ড. জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ। ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতির সংকট ও মন্দার পূর্বাভাস এবং বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি, ডলারের বাজারের অস্থিরতা, মেগা প্রকল্প ও বাজেট নিয়ে কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে
প্রথম আলো: করোনা মহামারির পর সামষ্টিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে ছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা। এ মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ কী?
জাহিদ হোসেন: সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেড় বছর ধরে যে পুনরুদ্ধার হচ্ছে, সেটি টিকিয়ে রাখা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে ২২ থেকে ২৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। করোনা মহামারিতে সেটি বেড়েছে। কেউ বলছেন সেটি ৪২ শতাংশ, কেউ বলছেন ৪৫ শতাংশ। এর অর্থ, মহামারিতে দুই থেকে তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। করোনার আগে যাঁরা দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিলেন, তাঁদের অবস্থা মহামারির সময় আরও খারাপ হয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কতজন তাঁদের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পেরেছেন, সে পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। বিপুলসংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্যসীমার মধ্য থেকে বের করে আনা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বৃহত্তর এক চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই আমরা দেখেছি, বিশ্বে বিভিন্ন পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছিল। আমাদের দেশেও সেই প্রবণতা চলছিল। যুদ্ধ শুরুর পরে চাপটা আরও বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির চাপটা এখন আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। ধনী, মধ্যবিত্ত কিংবা দরিদ্র—সবার জন্য মূল্যস্ফীতি একটি চ্যালেঞ্জ। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য মূল্যস্ফীতি হয়তো বিরক্তির বিষয়; কিন্তু শহর ও গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের জন্য মূল্যস্ফীতি জীবিকার সংকট।
প্রথম আলো: বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান সংকটের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হচ্ছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে?
জাহিদ হোসেন: যুদ্ধের কারণে গ্যাস, তেল, গম, ভোজ্যতেল, সার, শিল্প-কাঁচামালের সরবরাহ-শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেইন) বিঘ্নিত হয়েছে। আবার রাশিয়া ও রাশিয়ার বন্ধুদেশ, যেমন বেলারুশের ওপর যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেটি অন্যদের ওপরে কী প্রভাব ফেলছে, তা এখনো পরিষ্কার হয়নি। তবে যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হচ্ছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সেই অনিশ্চয়তা কাটবে না। বিশ্ব অর্থনীতি যে পুনরুদ্ধারের পথে ছিল, সেটি যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ২০২২-২৩ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে যে প্রাক্কলন করেছিল, গত এপ্রিল মাসে এসে সেটি কমে গেছে। পণ্য ও শ্রমবাজারে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে আমাদের বড় ধরনের সম্পর্ক আছে। ইউক্রেন যুদ্ধে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য। ইউরোপের বাজার সম্পর্কে বলা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি সেখানে চলতে থাকবেই এবং মন্দা একটি আসবেই। প্রশ্ন এখন, ইউরোপে মন্দাটা কি এ বছরের আগামী প্রান্তিকে, নাকি শেষ প্রান্তিকে আসবে এবং কতটা গভীর ও দীর্ঘ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ইউরোপের মতো অতটা ঝুঁকি নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি ইউরোপের চেয়ে এখন অনেক বেশি। আগামী বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে একটি মৃদু মন্দার শঙ্কা রয়েছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ানোর পথে ছিল। আবার আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে আমাদের শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। গত বছর প্রবাসে গেছেন ছয় লাখের বেশি শ্রমিক, এ বছর প্রথম চার মাসেই গেছেন চার লাখের বেশি। পণ্য ও শ্রমবাজারের নতুন এ সুযোগ বাধাগ্রস্ত হবে। যুদ্ধের আগে ধারণা করা হচ্ছিল, জ্বালানি তেলসহ পণ্যের যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, সেটা সাময়িক। ২০২২ সালের শেষ ছয় মাসে সেটি কমে যাবে। জ্বালানি তেলের দাম যে ১০০ ডলারে উঠেছে, সেটি স্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নয়। যুদ্ধের কারণে প্রাক্কলনটা এখন বদলে গেছে। এ মাসে বিশ্বব্যাংকের যে কমোডিটি মার্কেট আউটলুক বেরিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম যে পর্যায়ে উঠেছে, সেখান থেকে এ বছর নামার সম্ভাবনা কম। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির আগে যে দামটা ছিল, সেই পর্যায়ে ফিরে যেতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন হলে সেটি ভিন্ন কথা।
প্রথম আলো: অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও খাদ্যপণ্য ও খাদ্যপণ্যবহির্ভূত অন্যান্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি ঘটছে। বিবিএস বলছে, মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এ হিসাব কি বাস্তবসম্মত?
