রানা দাশগুপ্ত। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর। গত শুক্র ও গতকাল শনিবার ঐক্য পরিষদের সম্মেলন হলো। এ সম্মেলনে উত্থাপিত দাবিনামা এবং বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সার্বিক সমস্যা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন রানা দাশগুপ্ত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনোজ দে
প্রথম আলো: আপনারা তো সেক্যুলার বাংলাদেশ চান। কিন্তু আপনাদের সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সম্প্রদায়ভিত্তিক সংগঠন। কেন এ ধরনের সংগঠন করলেন?
রানা দাশগুপ্ত: মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ছিল বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান আমরা সবাই বাঙালি। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে পরিষ্কার করে বলা হয়েছিল, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সাম্য, সমতা ও সামাজিক মর্যাদা সুনিশ্চিত করা হবে। এ ঘোষণার প্রতি আস্থা রেখেই আমরা (ধর্ম যার যেটা হোক না কেন) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে আসা হলো। জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিলেন। এরপর অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়। সে সময় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো জোরালো প্রতিবাদ করেনি। এ প্রেক্ষাপটেই হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জন্ম।
প্রথম আলো: কিন্তু সে সময়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম দলসহ প্রায় সব বিরোধী দল রাষ্ট্রধর্ম বিলের বিরোধিতা করেছিল।
রানা দাশগুপ্ত: রাষ্ট্রধর্ম প্রস্তাব সংসদে উত্থাপনের আগে তাদের কোনো বিরোধিতা দেখিনি। বিলটি যখন পাস হয়ে গেল, তখন তাঁরা অর্ধদিবস হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। সংবাদপত্রের ভাষায় সেই হরতাল হয়েছে ঢিলেঢালা।
প্রথম আলো: কবে যাত্রা শুরু হলো ঐক্য পরিষদের?
রানা দাশগুপ্ত: রাষ্ট্রধর্ম বিল সংসদে উত্থাপিত হওয়ার পর। মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যালঘুদের মধ্যে কোনো রাজাকার, আলবদর ছিলেন না। তাঁরা নির্বিচার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, গণধর্ষণ ও গণধর্মান্তরের শিকার হয়েছিলেন। এক কোটি লোক ভারতে শরণার্থী হিসেবে গিয়েছিলেন, তাঁদের ৯০ শতাংশ ছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এত ত্যাগ স্বীকার করার পরও আমাদের রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হলো।
প্রথম আলো: কোনো কোনো গবেষক বলে থাকেন, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কম ছিল। তাঁরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানেই নিরাপদ বোধ করেছিলেন।
রানা দাশগুপ্ত: ওই গবেষকেরা কি আমাদের বলতে পারবেন, ’৭১ সালে কোনো মুসলিম পল্লিতে গণহত্যা হয়েছে? রাজনৈতিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের বাড়ি জ্বালানো হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে, ধর্ষণ চালানো হয়েছে। কিন্তু অপারেশন সার্চলাইটে উল্লেখ ছিল, হিন্দুদের নির্মূল করো, ধ্বংস করো। প্রশ্ন হলো, যে নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, তিনি কি মুক্তিযোদ্ধা নন? যাঁর বাড়িটা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তিনি কি মুক্তিযোদ্ধা নন? গণহত্যার শিকার যাঁরা হয়েছিলেন, তাঁরা কি মুক্তিযোদ্ধা নন?
প্রথম আলো: অনেকে বলেন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের যে অনুপাত, সে তুলনায় চাকরি–বাকরিতে তাঁদের সংখ্যা বেশি।
রানা দাশগুপ্ত: যাঁরা এগুলো বলেন, তাঁরা অপপ্রচার চালান। তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে পাকিস্তান আমলের মতো সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করুক। গত এক দশকে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, এসএসএফ, সেনাবাহিনী, পুলিশে সংখ্যালঘুদের নিয়োগ-পদোন্নতি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যে বৈষম্যটা ছিল, তার কিছুটা প্রতিকার হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে নিয়োগ-পদোন্নতি সংখ্যালঘুরা এখনো পাননি।
প্রথম আলো: ঐক্য পরিষদ কি রাজনৈতিক দলে রূপ নেবে?
