাদের একটি মৌলিক ‘টার্নিং পয়েন্ট’। পরবর্তী সময়ে যখনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের শক্তি একত্র হয়েছে, সেটা নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন বলি, ’২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বলি, সেগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে মাইলফলক। ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দেয়, নানা ধরনের বিভেদ থাকার পরও জাতি হিসেবে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একত্র হতে পারি। আমি এসব মাইলফলকের মধ্যে কোনো কনফ্লিক্ট (দ্বন্দ্ব) দেখি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়; এটি মুক্তচিন্তা, বাক্স্বাধীনতা, প্রগতিশীলতা ও সংস্কৃতির একটি কেন্দ্র। আগামী দিনগুলোতে সেখানে কি কোনো ছেদ পড়বে বলে আপনি মনে করেন?
নিয়াজ খান: ছেদ করার আমি কে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বজনতার বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তচিন্তার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার সম্পর্ক মৌলিক এবং অলঙ্ঘনীয়। যে উচ্চশিক্ষা মুক্তচিন্তার সুযোগ করে দেয় না, সেটাকে উচ্চশিক্ষা বলা যাবে না। আমি আন্তরিকতার সঙ্গে বলছি, যেকোনো রকম মুক্তচিন্তাকে আমরা লালন করব।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমরা দেখেছি, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকেরা কিছু বিষয় নিয়ে পড়াতে ভয় পেতেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয় ছিল। নতুন সময়ে শিক্ষকেরা কি সব বিষয়ে নির্ভয়ে পড়াতে পারবেন?
নিয়াজ খান: বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে আমরা একটি মৌলিক মূল্যবোধ জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছি, সেটা হলো, অপরের স্বাধীনতা বিনষ্ট না করে সবাই তাঁর স্বাধীন মতামত প্রকাশ করবেন। যেকোনো পরিসরে আমরা এটা উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি।
আপনাকে ধন্যবাদ।
নিয়াজ খান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।