সাক্ষাৎকার: মোস্তফা কামাল

শুধু চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিপাতের কারণেই বন্যার এ ভয়াবহতা নয়

মোস্তফা কামাল। কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক হিসেবে কর্মরত আছেন। দীর্ঘদিন ধরে দেশের জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ুমণ্ডলের প্রকৃতি ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করছেন। সিলেট অঞ্চলে একের পর এক বন্যার কারণ ও আবহাওয়া বিশ্লেষণ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এ বিশেষজ্ঞ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: রাফসান গালিব

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সিলেটে এক মাসের ভেতরে দুবার বন্যা হলো। সুনামগঞ্জে দুই মাসে তিনবার। এমন আকস্মিক বন্যার কারণ কী?

মোস্তফা কামাল: এই আকস্মিক বন্যাগুলোর মধ্যে দুটি মিল ও একটি অমিল রয়েছে। প্রথম মিলটি হলো প্রতিটি বন্যা হয়েছে কয়েক দিন ধরে অতিবৃষ্টির কারণে। ফলে একদমই আকস্মিক বন্যা শুরু হয়েছে, তা বলা যাবে না। দ্বিতীয় মিলটি হলো প্রতিটি বন্যার ক্ষেত্রে ভারী বৃষ্টির শুরুটা হয়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী মেঘালয় পর্বতের ওপরে, পরে যা সিলেট বিভাগের জেলাগুলোর ওপর বিস্তার লাভ করে। যেমন আজ শনিবার (১৮ জুন) ভোর ৪টা থেকে সিলেট বিভাগের চারটি জেলাতেই মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হয়েছে দুপুর পর্যন্ত যখন এই সাক্ষাৎকারটি দিচ্ছি।

এই বছর সিলেট ও সুনামগঞ্জে প্রথম যে বন্যাটি হয়েছে, সেখানে মানবসৃষ্ট একটি কারণ রয়েছে। কারণটি হলো, মেঘালয় পর্বতের ওপরে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে বাণিজ্যিক বন কিংবা চাষাবাদ করার জন্য বন পরিষ্কার করা। প্রাকৃতিক বনকে আমরা তুলনা করতে পারি খড়ের ঘরের চালার সঙ্গে। পক্ষান্তরে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে বাণিজ্যিক বন কিংবা চাষাবাদ করার জন্য যে পাহাড়ি ভূমি তৈরি করা হয়, তাকে তুলনা করতে পারি টিনের তৈরি ঘরের চালার সঙ্গে। একই পরিমাণ বৃষ্টি খড়ের চালা থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়তে যে সময় নেবে, তা অপেক্ষা কয়েক গুণ কম সময় লাগবে টিনের তৈরি ঘরের চলার ক্ষেত্রে। প্রকৃতপক্ষে টিনের তৈরি চালার ক্ষেত্রে পানি জমে থাকার কোনো সুযোগ নেই। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা মাটিতে পড়ে যায়। ঠিক এ ঘটনাটিই ঘটেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।

প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার জন্য মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টি হওয়ার পরে খুবই দ্রুত সময়ে এই পানি গড়িয়ে নদীতে পড়ছে ও পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি করছে। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার জন্য মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় প্রচণ্ড রকমের পাহাড়ি ভূমি ক্ষয় হচ্ছে ও ক্ষয়ে যাওয়া মাটি এসে জমা হচ্ছে সিলেট বিভাগের নদ-নদী ও হাওয়ার এলাকায়। ফলে নদ-নদীগুলোর নাব্যতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। অর্থাৎ অতিবৃষ্টি, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে দ্রুত বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়া, ভূমি ক্ষয়ের কারণে নদ-নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার মতো অনেকগুলো কারণ এক সঙ্গে মিলে যাওয়ায় এই বছর সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় একাধিক বন্যার সম্মুখীন হতে হলো।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এসব বন্যার পূর্বাভাস পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল কি না?

মোস্তফা কামাল: অবশ্যই ছিল। আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো ১০ থেকে ১৬ দিন আগেই সিলেট বিভাগ ও ভারতের মেঘালয় পর্বতের ওপর প্রচণ্ড ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা নির্দেশ করেছিল। জুন মাসের ৫ ও ১২ তারিখে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সাপ্তাহিক কৃষি সংবাদে আমার দুটি সাক্ষাৎকারে আমি স্পষ্টত করে উল্লেখ করেছিলাম জুন মাসের ১৫ তারিখের পরে সিলেট বিভাগে সম্ভাব্য বন্যার কথা।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: চেরাপুঞ্জিতে শতাধিক বছরের রেকর্ড বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেই বৃষ্টির ঢল সিলেটে নেমেছে। চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিপাত কত দিন চলতে পারে? এ বন্যা কত দিন থাকতে পারে?

মোস্তফা কামাল: এখানে উল্লেখ করতে চাই, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি নামক স্থানে বর্ষা মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু পরিমাণ বৃষ্টি হয়ে থাকে ভূপ্রকৃতিগত অবস্থানের কারণে। তবে জুন মাসের ১০ তারিখের পর থেকে চেরাপুঞ্জিতে যে বৃষ্টি হচ্ছে, তা অস্বাভাবিক রকমের ভারী বৃষ্টি। আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো নির্দেশ করছে যে ২০ জুনের পরে বৃষ্টি স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসবে চেরাপুঞ্জিতে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হতে আরও কয়েকটা দিন সময় লাগতে পারে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: জলবায়ু পরিবর্তন বা বায়ুমণ্ডলের কোন ধরনের আচরণের জন্য এমন আকস্মিক বন্যা হচ্ছে?

