>
অধ্যাপক এম শামসুল আলম। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল অনুষদের ডিন ও ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় গঠিত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন দেশের জ্বালানি খাতের বর্তমান পরিস্থিতি, সংকট ও সম্ভাবনার দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো: বিদ্যুৎ খাতের অবস্থা কী? একদিকে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে।
এম শামসুল আলম: বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের প্রধান বাধা নীতি-পরিকল্পনায় দুর্বলতা। সরকার বাস্তবতার নিরিখে পরিকল্পনা নেয়নি। ভোক্তার স্বার্থ না দেখে ব্যবসায়িক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। প্রায় শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ–সংযোগ পাচ্ছে। উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের ক্ষমতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু গ্রাহকের বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষমতা স্বল্প হওয়ায় কম বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে এবং বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় বাড়ছে। ফলে আর্থিক ঘাটতি বাড়ায় ভর্তুকি ও মূল্যবৃদ্ধি দুটোই বেড়ে চলেছে।
প্রথম আলো: কিন্তু সরকার তো বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়নের দাবি করে থাকে।
এম শামসুল আলম: প্রকৃত অর্থে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন হয়নি। বরং শতভাগ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। ঢাকার বাইরে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। কারণ, বিতরণব্যবস্থার দুর্বলতা। আবার বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে। অভিযোগ রয়েছে, ভর্তুকি কমানোর জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনও এখন কম করা হয়। বাস্তবে দেখা যায়, সক্ষমতা উন্নয়নে মান রক্ষা না হওয়ায় চাহিদার তুলনায় উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণক্ষমতা পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ–বিভ্রাট নিয়ন্ত্রণে নেই। ১০ ডলারের মিটার ২৫ ডলারে কিনে প্রান্তিক ভোক্তার ৩০ টাকারও কম বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে মাসে ৪০ টাকা মিটার ভাড়া আদায় করে। চুক্তির প্রথম মেয়াদেই প্রদত্ত ক্যাপাসিটি চার্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ব্যয় উশুল হয়েছে অথচ এরপর চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও সেই চুক্তির মেয়াদ বারবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে অথচ চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো অব্যাহত রাখা হয়েছে। গ্যাস–সংকটের কারণে কম দামে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়েছে। অথচ সেই গ্যাস ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দিয়ে সেখান থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। নিজস্ব গ্যাস ও কয়লা সাশ্রয়ী মূল্যে উত্তোলন ও ব্যবহারে দিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমদানিকৃত কয়লা, এলএনজি ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে কৌশলে বিদ্যুৎ খাতের এমন সব উন্নয়ন হয়েছে, যা ভোক্তা বা গণবান্ধব নয়, অসাধু ব্যবসাবান্ধব।
প্রথম আলো: ২০১০ সালে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছিল। প্ল্যান অনুযায়ী কাজ এগোচ্ছে কি?
এম শামসুল আলম: এ পরিকল্পনা করানো হয় জাপানি সংস্থা জাইকাকে দিয়ে। আবার তারাই বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা সরবরাহকারী জাপানি ঠিকাদারের অর্থের জোগানদাতা। কোল টার্মিনালও জাপানি অর্থায়নে হচ্ছে। অর্থাৎ কয়লা বিদ্যুৎ ঘিরে একটি বড় ব্যবসা জাপান পেয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানটি যদি তারা না করত, তবে সমস্যা ছিল না। কারণ, তাতে স্বার্থের সংঘাত হতো না। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ কয়লা বিদ্যুতের মূল্য অনেক বেশি হবে। দুর্ভাগ্য, আমরা দেশীয় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করতে পারি না। জাতীয় সক্ষমতাকে গুরুত্ব দিই না।
প্রথম আলো: রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। সরকার এগুলো অবসায়নের কথা ভাবছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
এম শামসুল আলম: বিদ্যুৎ–সংকটের দোহাই দিয়ে সরকার অনেক কোম্পানিকে এ সুযোগ দিয়েছিল। রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধারণাটি জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী। কোম্পানিগুলো থেকে সরকার উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনেছে। ১০ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ দিয়ে তাদের তেল আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে, বিদ্যুৎ ব্যবসার পাশাপাশি তেলের ব্যবসাও দিয়েছে।তা ছাড়া উৎপাদন করুক বা না করুক সরকারকে ভাড়া গুনতে হচ্ছে। একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী রেন্টাল, কুইক রেন্টালের নামে অসাধু ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে যাচ্ছে। আমরা বলেছিলাম, রেন্টাল, কুইক রেন্টালের দরকার নেই। পিডিবির সক্ষমতা বাড়ালে তারাই এ বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারবে।
প্রথম আলো: আপনারা বলছেন সরকার আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু দাম না বাড়ালে ভর্তুকির পরিমাণ তো বেড়ে যাবে।
এম শামসুল আলম: আমাদের গবেষণায় দেখিয়েছি, সরকারের লক্ষ্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বাজার সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ করা। নানা কৌশলে সরকার সে লক্ষ্য অর্জনে অগ্রসর হচ্ছে। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ হলেও সাহায্য সংস্থার চাপে বা পরামর্শে সরকার তা করছে। বিচার–বিশ্লেষণে দেখেছি, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নয়, কমানো যায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে আর্থিক ও কারিগরি দিক থেকে স্বনির্ভর করা যায়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণ দেখি না। জ্বালানিসংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থায় যত টাকা মজুত আছে, সেটাসহ গ্যাস ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল এবং জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের অর্থে এ খাতে আর্থিক ও কারিগরি সক্ষমতা কত অনায়াসেই অর্জিত হতে পারে। শুধু দরকার সরকারের নীতিকৌশলে পরিবর্তন। আমরা বলেছি, দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণেই মানুষ সঠিক দামে, সঠিক মাপে ও সঠিক মানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত।
প্রথম আলো: করোনা সংকটের সময় বিদ্যুৎ বিভাগ গ্রাহকদের কাছে ভুতুড়ে বিল পাঠিয়েছে। এর কারণ কী অসততা না অদক্ষতা?
