দেশের সবচেয়ে বড় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন ও শতভাগ বিদ্যুতায়নের নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মহিউদ্দিন
প্রথম আলো: বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সবার আগে উৎপাদনে এসেছে পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
নসরুল হামিদ: গত ৫০ বছরের ইতিহাসে কম সময়ে এমন বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য বড় সাফল্য। প্রকল্পের ব্যয় বা মেয়াদ বাড়েনি; বরং টাকা সাশ্রয় হয়েছে। জমি অধিগ্রহণসহ এ প্রকল্পের কোনো কিছু নিয়ে বিতর্ক ওঠেনি। পরিবেশদূষণসহ বিশেষজ্ঞরা নানা শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। দুই বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, ক্ষতিকর কিছুই ঘটেনি। কেউ চাইলে গিয়ে দেখে আসতে পারেন।
প্রথম আলো: এমন বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দক্ষিণাঞ্চলকে বেছে নেওয়ার বিশেষ কোনো কারণ ছিল?
নসরুল হামিদ: পদ্মা সেতু এ অঞ্চলের ১৯ জেলাকে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করছে। দক্ষিণাঞ্চলে বন্দর হচ্ছে, শিল্পকারখানা হচ্ছে, নতুন হাউজিং হচ্ছে। একের পর এক বিনিয়োগ হচ্ছে, আরও হবে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ইতিমধ্যে এখানকার জীবনমান বদলে দিয়েছে; মানুষ ছোট-বড় বিনিয়োগে ঝুঁকছে, এখানকার অর্থনীতি বদলে যাচ্ছে। যদিও আমলাতন্ত্র, বিশেষজ্ঞসহ নানা দিক থেকে বাধা ছিল। সব দিক ভেবেই কেন্দ্রটি নির্মাণে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চলকে বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রথম আলো: শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা হলো। কীভাবে এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এগিয়ে নিলেন?
নসরুল হামিদ: ২০২১ সালের মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়ন করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশের দিকে যেতে এটি করা জরুরি ছিল। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। তাঁর নেতৃত্বে এ মন্ত্রণালয় ও অধীন সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দলগতভাবে কাজ করেছেন। এর ফলে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্ভব হয়েছে। এডিপি বাস্তবায়নে আগে থেকেই এক নম্বরে এ মন্ত্রণালয়। এখন শতভাগ বিদ্যুতায়ন এ মন্ত্রণালয়ের জন্য শতভাগ সাফল্যের একটি দৃষ্টান্ত।
প্রথম আলো: দেশের সব উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়ন হলো, এতে কি দেশের সব গ্রামে বিদ্যুৎ–সুবিধা পৌঁছে গেল?
নসরুল হামিদ: অবশ্যই, দেশের প্রতিটি এলাকায় বিদ্যুৎ–সুবিধা পৌঁছ গেছে। প্রাথমিকভাবে বিচ্ছিন্ন চর ও দুর্গম পাহাড়ে লক্ষ্য ছিল সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহের। ৬০ লাখ ঘরে সোলার হোম সিস্টেম করা হয়েছে। কিন্তু সৌরবিদ্যুৎ মূলত রোদের ওপর নির্ভর করে। সব সময় তারা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। কিন্তু নিজ এলাকাকে ব্যবসা-বাণিজ্যর কেন্দ্র বানাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চায় তারা। তাই নদী-সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেব্ল টেনে এসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ–সুবিধা পৌঁছানো হচ্ছে। এটা একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ। তবু নির্ধারিত সময়ের আগেই শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ শেষ করা হয়েছে।
প্রথম আলো: সমুদ্র-নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেব্ল টানা, বিচ্ছিন্ন পাহাড়ে সংযোগ–সুবিধা নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ব্যয়বহুল ও জটিল, এটা নিয়ে আপনারা কী ভেবেছেন?
নসরুল হামিদ: বাণিজ্যিকভাবে এটা কোনোভাবেই লাভজনক নয়। কিন্তু সরকারের কাজ তো ব্যবসা করা নয়। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকের কথা চিন্তা করতে হয়। এটাই সরকারের দায়িত্ব। এসব গ্রামের একটি বাড়ি থেকে ১০০ বছর বিল নিলেও আরইবির খরচ উঠবে না। কিন্তু বিদ্যুৎ–সুবিধা পেয়ে ছেলেমেয়েদের রাতে লেখাপড়ার ব্যবস্থা হয়েছে। হাটবাজারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে। বিনিয়োগের বিপরীতে এটার মূল্য অনেক। আর এসব কারণেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলো: বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা অর্ধেকের বেশি, এটা নিয়ে নানা বিতর্কও আছে, আপনি কী বলবেন?
নসরুল হামিদ: ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেই শতভাগ বিদ্যুতায়নের চিন্তা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময়েই বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার কথা চিন্তা করেন তিনি। এ নিয়ে অনেক বাধা ছিল। কিন্তু বেসরকারি খাত ছাড়া এটা অসম্ভব ছিল। বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসায় বিদ্যুৎ খাতে একটা বিরাট ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এ খাতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে। কাজের মধ্যে তুলনা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে জবাবদিহি বেড়েছে।
প্রথম আলো: সহনীয় দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি, এটা নিয়ে কী ভাবছেন?
নসরুল হামিদ: সহনীয় দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের চ্যালেঞ্জ এখন সামনে। বিদ্যুৎ–সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হলেও মানুষের আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে বিদ্যুতের মূল্য ধরে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই যেন সরবরাহ ব্যাহত না হয়, সে দিকটি খেয়াল রাখতে হবে। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য সমন্বিত মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।