সাক্ষাৎকার: খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

দেশে চামড়া ফেলে দেওয়া হয় অন্যদিকে আমরা চামড়ায় আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছি

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক। দীর্ঘদিন ধরে চামড়াশিল্প নিয়ে তিনি গবেষণামূলক কাজ করছেন। এ শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি, সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
প্রশ্ন

প্রথম আলো: এবার চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত মনে করছেন?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আমাদের এখানে বহু বছর আগে থেকে চামড়ার একটি বেজ প্রাইস (ভিত্তিমূলক মূল্য) ধরে রাখা হয়েছে। সেটির ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতিবছর চামড়ার একটি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়।

আমার ধারণা, এই মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়ার ভেতরে চামড়ার যে বাণিজ্যিক মূল্যের বিষয়টি রয়েছে, সেটি তেমন বিবেচনায় নেওয়া হয় না। এখনো এটি কোরবানি দানের পণ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং দানের পণ্যের ক্ষেত্রে আর্থিক মূল্য যেহেতু একেবারে ন্যূনতম মাত্রায় ভাবা হয়, ফলে চামড়ার মূল্য নির্ধারণও সেভাবে ঘটে।

কিন্তু বাজারের ভিত্তিতে দরদাম করা এবং কাঁচামাল হিসেবে এর যে মূল্য থাকা উচিত, সে বিষয়গুলো এখানে উপেক্ষিত থেকে যায়। ফলে সব সময় এটির নিম্নমূল্য নির্ধারিত হয় এবং প্রকৃত বাজারমূল্য অনুসারে চামড়ার মূল্যায়ন হয় না।

এ বছর ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার মূল্য ৫০-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে তা ৪৫-৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার সামান্য বেড়েছে যদিও। সে ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এখানে ৬ শতাংশের মতো মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। অথচ এখন মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯ শতাংশের মতো। সে বিবেচনা করলেও চামড়ার মূল্য হওয়ার কথা ছিল ৫২-৫৭ টাকা।

রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে বিবেচনা করলে ডলারের বিনিময়ে টাকা অবমূল্যায়িত হওয়ার কারণে রপ্তানিকারকেরা হয়তো বেশি টাকা পাবেন। তবে টাকার অবমূল্যায়ন এবং মূল্যস্ফীতি যদি ১৫ শতাংশও হয়, তাহলে চামড়ার মূল্য ৫৪-৬০ টাকা হওয়ার কথা ছিল। সেদিক থেকে এবার যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে আসলে স্বাভাবিক সময়ে যে ন্যূনতম সূচকগুলো থাকে, সেগুলোও বিবেচনা করা হয়নি। এটিকে যদি আমি কাঁচামাল হিসেবে বিবেচনা করি, আমার ধারণা এটির মূল্য আরও বেশি হওয়ার কথা।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: একটা সময় সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে চামড়া বেচাকেনা হতো, গত কয়েক বছরে ঘটছে উল্টোটা। এমনকি মানুষ চামড়ার দাম না পেয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। এবারও কি দাম না পাওয়ার পরিস্থিতি দেখতে হবে?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: একটা সময় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে চামড়া বিক্রি হওয়ার বিষয়টি ছিল। তখন চামড়ার চাহিদার কারণে সেটি হতো। সে সময় চামড়া রপ্তানিতে ধারাবাহিক একটি প্রবৃদ্ধি ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবদ্ধির ওঠানামা চলছে।

এমনকি চামড়াজাতীয় পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে উচ্চমাত্রার যে প্রবদ্ধি হওয়ার কথা ছিল, সেটিও আমরা রাখতে পারছি না। গত বছর সন্তোষজনক ছিল না বলে যতটুকু মনে পড়ে, এ বছরও হয়তো তেমনটি দেখতে হবে। ফলে পণ্য রপ্তানি যদি নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে থাকে বা সন্তোষজনক না হয়, তাহলে প্রস্তুত চামড়া বা গুদামজাত পণ্য জমতে থাকে। এতে যারা জুতা বা অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য তৈরি করে, তাদের কাছে তখন চামড়ার চাহিদা কমে যায়। তখন এর একটি ধারাবাহিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গোটা শিল্পের ওপর, বিশেষ করে ট্যানারিগুলোতে, তারাই যেহেতু যারা চামড়া প্রস্তুত করে এবং পণ্য তৈরি করে, তাদের কাছ থেকে চামড়ার চাহিদা নিয়ে থাকে। ফলে তাদের কাছ থেকে চাহিদা পড়তি থাকলে ট্যানারিতেও চামড়া সংগ্রহ কম হয়।