রানা দাশগুপ্ত: আমরা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করি না। ঐক্য পরিষদের আন্দোলনটা ধর্মীয় আন্দোলন নয়। আমরা আমাদের সংগঠনকে একটা মানবাধিকার আন্দোলন রূপে দেখতে চাই। আমাদের দুজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, তাঁরা হলেন আমেরিকার মার্টিন লুথার কিং ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা। আমাদের মূল দাবি, বাংলাদেশ ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাক। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিক। সাম্য, সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে ঐক্য পরিষদেরও প্রয়োজন থাকবে না।
প্রথম আলো: জাতীয় হিন্দু মহাজোট নামে একটি সংগঠন গড়ে উঠেছে। তারা কি আপনাদের প্রতিদ্বন্দ্বী?
রানা দাশগুপ্ত: না, তারা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। সংগঠনটির মূল নেতা শহীদজননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সময় গৃহে অন্তরীণ থেকে মুক্তি পাওয়া গোলাম আযমকে ফুল দিয়েছিলেন। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁকেও ফুলের মালা দিয়েছিলেন। তারা মূলত দ্বিজাতি তত্ত্ব ফিরিয়ে আনতে চায়। এখানেই তাদের সঙ্গে আমাদের মূল দ্বন্দ্ব।
প্রথম আলো: সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বিবৃতিকে আপনারা সমালোচনা করেছেন। আপনাদের বিবৃতির প্রতিবাদ করেছে হিন্দু মহাজোট। এর ব্যাখ্যা কী?
রানা দাশগুপ্ত: পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতির প্রতিবাদ করেছি আমরা, তাঁরই জবাব দেওয়ার কথা। কিন্তু জোট জবাব দিল। অর্থাৎ ভূতের মুখে রাম নাম। এর কার্যকারণটা খুঁজে বের করা দরকার।
প্রথম আলো: প্রথম আলোর সঙ্গে আগে সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন রাজনীতিকেরা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এখনো কি সেই অবস্থানে অটুট?
রানা দাশগুপ্ত: রাজনীতিকেরা যদি কথা দিয়ে কথা রাখতেন, তবে বাংলাদেশ তো বাংলাদেশই থাকত। আজকের বাংলাদেশ তো বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ নয়। প্রতারণা তো শুরু হয়ে গেছে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। যে অলি আহাদকে আমরা একসময় নমস্য ব্যক্তি মনে করতাম, যিনি মুসলিম নামের কারণে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেননি, তিনিই স্বাধীনতার পর বিবৃতি দিয়ে আজাদ বাংলা কায়েম করার কথা বললেন। প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা আবদুল হক জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে চিঠি লিখে অস্ত্র চেয়েছিলেন।
প্রথম আলো: বামপন্থী লেখক-রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিভূমি নেই। যা আছে সেটা ধর্মের নামে রাজনীতি ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা।
রানা দাশগুপ্ত: বাংলাদেশে সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তিক, সাংবিধানিক, প্রশাসনিক সাম্প্রদায়িকতা আছে। এখানে সাম্প্রদায়িকতার উৎস হচ্ছে বর্তমান সংবিধান। রাষ্ট্রধর্ম সাম্প্রদায়িকতার উৎস হিসেবে কাজ করছে। হামলার শক্তিটা ওখান থেকেই পাচ্ছে।
প্রথম আলো: আপনারা সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার। কিন্তু রাষ্ট্রে যখন বিরোধী দল, বিরোধী মত, নাগরিক সমাজ কিংবা গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা চলে, তখন আপনারা কেন কথা বলেন না। প্রতিবাদ করেন না।
রানা দাশগুপ্ত: অবশ্যই প্রতিবাদ করি। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে যখন গ্রেপ্তার করা হলো, আমরা প্রতিবাদ করেছি। মুক্তবুদ্ধির চর্চা যাঁরা করেন, তাঁদের ওপর যখন হুমকি আসে, তখনো আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করি। এখানে গণতন্ত্রের যে সংকট, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতার সংকট। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের মৌল বিষয়ে বিরোধ থাকা উচিত নয়। স্বাধীনতার প্রশ্নে, রাষ্ট্রীয় মৌলনীতির প্রশ্নে ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রশ্নে সবাইকে এক জায়গায় আসতে হবে।
প্রথম আলো: সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারতের ঘটনাবলি আমাদের এখানেও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তৈরি করে? এ বিষয়ে আপনাদের অভিমত কী?
