ড. আবু জামিল ফয়সাল একজন জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে সরকার নিয়োজিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দলের (সিলেট বিভাগ) সদস্য। এ ছাড়া তিনি অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের সঙ্গে যুক্ত। করোনা সংক্রমণের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই বিশেষজ্ঞ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো: আপনি বলেছেন, করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আরও এক মাস থাকবে। আপনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী?
আবু জামিল ফয়সাল: তিনটি বিষয়ের গতিপ্রকৃতি দেখে আমরা এমন ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকি। প্রথমত মানুষের চলাচল। দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং তৃতীয়টি হলো স্বাস্খ্যসেবা ব্যবস্থাপনা। গুগলের একটি ম্যাপ আছে, যেখানে মানুষের চলাচলের চিত্র পাওয়া যায়। লকডাউনসহ নানা পদক্ষেপের কারণে মানুষের চলাচল অনেকটা কমেছে। বিশেষ করে সামাজিক সংযোগ, যা জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে অনেক বেশি ছিল। জনচলাচলের বর্তমান ধারা বজায় থাকলে সংক্রমণ কমে আসবে আশা করা যায়। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে বেশ দুর্বলতা আছে। অন্তত ৩০ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন, মাস্ক পরবেন, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। পরছেন মাত্র ৫ শতাংশ। তৃতীয়ত, রোগীর স্বাস্থ্যসেবা ঠিকমতো হলে সংক্রমণের মাত্রা কমে আসবে। এটাই বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি নিরূপণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, সংক্ষেপে বলে এসআইআর।
প্রথম আলো: ভারতে সংক্রমণ ভয়াবহ দিকে মোড় নিয়েছে। তার অভিঘাত কি এখানেও আসতে পারে? অনেকে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আপনিও কি তাই মনে করেন?
আবু জামিল ফয়সাল: আমিও মনে করি সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া উচিত। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৩৬টি স্থলবন্দর আছে। আমদানি–রপ্তানিসহ নানা কারণে মানুষ আসা–যাওয়া করছে। ভারতে যে নতুন ধরনের করোনা সংক্রমণ হচ্ছে, তার শক্তি অনেক বেশি। তাই সাময়িক হলেও এসব বন্দর বন্ধ রাখা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমেই বলেছিল সংক্রমণের প্রবেশপথগুলো বন্ধ করে দাও। আমরা তখন তাদের কথা শুনিনি। বিমানপথে যেসব যাত্রী বাইরে থেকে এসেছেন, তাদের ঠিকমতো পরীক্ষা করা হয়নি। আইসোলেশনে রাখা হয়নি। শাহজালাল বিমানবন্দরে কিছু নিয়মকানুন মানা হলেও অন্যগুলো খুবই উদাসীন ছিল।
প্রথম আলো: দ্বিতীয় ঢেউ আসবে, এটা আগেই বলা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের কি প্রস্তুতি ছিল?
আবু জামিল ফয়সাল: আমরা প্রথম ঢেউ থেকে ভালো করে শিক্ষা নিইনি। জনগণকে প্রস্তুত রাখতে পারিনি। সরকার স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলেছে। কিন্তু তাতেই দায়িত্ব শেষ হতে পারে না। সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি কী হতে পারে, কোথায় গেলে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি, এসব তাদের বোঝানো উচিত ছিল। পুরো কার্যক্রমের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করা উচিত। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব ছিল। তাঁরা সেটা পালন করেননি।
প্রথম আলো: বিশেষজ্ঞরা কঠোর লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু একবার লকডাউন কঠোর করা হয়, আরেকবার শিথিল।
আবু জামিল ফয়সাল: লকডাউন ঠিকমতো চললে বলা যেত সংক্রমণ কমবে। কিন্তু যেভাবে দোকানপাট খুলে দেওয়া হচ্ছে, গণপরিবহন চালুর চিন্তাভাবনা হচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তা বলা কঠিন। আমরা করোনার বাইরের ঢেউ ভয় পাচ্ছি। কিন্তু ভেতরেও তো করোনাভাইরাস চরিত্র বদলাচ্ছে। ধরুন, বিশেষ ধরনের করোনা কোনো স্থানে শনাক্ত হলো। তখন আমাদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হবে এটি যাতে অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেই পদক্ষেপ নেওয়া। এলাকাটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।
প্রথম আলো: করোনা সংক্রমণের গতিবিধি বোঝার জন্য পরীক্ষা জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশে পরীক্ষা কম হচ্ছে তুলনামূলক। তাহলে কীভাবে বোঝা যাবে সংক্রমণ বাড়ছে না কমছে?
আবু জামিল ফয়সাল: একদম ঠিক কথা। কয়েক দিন আগেও দিনে গড়ে ২৭ হাজার পরীক্ষা হতো। লকডাউনের কারণে পরীক্ষা অনেক কম হচ্ছে। তাই আক্রান্তের সংখ্যাও কম। ধরুন কোনো একটি উপজেলায় করোনায় একজন মানুষ মারা গেলেন। এখন সেই ব্যক্তির কাছ থেকে আরও কারও শরীরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে কি না, তা জানার জন্য আশপাশের সম্ভব হলে সব মানুষকে পরীক্ষা করতে হবে। আর সব সময় উপসর্গ ধরে পরীক্ষা করলে হবে না। অনেকের শরীরে উপসর্গ না–ও দেখা দিতে পারে।
প্রথম আলো: সংক্রমণ শুরু হয়েছে গত বছরের মার্চ মাসে। এই ১৩–১৪ মাসে স্বাস্থ্যসেবার মান ও সক্ষমতা কি বেড়েছে?