এ বছর যে পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং যে চাহিদা দেখানো হয়েছে, এসবের প্রতি যথেষ্ট উৎসাহ না–ও থাকতে পারে ট্যানারিগুলোর পক্ষ থেকে।

এ ক্ষেত্রে দুর্বলতা মূলত আমাদের বাজারকাঠামোর। আমরা চামড়ার বাজারটিকে একেবারে অভ্যন্তরীণ একটি ক্যাপটিভ মার্কেটে পরিণত করেছি। বড় স্বার্থের কথা বলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা আগে মেটানোর জন্য বাজারকে এমন করে রাখা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এটি করতে গিয়ে চামড়ার যে স্বাভাবিক কেনাবেচা বা উচ্চ মূল্য নির্ধারণের যে সুযোগ, সেটিও রুদ্ধ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে গত বছর সীমিত পর্যায়ে কিছু কাঁচা চামড়া বা ওয়েট ব্লু রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আমরা মনে করি, এ বছরও সে সুযোগ উন্মুক্ত রাখা উচিত সরকারের। এমনকি ওয়েট ব্লুর আগের পর্যায়ে লবণ দিয়ে রাখা হয় যে চামড়া, সেটিকেও রপ্তানির সুযোগ দেওয়া উচিত। তাতে চামড়ার অভ্যন্তরীণ যে অবনমিত বাজার রয়েছে, সেটির বিপরীতে আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বাজারটি খুঁজতে পারবে।

এমনটি করা গেলে আমাদের এখানে চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। এতে চাহিদাও তৈরি হবে এবং প্রকারান্তরে সেটি হলে চামড়া বেশি মূল্যে বিক্রিরও সুযোগ তৈরি হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া উচিত আরও আগে। চামড়া কতটা মজুত রয়েছে, চাহিদা কত, জোগান কেমন হবে, কী পরিমাণ নতুন চামড়া কেনা যাবে বা হবে, বাজার কতটা উন্মুক্ত করতে হবে না হবে—সেসব বিবেচনা করেই মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত, এসব বিবেচনায় রেখে গুরুত্বসহকারে বিষয়টি ভাবা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কোরবানি ঈদকে ঘিরে আমাদের দেশে চামড়াশিল্পের বড় একটা সম্ভাবনা আছে। শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই বলছেন, ইউরোপের ক্রেতারা বেশি দামে এখানকার চামড়া কিনে নেয়। কিন্তু তারা কেনে কম। তার মানে কি চামড়ার রপ্তানির বাজার তৈরিতে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের মনোযোগ কম বা এখানে নীতিনির্ধারণে কোনো সীমাবদ্ধতা কাজ করছে?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: এখানে সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো আমাদের নিজস্ব বিপুল কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে চামড়ার বাজারে এখন পর্যন্ত আমরা ফুটস্টেপ তৈরি করতে পারিনি। আমরা চামড়া রপ্তানিতে কখনো বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাই আবার কখনো সেখান থেকে পিছিয়ে পড়ি। অথচ বলা হয়ে থাকে, বিশ্বজুড়ে চামড়ার ৩০০-৪০০ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে। অথচ আশির দশকেও কিন্তু তৈরি পোশাকের ওপরে ছিল চামড়াশিল্পের অবস্থান। দীর্ঘদিন ধরে আমরা চামড়া বা চামড়াজাত পণ্যের বাজারটি তৈরি করতে পারিনি। এখানে সরকার, উদ্যোক্তা, ট্যানারিমালিক, চামড়া প্রস্তুতকারক, চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী—সবারই দায় রয়েছে।