রানা দাশগুপ্ত: আজ ভারতের রাষ্ট্রধর্ম হিন্দুত্ববাদ করার জন্য স্লোগান উঠছে। ভারতের মৌলবাদের এই ধারা ১০ বছরের। আমাদের এখানে এটা শুরু হয়েছিল ’৭৫-এর পর। শুধু বাংলাদেশ, ভারত নয়; উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধর্মকে ধর্মের জায়গায় রেখে রাষ্ট্রকে যদি সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখার সিদ্ধান্ত না নিতে পারেন, তাহলে বড় মানবিক বিপর্যয় আসন্ন।
প্রথম আলো: একটা সাধারণ অভিযোগ, আপনারা আওয়ামী লীগের প্রতি অতিশয় নির্ভরশীল। বিএনপিতে তো অনেক হিন্দু নেতা রয়েছেন।
রানা দাশগুপ্ত: কোনো বিশেষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আমাদের নির্ভরশীলতা নেই। আমাদের নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের মৌল নীতির প্রতি। কিন্তু যখন ভোট আসে, তখন আমাদের মূল উদ্বেগের বিষয় হয়, আবার তালেবান আসবে না তো? এই ভয়টা কিন্তু শুধু সংখ্যালঘুদের নয়, এই ভয় দেশের মুক্তচিন্তার ও গণতান্ত্রিক সব মানুষেরও।
প্রথম আলো: সম্প্রতি দুর্গোৎসবে যে হামলা ও সহিংসতা হলো, তাতে কি সরকারি দলের লোকজন জড়িত ছিল না?
রানা দাশগুপ্ত: আওয়ামী লীগ, যুবলীগের অনেক নেতা জড়িত ছিলেন। ১৯৯০ সালে এরশাদের আমলে তিন দিন, একানব্বইয়ে নির্বাচনের পর বিএনপির আমলে ২৭ দিন, ২০০১-২০০৬ বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে একটানা পাঁচ বছরের সাম্প্রদায়িক যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে সাহাবুদ্দীন কমিশনের সুপারিশ ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করেনি বর্তমান সরকার। তাহলে যে প্রশ্ন সামনে চলে আসে সেটা হলো, সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কি গোপন আঁতাত রয়েছে?
প্রথম আলো: ভারতে হিন্দু সংগঠনগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনীর ছয়জন সাবেক প্রধান। ভারতে মুসলিমবিদ্বেষের প্রভাব তো বাংলাদেশেও পড়তে পারে?
রানা দাশগুপ্ত: আমিও তাঁদের বিবৃতিটি পড়েছি। ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা যেখানেই হোক, আমরা তার বিরোধিতা করি। আমরা ভারতকে যেমন সেক্যুলার দেশ হিসেবে দেখতে চাই, তেমনি বাংলাদেশকেও। অনেকে ভারত, ব্রিটেন, আমেরিকাকে সেক্যুলার দেশ হিসেবে দেখতে চান। কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্ন এলেই বলেন, এখানে ৯০ শতাংশ মুসলমান, তাই রাষ্ট্রধর্ম থাকতে হবে। এ কারণে আমরা বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানাই।
প্রথম আলো: কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানে তো বাঙালির বাইরে কোনো জনগোষ্ঠীর জাতিগত স্বীকৃতি নেই। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা সবাই বাঙালি।
রানা দাশগুপ্ত: পঞ্চদশ সংশোধনীতে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হলো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে। আমরা বলেছিলাম তাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, সেটা করা হয়নি। রাষ্ট্রের ভেতরে যাঁরা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার দিতে চান, তাঁরাই এটি করেছেন। মন্ত্রী হওয়ার আগে এঁরা আদিবাসীদের ব্যানার নিয়ে মিছিল করেন, মন্ত্রী হওয়ার পর বলেন বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই।
প্রথম আলো: বহুল আলোচিত অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন জারি হওয়ার পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কতজন জমি ফেরত পেয়েছেন?
