জোবেদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান। ই-কমার্স খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হওয়া গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এ নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম।
প্রথম আলো: প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা আছে জেনেও অনেক গ্রাহক বিনিয়োগ করেন। এ ধরনের ঝুঁকি নেওয়ার পেছনে কোন মানসিকতা কাজ করে?
জোবেদা খাতুন: নিজের ক্ষতি হওয়ার কথা মানুষ সহজে বিশ্বাস করতে পারে না। নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারার স্বস্তিটা অবচেতনেই মানুষের অভ্যাস হয়ে যায়। আরেকটি ব্যাপার খেয়াল করবেন, এখন ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার ধরনে অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। আগে সন্তানদের পড়ালেখার পাশাপাশি অভিভাবক-শিক্ষকেরা নৈতিকতার শিক্ষা দিতেন। গল্পের ছলে জীবনের নানা ঝুঁকি সম্পর্কে নীতিকথা বলতেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। বাচ্চাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো। কিন্তু এখন সে অভ্যাসগুলো নেই। আমাদের নৈতিক উন্নয়নের ভাবনার জায়গায় পরিবর্তন এসেছে।
প্রথম আলো: শুধু নিজে নিরাপদ ভেবে স্বস্তি পাওয়া কি চারপাশের সঙ্গে সংযোগ খুঁজে না পাওয়া?
জোবেদা খাতুন: মানুষ যে দ্রুত সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই। মানুষ এখন ‘আমরা’ থেকে ‘আমি’ হয়ে যাচ্ছে। এই ‘আমি’ ব্যাপারটা এতই ভয়ংকর যে কখনো কখনো মানুষ নিজের সঙ্গেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অথচ তা সে টের পায় না। এটাকে বলে ‘ফ্রাজাইল সেলফ’ বা ভঙ্গুর ব্যক্তিত্ব। সে কেন দৌড়াচ্ছে, নিজেও কিন্তু ভালোভাবে জানে না। কেননা, তার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। ‘আমরা’ আর ‘আমি’র কথা বলছিলাম। মানুষ যখন ‘আমরা’ হিসেবে ভাবত, তখন তার সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনায় চারপাশের মানুষ, সমাজ-সংসার স্থান পেত। ‘আমি’ ব্যাপারটা বেশি হয়ে যাওয়ার ফলে মানুষ নিজেকে ছাড়া অন্য কিছুই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। ফলে, সে অধিকারহীনতায় ভুগতে থাকে। সেখান থেকে মানুষ বস্তুগত ব্যাপারে বেশি ঝুঁকে পড়ে। বস্তুর প্রতি দখল দিয়ে সে পরিপূর্ণ হতে চায়। একটা সময় সে টের পায়—যেমন শূন্য ছিল, তা-ই রয়ে গেছে। তখন মানুষ আরও বেশি বস্তুতে আগ্রহী হয়। মনের শূন্যতা আর বস্তুগত দ্রব্য দিয়ে তা পূরণের চেষ্টা একটা চক্রের মতো।
প্রথম আলো: তার মানে একজন মানুষ একবারেই লোভী হয় না, এর ধাপ আছে।
জোবেদা খাতুন: নিশ্চয়ই। এক দিনে মানুষ লোভী হয় না। মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত হয় প্রতিযোগিতার মনোভাব। চারপাশের সঙ্গে তুলনা শুরু হয়। এমনকি কাছের মানুষ, আত্মীয়-পরিজনও তাকে সেদিকে ঠেলে দেয়। তখন মানুষের মধ্যে সুখী হওয়া বা খারাপ থাকার বোধ তুলনার ওপর নির্ভর করে। দেখবেন, যে কৃষক মাঠে কাজ করে, তার ভালো থাকা নির্ভর করে আরেক কৃষকের কতটুকু ফলন হলো, তার হিসাবের ওপর। যে মানুষ ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জন করে, তার সুখ নির্ভর করে পরিচিত আরেক ব্যবসায়ী একই পণ্যে কতখানি মুনাফা করল, তার ওপর। সে তুলনা না করে শুধু নিজের পরিস্থিতি বিবেচনায় সুখী হওয়ার মানসিকতা হারিয়ে ফেলছে। এভাবেই ধাপে ধাপে আরও বেশি লোভী হয় মানুষ।
প্রথম আলো: এই ভঙ্গুর ব্যক্তিত্ব মানুষ নিজে বুঝতে পারে? এই ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো কেমন?
