বাংলাদেশিরাও সিরীয়দের জন্য অর্থ দিতে পারেন

>
স্টিনা লুংডেল
স্টিনা লুংডেল
জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) বাংলাদেশ প্রতিনিধি স্টিনা লুংডেল সম্প্রতি তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সিরিয়ার জন্য তহবিল সংগ্রহের বিষয় ছাড়াও ভূমধ্যসাগর ও বঙ্গোপসাগরে মানব পাচার, রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহীদ এজাজ

প্রথম আলো : সিরিয়ার জন্য ইউএনএইচসিআরের তহবিল সংগ্রহে বাংলাদেশ কীভাবে যুক্ত হয়েছে?
স্টিনা লুংডেল : তুরস্কের সৈকতে সিরিয়ার তিন বছরের শিশু আয়লান কুর্দির নিথর দেহ সিরিয়ার সংকট নিয়ে ইউরোপের দ্বিধা যেমন ভেঙেছে, তেমনি সারা বিশ্বের ঘুম ভাঙিয়েছে। মা, বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে শিশুটির তুরস্ক থেকে গ্রিসে যাওয়ার পথে এই করুণ পরিণতি বাংলাদেশ ও এর জনগণকেও নাড়া দিয়েছে। লোকজন জানতে চেয়েছে, সিরিয়ার ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের জন্য কীভাবে হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়। এ দেশের মানুষের এমন আগ্রহের কারণেই সিরিয়ার জন্য জাতিসংঘের তহবিল সংগ্রহের তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের নাম। আমি তো মনে করি, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই যাঁদের সন্তান আছে, তাঁরা শিশু আয়লানের ঘটনার সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে নিয়েছেন। শিশুটির বিয়োগান্ত পরিণতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে সমবেদনার এক অবিশ্বাস্য প্রচারণা। বাংলাদেশের অসংখ্য লোক আমাদের ফোন করেছেন। কীভাবে সিরিয়ার লোকজনের পাশে দাঁড়ানো যাবে, সেটা তঁারা জানতে চেয়েছেন। সাগরপথে ভয়ংকর যাত্রার করুণ পরিণতি এখানকার মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে।
প্রথম আলো : তহবিল-সংকটের কারণেই কি বিশ্বজুড়ে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?
স্টিনা লুংডেল : সিরিয়ার পর্যুদস্ত লোকজনের জন্য যে মানবিক সহায়তা দরকার, তা মেটাতে যে তহবিলের প্রয়োজন, সেখানে প্রায় অর্ধেক তহবিলের সংকট রয়েছে। তাদের সহায়তার জন্য তাঁবু, কম্বল ও রান্নার চুলার মতো ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলোর অভাব রয়েছে। এসব ছাড়া তাদের সেখানে টিকে থাকা অসম্ভব। মৌলিক এ চাহিদাগুলো মেটানো না গেলে তাদের সেখান থেকে অন্য জায়গায় সরে পড়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই অসহায় এসব মানুষকে সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহের এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো : এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে যুক্ত করার পরিকল্পনা কি আগে থেকেই ছিল?
স্টিনা লুংডেল : সিরিয়ার জন্য বিশ্বজুড়ে বেসরকারি খাত থেকে তহবিল সংগ্রহে আমাদের একটি কর্মসূচি আছে। অনেক দেশেই এ তহবিল পরিচালিত হলেও বাংলাদেশে তা নেই। আয়লানের মৃত্যুর পর এখানকার মানুষের আগ্রহ দেখে বাংলাদেশে তহবিল চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। আয়লানের মৃত্যু বাংলাদেশের লোকজনকে সিরিয়ার চলমান পরিস্থিতির সঙ্গে সেতুবন্ধে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের লোকজনের পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত জোরালো। কাছের মানুষকে হারানোর বিষয়টি তাদের গভীরভাবে স্পর্শ করে। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ঠাঁই নিয়েছিল পাশের দেশে। জনগণের একাংশ নিজেরাই ওই দুর্দশার সাক্ষী। আবার তরুণ প্রজন্ম তাদের অভিভাবকদের কাছে শরণার্থী হওয়ার দুর্বিষহ যন্ত্রণার কথা শুনেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দুঃসহ এসব স্মৃতি এখনো এখানকার মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তাই সিরিয়ার মানুষের দুর্ভোগ এখানকার মানুষকে বিশেষভাবে স্পর্শ করেছে।
প্রথম আলো : ভূমধ্যসাগরে লোকজন যেভাবে সাগর পাড়ি দিচ্ছে, গত মে মাসে বঙ্গোপসাগরেও নৌকায় চড়ে মানব পাচারের ঢল নেমেছিল। বর্ষা মৌসুম শেষে বঙ্গোপসাগরে আবার মানব পাচারের শুরুর আশঙ্কা কতটুকু?
