সাক্ষাৎকার : রানা দাশগুপ্তর

রাজনীতিকেরা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন

কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে এবারের দুর্গোৎসবে বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা হয়েছে। সংঘর্ষে একাধিক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। এই প্রেক্ষাপটে গতকাল বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান

রানা দাশগুপ্ত
রানা দাশগুপ্ত
প্রশ্ন

প্রথম আলো: চট্টগ্রামের সমাবেশে আপনি বলেছেন, রাজনীতিকদের প্রতি আর আমাদের আস্থা নেই। কেন এই অনাস্থা?

রানা দাশগুপ্ত: রাজনীতি ছাড়া রাষ্ট্র চলতে পারে না। কিন্তু সেই রাজনীতি যদি আদর্শ হারিয়ে ফেলে, তখন আর সেটি রাজনীতি থাকে না। অপরাজনীতিতে পরিণত হয়। রাজনীতিকেরা ভোটের সময় বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেন; ভোট শেষ হলে সেসব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন না। এ জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মনে করে, রাজনীতিকেরা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছেন। কিন্তু সাধারণ প্রবণতা হলো কথা দিয়ে কথা না রাখা। এর জন্য আদর্শহীন ও সংস্কৃতি বিযুক্ত রাজনীতিই দায়ী। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বাঙালি আর নিজেকে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে পারছে না; ধর্মীয় বিভেদ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এটি কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমস্যা নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপে যে হামলার ঘটনা ঘটল, তা কীভাবে দেখছেন?

রানা দাশগুপ্ত: শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির-পূজামণ্ডপ ও বাড়িঘরে যে হামলার ঘটনা ঘটল, সেসব বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত হামলার মাত্রা ছিল এক রকম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সাল থেকে থেমে থেমে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে। এর পেছনে যেমন সাম্প্রদায়িক অপশ
ক্তি আছে, তেমনি আছে সরকারি দলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অপশক্তিও। যে আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই আওয়ামী লীগ আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করতে পারছে না। একই কথা বলব বাম দলগুলো সম্পর্কেও। এরা সবাই লোকদেখানো অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন না সরকার চেষ্টা করলে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঠেকাতে পারত?

রানা দাশগুপ্ত: হ্যাঁ, আমি মনে করি, সরকার চাইলে এই হামলা ঠেকাতে পারত। পারেনি তার কারণ, আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে মোশতাক গংরা এবং প্রশাসনের মধ্যে পাকিস্তানি ভূত আছে। সংকটের মূল এখানেই। এবারে দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তার পেছনে হীন উদ্দেশ্য আছে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান পাস হয়। সেবারেও দিন পনেরো আগে দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে পূজামণ্ডপে হামলা চালানো হয়েছিল। হামলা হয়েছিল সাবেক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত মনোরঞ্জন ধরের বাড়ির পূজামণ্ডপেও। সে সময়ে উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বাধাগ্রস্ত করা। এবার সামনের নির্বাচনকে টার্গেট করা হয়েছে। রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের এখনো যেটুকু ভূমিকা আছে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এসব হামলার মাধ্যমে তা নস্যাৎ করতে চায়। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য দেশ থেকে হিন্দুদের বিতাড়ন করা।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলার দায় নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির নেতারা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

রানা দাশগুপ্ত: এটি দুঃখজনক। আমরা মনে করি, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার জন্যই এটা করা হচ্ছে। কেবল আওয়ামী লীগ, বিএনপি নয়, যাঁরাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা বলেন, তাঁদের সবার উচিত দোষারোপের রাজনীতি ছেড়ে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা ও অপরাধীদের শাস্তি বিধানে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এটা করতে হবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: অতীতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন, এবার কি তাঁরা সেভাবে এসেছেন?

রানা দাশগুপ্ত: পাকিস্তান আমলে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময় বঙ্গবন্ধু যেভাবে সব বিরোধী রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজকে নিয়ে দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন, এখন সেই অবস্থান কাউকে নিতে দেখা যায় না। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রুখতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল। আর সেই আন্দোলন ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরেই সীমিত ছিল না। ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রাম পর্যন্ত। এবারও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বাঙালি সংস্কৃতির জাগরণ ঘটাতে হবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: রাজনীতির ওপর সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ আছে। তারপরও এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ঠেকানো গেল না কেন?

রানা দাশগুপ্ত: এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। অনেকেই বিষয়টিকে সংখ্যালঘুদের সমস্যা হিসেবে দেখছেন। কিন্তু এটি যে জাতীয় সংকট, তা উপলব্ধি কেউ করছেন না। সরকার শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে বসে ছিল; কিন্তু অশুভ শক্তিকে রুখতে যে গণজমায়েত প্রয়োজন, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে একত্র করা প্রয়োজন, সে কথা বেমালুম ভুলে গেছে। বিভিন্ন স্থানে হামলাকারীদের চেয়ে প্রতিরোধকারী মানুষের সংখ্যা বেশি হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এতটা নির্লিপ্ত থাকতে পারত না। কেবল বন্দুক দিয়ে অশুভ শক্তিকে মোকাবিলা করা যায় না, তার সঙ্গে জনশক্তির সমাবেশও থাকতে হয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এবার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের কোনো নিষ্ক্রিয়তা কীভাবে দেখছেন?

রানা দাশগুপ্ত: মাঠে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের তেমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করিনি। এ কারণেই সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে হয়েছে। আমরা আশা করতে চাই, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ ও প্রগতিশীল অংশ আমাদের পাশে থাকবে। বিভিন্ন কর্মসূচিতে এগিয়ে আসবে। মনে রাখতে হবে, এটি সংখ্যালঘুদের সমস্যা নয়, জাতীয় সংকট। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা আমাদের মতো কর্মসূচি নিয়েছি। ২৩ অক্টোবর সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত গণ-অনশন ও গণ-অবস্থান পালিত হবে। আমাদের প্রথম দাবি হলো সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রতিরোধ করতে হবে; যারা সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ঘরবাড়িতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই কাজটি করতে হবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এর আগে কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে যে হামলা হয়েছে, সেসব ঘটনায় অপরাধীরা কি শাস্তি পেয়েছে?

রানা দাশগুপ্ত: দুর্ভাগ্যজনক হলো কোনো ঘটনার বিচার হয়নি। অপরাধীরা শাস্তি পায়নি। কেন বিচার হলো না, সেই প্রশ্ন আমরা সরকারের নীতিনির্ধারক ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে রাখছি। আগেও অনেকবার বলেছি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাঁরা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে আসামিরা বেরিয়ে এসেছে। এ কারণে আমরা সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও বৈষম্য বিলোপ আইনের দাবি জানিয়েছি। জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনেরও দাবি জানিয়েছি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সরকার এসব দাবি পূরণের কথাও বলেছিল। কিন্তু আড়াই বছর পার হলেও সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখছি না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

রানা দাশগুপ্ত: আপনাকেও ধন্যবাদ।