এখানে মনে রাখা দরকার যে চামড়া প্রস্তুত করা ও চামড়াজাত পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে মূল নির্ণায়ক পরিবেশসম্মতভাবে তা করা। আমাদের এখানে পরিবেশসম্মতভাবে চামড়া প্রস্তুত করা হয় না। চামড়া প্রস্তুতের ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিকভাবে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদপ্রাপ্ত মাত্র চারটি লেদার ফ্যাক্টরি রয়েছে এখানে, তা–ও তারা নিজস্ব উদ্যোগে সেটি করেছে। কিন্তু এখানে জাতীয়ভাবে যে বিসিক শিল্পনগরী রয়েছে সাভারে, তা মোটেই এমন মানসম্পন্ন নয়। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের চামড়ার মান এখন পর্যন্ত পরিবেশসম্মত না হওয়ায় চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী মূল প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে এ চামড়া ব্যবহার না করে, এমনটা বলে দেওয়া হয়ে থাকে।

আরও দুর্ভাগ্য হচ্ছে, প্রতিবছর আমাদের এখানে চামড়া আমদানি বাড়ছে। অথচ আমাদের এখানে অভ্যন্তরীণভাবে চামড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফেলা দেওয়া হয়, পুঁতে ফেলা হয়। নিজেদের কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি করা হচ্ছে এবং প্রতিবছর সেটির পরিমাণ বাড়ছে। এলডব্লিউজি সনদে প্রস্তুত হওয়া চামড়া আমাদের বড় বড় কারখানামালিক বা কোম্পানিগুলো আমদানি করছে। তার মানে আমরা যত দিন পর্যন্ত এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত হব না, তত দিন আমরা বৈশ্বিক চামড়ার বাজারে ঢুকতে পারব না। এখন আমরা চামড়ার বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা বলছি। সেটি হলে দেখা গেল, আমাদের চামড়াগুলো নিয়ে ভারত, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান বা চীনের মতো দেশগুলো প্রস্তুত করছে এবং তারা সেখান থেকে সেগুলোকে তাদের ব্র্যান্ড হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করছে। অথচ সেটি আমরা করতে পারছি না। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী আছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এমনিতেই আমরা অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর দেশ হয়ে পড়েছি। দেশে কাঁচামালের বিপুল জোগান থাকা সত্ত্বেও এখন চামড়া খাতেও আমরা আমদানিনির্ভর দেশ হয়ে পড়ছি কি না? এটি তো শঙ্কার বিষয়।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: অবশ্যই এটি শঙ্কার বিষয়। আমাদের এখানে দক্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও চামড়ার গুণগত মান নিশ্চিত না করার কারণে আন্তর্জাতিক বড় যেসব ব্র্যান্ড আমাদের এখান থেকে চামড়াজাত পণ্য তৈরি করে নেয়, তারা তাদের পণ্যে ব্যবহারের জন্য চামড়া বাইরে থেকে আমদানি করার জন্য বলে থাকে। তথ্যমতে, ২০২০-২১ সালে সম্ভবত ১১১ মিলিয়ন ডলারের চামড়া আমদানি হয়েছে। প্রতিবছর সেটি ১০-১২ শতাংশ হারে বাড়ছে। সুতরাং এখানে আমদানিনির্ভরতা তৈরি হচ্ছে।

এখান থেকে সরে আসার জন্য যে পর্যাপ্ত উদ্যোগ প্রয়োজন, সেসব নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ও উদ্যোক্তা—উভয়েরই ঘাটতি রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে ট্যানারিমালিকেরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন, তাঁরা এলডব্লিউজি সার্টিফায়েড হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন। কিন্তু এ উদ্যোগগুলোর সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এতে আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী প্রস্তুত চামড়ার উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এর জন্য যে বড় বিনিয়োগ করতে হবে, এটির জন্য আমাদের ট্যানারিমালিকেরা এবং চামড়া প্রস্ততকারীরা প্রস্তুত নন। এ বিনিয়োগটুকু না করলে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য এলডব্লিউজি সার্টিফায়েড হতে পারব না।

