বিশেষ সাক্ষাৎকার

ব্যবসাবান্ধব হলে বিদেশি বিনিয়োগের ঢল নামবে

>

কানাডার নাগরিক মাইকেল ফোলি বাংলাদেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে ২০১৭ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। এ দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের নানা বিষয় নিয়ে ১৩ জানুয়ারি তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। কথোপকথনে বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আয়েশা কবিররাজীব আহমেদ 

প্রথম আলো: গ্রামীণফোন বাংলাদেশে এসেছে ২১ বছর হলো। ব্যবসা কত দূর বিস্তৃত হয়েছে?

মাইকেল ফোলি: আমরা যখন এসেছি, তখন শুরুতে পরিকল্পনা ছিল এক থেকে দুই লাখ গ্রাহক ধরা। আর এখন আমাদের গ্রাহকসংখ্যা ৭ কোটি ২০ লাখের বেশি। এঁদের মধ্যে ৩ কোটি ৬০ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। ইউরোপের একটি ছোট দেশের একটি কোম্পানি ও এই দেশের উদ্যোক্তাদের যৌথ উদ্যোগে গ্রামীণফোনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের অনেক মানুষ প্রথম মুঠোফোনে কথা বলার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন গ্রামীণফোনের মাধ্যমে। শুধু টেলিযোগাযোগ খাত নয়, গ্রামীণফোন আরও নানাভাবে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে। এটি একটি অসাধারণ গল্প।

প্রথম আলো: টেলিযোগাযোগের বিকাশের সঙ্গে অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়ার একটি সম্পর্ক আছে। এ ক্ষেত্রে গ্রামীণফোন কী ভূমিকা রাখতে পারছে বলে আপনি মনে করেন?

মাইকেল ফোলি: আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। দারিদ্র্যের হার কমছে, শিক্ষার হার বাড়ছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশ বেশ ভালো করেছে। সব মিলিয়ে সমাজে একটি মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। মোবাইল ফোন সেই গুটিকয়েক প্রযুক্তির একটি, যা সমাজে বড় প্রভাব ফেলে। কারও একটি মুঠোফোন থাকলে তথ্য পাওয়া, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক সেবা, নিরাপত্তা ইত্যাদি তার হাতের মুঠোয় চলে আসে। এমনকি মানুষের মতপ্রকাশের কাজটিও সহজ হয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১৪ কোটি সিম বিক্রি হয়েছে। আরও অনেক করার আছে, কিন্তু যা কিছু হয়েছে, তা সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। কিন্তু গ্রামীণফোনের মূল মালিকানায় থাকা টেলিনরের যেসব দেশে ব্যবসা আছে, তার মধ্যে মুনাফার দিক দিয়ে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয়। এর কারণ কী বলে মনে করেন?

মাইকেল ফোলি: প্রথমে আপনাকে বুঝতে হবে, আমরা কত বড় বাজারে কাজ করি। সব মিলিয়ে টেলিনর গ্রুপের ১৭ কোটি ৩০ লাখ গ্রাহক আছে। এর মধ্যে ৭ কোটি ২০ লাখই বাংলাদেশে। বাংলাদেশে আমরা কেন লাভজনক, এ প্রশ্নের জবাবে আমি কয়েকটি কারণ বলব। সেবার বিস্তৃতি ও মান উন্নয়নে ১৫-২০ বছর ধরে আমরা ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ করেছি। ফলে ভালো গ্রাহক পেয়েছি। বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। ফলে আমাদের নেটওয়ার্কের আওতার মধ্যে অনেক গ্রাহক পাওয়া যায়। আরেকটি কারণ হলো, আমাদের প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বাড়াতে আমরা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে এগুলোকেই আপনি লাভজনক হওয়ার কারণ বলতে পারেন।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে শীর্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় গ্রামীণফোনের নাম থাকবে। আপনাদের এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ কত দাঁড়াল?

