বিশেষ সাক্ষাৎকার

সার্কের দাফন হবে না, ফের জেগে উঠতে পারে: মুচকুন্দ দুবে

মুচকুন্দ দুবে
মুচকুন্দ দুবে
>বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ও পররাষ্ট্রসচিব মুচকুন্দ দুবে বর্তমানে দিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের (সিএসআর) সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন ইতিহাসবিষয়ক এক সেমিনারে। এ সময় তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচন, ভারত-পাকিস্তান বিরোধ ইত্যাদি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও ইফতেখার মাহমুদ।


প্রথম আলো: আপনি তো এবারে অনেক দিন পর ঢাকায় এলেন। কেমন দেখছেন?

মুচকুন্দ দুবে: বছর তিনেক পর এলাম। দেখলাম, আরও সুউচ্চ ইমারত। আরও বেশি যানজট।

প্রথম আলো: গেলবার প্রথম আলোর আয়োজনে আপনি লালনের ওপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন। একজন অবাংলাভাষী ভারতীয় কূটনীতিক লালন ফকিরকে নিয়ে কাজ করছেন, তাঁর গান অনুবাদ করেছেন, ভাবতেও অবাক লাগে।

মুচকুন্দ দুবে: আমি শুধু লালনের গান অনুবাদ করিনি, রবীন্দ্রনাথ ও শামসুর রাহমানের অনেক কবিতা হিন্দিতে অনুবাদ করেছি। ১৯৫৩ সালে আমি যখন ছাত্র ছিলাম, তখন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি অনুবাদ করি। গেল শতকের আশির দশকে আমি ঢাকায় হাইকমিশনার থাকাকালে হাইকমিশনে ফরিদা পারভীন গান গাইতে আসতেন। তখন থেকেই লালনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। হিন্দিতে লালনের ওপর আমার গবেষণা বই বের হয়েছে। আমি তাঁর বেশ কিছু গানও অনুবাদ করেছি। শামসুর রাহমান আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। ঢাকার কুট্টি ভাষায় লেখা ‘এই মাতোয়ালা রাইত’সহ তাঁর অনেক কবিতা আমি হিন্দিতে অনুবাদ করি। নির্মলেন্দু গুণের কবিতা আমি অনুবাদ করেছি।

প্রথম আলো: সামনে ভারতের লোকসভা নির্বাচন। জনসমর্থনের পাল্লা কোন দিকে ভারী বলে মনে করেন?

মুচকুন্দ দুবে: আমার ধারণা, নরেন্দ্র মোদি একটু এগিয়ে আছেন। সাম্প্রতিক কাশ্মীর-কাণ্ডের পর বিজেপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী মাঠে নেমেছেন। কিন্তু মাঠের প্রচারে বিজেপি এগিয়ে আছে।

প্রথম আলো: কিন্তু পাকিস্তানে ভারতীয় বিমান বিধ্বস্ত হওয়া ও বৈমানিক অভিনন্দন বর্তমানের সেখানে আটকের ঘটনায় তো শুনেছি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।

মুচকুন্দ দুবে: হ্যাঁ, ইমরানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে, তবে তা বহির্বিশ্বে। আর মোদির জনপ্রিয়তা বেড়েছে ভারতে। এই যে অভিনন্দন ফিরে এলেন, তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আটকের পর যে ধৈর্য ও সাহস দেখালেন, সেটি মোদির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফিরে আসার পর অভিনন্দনকে বীরোচিত সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস কাশ্মীর নিয়ে মোদির সমালোচনা করলেও প্রচারে তারা পিছিয়ে আছে।

প্রথম আলো: পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা কী ছিল? তারাও কি সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে?

মুচকুন্দ দুবে: ভারতীয় গণমাধ্যম অনেক মন্দ কাজে সমর্থন দেয়, যা প্রকাশ করলে পত্রিকার কাটতি বাড়বে, তারা তা–ই লেখে, প্রচার করে। কিন্তু আমার ধারণা, গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করেছে। যে ভাষায় তারা পাকিস্তানকে আক্রমণ করেছে, সেটা ভালো কিছু নয়।

প্রথম আলো: এটা কি উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব থেকে হয়েছে?