মোস্তফা কামাল: পৃথিবীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তাপ, জলীয় বাষ্প বয়ে নিয়ে যায় ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার উচ্চতায় পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত একটি বায়ুপ্রবাহ, যা জেট স্ট্রিম (জেটতরঙ্গ) নামে পরিচিত, যেহেতু এই বায়ু প্রায় যুদ্ধবিমানের গতিতে প্রবাহিত হয়। স্বাভাবিক সময়ে এই জেট স্ট্রিম চলে প্রায় সরল রৈখিক পথে। কিন্তু সময়ে-সময়ে এই জেট স্ট্রিমের সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথে চলে। এই জেটতরঙ্গ যখন প্রচণ্ড আঁকাবাঁকা হয়ে কোনো স্থানে স্বাভাবিকের চেয়ে ধীরগতিতে অগ্রসর হয়, তখন জেট স্ট্রিমের অগ্রবর্তী অংশের ঠিক নিচের স্থানে প্রচণ্ড ভারী বৃষ্টি হতে থাকে। ঠিক এই রকম প্রচণ্ড আঁকাবাঁকা একটি জেট স্ট্রিম বর্তমানে ভারত উপমহাদেশের ওপর দিয়ে অতিক্রম করছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই জেটতরঙ্গ অগ্রবর্তী অংশটি এক সপ্তাহ ধরে ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের আকাশের ওপর অবস্থান করছে।

আরও একটি দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো এই জেটতরঙ্গটির অগ্রবর্তী অংশ যে স্থানে অবস্থান করছে ঠিক সেই স্থানের নিচে দিয়ে মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে ও মৌসুমি বায়ুর অগ্রবর্তী অংশও একই স্থানের ভূপৃষ্ঠের নিচের তিন কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করছে।

তৃতীয় দুর্ভাগ্যজনক প্রাকৃতিক কারণ হচ্ছে, এই বছর মৌসুমি বায়ু অন্য বছরগুলোর চেয়ে একটু ধীরগতিতে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মৌসুমি বায়ু বঙ্গোপসাগর থেকে যে জলীয় বাষ্প প্রবাহিত করে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড ও বিহার রাজ্যের ওপর সে জলীয় বাষ্পের পুরোটুকুকে প্রথমে মেঘ ও পরে বৃষ্টিতে পরিণত করতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছে জেটতরঙ্গ অগ্রবর্তী অংশটি। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বায়ুমণ্ডলে ৩০ বছর আগে থেকে বর্তমানে অনেক বেশি পরিমাণে জলীয় বাষ্প ধরে রাখছে। যে কারণেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোনো নির্দিষ্ট ঝড় থেকে বেশি পরিমাণে বৃষ্টি ভূমিতে পতিত হচ্ছে আগের চেয়ে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এমন একটি ভয়াবহ বন্যার জন্য সুরমা নদী ভরাট হয়ে যাওয়া এবং কিশোরগঞ্জের হাওরে নির্মিত অল ওয়েদার রোডকে অনেক দুশছেন। সেটা কতটা যুক্তিসংগত?

মোস্তফা কামাল: আমি উল্লেখ করেছি যে সিলেটের নদ-নদীগুলোর নাব্যতা ব্যাপক পরিমাণে কমে গেছে মেঘালয় পর্বত এলাকায় প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে চাষাবাদ করার কারণে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিশোরগঞ্জের হাওরে অল ওয়েদার রোড। এই সড়কপথ মেঘালয় পর্বত থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ি ঢলের পানির স্বাভাবিক চলাচলের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধক। এই সড়কপথের কারণে পাহাড়ি ঢলের ফলে আসা বৃষ্টির পানিবাহিত পলিমাটি বা পলিমাটিযুক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের সুযোগ না পেয়ে স্থির হয়ে আছে তিন বছর ধরে। যার কারণে হাওর এলাকার নদ-নদীর নাব্যতা কমে গেছে। আগের পানি সেখানে জমে থাকার কারণে উজানের পানি ভাটিতে নেমে আসার হার কমে গেছে। এ সড়কের নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি, যেটি সাদাচোখে বুঝতে পারাটা কঠিন। কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে এই রকম একটি সড়ক তৈরি করাকে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করার শামিল। রাস্তাটি তৈরির আগে পরিবেশ সমীক্ষা করা হয়েছিল কি না কিংবা হলেও সেই সমীক্ষা স্বাধীনভাবে করা হয়েছিল কি না, তা যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এ ধরনের বন্যা কি আরও হওয়ার আশঙ্কা আছে? তা এড়ানোর জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?

মোস্তফা কামাল: জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতিবৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেছে বিশ্বব্যাপী, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম না। মেঘালয়ে বন ধ্বংসের কথা তো বলেছিই, যদিও ভারতীয় সরকারের হস্তক্ষেপে বন ধ্বংসের হার গত কয়েক বছরে অপেক্ষাকৃত কমে এসেছে। তবে ইতিমধ্যে পরিষ্কার করা পাহাড় থেকে ভূমি ক্ষয়ের কারণে সিলেট বিভাগের নদ-নদীগুলো নিয়মিত নাব্যতা হারাবে। সিলেট অঞ্চলে বনভূমি–পাহাড়–ঠিলা ধ্বংসের বিষয়টাও এখানে মাথায় রাখতে হবে। ফলে প্রতিবছর সিলেটের বড় নদীগুলোতে ড্রেজিং করে নাব্যতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। মানুষ যেহেতু এখনো প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা অর্জন করেনি; প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব না। তবে নিশ্চিতভাবে মানুষের অর্জিত জ্ঞান ব্যবহার করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের অপেক্ষাকৃত নির্ভুল আবহাওয়া পূর্বাভাসের দুই সপ্তাহ আগে মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হলে জান ও মালের ক্ষতি ব্যাপক পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। বিশ্বব্যাপী সেটাই করা হচ্ছে।