আর আমাদের বিসিক শিল্পনগরীর যে ইটিপি রয়েছে, সেটিও কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে মানসম্পন্ন নয়। এটিকেও সেই মানদণ্ডে নিয়ে যেতে সেখানে আরও বিনিয়োগ দরকার।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের চামড়ার বড় একটি বাজার হচ্ছে অভ্যন্তরীণ এবং আমাদের ট্যানারিমালিকেরা এখন পর্যন্ত এ অভ্যন্তরীণ বাজারকেই বেশি গুরুত্ব দেন, এমনকি উৎপাদকেরাও। অভ্যন্তরীণ ভোক্তারা আসলে এ পরিবেশ মানদণ্ডের চামড়া নিয়ে সচেতন নন। ফলে তাঁদের কাছে এটির তেমন কোনো মূল্য নেই। ফলে একই ট্যানারি যখন অভ্যন্তরীণ ও বাইরের বাজারের জন্য চামড়া প্রস্তুত করে, তারা তখন একই মানদণ্ডে করে ফেলে। ফলে বাইরের মানদণ্ডে এটি আর টেকে না। এখন রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য আলাদা রকমের ট্যানারি কারখানা করা অবশ্যই জরুরি। সেটি অবশ্যই আন্তর্জাতিক সনদপ্রাপ্ত এবং অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকবে। আলাদাভাবে সেখানে চামড়া প্রস্তুত বা উৎপাদিত হবে, এ রকম আলাদা শিল্পকাঠামো দরকার।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনি বলছেন চামড়ার চাহিদা না থাকার কারণে এর দাম পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সাধারণ মানুষকে বলতে শোনা যায়, অমুক কোম্পানির এক জোড়া চামড়ার জুতা কিনতে কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ কোরবানির চামড়া নামকাওয়াস্তে বিক্রি করতে হয় বা ফেলে দিতে হয়। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আপনি আসলে ঠিকই বলেছেন। কাঁচামাল থেকে চামড়া প্রস্তুত করা এবং পণ্য তৈরি পর্যন্ত যে সাপ্লাই চেইন, আমাদের এখানে এখনো তা পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে হয় না। যে কারণে বলছিলাম, কাঁচা চামড়াকে এখানে এখনো দানের পণ্য হিসেবে দেখা হয়, শিল্পপণ্য হিসেবে দেখা হয় না। এই চামড়াগুলোকে অভ্যন্তরীণ বাজারে আটকে রাখা হয়েছে, যাতে বাইরের বাজারে যেতে না পারে। ফলে সেগুলো নিম্নমূল্যে বিক্রিতে মানুষ বাধ্য হচ্ছে। এটি একটি বড় দুর্বলতা।

আবার এ চামড়া ব্যবহারকারী যে কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে, তাদের সংখ্যাও কিন্তু বেশি নয়, বড় ৮-১০টি কোম্পানি রয়েছে। তার মধ্যে এক-দুটির মার্কেট শেয়ারই ৬০-৭০ শতাংশ। যদি তা–ই হয়ে থাকে, এ রকম একটি বাজারকাঠামোতে একধরনের মনোপলি বা একচেটিয়া বাজারের প্রভাব তৈরির আশঙ্কা থাকে। এতে চামড়া প্রস্তুতকারী বা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান উচ্চ মূল্যে ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রির একটি সুযোগ নিয়ে থাকে। সম্ভবত আমাদের এখানে তেমনটি ঘটছে।

যদি এখানে সুষম বাজারকাঠামো থাকত, তাহলে কাঁচামালের মূল্যও বেশি পাওয়া যেত এবং এখন ভোক্তারা যে মূল্যে পণ্য কিনছেন, সেই মূল্যে কিনতেও তাঁদের তেমন আপত্তি থাকত না। চামড়ার মূল্য আরও বেশি পেলে সাপ্লাই চেইনে থাকা সবাই উপকৃত হতো। অথবা এ বাজার যদি ক্যাপটিভ না হয়ে আরও উন্মুক্ত হতো, তাহলে ভোক্তা পর্যায়েও চামড়াজাত পণ্যের মূল্য আরও কমে আসতে পারত।

আমরা দেশীয় শিল্প সংরক্ষণের স্বার্থে সুবিধা দিতে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু সেই সুবিধা ভোক্তা পুরোপুরি নিতে পারছেন না। সেই অর্থে যারা চামড়া সংগ্রহকারী বা বিক্রয়কারী, তারাও সেই সুবিধা নিতে পারছে না। মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা কিছু উৎপাদনকারী এ সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ট্যানারিমালিকেরা বা একধরনের একটি সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়, যারা চামড়ার বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সে ব্যাপারে কী বলবেন?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: এ সমস্যা আমাদের সব খাতেই কমবেশি রয়েছে। বিশেষ করে বড় খাতগুলোতে আমরা দেখি, বড় বড় ব্যবসায়ী বা শিল্পমালিকেরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। চামড়াশিল্পের ক্ষেত্রেও ট্যানারিতে বা যারা চামড়া প্রস্তুত করে বা যারা পণ্য উৎপাদন করে—এ জায়গাগুলোতে একধরনের সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকে। সিন্ডিকেট আছে, এমন অভিযোগ অমূলকও নয়।