মুচকুন্দ দুবে: অনেক ক্ষেত্রে তা–ই। কারণ, সমাজের ভেতরে যা আছে তা তো গণমাধ্যমেও আসবে। অন্যদিক থেকে যদি দেখেন, যাঁরা ভিন্নমত দেন, ভিন্ন কথা বলেন, তাঁদের ওপরে নানা ধরনের আক্রমণ আসে। এক পক্ষকে বলা হয় আরবান মাওবাদী, আরেক পক্ষকে পাকিস্তানের দালাল। অনেক বুদ্ধিজীবীকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

প্রথম আলো: আসলে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান কী?

মুচকুন্দ দুবে: কাশ্মীর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হতে হবে। কিন্তু মোদি সরকার রাজনৈতিক সমাধানের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। তারা আরও কঠোর অবস্থানে গেছে। এতে সমাধান হওয়া কঠিন হবে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের আমলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি। তাঁর আত্মজীবনীতে এই সমস্যার একটি ভালো সমাধানের পথরেখা আছে। অর্থাৎ আলাপ-আলোচনা। মনমোহন সিংয়ের আমলে একজন কূটনীতিকও সমাধানের পথ দেখিয়েছেন। সবাই রাজনৈতিক সমাধানের ওপরই জোর দিয়েছেন।

প্রথম আলো: কাশ্মীর বা অন্য অনেক বিষয়ে মোদি সরকার কঠোর পথ বেছে নিচ্ছে কেন? ভারতের যে বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের ঐতিহ্য, তা কি প্রশ্নের মুখে?

মুচকুন্দ দুবে: চরমপন্থা দিয়েই মোদির উত্থান। সেই পথ দিয়েই তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তাই এই পথ তিনি কখনো ছাড়তে পারবেন না। ভারতের যে সহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজের দীর্ঘ ইতিহাস আছে, সেটি এখন অনেকটা হুমকির মুখে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব তো এখন দক্ষিণ এশিয়ায় উদাহরণ হয়ে উঠেছে। তারপরও এই দুই দেশের অনেক সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। যেমন তিস্তার পানিবণ্টন।

মুচকুন্দ দুবে: বাংলাদেশে একদল সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী আছেন, যাঁরা কিছু হলেই ভারতের দোষত্রুটি ধরার চেষ্টা করেন। এটা রাজনৈতিক কারণে হয়। আগে এটা বেশি ছিল, এখন কমেছে। তিস্তা চুক্তির কথা ধরুন, মনমোহন সিং চূড়ান্ত করেছিলেন। তারপরও কেন হয়নি, তা আপনারা জানেন। মমতাকে রাজি করানো যায়নি। নরেন্দ্র মোদিও তাঁকে রাজি করাতে অনেক চেষ্টা করেছেন। লাভ হয়নি। তবে একটি সমস্যার সমাধান না হওয়া সত্ত্বেও দুই দেশের অনেক বিষয়ে একমত হওয়ার জায়গা আছে। একমত হওয়ার বিষয়গুলো ধরে এগিয়ে যেতে হবে। কোনো পদক্ষেপ যদি দুই দেশের জন্যই লাভজনক হয়, তাহলে সেটি করা উচিত।

প্রথম আলো: দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ভূমিকা নিয়ে অনেক কথা উঠছে। ভারত-চীনের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে কি না?

মুচকুন্দ দুবে: চীনের বিষয়টি নিয়ে অনেক অতিরঞ্জন আছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর চীনের বিপক্ষে অনেক কথা বলেছেন। চীন পশ্চিমা দেশগুলোর প্রযুক্তি চুরি করছে—এমন অভিযোগও আনা হচ্ছে। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড পরিকল্পনা আছে। আবার নৌপথ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতেরও পরিকল্পনা আছে। তবে এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে বলে মনে হয় না। এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ করবে, এমন বাস্তবতা এখন নেই। ভারতের এলিট মধ্যবিত্তের একটি অংশ ও গণমাধ্যম চীনকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। আবার কেউ কেউ চীনের শক্তিকে বড় করে দেখছে। আমি মনে করি, চীন এখনো সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি, যে জায়গায় সে যেতে চায়। চীনকে আরও অনেক দূর এগোতে হবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ তো রাজনৈতিকভাবে ভারতের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ, কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য ও বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে চীনের ওপর নির্ভরশীল। এটাকে কীভাবে দেখছেন?