মাইকেল ফোলি: প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ৩৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা)। আমরা মূলত নিজেদের তহবিল থেকে বিনিয়োগ করি। আমরা যেহেতু লাভজনক এবং একই সঙ্গে নিজেদের লাভজনক দেখতে চাই, তাই ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে আমরা নিয়মিত বিনিয়োগ করি। আমরা মনে করছি, আমরা প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক দিকে আছি; বিশেষ করে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে।

প্রথম আলো: দ্বিতীয় প্রজন্মের (টু–জি) পর তৃতীয় প্রজন্মের (থ্রি–জি) ইন্টারনেট সেবায় আসতে বাংলাদেশ বেশ সময় নিয়েছে। কিন্তু থ্রি–জি থেকে ফোর–জিতে (চতুর্থ প্রজন্ম) আসতে সরকার সময় খুব কম নিল। এখন ২০২০ সালে ফাইভ–জি (পঞ্চম প্রজন্ম) ইন্টারনেট চালুর কথা বলা হচ্ছে। দেশের অপারেটরগুলো কি একে চ্যালেঞ্জ মনে করে? বিশেষ করে গ্রামীণফোন? গ্রাহকেরা কী এর সুফল পাচ্ছেন?

মাইকেল ফোলি: ভালো প্রশ্ন করেছেন। বাংলাদেশ ৮ বছরের মধ্যে থ্রি–জি থেকে ফাইভ–জিতে যেতে চাইছে।বিশ্বের অন্য অনেক দেশে এই পরিবর্তন ২০ বছর ধরে হয়েছে। বাংলাদেশে আমাদের পুনর্বিনিয়োগ করে যেতেই হবে এবং সেটা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। বাকি বিশ্বকে ধরতে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। তবে ব্যবসার দিক থেকে বিবেচনা করলে এটার জন্য খুবই চাপের একটি বিষয়। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে প্রচুর মূলধন ব্যয় করতে হয়। আমরা লাভজনক বলে এই চাপ নিতে পারি। কিন্তু অন্য অপারেটরদের জন্য তা কঠিন। এ জন্য আমাদের এমন একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে, যার মাধ্যমে সবাই সফল হবে। অন্যদিকে আমাদের সাড়ে ৪ কোটি গ্রাহক আছেন, যাঁরা এখনো সাধারণ মুঠোফোন ব্যবহার করেন। এ কারণে দেশের বড় অংশের মানুষ উচ্চগতির ইন্টারনেট-সুবিধা পাচ্ছেন না। দেশে মুঠোফোনের দামও তাঁদের কাছে বেশ চড়া। এ বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।

প্রথম আলো: মুঠোফোনের দাম কমানোর বিষয়ে আপনাদের কোনো পরামর্শ রয়েছে কি? 

মাইকেল ফোলি: নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আমি কোনো পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করব না। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণভাবে মুঠোফোন উৎপাদনের যে নীতি নিয়েছে, সেটা ন্যায্য। তবে আমদানির ওপরে উচ্চমাত্রায় শুল্ক থাকলে অবৈধ পথ উৎসাহিত হয়। এই চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অবগত। প্রশ্ন হলো, কীভাবে ক্রেতাস্বার্থ রক্ষা করার পাশাপাশি রাজস্ব আয়ের দিকেও নজর দেওয়া যায়।

প্রথম আলো: আপনারা কেন কিস্তিতে মুঠোফোন বিক্রি করেন না?

মাইকেল ফোলি: আমরা সেটা করতে পারি। এখন সীমিত পর্যায়ে পরীক্ষা চলছে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের ক্রেতারা প্রায়ই অভিযোগ করেন, এ দেশে ইন্টারনেটের দাম বেশি। এ বিষয়ে কী বলবেন?

মাইকেল ফোলি: আমরা ইন্টারনেটের যে দাম রাখি, তা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এর চেয়ে কমানোর সুযোগ খুবই কম। আপনাদের বুঝতে হবে টেলিযোগাযোগ খাতের ওপর করের হার কত এবং এখান থেকে কী পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়। আমরা ইন্টারনেটের ওপর আরও কম হারে কর চাই, যাতে দাম কমানো যায়। এখন বাজারে বেশ প্রতিযোগিতামূলক দামে ইন্টারনেট সরবরাহ করা হচ্ছে। সবাই শুধু চায় টেলিযোগাযোগ খাতে সেবার দাম আরও কমুক, যেখানে অন্যান্য ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। শ্রমের মূল্য, ভাড়া, জ্বালানি, সরঞ্জাম ইত্যাদির দাম বাড়ছে। সব মিলিয়ে আমাদের যৌক্তিক হতে হবে। শিল্পকে টেকসই রাখাটাও জরুরি। আমি মনে করি, এ দেশে ইন্টারনেটের এখনকার দাম ন্যায্য। সবাইকে কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে অংশীজনদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে।

প্রথম আলো: সম্প্রতি সরকার ইন্টারনেটের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ১০ শতাংশ কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে। এতে কোনো লাভ হয়নি?

