ড. সেলিম রায়হান
ড. সেলিম রায়হান

চার শিকল ভাঙতে না পারলে মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়তে হবে

ড. সেলিম রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী, উত্তরণের পথ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

প্রশ্ন

টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করল আওয়ামী লীগ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের সামনে মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী দেখতে পাচ্ছেন?

সেলিম রায়হান: পুরোনো চ্যালেঞ্জগুলোই নতুন সরকারের সামনে আরও প্রকটভাবে দেখা দেবে। মূল্যস্ফীতি, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো দেখছি, সেগুলোর তো সমাধান হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে আর্থিক খাতের এসব মৌলিক সমস্যায় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ঠিক সময়ে ঠিক উদ্যোগ না নেওয়ায় নতুন নতুন সমস্যার জন্ম হয়েছে।

প্রশ্ন

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, প্রবাসী ও রপ্তানি আয়—কোনোটাই তো স্বস্তিদায়ক অবস্থানে নেই...

সেলিম রায়হান: আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে পর্যায়ে নেমে এসেছে, সেটি কোনোভাবেই স্বস্তিদায়ক নয়। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের অস্থিরতা রয়েছে। প্রবাসী ও রপ্তানি আয় আমাদের বড় দুটি চালিকা শক্তি। এ দুইয়ের ক্ষেত্রেও অস্থিরতা রয়েছে। বৈধ পথে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধির পরিমাণ খুব কম। দেশ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে টাকা পাচার হয়েছে। পাচারের মাধ্যম হিসেবে হুন্ডি ব্যবহৃত হচ্ছে। হুন্ডির কারণে আনুষ্ঠানিক পথের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক পথে রেমিট্যান্স আসছে। রপ্তানি ক্ষেত্রেও ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে না। কখনো ভালো, কখনো খারাপ।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যখন বেশ বড় পতন হচ্ছিল, ডলারের বড় ধরনের সংকট দেখা দিচ্ছিল, তখন আমদানি নিয়ন্ত্রণের যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মূল প্রভাবটা গিয়ে পড়েছে বিনিয়োগে। বিশেষ করে কাঁচামাল থেকে শুরু করে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে বড় ক্ষতি হয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ অল্প কিছু সময়ের সমাধান হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সেটি চলতে পারে না।

প্রশ্ন

চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণে সরকার একদম প্রাথমিকভাবে এখন কী কী উদ্যোগ নিতে পারে?

সেলিম রায়হান: আর্থিক খাতের সমস্যাগুলো সমাধানে দীর্ঘ সময়জুড়েই নেতৃত্বের অভাব আমরা দেখছি। সমস্যাগুলোকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখা হয়নি, বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হয়েছে। কোভিড মহামারির আগপর্যন্ত অর্থনীতিতে আমরা একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় ছিলাম। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ছিল। আমরা যখন ভালো সময় পার করেছি, তখন অর্থনীতির নীতিগত বিষয়গুলোতে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছি কি না, সেই প্রশ্ন সেভাবে আসেনি। কিন্তু আমরা যখন সংকটে পড়লাম, তখন অর্থনীতি আমাদের বড় বড় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের কাছে আছে কি না, সেটিই বড় বিষয়। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই।

দৃষ্টান্ত হিসেবে বলব, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। দেড় দশক ধরে আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নের বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের জন্য অর্থের সংকুলান দরকার। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংকুলানের ক্ষেত্রে বড় ঘাটতি দেখা দেওয়ায় বৈদেশিক ঋণের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে। এই সংকট গভীর হওয়ার কারণ হলো, আমরা বড় ধরনের রাজস্ব আদায় করতে পারছি না। এটা শুধু অর্থনৈতিক কারণে হচ্ছে তা নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ আছে। আমাদের বড় একটা গোষ্ঠী কর দেয় না, অথচ তারা নানা ধরনের সুবিধা ভোগ করে। তারা প্রভাবশালী। এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেখানে প্রভাবশালী গোষ্ঠীটি কর থেকে অব্যাহতি পায়, কর ছাড় পায়, কর ফাঁকি দেয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এই সংস্কৃতিটা শক্তিশালীভাবে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকটের এটা বড় একটা কারণ।

প্রশ্ন

আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে কিছু সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল। বিদায়ী অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এসব শর্ত পূরণ করা সম্ভব হবে না। আপনি কী মনে করেন?