আবু জামিল ফয়সাল: কঠিন প্রশ্ন। গত বছর করোনা পরীক্ষায় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। কিন্তু সিস্টেম তো বদলায়নি। এবার বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ না উঠলেও অবহেলার অভিযোগ আছে। কোভিড চিকিৎসার জন্য যে যন্ত্রপাতি আনা হয়েছিল, তা বিমানবন্দরেই পড়ে থাকল কয়েক মাস। এগুলো আনা হয়েছিল করোনা রেগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য। যন্ত্রপাতি যদি বিমানবন্দরেই পড়ে থাকে, তাহলে লাভ কী হলো। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের মানসিকতার যেমন পরিবর্তন প্রয়োজন, তেমনি জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে। কেউ অনিয়ম করে, দায়িত্বে অবহেলা করে যদি পার পেয়ে যান, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। স্বাস্থ্যসেবার দক্ষতাও বাড়বে না। গত ১৩–১৪ মাসে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলা যাবে না।
প্রথম আলো: গত বছর বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল, তা খরচ করা যায়নি অনিয়মের কারণে। স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ জনবল ও যন্ত্রপাতি উভয়ের সংকট আছে। উত্তরণের কোনো উপায় দেখছেন কি?
আবু জামিল ফয়সাল: আমি মনে করি, পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য একটি স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করা যেতে পারে। তবে সেই কমিশন আমলাদের নেতৃত্বে হলে চলবে না। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির নেতৃত্বেও হতে পারে। বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিও থাকবেন। আমি মনে করি, স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের এটাই সেরা সময়।
প্রথম আলো: করোনার চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। এর সমাধান কী?
আবু জামিল ফয়সাল: সমাধান হলো কোভিড রোগীদের জন্য আলাদা হাসপাতালের দরকার নেই। একই হাসপাতালে কোভিড ও নন–কোভিড রোগীর চিকিৎসা হতে পারে। প্রবেশদ্বারে চিহ্নিত করতে হবে কে কোভিড আক্রান্ত, কে নন। কোভিড আক্রান্তদের জন্য আলাদা বিভাগ থাকবে। আলাদা জায়গা থাকবে। গত বছর কোভিড রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা ধ্বংস করা হয়েছে। এমনও দেখা গেছে হৃদ্রোগে আক্রান্ত রোগীকেও ভর্তি করা হয়নি কোভিড রোগীর কারণে। ফলে তিনি বিনা চিকিৎসায়ই মারা গেছেন। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
প্রথম আলো: সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ দল ও কমিটি করে। কিন্তু তারা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ কতটা শুনছে?
আবু জামিল ফয়সাল: এখানে পদ্ধতিগত সমস্যা আছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়ার পর কী হয়? সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সেই সুপারিশ বা পরামর্শ নিয়ে আলোচনা হয় বাস্তবায়নের জন্য। এ প্রক্রিয়ায় কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কোনো ভূমিকা থাকে না। যেমন বিশেষজ্ঞরা বললেন, সর্বাত্মক লকডাউন প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো জীবনের সঙ্গে জীবিকার কথাও ভাবেন। তাঁরা তাঁদের মতো সিদ্ধান্ত নেন। আমাদের পরামর্শ কাজে লাগছে কি না, তা–ও আমরা বলতে পারছি না। কেননা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় তো বিশেষজ্ঞদের রাখা হয় না।
প্রথম আলো: আপনি ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, ইউএনএইড, বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জানতে চাইছি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে তাদের সহায়তা কি যথেষ্ট বলে মনে করেন? এ ক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকদের কোনো ঘাটতি আছে কি না?
আবু জামিল ফয়সাল: এসব সংস্থা অর্থ দেয়। অর্থ ব্যবহারের গাইডলাইনও দেয়। কিন্তু সেই গাইডলাইন অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তাদের ভূমিকা থাকে না। তারা কেবল জানতে চায় তাদের প্রদত্ত অর্থ কোথায় ও কীভাবে খরচ হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে একটি জবাবও দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বদলি হওয়ার কারণে কাজে বিলম্ব হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১০ কোটি ডলার এবং ইউনিসেফের অর্থায়নে ১০ কোটি ডলারের স্বাস্থ্যসেবার যন্ত্রপাতি এনে বিমানবন্দরে ফেলে রাখা হলো। শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি জটিলতার কারণ দেখানো হলো। এর জবাব কী? প্রশ্ন হলো জনগণের করের হোক বা বিদেশিদের অনুদান হোক, সেই অর্থ খরচ কীভাবে হয়েছে, অপচয় হয়েছে কি না, তা যাচাই করার জন্য একটি কাঠামো থাকা দরকার। এ কারণেই আমি স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের কথা বলেছি।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আবু জামিল ফয়সাল: আপনাকেও ধন্যবাদ।