মাইকেল ফোলি: এ বিষয়টি মজার। সরকার ভ্যাট কমিয়েছে, কিন্তু সেখানে রেয়াত নেওয়ার সুযোগ ছিল না। ফলে আসলে ব্যয় আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে বাইরে থেকে ইতিবাচক দেখালেও ভেতরে তা অপারেটরদের জন্য বোঝা তৈরি করেছে; বিশেষ করে ছোট অপারেটরদের জন্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের জন্য শক্ত রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলে সরকার একটি কাজ করতে পারে। সেটি হলো, চার-পাঁচ বছরের জন্য কর ছাড় দিতে পারে। অবশ্য আমি জানি যে এ দেশে খুব কম মানুষ আয়কর দেন। এ কারণে রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারকে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য থাকতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গেও আমাদের চমৎকার আলোচনা হয়েছে। কখনো কিছু বিষয়ে তারা হ্যাঁ বলেছে, কিছু বিষয়ে না বলেছে। কিন্তু এটা ইতিবাচক যে আলোচনার দরজা খোলা। 

প্রথম আলো: বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) শিরোনামের একটি নতুন বিধিমালা জারি করেছে, যেখানে একটি অপারেটরের ৪০ শতাংশের বেশি বাজার হিস্যা থাকলে তাকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্রামীণফোনের অবস্থান কী? আপনাদের বাজার হিস্যা ৪০ শতাংশের বেশি।

মাইকেল ফোলি: প্রথমে আমি মনে করি, প্রতিযোগিতা খুবই চমৎকার। বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে বেশ ভালো প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। আমাদের ৭ কোটির বেশি গ্রাহক রয়েছেন। আরেকটি অপারেটরের সাড়ে ৪ কোটির বেশি গ্রাহক আছেন। আরেকটি অপারেটর সাড়ে ৩ কোটির বেশি গ্রাহক নিয়ে ব্যবসা করছে। কারও ব্যবসাই ছোট নয়। এসএমপি বিধিমালাও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো অপারেটর যদি তার বড় বাজার হিস্যার অপব্যবহার করে, অন্যদের বাজারে প্রবেশে বাধা দেয়, তাহলে তা ঠেকাতে এসএমপি অনেক দেশেই ব্যবহার করা হয়। একটা কথা মনে রাখা দরকার, এসএমপি করা হয়েছে অপব্যবহার রোধ করতে। গ্রামীণফোন কখনোই তার বাজার অবস্থানের অপব্যবহার করেনি। যদি ভালো সেবা দেওয়া অপব্যবহার হয়, আমরা সেটা করছি। যদি সরবরাহব্যবস্থা বড় হওয়া এবং পণ্য সহজলভ্য হওয়া অপরাধ হয়, সেটা আমরা করেছি। আমরা কিন্তু অন্যদের চেয়ে সামান্য বেশি মূল্য রাখি। অন্যদের ব্যবসা করার ক্ষেত্রে আমরা কোনো বাধা দিই না। ফলে আমরা এসএমপি নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নই। আমি মনে করি, এটা স্বাভাবিক। এটা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।

প্রথম আলো: গ্রাহকেরা সেবার মান নিয়ে প্রায়ই অভিযোগ করেন। এমনকি সেটা গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রেও। কারণ কী?