জাহিদ হোসেন: বিবিএস যে হিসাব দেয়, সেটি জাতীয় পর্যায়ের হিসাব। শহর ও গ্রামের দুটি কনজামশন বাস্কেটের (ভোগের ঝুড়ি) ভিত্তিতে এটা করা হয়। শহরের ঝুড়িটাতে ৪৭০টির মতো পণ্য আছে, গ্রামের ঝুড়িতে আছে ৩২২টি। বিবিএস চাল, ডাল বা অন্য পণ্যের যে দরের ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব করছে, সেটি বাজারদরের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন নয়। তাই বিবিএসের তথ্যটা ঠিক নয়, সেটা বলা যাচ্ছে না। প্রশ্নটা হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য সব দেশের জন্য বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সমপর্যায়ের অন্যান্য অর্থনীতির চেয়ে কম কেন? এখানে একটি অর্থনৈতিক কারণ আছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের অবদান সবচেয়ে বেশি। ভারত বা আমাদের সঙ্গে তুলনীয় পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানির দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের দেশে এটা প্রশাসনিকভাবে নির্ধারিত। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের বাজারে সংক্রমিত হয়নি। ডিজেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে গত নভেম্বর মাসে একবার দাম সমন্বয় করা হয়েছে। সরকার যেটা করছে, সেটি হলো বাজেটের ওপর ভর্তুকি চাপাচ্ছে এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর আর্থিক বোঝাটা চাপিয়ে দিচ্ছে।
প্রথম আলো: ২০০৮ সালে বৈশ্বিক যে মন্দা হয়েছিল, তাতে বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল। তাতে দরিদ্রের সংখ্যাও এক ধাপে বেড়ে গিয়েছিল। সে পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার বাংলাদেশের জন্য করণীয় কী?
জাহিদ হোসেন: বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে ২০০৮ সালের খাদ্যসংকট আর চলমান খাদ্যসংকটের মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে। সে সময় চালের বাজারের ওপর প্রভাবটা সবচেয়ে বড় ছিল। সে বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোয় উৎপাদনের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। তেল ও সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চাল উৎপাদনের খরচ বেড়ে গিয়েছিল। এবারের খাদ্যসংকট চালকেন্দ্রিক নয়। এটা আমাদের জন্য অপেক্ষাকৃত সৌভাগ্য ও তুলনামূলক স্বস্তির বিষয়। তবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য চালের উৎপাদনটা যাতে ঠিক থাকে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন বোরো উঠছে, আউশের চাষ চলছে; সামনে আমনের সময়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটা বড় ঝুঁকি সামনে আছে। দুর্যোগ এলে কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু সেটি যাতে পুষিয়ে নেওয়া যায়, তার আগাম প্রস্তুতি থাকতে হবে। আমাদের গমের ওপর নির্ভরতা কম থাকলেও গম আমদানির বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে।
প্রথম আলো: মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখা এবং খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্যের দামের লাগাম টেনে ধরা সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অনেকে। এটা মোকাবিলার পথ কী?
জাহিদ হোসেন: বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখতে পাচ্ছি, প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিটা খুব বিস্তৃত। আমদানি করা পণ্যে, দেশে উৎপাদিত পণ্যে কিংবা যেসব পণ্য বা সেবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঢোকে না, সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতির লক্ষণটা দেখা যাচ্ছে। তাহলে কীভাবে আমরা বলতে পারি, শুধু আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধিই আমাদের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির কারণ। মূল্যস্ফীতির জন্য বড় আরেকটি কারণ হলো, অভ্যন্তরীণ চাহিদার একটি বড় ধরনের বৃদ্ধি হয়েছে। এ বছরে বিবিএসের প্রাক্কলন হলো, ভোক্তা ব্যয় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এখন মোট জিডিপির ৭৮ শতাংশ ভোক্তা ব্যয়, যেটা আগে ৬৯ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। দরিদ্র নয়, উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে ভোক্তাব্যয় বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে কিছুটা প্রশমন করে দিতে হবে। সেটা করার অস্ত্র সরকারের কাছে আছে। একটি হলো বাজেট, অন্যটা মুদ্রানীতি। বাজেটে এবার অভ্যন্তরীণ চাহিদার ক্ষেত্রে যে শক্তিশালী প্রবণতা আছে, সেটিতে নতুন করে কিছু যোগ করা যাবে না। এর অর্থ হচ্ছে সম্প্রসারণমূলক বাজেটে যাওয়ার খুব একটা সুযোগ এবার নেই। বাজেটে যে ঘাটতি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে, তার তুলনায় ঘাটতি বাজেটটা কম হতে হবে। মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদাটা বেড়েছে, তেমনটা নয়। মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির হার এখনো এক ডিজিটে আছে। বিশ্ব অর্থনীতির দিকে লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে, এখন সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকই নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। নীতি সুদহার টাকার বাজারে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাব ফেলে। এটি একটি সংকেতের মতো কাজ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারকে বলছে যে মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি এবং প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপের দিকে যদি যেতে হয়, সেটা আমরা যাব। তবে বাস্তবের মূল্যস্ফীতির ওপর যদি প্রভাব ফেলতে হয়, তাহলে অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। সে জন্য ঋণ প্রদানের সুদহার (লেন্ডিং রেট) বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক স্তর বা ৫ শতাংশের নিচে না আসা পর্যন্ত গ্রাম ও শহরের দরিদ্র মানুষের জন্য নগদ সহায়তা দিতে হবে।
প্রথম আলো: ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়ার রেটের চেয়ে খোলাবাজারে অনেক বেশি দামে ডলার বেচাকেনা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও ডলারের সংকটেও ভুগছে। এর কারণ কী?