সেলিম রায়হান: সাবেক অর্থমন্ত্রী সম্ভবত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রসঙ্গে এসব কথা বলেছেন। আইএমএফ দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় দিয়েছে। তৃতীয় কিস্তির ক্ষেত্রে তারা আরও কঠোর হতে পারে। দ্বিতীয় কিস্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদের দুটি শর্ত পূরণ করতে পারেনি। তৃতীয় কিস্তির জন্য তারা যখন পর্যালোচনায় বসবে, তখন তারা তাদের শর্তের জায়গাগুলো কতটা পূরণ হচ্ছে, তা আরও কঠোরভাবে দেখতে পারে।

আমি এখানে বরং একটা মৌলিক প্রশ্ন তুলতে চাই। আমরা আইএমএফের শর্তকে শর্ত হিসেবে দেখছি। মনে হচ্ছে, ঋণ পাওয়ার জন্য শর্তগুলো পূরণ হওয়া দরকার। অথচ সংস্কারের এই বিষয়গুলো আমাদের নিজেদের তাগিদেই অনেক আগেই করার দরকার ছিল। আইএমএফ যা বলছে, তার থেকে বড় পরিসরে আমাদের সংস্কার প্রয়োজন। আইএমএফ তো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আমাদের সংস্কারের কথা বলছে না। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতেও আমাদের বড় সংস্কার প্রয়োজন।

প্রশ্ন

বিদেশি ঋণের একটা বড় চাপ বাংলাদেশের ঘাড়ে। বলা হচ্ছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বাড়বে। এর কী প্রভাব পড়বে আমাদের অর্থনীতিতে? এই পরিস্থিতি সরকার কীভাবে সামাল দেবে?

সেলিম রায়হান: আমরা একদিকে ঋণ নিচ্ছি; কিন্তু ঋণ পরিশোধ ও ঋণের যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা ভাবছি না। দেখা যাচ্ছে, ঋণের বেশির ভাগটা নেওয়া হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে। এ প্রকল্পগুলো দুটি সমস্যায় আক্রান্ত। প্রথমটা কস্ট ওভার রান। অর্থাৎ বাজেটে যে খরচটা নির্ধারণ করা হয়, শেষ পর্যন্ত তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ করতে হয়। অতিরিক্ত খরচের কারণে আরও বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হয়। আবার যে সময়টার মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় নিয়ে প্রকল্পটা শেষ করা হয়। এর ফলে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সময় প্রকল্প থেকে যে সুবিধা পাওয়ার কথা চিন্তা করা হয়, শেষে গিয়ে বড় ধরনের ওলট–পালট হয়ে যায়।

বৈদেশিক ঋণের সর্বোত্তম ব্যবহার করা গেলেই আমরা বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ দেখতাম। এ জায়গায় উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। কয়েকটি ছাড়া বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু করা যায়নি। অন্তত ১০ থেকে ১৫টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল যদি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা যেত এবং সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ আনা যেত, তাহলে বিদেশি ঋণ পরিশোধের ওপর আমাদের চাপ কমত।

প্রশ্ন

যে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচনের কারণে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অর্থনৈতিক চাপের আশঙ্কা করেন অনেকে। এমন কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে বাংলাদেশ কীভাবে তা সামাল দিতে পারে?

সেলিম রায়হান: স্বল্পোন্নত দেশের কিছু বাণিজ্যসুবিধা বাংলাদেশ এখনো পাচ্ছে। বাইরে থেকে কোনো অর্থনৈতিক চাপ আসা আমাদের জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রশ্ন হলো, এই চাপ কাটানোর উপায় কী? সমস্যাটি রাজনৈতিক পরিসরে সৃষ্টি হয়েছে, সেটির সমাধান রাজনীতিবিদদেরই হাতে। এ ক্ষেত্রে তাঁদেরকেই চেষ্টা করতে হবে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন সরকারের একটা উদ্যোগের বিষয় এখানে রয়েছে। আশা করি যে অস্বস্তিটা তৈরি হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে, সেই অস্বস্তি কাটানোর উদ্যোগ তারা নেবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে একক পণ্যের ওপর (তৈরি পোশাক) আমরা নির্ভরশীল। আবার রপ্তানির গন্তব্যও প্রধানত দুটি অঞ্চল (ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও উত্তর আমেরিকা)। রপ্তানির গন্তব্য বাড়ানোর পাশাপাশি রপ্তানির বহুমুখীকরণের সময় এসেছে।

প্রশ্ন

নিত্যপণ্যের দাম ও মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য বড় সংকটের কারণ। ভারত ও শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও আমরা কেন ব্যর্থ হচ্ছি?