স্টিনা লুংডেল : দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, একান্ত নিরুপায় হয়ে সাগরপথে লোকজনের পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমধ্যসাগর ও বঙ্গোপসাগরের পরিস্থিতির মধ্যে মিল রয়েছে। ন্যূনতম মর্যাদার সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে আবাসভূমিতে থাকতে ব্যর্থ হওয়ার পর লোকজনকে অজানার পথে পাড়ি দিতে দেখছি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় স্বদেশ ছাড়ার ক্ষেত্রে লোকজনের মধ্যে মরিয়া ভাব বেশি চোখে পড়ছে। বিশ্বায়নের এ কালে যেকোনো উপায়ে সীমান্তে পাড়ি দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। কাজেই মাতৃভূমিতে কেউ নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে বাস করতে ব্যর্থ হলেই লোকজন নতুন গন্তব্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। প্রথমেই লোকজন নিজের অঞ্চলে থাকার চেষ্টা করে। নিরাপত্তা ও মর্যাদা না পেলে তখন তারা অজানার পথে পা বাড়ায়। এই প্রবণতা আমরা সিরিয়াতে দেখছি। সিরিয়ার লোকজন প্রথমে পা বাড়ায় তুরস্ক, জর্ডান ও লেবানন। তারা যদি ওই দেশগুলোয় প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা ও নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেত, তবে তাদের বেপরোয়া হয়ে অজানার পথে পা বাড়াতে হতো না।
প্রথম আলো : রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে?
স্টিনা লুংডেল : বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গাদের পরিণতিও সিরিয়ার লোকজনের মতোই হয়েছে। মিয়ানমারে নিরাপত্তা ও মর্যাদা না থাকায় তাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে। মৌলিক মানবাধিকার না থাকায় তারা শুরুতে বাংলাদেশে আসে। এখানে এসে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সহযোগিতা না পেয়ে তারা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন গন্তব্যে পাড়ি দিচ্ছে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার এই প্রবণতা খুবই স্বাভাবিক। সিরিয়া সংকটের মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। মিয়ানমারেও মূল সমস্যা দূর হয়নি। আমাদের আশঙ্কা, বর্ষা মৌসুম শেষে আবার বঙ্গোপসাগরে নৌকায় চড়ে মানুষের অজানায় পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা শুরু হবে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছে, এর ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। মানুষ যেসব সময় বিকল্প উপায় খুঁজতে থাকে, সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে। একটি রাস্তা বন্ধ করলেই সমস্যার সমাধান হবে—এটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।
প্রথম আলো : ভূমধ্যসাগরে পাড়ি দেওয়া লোকজনকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে ইউরোপের দেশগুলো দ্বিধায় আছে। অনেক দেশই নিঃস্ব লোকজনকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করছে। ইউএনএইচসিআর ইউরোপের দেশগুলোর এই অবস্থানকে কীভাবে দেখে?