মাইকেল ফোলি: কারণ, একই সময়ে সবাইকে সন্তুষ্ট রাখা কঠিন। আমরা এ দেশে একই সঙ্গে টু–জি, থ্রি–জি ও ফোর–জি সেবা চালাই। যদিও এটা কঠিন। বিশ্বের যেসব দেশে সেবার মূল্য সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম, কিন্তু করের দিক থেকে শীর্ষস্থানীয়। এরপরও দেশজুড়ে আমরা ইন্টারনেট সেবা দিই। আমরা পুরোপুরি নিখুঁত নই। অনেক কাজ এখনো বাকি। বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি, যেখানে দুই বর্গকিলোমিটার নেটওয়ার্কের বাইরে থাকলেই ৬ থেকে ৭ হাজার মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হন। এ কারণে আমরা গত বছর ৫ হাজার ফোর–জি ও দেড় হাজার টু–জি, থ্রি–জি টাওয়ার বসিয়েছি। চলতি বছর আরও ১৯ হাজার বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এ দেশে গ্রাহক বাড়ানো এবং আরও ভালো সেবা দেওয়ার বড় সুযোগ রয়েছে। গত বছর আমরা ৭০ লাখ নতুন গ্রাহক পেয়েছি। তঁারা আমাদের নেটওয়ার্কে এসেছেন, কারণ আমরা দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সেবা দিই। এরপরও যে সমস্যা আছে আমরা তা সমাধানের চেষ্টা করছি।

প্রথম আলো: সেবার মান কি শুধু মোবাইল অপারেটরদের ওপর নির্ভর করে?

মাইকেল ফোলি: আসুন, শুরুতে কলড্রপ নিয়ে কথা বলি। কলড্রপের হার বিটিআরসির সীমার বেশ নিচেই আছে। এ ক্ষেত্রে আমরা বেশ ভালো করছি। কথা বলার সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু আরও অনেকে যুক্ত। আমরা অপটিক্যাল ফাইবার কেব্‌ল পরিচালনা করি না, করার অধিকার নেই। কিছুদিন পরে আমরা নিজেরা টাওয়ার তৈরি করব না। আন্তর্জাতিক কলের ক্ষেত্রে সংযোগ দেয় অন্যরা। সব ক্ষেত্রে মান উন্নত না হলে গ্রাহক পর্যায়ে সেরা মানের সেবা দেওয়া কঠিন। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশে সেবার মান বেশ ভালো, এমনকি আন্তর্জাতিক মানের বিবেচনাতেও। অবশ্য এখনো অনেক কিছু করার আছে। আন্তর্জাতিক কলের মান খুবই খারাপ। আমাদের আরও বেশি তরঙ্গ নিতে হবে, যাতে গতি বেশি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক সবচেয়ে উচ্চগতির। অন্যদিকে নরওয়েতে টেলিনরের নেটওয়ার্ক বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির। সুতরাং আমরা জানি, কীভাবে সেরা নেটওয়ার্ক করতে হয়। সেটা এখানেও আমাদের পক্ষে করা সম্ভব, যদি গ্রহণযোগ্য দামে তরঙ্গ পাওয়া যায়।

প্রথম আলো: একসময় মোবাইল অপারেটরদের আয়ের প্রায় শতভাগ ভয়েস কল বা কথা বলা থেকে আসত। সেই অবস্থা এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে?

মাইকেল ফোলি: এখনো ৭০ শতাংশ রাজস্ব আসে ভয়েস কল থেকে। ২০-২৫ শতাংশ আসে ইন্টারনেট থেকে। বাকিটা অন্যান্য খাতের। আগামী দিনগুলোতে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়বে। ফোর–জি মাত্র ৯ মাস হলো চালু হয়েছে। আগামী চার-পাঁচ বছর ফোর–জিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি আসবে।

প্রথম আলো: পৃথিবীর অনেক দেশে মোবাইল কোম্পানিগুলো মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা বাস্তবতা কী?