মুচকুন্দ দুবে: আমি এতে কোনো সমস্যা দেখি না। প্রতিটি দেশেরই তার নিজস্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যের ব্যাপারে পছন্দ থাকবে। বাংলাদেশের চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়া স্বাভাবিক। চীন বাংলাদেশকে যা দিতে পারবে, ভারত তা পারবে না। ভারতকে তা স্বীকার করতে হবে। ধরুন, জ্বালানি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশ যেভাবে সহযোগিতার সম্পর্কে যেতে পারবে, চীন তা পারবে না। আবার চীন বড় অবকাঠামোতে যেভাবে সহযোগিতা দিতে পারবে, সেটা তো ভারত পারবে না।

প্রথম আলো: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতি কি পাতানো খেলা?

মুচকুন্দ দুবে: নরেন্দ্র মোদি জানেন, পাকিস্তানের কাছে পারমাণবিক বোমা আছে। ফলে ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত কখন থামাতে হবে, তা-ও নিশ্চয়ই তিনি জানেন।

প্রথম আলো: দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্ক তো অক্কা পেয়েছে। কিন্তু এর আনুষ্ঠানিক দাফন তো হচ্ছে না!

মুচকুন্দ দুবে: সার্ক অক্কা পেলেও এর লাশ আমাদের অনেক দিন বহন করে যেতে হবে। এটিকে দাফন করা যাবে না। কারণ, এটি আবার যেকোনো সময় জেগে উঠতে পারে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের ২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে নানা ধরনের পর্যবেক্ষণ এসেছে। অনেক দেশ বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ভারতের বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্লেষকেরাও একই মত দিচ্ছেন।

মুচকুন্দ দুবে: একটি দেশের নির্বাচন বা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কোন দেশ কোন ধরনের অবস্থান নেবে, তা নির্ভর করে ওই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশে অনেক ব্যবসায়িক স্বার্থ আছে। ফলে তারা তাদের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবস্থান নিয়েছে, ভবিষ্যতেও নেবে।

প্রথম আলো: আপনি তো ভারতের আর্থসামাজিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। সরকারের নানা উদ্যোগ নিয়ে সমালোচনা করেন। কোনো চাপ অনুভব করেন কি না?

মুচকুন্দ দুবে: আমরা গরিব মানুষের পক্ষে কাজ করি। সরকারের বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করি। আমরা দেখি, সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত গরিব মানুষের পক্ষে না বিপক্ষে যাচ্ছে। আমি কিছুদিন আগে একটি লেখায় বলেছি, ভারতের সাড়ে চার কোটি শিশু শিক্ষাবঞ্চিত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় শিশুদের স্কুলে ভর্তির হার শতভাগ। কিন্তু তারপর অনেক শিশু ঝরে যায়। এগুলো আমরা বলি।

প্রথম আলো: গরিব মানুষের প্রতি নীতির ক্ষেত্রে বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে তো পার্থক্য আছে?

মুচকুন্দ দুবে: খুব কম। আগে কংগ্রেসের কিছু কিছু নীতি গরিব মানুষের পক্ষে থাকত। কিন্তু এখন তাদের ওপরও করপোরেটদের প্রভাব বাড়ছে। বিজেপির ওপর সেই প্রভাব অনেক বেশি। বলতে পারেন, তাদের বেশির ভাগ নীতি ও পরিকল্পনা করপোরেটদের স্বার্থে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ভারতকে যা দিয়েছে, তা তাদের অনেক দিন মনে রাখতে হবে।’

মুচকুন্দ দুবে: হ্যাঁ, বাংলাদেশ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিগুলো উচ্ছেদ করেছে, এখানে যেসব শীর্ষ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ছিলেন, তাঁদের ভারতে ফেরত পাঠিয়েছে। ভারতের নিরাপত্তার ঝুঁকি কমাতে এটা বড় পদক্ষেপ বলে মনে করি।

প্রথম আলো: এই মুহূর্তে ভারতের সামনে বড় সংকট কী?

মুচকুন্দ দুবে: ভারতের বহুত্ববাদী সমাজ আক্রমণের মুখে। এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। তবে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়াও আছে। কয়েকটি রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তারা হেরে গেছে। সম্প্রতি কাশ্মীর-সংকটের মধ্য দিয়ে বিজেপি আবারও জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মুচকুন্দ দুবে: আপনাদেরও ধন্যবাদ।