স্টিনা লুংডেল : আশ্রয়প্রার্থী লোকজনকে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে আমাদের দেখতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ইউএনএইচসিআরের অবস্থান খুব স্পষ্ট। যখন কেউ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আন্তর্জাতিক সুরক্ষার আর্তি জানায়, তাদের অবশ্যই আশ্রয় দিতে হবে। তাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকার করাটা আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেকোনো দেশে আশ্রয় প্রার্থনা মৌলিক মানবাধিকার এবং এটি সমুন্নত রাখতে হবে। বাংলাদেশসহ সব দেশের জন্য এটি প্রযোজ্য। ইউরোপে অনেক বেশি শরণার্থীর উপস্থিতি চোখে পড়ে। গ্রিসে যেসব শরণার্থী আসে, তাদের ৭০ শতাংশ সিরিয়ার নাগরিক। সিরিয়া ছাড়াও আফগানিস্তান, ইরাকসহ অনেক দেশ থেকে শরণার্থীরা ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছে। আবার অনেক বাংলাদেশিও এই দলে রয়েছে। এমন এক পরিস্থিতি, কাদের আন্তর্জাতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, সেটি ঠিক করা চ্যালেঞ্জের। তাই ইউএনএইচসিআর ইউরোপে যাচাই-বাছাই পদ্ধতি চালুর কথা বলছে। যে লোকগুলো ইউরোপে আসছে, তারা কতটা নিরুপায় হয়ে এসেছে, আবার কতটা নিজেদের ভাগ্য বদলের জন্য এসেছে, সেটি ঠিক করতে হবে। কেউ যদি অর্থনৈতিক কারণে আসে, নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ফেরত পাঠাতে হবে।
প্রথম আলো : বঙ্গোপসাগরে মানব পাচার রোধে আঞ্চলিক সহযোগিতা কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে?
স্টিনা লুংডেল : ইউএনএইচসিআর এ সমস্যার সমাধানে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে যৌথ উদ্যোগ নিতে উৎসাহিত করে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংস্থার (আসিয়ান) বাইরে এসে একটি বৃহৎ পরিমণ্ডল গড়ে তোলা জরুরি। কারণ, এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে যেমন ৩২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, তেমনি এ দেশে ঠাঁই নিয়েছে অনিবন্ধিত প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশের জন্য এটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাই এ সমস্যা সমাধানে আমরা আঞ্চলিক উদ্যোগকে উৎসাহিত করে আসছি। কেন এসব লোক এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাচ্ছে, তার উৎস খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি মানব পাচারকারীদের মোকাবিলায় আমরা আরও কার্যকর আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছি। অসহায় লোকজনের মরিয়া মনোভাবকে পুঁজি করে যেসব পাচারকারী এ ব্যবসা করছে, তাদের ধরতে হবে। পাশাপাশি লোকজনের অবৈধ পথে যাওয়া নিরুৎসাহিত করতে অর্থনৈতিক অভিবাসন-প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে। মোট কথা, সমন্বিতভাবে এ সমস্যা দূর করার বিকল্প নেই। আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে তৈরি আছি। তবে এই অঞ্চলের দেশগুলোকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা মানব পাচার বন্ধে আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে লোকজন যতক্ষণ নিজেদের জীবন নিয়ে জুয়া খেলা বন্ধ করছে না, নতুন নতুন চক্র আর পাচারকারীর দৃশ্যপটে আসা বন্ধ করা যাবে না।
প্রথম আলো : রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন আবার শুরুর জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনায় বসার সময় হয়েছে কি না?
স্টিনা লুংডেল : লোকজন যেখান থেকে এসেছে, সেখানে তাদের ফিরিয়ে দেওয়াকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সেটা চায়। চূড়ান্তভাবে মিয়ানমারেই তাদের যেতে হবে। তবে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য সহায়ক নয়। রোহিঙ্গাদের ন্যূনতম নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা, তাদের চলাফেরার ওপর বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশের রাজি করাতে হবে। মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ যা করছে, তা যে ঠিক হচ্ছে না, সেটি ইউএনএইচসিআরসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের আচরণ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সব উদ্যোগই ভেস্তে গেছে। সুতরাং, এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের মতো পরিস্থিতি নেই। এমন বৈরী পরিস্থিতির পরও আমাদের হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
স্টিনা লুংডেল : আপনাকেও ধন্যবাদ।

যঁারা সাহায্য করতে চান: সিরীয় শরণার্থীদের সহায়তা করতে আগ্রহীরা ইউএনএইচসিআর তহবিলে অর্থ জমা দিতে পারেন। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, হিসাবের নাম: UNHCR, হিসাব নম্বর ০২–৫৬২৫২৭০–০২