মাইকেল ফোলি: এই একটা জায়গা, যেখানে সরকারের নীতির সঙ্গে আমরা দ্বিমত পোষণ করি। এমএফএস সেবার মালিকানার ক্ষেত্রে আমাদের কার্যত নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এমএফএসের মাধ্যমে বিপুল জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার আওতায় আনা যায়। আমরা কোনো ব্যাংক চালাতে চাই না, ব্যাংকের প্রতিযোগীও হতে চাই না। আমরা এমন মানুষকে মুঠোফোনে আর্থিক সেবা দিতে চাই, যাঁদের ব্যাংকের আওতায় আনা যায়নি। মোবাইল অপারেটরদের নিষিদ্ধ করে রাখাটা কৌশলগত ভুল। এটা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আমাদের আরও আলোচনা হবে। এটা আমাদের আয়ের কোনো বড় অংশ নয়, কিন্তু এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখার সুযোগ আছে।

প্রথম আলো: গ্রামীণফোন একমাত্র অপারেটর, যার ১০ শতাংশ শেয়ার বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ছাড়া হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও শেয়ার ছাড়ার লক্ষ্য আছে কি?

মাইকেল ফোলি: আমার ঝটপট জবাব হচ্ছে; না। কোম্পানি আরও শেয়ার বাংলাদেশের বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করছে বলে আমার মনে হয় না। 

প্রথম আলো: বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা সূচক বা ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশ ১৮৯টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম অবস্থানে রয়েছে। আপনি কি মনে করেন, পরিস্থিতি আদৌ ততটা খারাপ?

মাইকেল ফোলি: আমরা দুই দশকের বেশি সময় ধরে এ দেশে কাজ করে বিষয়গুলো রপ্ত করেছি। কিন্তু কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী যখন এশিয়ার কোনো দেশে বিনিয়োগের চিন্তা করে, তখন এসব সূচক বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে আসার পরে কেউ হয়তো বিশ্বমানের পোশাক, ওষুধ ও অন্যান্য কারখানা দেখবে। কিন্তু এখানে আসার আগে বা বাইরে থেকে ওই সব সূচক দেখেই সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বব্যাংকের সূচকে উন্নতির জন্য বাংলাদেশবিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ভালো কাজ করছে। তবে  সংস্থাটির নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলামের প্রতি সবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া দরকার। এটা হওয়া উচিত পুরো সরকার, এমনকি সমাজের একটি কাজ। বাংলাদেশ যদি তার ১০ বছর আগের ৮৮তম অবস্থানে আবার ফিরতে পারে, বিদেশি বিনিয়োগের ঢল সামলানো কঠিন হবে।

প্রথম আলো: গ্রামীণফোনের ব্যাপারে সরকার কোনো ধরনের বিরূপ মনোভাব পোষণ করে বলে মনে করেন কি?

মাইকেল ফোলি: না, সরকার মোটেও আমাদের প্রতি বিরূপ নয়। আমাদের কোম্পানি সবচেয়ে বড় করদাতা, আমরা সবচেয়ে বেশি ভ্যাট দিই। যদি জানতে চান, কর নিয়ে আমাদের সঙ্গে সরকারের কোনো বিরোধ আছে কি না, আমি বলব, অবশ্যই আছে। আপনি একটি কোম্পানি দেখান, যার সঙ্গে কর নিয়ে সরকারের বিরোধ নেই। এটা থাকবেই। সব মিলিয়ে বলছি, সরকার আমাদের প্রতি বিরূপ নয়; বরং আমরা অতীতে রাজনৈতিকভাবে ও সরকারের অঙ্গীকার পূরণের জন্য যা করার দরকার ছিল, সেখানে ততটা নজর দিইনি। আমাকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষ সম্পর্কে আপনার ধারণা বা মূল্যায়ন কী?

মাইকেল ফোলি: আমি পুরো দেশ ঘুরেছি। এটা সেই দেশ, যেখানে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষটি তাঁর যতটুকু আছে, তার অর্ধেক অতিথিকে খাওয়াতে চান। এ দেশের মানুষের মধ্যে আমি উদ্যোগী মনোভাব দেখি। অনেকে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে মিরাকল বলে, পোশাকশিল্পকে মিরাকল বলে, মধ্যবিত্তের উত্থানকে মিরাকল বলে। আসলে তা মিরাকল নয়। এগুলো সবই মানুষের কঠোর শ্রম, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও নীতির বাস্তবায়নের ফল। বাংলাদেশে আসা আমার জন্য খুব ভালো অভিজ্ঞতা।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মাইকেল ফোলি: আপনাদেরও ধন্যবাদ।