এ সমস্যা থাকার মূল কারণ হচ্ছে এ শিল্প এখনো ফরমালাইজড বা আনুষ্ঠানিক মার্কেট কাঠামোতে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। চামড়া বা চামড়াজাত পণ্যের সাপ্লাই চেইনে এখনো ইনফরমালাইজেশন বা অনানুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড থেকে গেছে এবং সেটি বড় অংশে। রেজিস্টার্ড লেনদেনকারীর বাইরেও আনরেজিস্টার্ড লেনদেনকারী বা মৌসুমি বিভিন্ন রকমের ক্রেতা-বিক্রেতার আগমন ঘটে। এদের একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আনা হচ্ছে না বা উদ্যোগও নেই। এমনকি যে লেনদেনগুলো হচ্ছে, সেখানেও অসচ্ছতা থেকে যাচ্ছে। ফলে চামড়ার বাজারে ব্যাংকগুলো যে ঋণ দেয়, তা খেলাপি হয়ে যায়। এমনকি সেই ঋণের টাকাও অনেক সময় উঠে আসে না। ফলে এখানে সিন্ডিকেট বা নানা ধরনের সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে হলে ফরমাল বা আনুষ্ঠানিক কাঠামোতে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

এ বাজারে কাঁচামাল থেকে শুরু করে প্রস্তুত চামড়া তৈরিতে প্রতিটি পর্যাযে যারা কাজ করে, তাদের রেজিস্টার্ড বা নিবন্ধিত হতে হবে। তাদের লাইসেন্স থাকতে হবে। সেগুলোর ভিত্তিতেই কেবল তারা লেনদেন করতে পারবে। মৌসুমি ক্রেতা-বিক্রেতা হলেও তার জন্য একধরনের লাইসেন্স থাকতে হবে। যে লেনদেনগুলো হবে, সেগুলো উপযুক্ত রসিদের মাধ্যমে হবে এবং বড় লেনদেনগুলো অবশ্যই মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বা ব্যাংকের মাধ্যমে হতে হবে। যাতে লেনদেনগুলো দৃশ্যমান থাকে। এর ভিত্তিতে ব্যাংকও ঋণ দিতে চাইবে।

এ রকম একটি ফরমাল মার্কেট কাঠামোতে আমরা যেতে পারিনি। অথচ এক বিলিয়ন ডলারের মতো পণ্য এখানে রপ্তানি হচ্ছে। এত বড় একটি রপ্তানিমুখী শিল্প, এর মার্কেটটি এখনো ইনফরমাল বা ট্র্যাডিশনাল কাঠামোতে থেকে গেছে। এ ধরনের কাঠামোতে পণ্য ও লেনদেন ট্রেস বা ট্র্যাক করা যায় না। বাইরের কোম্পানিগুলো যদি আমাদের কাঁচামালের উৎস ও প্রস্তুত সম্পর্কে নিশ্চিত বা সন্তুষ্ট না হয়, তারাও এখানে লেনদেনে উৎসাহী হয় না। সুতরাং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই রেজিস্টার্ড আর স্বচ্ছ ট্র্যাকিং ও ট্রেসিং সিস্টেমে যেতে হবে এবং ধাপে ধাপে ইনফরমাল বাজারকাঠামো থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: দেশে ট্যানারিশিল্পকে ঢেলে সাজানোর বড় প্রকল্প নেওয়া হলো, প্রচুর অর্থও সেখানে ব্যয় হলো, এরপর এই শিল্প টেকসই হলো না। এখানে সরকার, মন্ত্রণালয় বা শিল্পসংশ্লিষ্ট সবার সদিচ্ছার অভাব ছিল নাকি তাদের দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতাকে দায়ী করবেন?