জোবেদা খাতুন: তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারলে তো মানুষ সচেতন হতোই। আসলে সে একটা মোহের মধ্যে থাকে। বুঝতে পারলেও সে কতটা সচেতন হবে, সেখানেও প্রশ্ন আছে। মানসিক সেই দৃঢ়তা ও শক্তিগুলো তার বেড়ে ওঠার অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে অনুপস্থিত থাকছে। একসময় টেলিভিশন বা ক্যাসেট প্লেয়ার নষ্ট হলে নব ঘুরালে ঘড়ঘড় শব্দ হতো, মনে আছে? অস্থির চিত্তের, সংকল্পহীন মানুষের কাছে আপনি কিছু জানতে চাইলে দেখবেন কিছুরই সদুত্তর পাবেন না। অসংলগ্ন পরিকল্পনার কথা শুনবেন। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েই স্পষ্ট ধারণা নেই। অস্থির মানুষের ‘ইমোশন রেগুলেশন’ নষ্ট হয়ে যায়। আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো আর তার আয়ত্তে থাকে না। ফলে, কিছু একটা ঘটলে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মানুষ নিজে শান্তি পেলে সে তখন জগৎকে শান্তি দিতে পারে। মানুষ নিজেই তো শান্তিতে থাকছে না। ফলে, সে অন্যকে শান্তি দেওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে। এই অশান্ত হওয়ার প্রক্রিয়া তার চারপাশ থেকে তৈরি হচ্ছে।
প্রথম আলো: এই হুমড়ি খেয়ে পড়ার জন্য সমাজও নানান প্রলোভন দেয় না? এই যে ইভ্যালি বা ই-অরেঞ্জে অনেক গ্রাহক একটা কিনলে আরেকটা পাবেন, ইনস্ট্যান্ট ক্যাশব্যাক বা সাইক্লোন অফারের মতো অফার পেয়ে কোনো কিছু না ভেবে বিনিয়োগ করলেন?
জোবেদা খাতুন: সমাজ ও চারপাশের জন্যই তো মানুষ এমন হচ্ছে। এই যে এত বিজ্ঞাপন ক্রমাগত তারা দেখছে, আশপাশের মানুষের মুনাফার কথা শুনছে। এর জন্য নিজের মধ্যে প্রলোভন ও ভালো থাকার লোভ বাড়ছে। এসব প্রচারণা তো তার কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। গণমাধ্যমের এখানে গুরুত্বপূর্ণ দায়বদ্ধতা আছে। পণ্যের প্রচারের চেয়ে তাদের নৈতিকতার প্রচার বেশি করা উচিত। তারা কোন পণ্যের প্রচার করবে, সেখানে ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। এসব প্রচারণা মানুষের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করে। সাধারণ মানুষ ক্রমাগত মিথ্যা শুনলেও সেটাকে সত্য বলেই বিশ্বাস করবে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ই-কমার্স খাতে বিনিয়োগ করে যে গ্রাহকেরা প্রতারিত হয়েছে, তাদের দেখুন। কেউ কিন্তু একেবারে নিরক্ষর মানুষ না। তারা যে পণ্যগুলোর জন্য অর্থ ব্যয় করেছে, সেগুলো মৌলিক চাহিদার? হয় ব্যবসায়ী পণ্য অথবা বিলাসদ্রব্য। আবার যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে কম মূল্যে আরও একটু ভালো জীবনযাপনের সুযোগের প্রলোভন দেখাচ্ছে, তাদের বিকল্প হিসেবে আপনি গ্রাহককে কী দিচ্ছেন? এখান থেকে আপনি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন? একটাই কথা, লোভ। দুপক্ষেরই লোভটা হচ্ছে নানা প্রলোভনে। এই লোভ নেশার মতো। ক্রমাগত বাড়তে থাকে চাহিদা। ফলে, এখানে রাষ্ট্রের নজরদারি জরুরি। রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে, সে কোথায় কোথায় আগে থেকেই গেট কিপিং করবে। কোন পণ্যের প্রচারণা কতটুকু করা যাবে।
ভারতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ব্যক্তি উদাহরণ তৈরি করেছেন মাদকদ্রব্য বা রং ফরসাকারীর মতো পণ্যের জন্য বিজ্ঞাপন না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে। সেসব বিজ্ঞাপণের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে চেয়েছিল সংস্থাগুলো। কিন্তু এই যে নিজের ব্যক্তিত্বকে তাঁরা খারাপ পণ্যের প্রচারণার জন্য বিক্রি করতে চাননি, এতে যেমন সমাজের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে, একই সঙ্গে অসংখ্য মানুষকে প্ররোচিত করা থেকেও তাঁরা সুরক্ষা দিতে পেরেছেন। ভালো উদাহরণগুলো সামনে এনে আমাদের দেশের মানুষকেও শেখাতে হবে।
প্রথম আলো: গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদেরও তাহলে দায় আছে?