সেলিম রায়হান: বাংলাদেশে যে সময়টাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে, সে সময়ে আশপাশের অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশেষ করে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা স্বাধীন ভূমিকা নিচ্ছে। সুদের হার বাড়ানো, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মতো শক্ত পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে। রাজস্ব নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও এ দেশগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো করেছে। প্রশ্ন হলো, পদক্ষেপগুলো তারা নিতে পারল, বাংলাদেশ কেন পারল না? নীতিকৌশল নেওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, সঠিক নীতি সময়মতো নিতে না পারা ও সমন্বয়হীনতা—এ তিনটি বিষয়ই আমাদের এখানে প্রকট রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়টাতে। এর খেসারতই আমরা দিচ্ছি।

সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বাংলাদেশে একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এসেছিলেন। সেখানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, শ্রীলঙ্কা কীভাবে ভয়াবহ সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াল। তিনি অনেকগুলো বিষয়ের সঙ্গে এটিও বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে ভূমিকা নিতে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করা হয়নি। এ জায়গাটিতে বাংলাদেশের দুর্বলতা আছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো স্বাধীন নয়। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তারা স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে না।

প্রশ্ন

মল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে নতুন মুদ্রানীতি কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে?

সেলিম রায়হান: আমরা আশাবাদী হতে চাই। দেরিতে হলেও সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে আমরা দেখছি। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলো। এটা সময়ের একটা দাবি। এতে সুদের হার বাড়বে। মানুষের চাহিদা সংকুচিত হবে; কিন্তু এই উদ্যোগটা অনেক দেরি করে নেওয়া হলো। যে সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল, সে সময় সুদের হার সেই ৬ ও ৯–এর মধ্যেই আটকে রাখা হয়েছিল।

তবে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এখানে আরও দুটি বিষয় রয়েছে। রাজস্ব নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনা। আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। নজরদারি থেকে শুরু করে তদারকি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতে ঘাটতি রয়েছে। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাঁরা নানাভাবে বাজারে কারসাজি করেন। জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেন। এর বিরুদ্ধে সরকারের যে সংস্থাগুলোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখি, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখি না।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বয় দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, এনবিআরসহ সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে একক নেতৃত্বের আওতায় যে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার, সেটির আমরা খুব ভয়ানক অনুপস্থিতি দেখেছি। এখন এটা স্পষ্ট যে আমরা যদি সমন্বিতভাবে উদ্যোগ না নিতে পারি, তাহলে আমরা এই কঠিন সমস্যার সমাধান করতে পারব না। উত্তরণটা আরও দীর্ঘায়িত হবে।

প্রশ্ন

বাংলাদেশে আয়বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। আয়বৈষম্য সমাজে নানা বিভাজন তৈরি করছে। বেরিয়ে আসার পথ কী?

সেলিম রায়হান: আয়বৈষম্যের একটি বড় কারণ হলো, শ্রমবাজারে কাজের যে ক্ষেত্র আছে, সেখানে দরিদ্র মানুষেরা নির্দিষ্ট কিছু কাজের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকছেন। এখানে সচলতাও খুব কম। শিক্ষাটা যদি সর্বজনীন না করা যায়, তাহলে বৈষম্য বাড়তেই থাকবে। অনেকে বলবেন প্রাথমিক শিক্ষাটা তো সর্বজনীন। আমি বলব, গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার সর্বজনীনতা দরকার। কে কোন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে, শ্রমবাজারে সে কোন ধরনের কাজে নিয়োজিত হবে, তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও আমরা দেখছি, যাঁর টাকা আছে, তিনি ভালো স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন; যাঁর নেই তিনি ভালো স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছেন না। অনেক গরিব মানুষকে তাঁর সম্পত্তি বিক্রি করে স্বাস্থ্যসেবা নিতে হচ্ছে।

আমাদের এখানে বৈষম্যের আরেকটা বড় জায়গা হলো সম্পদের বৈষম্য। বৈধ পথে, অবৈধ পথে সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে কিছু মানুষের হাতে। সমাজে ঋণখেলাপি, করখেলাপি ও দুর্নীতি বেশি থাকলে সেগুলো নানাভাবে সম্পদের বৈষম্য তৈরি করে। বৈষম্যের উৎসগুলোর ব্যাপারে আমাদের কারও দ্বিমত নেই। কিন্তু উৎসগুলো বন্ধে যদি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, উল্টো উৎসগুলো শক্তিশালী হওয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যদি জিইয়ে থাকে, তাহলে বৈষম্য বেড়েই চলবে। আয়বৈষম্যের উৎসগুলো আমরা যদি বন্ধ করতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশ আরও বৈষম্যের একটা সমাজে পরিণত হবে। তরুণদের মধ্যে আরও অস্থিরতা ও হতাশা বাড়বে।

প্রশ্ন

জনমিতিতে তরুণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁদের জন্য যথাযথ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। তরুণদের জন্য করণীয় কী?

