বাজেটে সরকার নিজেই নিজের কথা রাখেনি

ড. সেলিম রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

ড. সেলিম রায়হান
প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাজেটে বরাদ্দ, ব্যয় ও অর্থের উৎসের একটি হিসাব-নিকাশ থাকে। এর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাষ্ট্র পরিচালনার অর্থনৈতিক নীতিকৌশল ও দিকনির্দেশনা। এবারের বাজেটে কী দিকনির্দেশনা পাওয়া গেল?

সেলিম রায়হান: বাজেট রাষ্ট্র পরিচালনার আয়-ব্যয়ের একটি হিসাব। দেশের অর্থনৈতিক নীতি ও কৌশলের সঙ্গে সংগতি রেখেই তা করার কথা। মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল বিবেচনায় নিলে আমাদের ক্ষেত্রে এর ভিত্তি হচ্ছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনা। এর আগের ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের দেখতে হবে, এই লক্ষ্য পূরণের পথে বর্তমান বাজেট কতটুকু সংগতিপূর্ণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের পলিসি ডকুমেন্টের সঙ্গে বাজেটের মিল নেই। আগের বাজেটগুলোতেও এমন হয়েছে, এবারও হলো। এই সমস্যা দিনে দিনে বাড়ছে। কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও সামগ্রিকভাবে বর্তমান বাজেট সরকারের ঘোষিত নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সরকার নিজেই নিজের কথা রাখছে না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: একটি বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির আশঙ্কার মধ্যে এবারের বাজেট করতে হয়েছে। বাজেটের আগে আপনাদের অনেকের কাছ থেকেই এই পরামর্শ শোনা গেছে যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি যেন বিশেষ গুরুত্ব পায়। প্রস্তাবিত বাজেটে তার কোনো প্রতিফলন রয়েছে কি?

সেলিম রায়হান: বাজেটে সমস্যাটির স্বীকৃতি আছে, কিন্তু যে রকম পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, তা নেওয়া হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, বাজার অর্থনীতিতে সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কী করতে পারে? বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের এমন যুক্ততা তৈরি করতে হবে, যাতে তারা কোনো অবৈধ সুযোগ নিতে না পারে। ব্যক্তি খাতকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে এবং তাদের ওপর নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার কীভাবে তা করবে, সেই নির্দেশনা বাজেটে নেই। প্রতিযোগিতা কমিশন, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়—যাদের এসব করা উচিত, তাদের সক্ষমতা দুর্বল। এ নিয়ে বাজেটে কোনো বক্তব্য বা দিকনির্দেশনা নেই।

এ ছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের হাতে কিছু টুলস রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্য আমদানিনির্ভর হলে সাময়িকভাবে বা এক বছরের জন্য সরকার এর ওপর থেকে সব ধরনের শুল্ক তুলে নিতে পারে। তেমন কোনো পদক্ষেপ এবারের বাজেটে দেখা যায়নি। পণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখার জন্য চাহিদার পরিমাণ জানা জরুরি। এর ওপর ভিত্তি করে জোগানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। ফলে কোন পণ্য কী পরিমাণ আমদানি করতে হবে, সেখানে কতটুকু ছাড় দেওয়া যায়, এর ফলাফল কী হবে, সেই হিসাব-নিকাশটি করা যায় না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটি আলোচনায় ছিল, তা হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ কমানো। বাজেটে সেটা কতটা আছে?

সেলিম রায়হান: দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তার আওতা ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি করা হয়েছে। কিন্তু এখানেও যথাযথ তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। ২০১৬ সালে করা এক জরিপের সূত্রে এখনো দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আকার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ বলে ধরা হয়। এর মধ্যে করোনার আঘাতে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে। এটা স্বীকার করা হচ্ছে না। তা ছাড়া শুধু দরিদ্র নয়, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তও চাপের মধ্যে পড়েছে। তাদের আয় বাড়েনি বরং অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত বিভিন্ন খাতে তাদের খরচ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব সামনে বোঝা যাবে। দ্রব্যমূল্যকে একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে বাজেটে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো পথ সেখানে নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের বরাদ্দ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

সেলিম রায়হান: জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ গতবারের তুলনায় কমেছে। স্বাস্থ্য খাতে আগের পর্যায়ে রয়ে গেছে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে এই বরাদ্দের কোনো সংগতি নেই। এই দুটি খাতে যেখানে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা, সেখানে কমানো হচ্ছে। মুখে যা-ই বলুন, নীতিনির্ধারকেরা আসলে এর গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না। একটি পরিবারের প্রধান যদি তাঁর সন্তানদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য যা খরচ করা প্রয়োজন, তা করতে না পারেন, তবে তাঁর সন্তানেরা যোগ্য, দক্ষ ও সক্ষম হিসেবে গড়ে উঠবে না। এখন সরকার যদি আমাদের অভিভাবক হয় এবং এই দুই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খরচ করতে না পারে, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ জনগোষ্ঠী শিক্ষিত ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে না। এমন জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধরে রাখা কঠিন। জনমিতির যে সুবিধার কথা বলা হচ্ছে, তা আর ১০ থেকে ১৫ বছর পাওয়া যাবে। এই প্রজন্মের জন্য যদি আমরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিনিয়োগ করতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে যে বাংলাদেশের প্রত্যাশা আমরা করছি, তা পূরণ করা যাবে না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি ধরে রাখা, প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা, মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ, এসডিজি অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়া—সবই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এবারের বাজেট এ ক্ষেত্রে কতটা ভারসাম্যপূর্ণ হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

