প্রথম আলো: সাংবাদিক সংগঠনগুলোর সাম্প্রতিক আন্দোলনে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য অশনিসংকেত সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য নানা ধরনের আইনি বাধা তৈরি করা হচ্ছে বলে মনে করেন কি?
রেজোয়ানুল হক: স্বাধীন সাংবাদিকতা দুনিয়াজুড়েই চাপের মুখে রয়েছে। রোজিনা ইসলামকে নিয়ে আন্দোলনের মধ্যেই আমরা দেখলাম বেলারুশ সরকারের অপছন্দের এক সাংবাদিককে বহনকারী উড়োজাহাজের গতিপথ বদল করে অনেকটা জোর করে দেশটির বিমানবন্দরে নামিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রোজিনার ঘটনাটি কিছুটা অশনিসংকেত তো বটেই। এর মাধ্যমে অন্য সাংবাদিকদের বার্তা দেওয়া হয়েছে। অথবা তাঁরা (সাংবাদিকেরা) নতুন করে উপলব্ধি করেছেন যে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ সাংবাদিকতা, বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার তথ্য দুনিয়ার সবখানেই গোপনেই জোগাড় করতে হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারাও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা তৈরি করেছে। এখন শতবর্ষী অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সামনে আনা হলো। অথচ তার অনেক পরে প্রণীত সংবিধান, তথ্য অধিকার আইন এবং জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইনের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ ও ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে উৎসাহ দেয়। শুধু তা-ই নয়, ২০১১ সালে প্রণীত জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইনের ৪, ৫ ও ১৪ ধারায় তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। এমনকি তথ্য প্রকাশকারীকে পুরস্কৃত করার কথাও বলা হয়েছে।
প্রথম আলো: সাংবাদিক নেতারা বলছেন, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা সরকার ও গণমাধ্যমকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেন এমন পরিস্থিতি তৈরির সুযোগ পাচ্ছেন কর্মকর্তারা?
রেজোয়ানুল হক: রোজিনার ঘটনাটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার কাণ্ড, সরকারের নয়। কিন্তু এই ঘটনার জন্য দেশে-বিদেশে পুরো সরকারকেই সমালোচনার মুখে পড়তে হলো। এভাবেই প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা সরকার ও গণমাধ্যমকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছেন, ওই দিনের ঘটনাটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপস্থিত কর্মকর্তারা ঠিকভাবে সামাল দিতে পারেননি বলেই পরে তা অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। ঘটনাটি সেখানেই মিটিয়ে ফেলা যেত। আমলাতন্ত্র এখন অনেক ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতা প্রকাশের প্রবণতাও দিন দিন বাড়ছে। আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার সাম্প্রতিক দুটো উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। এক. করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো দেখভালের জন্য প্রতি জেলায় সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, মন্ত্রী বা এমপিদের নয়। দুই. দেশে মহামারি দেখা দিলে এবং সংক্রামক ব্যাধি আইন অনুযায়ী দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দেওয়া হলে তা সামাল দেওয়ার জন্য বিধিনিষেধ আরোপসহ সব ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার এ আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের। তাঁকে সহযোগিতা করবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উপদেষ্টা কমিটি। কিন্তু আমরা দেখছি, সব ব্যবস্থা নিচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
প্রথম আলো: সাংবাদিকেরা ডিজিটাল আইনের বড় শিকার হচ্ছেন, এতে সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে সেলফ সেন্সরশিপ তৈরি হচ্ছে কি না?
রেজোয়ানুল হক: সেলফ সেন্সরশিপ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই কথা হচ্ছে। এটা আছে। তবে এ জন্য শুধু ডিজিটাল আইনকে দুষলে হবে না। স্বাধীন সাংবাদিকতা সব সরকারেরই অপছন্দের বিষয়। একে বাগে রাখতে যুগে যুগে আইনসহ নানা ধরনের বাধা তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে এর মধ্য থেকেই সাংবাদিকতা করতে হয়। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে নতুন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা আরও মারাত্মক। আগে গণমাধ্যম এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের একটাই স্বার্থ ছিল—জনগণকে তথ্যসেবা দেওয়া। এখন আরও অনেক স্বার্থ যুক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক, আর্থিক, ব্যবসায়িক ইত্যাদি। সেলফ সেন্সরশিপের জন্য এগুলোরও বড় অবদান আছে।
প্রথম আলো: সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের প্রতি সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় ক্ষমতাবান গোষ্ঠীগুলোর অসহিষ্ণু আচরণ দেখা যাচ্ছে। সুশাসনের ঘাটতির কারণেই কি এমনটি ঘটছে বলে মনে করেন?
রেজোয়ানুল হক: রোজিনার ঘটনাটির মধ্যেই এ প্রশ্নের জবাব রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে সাড়াজাগানো বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন করেছিলেন। এতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, বিশেষ করে যাঁরা এসব দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা রোজিনার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। একদিকে বিপুল ক্ষমতা, অন্যদিকে দুর্নীতি-অনিয়মের খবর প্রকাশ পাওয়ায় বেকায়দায় পড়ার কারণে ক্ষোভ—সব মিলিয়ে এই অসহিষ্ণু আচরণ। আরও সরাসরি বললে, আমলাতন্ত্রের দুর্নীতিবাজ অংশটি তাদের অবৈধ সম্পদ রক্ষায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এখনো দেশের গণমাধ্যমে দুর্নীতি-অনিয়মের অনেক খবর প্রকাশিত/প্রচারিত হয়। দুর্নীতিবাজেরা তাই সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের প্রতি ক্ষিপ্ত।