এম শামসুল আলম: দুটোই। তাদের অসততা আছে। অর্থবছরের শেষে আদায় বেশি দেখাতে পারলে কিছু প্রণোদনা পাওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার ১৩০ শতাংশ আদায় দেখানো হয়েছে। আর অসততা ও গাফিলতি তো আছেই। আগের মাসের বিল দেখে করলেও টাকার অঙ্ক অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে যেত না।
প্রথম আলো: বিদ্যুৎ খাতের এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
এম শামসুল আলম: উত্তরণের পথ সোজা। স্বাধীনতার পর পেট্রোবাংলা করা হয়েছিল জ্বালানি খাতকে স্বনির্ভর করতে। কিন্তু পূর্বাপর সরকার সেটিকে পরনির্ভরশীল করে ফেলেছে। জ্বালানি বা বিদ্যুৎ খাত কীভাবে চলবে, সেই সিদ্ধান্ত আমলারা নিলে চলবে না। বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) অংশীজনের সঙ্গে কথা বলুক। বিদ্যুৎ বিভাগেরও কথা শুনুক। দেশের সম্পদ কীভাবে রক্ষা করা যাবে, কীভাবে মানুষের কাছে বিদ্যুৎ সহজলভ্য হবে, সেটা ভাবতে হবে। বাইরের কারও পরামর্শে জ্বালানি খাত চললে দেশের সর্বনাশ হবে। সরকারকে ব্যবসার চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারের আমলারা সরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ কোম্পানির চেয়ারম্যান হয়ে আছেন। তাঁদের দিয়ে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে না। তাই সবার আগে তাঁদের কোম্পানির পরিচালনা বোর্ড থেকে অবমুক্ত হতে হবে।
প্রথম আলো: সারা বিশ্ব এখন নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। এ ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি কেন?
এম শামসুল আলম: এখানেও সরকারের ভুল নীতি। ইতালির মতো অনেক দেশ রুফ টপ ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। শহরের ভবনগুলোর সিংহভাগ বিদ্যুৎ চাহিদা এই বিদ্যুতেই মেটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা খরচ বেশির দোহাই দিয়ে সৌরবিদ্যুতে আগ্রহ দেখাচ্ছি না। কারণ, বিদ্যমান ভর্তুকিনির্ভর গ্রিড বিদ্যুৎ ব্যবসা সুরক্ষার স্বার্থে। স্থানীয়ভাবে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ও সরবরাহ সম্ভব। কিন্তু আমরা সব গ্রাহককে জাতীয় গ্রিডে আনার ব্যয়বহুল ভুল পথে নিয়েছি। জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে অর্থ চুরি ও তছরুপ বেশি করা যায়। আমরা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়িয়েছি। ভর্তুকি দিচ্ছি। এর দায়ভার বহন করতে হচ্ছে জনগণকেই।
প্রথম আলো: গ্যাস খাতের উন্নয়নে সরকার কী করেছে?
এম শামসুল আলম: ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে কিছু ভয়ংকর কাজ করেছে। গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এ টাকার জোগান দিয়েছে জনগণ। অথচ গ্যাসক্ষেত্রের সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করেছে বাপেক্স। কিন্তু গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে বিদেশি কোম্পানি দিয়ে। ভোলার গ্যাসক্ষেত্রে অনুসন্ধান করল বাপেক্স। কিন্তু কাজ দেওয়া হলো রাশিয়ান কোম্পানিকে। এখন জল-স্থলে সব গ্যাস তোলার অধিকার এ কোম্পানিকে দেওয়ার জন্য স্মারক চুক্তি হলো। এ খাতে জাতীয় সক্ষমতা অর্জনের সব সম্ভাবনা জলে গেল। ভোলায় গ্যাস পর্যাপ্ত। বাপেক্স উত্তোলন করলে দাম কম পড়ত। বিদেশিরা উত্তোলন করায় বেশি পড়বে। মডেল পিএসসিতে বিদেশি কোম্পানির গ্যাস ক্রয়মূল্য যেভাবে বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তাতে একসময় বলা হবে গ্যাস তুলে লাভ নেই। আমদানি করাই ভালো। ভোক্তার ব্যয় কম হবে। ভোলার গ্যাস দিয়ে খুলনাসহ গোটা দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের চাহিদা মেটানো যেত। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হতো না। গ্যাসের উৎস নিশ্চিত না হলেও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে গ্যাস বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন বসানো হয়েছে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
এম শামসুল আলম: আপনাকেও ধন্যবাদ।