রানা দাশগুপ্ত: আমাদের হিসাব অনুযায়ী, ১ লাখ ৬২ হাজার মামলা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু জমি ফেরত পেয়েছেন ৭ থেকে ১০ শতাংশ।
প্রথম আলো: সংখ্যালঘুদের মধ্যে যাঁরা প্রান্তিক ও দুর্বল, তাঁরাও কি সমান হারে সম্পত্তি ফিরে পেয়েছেন, না এ ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে।
রানা দাশগুপ্ত: বৈষম্য তো আছেই। যাঁরা দুর্বল, তাঁদের অনেকে মামলা করতেই ভয় পান। একই ঘটনা ঘটছে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ক্ষেত্রেও। হিসাবটা সোজা। কারও জমি দখল করতে পারলে তাঁকে দেশ থেকে বিতাড়ন করা সহজ হয়। এ কারণেই আমরা বৈষম্য বিলোপ আইন করার দাবি জানিয়েছি। ২০১৫ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আহূত সম্মেলন ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে সাত দফা দাবি পেশ করেছি। যার মধ্যে ছিল সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন, বৈষম্য বিলোপ আইন এবং সংখ্যালঘু কমিশন গঠন। গত শুক্রবার ও শনিবার ঐক্য পরিষদের জাতীয় সম্মেলনেও বলেছি, সরকার ২০১৮–এর নির্বাচনের সময় যেসব অঙ্গীকার করেছিল, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রথম আলো: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, বাড়িঘর পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে কারা ছিল বলে মনে করেন?
রানা দাশগুপ্ত: ২০১১ সালে রামু দিয়ে শুরু। একজনের ফেসবুক ব্যবহার করে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে রামুতে বৌদ্ধদের বাড়িঘর ও প্যাগোডা জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। সর্বশেষ কুমিল্লায় দুর্গোৎসবের সময় মন্দিরে হামলা চালানো হয়। পীরগঞ্জেও বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে। পীরগঞ্জের দিকে তাকালে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ দেখি, চৌমুহনীতে দেখি সরকারি ও বিরোধী দুই দিকের লোকই আছে। সালনায় দেখি স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার জড়িত।
প্রথম আলো: রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে বিভিন্ন সরকারের আমলে বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুরা চলে যাচ্ছে বলে আপনারা অভিযোগ করেন। আওয়ামী লীগ আমলেও কি সেই প্রবণতা আছে বলে মনে করেন?
রানা দাশগুপ্ত: পঁচাত্তরের পরই সংখ্যালঘুদের অনেকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ইদানীং সেই প্রবণতা কমেছে। এখন গ্রামে গিয়ে দেখবেন, সংখ্যালঘুরা দোতলা-তিনতলা বাড়ি করছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। তাঁদের মনে এই প্রত্যয় এসেছে যে এ দেশেই থাকতে হবে। এটা ইতিবাচক। আওয়ামী লীগ আমলে কিছু আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা তাদের মধ্যে অভয় সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথম আলো: বিএনপি আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিচার হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলেও হচ্ছে না। তাহলে এই দুই দলের মধ্যে পার্থক্যটা কী?
রানা দাশগুপ্ত: পার্থক্য একটাই। আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কথা বলে। কিন্তু বিএনপি তো এর ধারেকাছেও নেই। বিএনপি বলুক জামায়াত তাদের সঙ্গে নেই।
প্রথম আলো: আপনারা বলছেন রাজনীতিকেরা কথা রাখেননি। ভবিষ্যতে তাঁরা কি কথা রাখবেন?
রানা দাশগুপ্ত: রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করতে আজ বড় কষ্ট হয়। তাঁরা কথা দিয়ে কথা রাখেন না। তবে এখনো আস্থা রাখতে চাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র তিনি এখনো ধরে আছেন। আবার এ-ও সত্য যে আওয়ামী লীগ ক্রমাগত আওয়ামী মুসলিম লীগের দিকে চলে যাচ্ছে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
রানা দাশগুপ্ত: আপনাদেরও ধন্যবাদ।