সেলিম রায়হান: জনমিতির লভ্যাংশ, একটা উপহার। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পর সেটি আর থাকবে না। গবেষণা বলছে, ২০৩৪-৩৫ সাল পর্যন্ত আমরা এই সুবিধাটা পাব। তারপর সেটি হারাতে থাকব। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে সরকারি চাকরির জন্য মোহগ্রস্ততা আছে। কিন্তু এ চাকরির জন্য যে সংখ্যক তরুণ আবেদন করেন, তঁাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ সফল হন। অথচ তাঁরা বছরের পর বছর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এতে তাঁদের শ্রম, সময়, মেধা সবই অপচয় হচ্ছে, আমাদের সমাজ-অর্থনীতি তাঁদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল খাতগুলো যদি বিকশিত হতো, সেখানে যদি তাঁদের কাজের সুযোগ তৈরি হতো, তাহলে তরুণেরা সরকারি কাজের জন্য মোহগ্রস্ত হতেন না। আমাদের উৎপাদনশীল খাতে তাহলে কারা যাবে? গত ১০-১৫ বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধির গল্পটা যতটা শক্তিশালী, কর্মসংস্থানের গল্পটা ততটাই দুর্বল।

প্রশ্ন

আপনি এর আগে বলেছিলেন মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে মূল্যায়ন দরকার...

সেলিম রায়হান: আমি এখনো বলছি, আমাদের মেগা প্রকল্পগুলোর একধরনের মূল্যায়ন দরকার। যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা দরকার। এখন আমাদের অর্থনীতির সুসময় চলছে না, একটি সংকটকাল চলছে। এ মুহূর্তে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। এখন যদি আমরা মেগা প্রকল্পের জন্য নতুন করে ঋণ নিতে শুরু করি, তাহলে আমাদের অর্থনীতির ওপর চাপটা আরও বাড়বে। এ মুহূর্তে নতুন করে মেগা প্রকল্প নেওয়াটা একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

প্রশ্ন

একটা দুর্বল ব্যাংক খাত নিয়ে আমরা কত দূর সামনে এগোতে পারব?

সেলিম রায়হান: অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে স্তরে আমরা আছি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা আমরা ঠিক করেছি, তার সঙ্গে আমাদের ব্যাংকিং খাত যেভাবে চলছে, সেটিকে খুব আশ্চর্যজনক ব্যাপার বলে মনে হয়। এর একটি ব্যাখ্যা থাকতে পারে। হাজারো সমস্যা থাকার পর তৈরি পোশাকশিল্প ও প্রবাসী আয়ের কারণে ব্যাংকিং খাত এখনো কোনো না কোনোভাবে সেবাটা দিয়ে যেতে পারছে। ব্যাংকিং খাতে সামগ্রিকভাবে সুশাসন ভয়ানকভাবে অনুপস্থিত। এ খাতে যে বড় ধরনের সংস্কার দরকার, সে ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই।

উচ্চ ঋণখেলাপি, একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রভাব, ব্যাংক কোম্পানি আইনের কোনোটাই ব্যাংক খাতের সুশাসনের সহায়ক নয়। আগের অর্থমন্ত্রী ব্যাংকিং খাতে কমিশন গঠনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেটির বাস্তবায়ন আমরা দেখিনি। ব্যাংকিং খাতে অবশ্যই একটি স্বাধীন কমিশন হওয়া উচিত। এই ব্যাংকিং খাত নিয়ে আমাদের অর্থনীতি খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না।

অর্থনীতিতে অন্য অনেক দেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, তারা মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকে পড়েছে। চারটি বড় শিকল একটি দেশকে সেই ফাঁদে আটকে দেয়। ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা, কর খাতের কম রাজস্ব আদায়, রপ্তানিতে একক পণ্যনির্ভরতা এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে অতি কম সরকারি ব্যয়—এই চার শিকল ভাঙতে না পারলে আমরা মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ে যাব।

প্রশ্ন

 আপনাকে ধন্যবাদ।

সেলিম রায়হান: আপনাকেও ধন্যবাদ।