জাহিদ হোসেন: কৃত্রিমভাবে বাজারমূল্য বেঁধে দেওয়া হলে বাজার তার নিজস্ব বিকল্পগুলো খুঁজে নেয়, এর ফলাফল কখনো শুভ হয় না। মূল্যস্ফীতি ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি—এ দুটি কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা। ডলারের চাহিদা এখন বিশ্বব্যাপী বেড়েছে। চাহিদা বাড়ার পেছনে দুটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমটা হলো, বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চিত একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি ও বড় বিনিয়োগে যেতে চাইছেন না। আপৎকালে তাঁরা সোনা ও ইউএস ডলারে বিনিয়োগ করছেন। সোনার জোগান সীমিত, তাই তাঁরা ইউএস ডলারের দিকেই ঝুঁকছেন। দ্বিতীয়টা হলো, পণ্য আমদানিকারক দেশগুলোর বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেছে, সেখানে অর্থায়নের দরকার পড়ছে। সেখানেও ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার এখন গত ১৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার ও পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দেশেও আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় জোগান কমে গেছে। আমাদের রপ্তানি ঘুরে দাঁড়ালেও প্রবাসী আয়ে ভাটা পড়েছে। এ কারণে একটা ভারসাম্যহীনতা মুদ্রাবাজারে সৃষ্টি হয়েছে।
এ পরিস্থিতিকে সামাল দিতে গেলে গোড়ার কারণটায় হাত দিতে হবে। ডলারের চাহিদা বৃদ্ধিকে কীভাবে কমাতে পারি এবং জোগান কীভাবে বাড়াতে পারি—সেটি বের করতে হবে। এটি একটি সূত্রের মতো। এ ক্ষেত্রে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে বেঁধে দিয়ে কিংবা বাজারে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যভাবে হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। একই দিনে একই ধরনের লেনদেনে, ভিন্ন দরে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে। ডলার তো আর টুথপেস্ট না যে মান অনুযায়ী ভিন্ন দাম হবে। এটা বাজার ব্যবস্থাপনার বিরাট একটি সমস্যার নির্দেশক। আমরা আমাদের শেয়ারবাজারকে চিরস্থায়ীভাবে নবীন একটি বাজার বলি, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার বাজার তো খুব পরিপক্ব বাজার। সেখানে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা কাম্য নয়।
ডলারের দাম যে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, সেটি আমদানি ও প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। শুধু রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে। ডলারের সরকারি দরটা বাস্তব দর থেকে এখন অনেক দূরে সরে গেছে। ডলারের নিয়ন্ত্রিত দর তখনই কার্যকর করা যাবে, যখন চাহিদা ও জোগানের ঘাটতি পূরণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করবে। কিন্তু বড় প্রশ্নটা হলো, সেটি কত দিন করা যাবে? যদি সংকটটা সাময়িক হতো, তাহলে এটা কার্যকর হতে পারত। রিজার্ভটা এখন নিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে, সে কারণে আমার মতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি হতে দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। কিন্তু তাতে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংকের যে রিজার্ভ আছে, তাতে সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি-বাণিজ্যের ব্যয় মেটানো সম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটা কতটা শঙ্কার বিষয়?