সেলিম রায়হান: এবারের বাজেটের লক্ষ্য যেন অনেকটাই সাময়িক। বর্তমান সময়ের সমস্যাকেই মাথায় রাখা হয়েছে। লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্ব কম দেখা যাচ্ছে। কিছু প্রশংসনীয় দিক আছে। যেমন দেরি না করে ডলারের দামটি পর্যায়ক্রমে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ও আনুষ্ঠানিক রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেখতে হবে, এই প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক কি না। দারিদ্র্য বড় সমস্যা, কর্মসংস্থানের সমস্যা আছে, অসাম্য বেড়েছে। এসব নিয়ে আলোচনা আছে, তবে সমাধানের পথনির্দেশ নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এবারের বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব বলা হচ্ছে। আপনার মন্তব্য কী?

সেলিম রায়হান: এই বাজেটকে আমি পুরোপুরি ব্যবসাবান্ধব বলব না। করপোরেট কর কমানো হয়েছে আর নির্দিষ্ট কিছু শিল্পের জন্য ছাড় দেওয়া হয়েছে। করপোরেট কর দেয় আনুষ্ঠানিক খাত। কিন্তু আমাদের ব্যবসার ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের এবং তারাই কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। এ খাত কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য এই বাজেটে কিছু নেই। এই বাজেটকে বরং বৃহৎ ব্যবসায়ীবান্ধব বলা যায়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: পাচার করা টাকার বৈধতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর একটি নৈতিক দিক রয়েছে। প্রশ্ন তোলা যায় যে নৈতিকভাবে এটা কতটা যথাযথ? অন্যদিকে যে প্রশ্ন আপনাকে করতে চাই তা হলো, এই সুযোগের ফলে পাচার করা টাকা ফেরত আসবে বলে মনে করেন কি?

সেলিম রায়হান: এর মাধ্যমে যাঁরা টাকা পাচার করেছেন, তাঁদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে। টাকা পাচার করে তাঁরা যেমন লাভবান হয়েছেন, এখন কম সুদে টাকা ফেরত আনলেও তাঁরা লাভবান হবেন। নৈতিকভাবে এটা সমর্থনযোগ্য নয়। এটা সমাজে খারাপ সংকেত দেবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এতে কাজ হবে কি না। অথবা কত টাকা ফেরত আনার আশা সরকার করছে? সরকারের কাছে কি হিসাব আছে কত টাকা পাচার হয়েছে এবং তারা কি প্রাক্কলন করে দেখেছে যে এই সুযোগের ফলে কত টাকা ফেরত আসতে পারে। সরকারের যদি জানা থাকে যে কীভাবে টাকা পাচার হচ্ছে, তাহলে উচিত এই পাচারের পথ বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া। কোনো কোনো দেশ বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু এ থেকে ভালো ফল পাওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। পাচারকারীদের কাছে সরকার কেন নৈতিকভাবে দুর্বল হবে? যেকোনো বিবেচনাতেই এটা বাতিলযোগ্য বলে মনে করি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: প্রস্তাবিত এই বাজেটে যদি আপনাকে কিছু সংশোধনী আনার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আপনি কোন কোন ক্ষেত্রে সংশোধনীর প্রস্তাব করবেন?

সেলিম রায়হান: বাজেটে যেসব বিষয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, তা প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের বাইরে থাকা লোকজনের অনেক পরামর্শ এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। একে সাধুবাদ জানাই। সেই সঙ্গে বলতে চাই, মূল্যস্ফীতির যে অভিঘাত, তা স্বীকৃত দরিদ্রের বাইরেও অনেকের ওপর পড়েছে। তারা যে বিপদে পড়েছে এবং এটা যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ, এই বাস্তবতার স্বীকৃতি বাজেটে নেই। এটিকে স্বীকৃতি দিয়ে এই জনগোষ্ঠীর চাপ কমানোর জন্য যেন কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। আরেকটি চাওয়া হচ্ছে, সরকারের নিজস্ব নীতিকৌশলের সঙ্গে বাজেটকে আরও সংগতিপূর্ণ করা এবং এর জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সেলিম রায়হান: আপনাকেও ধন্যবাদ।