জোবেদা খাতুন: গ্রাহকেরা যাতে প্রতারিত না হয়, সে জন্য রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের দায়দায়িত্ব রয়েছে। এই যে এখন ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা পথে দাঁড়িয়ে তাদের টাকা ফেরত চাইছে, এটা কার কাছে চাইছে? প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের দিকেই কিন্তু দায়ভার চলে যাচ্ছে। প্রতারক প্রতিষ্ঠানের লেনদেন সম্পর্কে রাষ্ট্রের নজরদারি আরও কঠিন হওয়া উচিত ছিল না? অবশ্যই পুরো ব্যবস্থাপনাতেই ঘাটতি আছে।
দেখুন, যে মানুষটি বাজারে গিয়ে আরও একটু কম মূল্যে চাল বা তেল কিনতে চায়, সেটাও কিন্তু তার ভালো থাকার লোভ। এই লোভ মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। প্রসঙ্গটা হচ্ছে লোভের রাশ টানার। কতটুকু লোভ সে করতে পারবে, আর কতখানি ঝুঁকি আসলে তার নেওয়া উচিত না, সেটা ছোটবেলার শিক্ষা থেকেই ধীরে ধীরে তার মধ্যে বোধ তৈরি করবে।
শিক্ষক–অভিভাবককে সচেতন হতে হবে সন্তানের বেড়ে ওঠায় তাঁরা কতটা নৈতিকতা ও ভালো-মন্দের পার্থক্য, ঝুঁকি গ্রহণ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের শিক্ষা দিচ্ছেন। যারা বড় হয়ে প্রতারণা করে, তাদের এমন মানসিকতা কিন্তু শৈশবেও ছোটা ছোট ঘটনায় প্রকাশ পায়। মানুষ তো এক দিনে লোভী হয় না। আবার মানুষ এক দিনে প্রতারকও হয় না। এখন যে লোকসানে পড়া গ্রাহক ও প্রতারক ব্যবসায়ী আছে, তারাই শেষ নয়; নতুন প্রজন্ম আসবে, আবার নতুন গ্রাহক ও প্রতারক তৈরি হবে। শুরু হবে নতুন নতুন প্রতারণার প্রতিষ্ঠান, যাদের পুঁজিই হবে মানুষের লোভ।
প্রথম আলো: নৈতিকতার শিক্ষা শৈশব থেকে জোরালো করতে আপনার পরামর্শ কী?
জোবেদা খাতুন: প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এখনো দেওয়া হয়, তবে তা নন–ক্রেডিট। নৈতিকতা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা বা জীবনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের অভ্যাস পাঠ্যতালিকায় ক্রেডিট কোর্স হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। কমিউনিটির দায়িত্ব উপেক্ষা করা যাবে না। ক্ষুদ্র পর্যায় থেকে নজরদারির মাধ্যমে মানুষের নৈতিকতা বোধের ইতিবাচক পরিবর্তন না আনা গেলে বড় পর্যায়ে গিয়ে সবকিছু সামলানো সম্ভব হয় না। তাই দায়িত্বটা সমাজের প্রতিটি মানুষের। আবার একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, মানুষ এক দিনে লোভী হয়ে যায় না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
জোবেদা খাতুন: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।