জাহিদ হোসেন: ঝুঁকি মোকাবিলার বড় একটা অস্ত্র তো হাতে যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা। ভারতে বর্তমানে যে রিজার্ভ আছে, সেটা দিয়ে ১৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আইএমএফের বিশ্লেষণে বলা হয়, স্বাভাবিক সময়ে তিন থেকে পাঁচ মাসের রিজার্ভ নিরাপদ। অস্বাভাবিক অবস্থার ক্ষেত্রে সেটা ৮ থেকে ১২ মাস। এখন সরকার রিজার্ভকে সুরক্ষিত রাখার জন্য কিছু অতিরিক্ত ব্যবস্থার কথা ভাবতে পারে। আর্থিক খাতে বিদেশি নগদ সহায়তা পাওয়ার সুযোগ আছে। এডিবি, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বাজেট-সহায়তা দেয়। সেটা পেতে হলে কাঠামোগত কিছু সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির পেছনে একটি কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত মেগা প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প চলমান। মেগা প্রকল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কতটা দুশ্চিন্তার বিষয়?
জাহিদ হোসেন: শ্রীলঙ্কা থেকে আমাদের বড় শিক্ষার বিষয় হচ্ছে ভবিষ্যতে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, সেটিকে এখনই স্বীকৃতি দেওয়া। ২০০৮-২০০৯ সাল থেকেই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি শ্রীলঙ্কাকে সতর্ক করেছে যে দেশটি অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। তখন শ্রীলঙ্কার সরকার বলেছিল, এসব সংস্থা সব সময়ই রক্ষণশীল। তারা সব সময় জুজুর ভয় দেখায়। সমস্যা দেখেও না দেখা কিংবা উটপাখি হয়ে বালুর মধ্যে ঘাড় গুঁজে দেওয়া ভালো ফল বয়ে আনে না। শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে সেটিই সবচেয়ে বড় শিক্ষা হতে পারে। মেগা প্রকল্পগুলো শ্রীলঙ্কার জন্য সমস্যা ছিল না। বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা এ ক্ষেত্রে দায়ী। গভীর সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন ও বড় বড় রাস্তার মতো মেগা প্রকল্প তাদের দরকার ছিল। তবে প্রকল্পের নকশাটা অর্থনীতির বিচারে না করে রাজনৈতিক সুবিধা দেখে করা হয়েছে। আবার শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় দেখা গেছে, সেটি হলো, প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়ার আগেই ঋণ পরিশোধের সময় এসে পড়েছে। বিনিয়োগ করা হলো, কিন্তু ফেরত আসার আগেই অর্থটা পরিশোধ করতে হচ্ছে, সেটি তো একটি বোঝা তৈরি করবেই।
মেগা প্রকল্পের ঋণ শোধে যে আর্থিক চাপ, সেটা সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুতিটা দরকার। একটি পরিকল্পনা করে বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এগোতে পারলে সংকটে পড়ার কোনো কারণ নেই। মেগা প্রকল্পগুলো যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে, তাহলে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
প্রথম আলো: বাজেট আসছে। এবারের বাজেটে আপনার চাওয়া কী?
জাহিদ হোসেন: আমাদের মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে যে রাজস্ব জিডিপি হওয়ার কথা, তার তুলনায় আমরা ৩ থেকে ৪ শতাংশ কম পাই। এই বাজেটে জিডিপি রাজস্ব বাড়ানোর খুব একটা সুযোগ নেই। কারণ, প্রাক্-বাজেট আলোচনায় সব কটি অংশীজনের বক্তব্য হচ্ছে বাজেটে কর বাড়ানো যাবে না। ভর্তুকি বাজেটে সংস্কারের সুযোগ আছে। বিদ্যুৎ বিভাগ, ওয়াসা, পেট্রোবাংলা—সবাই বলছে দাম বাড়াও। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসে কিছু মূল্যবৃদ্ধি তো করতেই হবে। অর্থনীতি বিভাগ হিসাব দেখাচ্ছে, কোনো ধরনের মূল্য সমন্বয় না হলে ভর্তুকির ক্ষেত্রে আগামী বাজেটে অতিরিক্ত ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। উভয়সংকট একটি পরিস্থিতি। ভর্তুকি বাড়াতে হলে বাজেট বাড়াতে হবে। আবার ভর্তুকি কমাতে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে জ্বালানির দাম বেড়েছে, সেটি পুরোটা ‘পাস অন’ করা যাবে না। ভর্তুকি কিছুটা দিতেই হবে। তাহলে বাজেটের অন্য জায়গা থেকে সাশ্রয় করতে হবে। সাশ্রয়ের একটা বড় জায়গা হতে পারে প্রবাসী আয়ের ওপর যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, সেটা সরিয়ে নেওয়া। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রবাসীরা ভালো সুফল পাচ্ছেন। আবার পরিসংখ্যান বলছে, শিল্প খাতের প্রতিটি উপখাতে পরপর দুই বছর দুই ডিজিট প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তাহলে শিল্প খাতে প্রণোদনার ওপর যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, সেটির যৌক্তিকতা কী?
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
জাহিদ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।