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আসলে এর সঙ্গে এই সবকিছুই কমবেশি জড়িত। প্রথমত, ট্যানারিশিল্প আধুনিকায়নের জন্য যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, তা বিবেচনা করেই প্রকল্প ঠিক করা ও বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এলডব্লিউজির মানদণ্ডের ভিত্তিতে যদি সাভারে আমাদের ট্যানারির শিল্পনগরীটি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে শুরু থেকে সেভাবে বিনিয়োগ করা, সেভাবে সিইটিপির জন্য জায়গা রাখা, প্রয়োজনীয় উন্মুক্ত জায়গা রাখা, সবুজায়ন ও পরিবেশবান্ধব রাখা, ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করা, শক্ত বর্জ্য প্রক্রিয়ার জন্য স্থাপনা তৈরি করা—এসবই সেখানে থাকত বা হতো। এখন সেগুলো ছাড়াই যখন শিল্পনগরীটি হলো, তখন এটি মোটেই চাহিদাসম্পন্ন হয়নি। এলডব্লিউজির মানদণ্ডের ধারেকাছে এটি নেই। ফলে বাইরের বায়ার বা ক্রেতাদের বাংলাদেশের চামড়া খাত নিয়ে যে আগ্রহ-উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, তা আমরা ধরে রাখতে পারিনি।

এ জায়গায় সরকারের দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু একই সঙ্গে বেসরকারিভাবে এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ); বাংলাদেশ প্রস্তুত চামড়া, চামড়াপণ্য ও জুতা রপ্তানিকারক সমিতিসহ (বিএফএলএলএফইএ) আরও যেসব সংগঠন আছে, তাদের দিক থেকেও উচিত ছিল সরকারকে সচেতন করা। কেননা সরকার নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা না করে এখানে প্রকল্প করার ব্যাপারে পূর্ণ সিদ্ধান্তে যায়নি। ফলে সেখানে এসব সংগঠন বা পক্ষ পর্যাপ্ত সহযোগিতা করেছে বলে আমার মনে হয় না। তবে এখন আমার মনে হয় যে বিটিএ থেকে কিছু ঘুরে দাঁড়ানোর উপলব্ধি তৈরি হচ্ছে। যদিও আন্তর্জাতিক মানে নেওয়ার জন্য বিনিয়োগ করা, এর বিনিয়োগের জন্য মালিককে প্রস্তুত করা—সেসবের প্রতি আগ্রহের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। ফলে বিটিএর উদ্যোগ আরও জোরালো হওয়া দরকার।

আমাদের অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানিমুখী বাজারের জন্য আলাদা আলাদা ট্যানারি ও শিল্পকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। জামালপুরে সরকার আরেকটি ট্যানারিপল্লি করার চিন্তাভাবনা করছে, সেটিকে রপ্তানিমুখী ট্যানারি বা শিল্প হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত হবে। সেটিকে যদি শুরু থেকে এলডব্লিউজি মানদণ্ডে গড়ে তোলা হয়, তাহলে আমরা কিছু সুবিধা পেতে পারি।

তবে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তজাতিক সার্টিফায়েড এজেন্সি প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলোরও সহযোগিতা নেওয়া উচিত হবে। তাদের মতামত ও মূল্যায়নগুলো নেওয়া উচিত এবং কারিগরি সহায়তাও বাইরে থেকে নেওয়া। ব্যক্তিগতভাবেও এখানে এলডব্লিউজি সনদ অনুসারে ফ্যাক্টরি গড়ে তুলতে চাইলে সে সুযোগ তৈরি করতে হবে। তারা যাতে সে অনুসারে বিনিয়োগ করতে পারে, এর জন্য ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

একই সঙ্গে সাভার শিল্পনগরীতেও কেউ যদি এমন মানসম্পন্ন কারখানা করতে চান, এর জন্যও সুযোগ করে দিতে হবে। সেখানে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা থাকলে উদ্যোক্তারা আগ্রহ দেখাবেন। তবে সবচেয়ে বড় কথা, আমরা যদি সত্যিকার অর্থে পোশাকশিল্পের মতো চামড়াকেও আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্পপণ্য হিসেবে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে সেটির সুযোগ বা সম্ভাবনা এখনো রয়েছে। এর জন্য বড় বিনিয়োগ ও ব্যয়কাঠামো মেনে নিয়েই এগোতে হবে। দেশীয় বাজারকে মাথায় রেখে যদি উদ্যোগগুলোর ভেতরে একধরনের লুকোচুরি বা গোঁজামিলের চেষ্টা করা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা কখনো অবস্থান তৈরি করতে পারব না।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আপনাকেও ধন্যবাদ