>সেলিম রায়হান। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক। করোনাকালে বিশেষ পরিস্থিতি ও আসন্ন বাজেট নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম
প্রথম আলো: করোনা সংক্রমণ দেশের অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশই পাল্টে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটকে কীভাবে দেখতে চাইবেন?
সেলিম রায়হান: আগামী বাজেটটি ব্যতিক্রমী হওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু যতটুকু শুনতে পাচ্ছি, করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯–এর এত বড় আঘাতের পরও তা গতানুগতিকই হচ্ছে। সময় কম জানি, তবু বাজেটটিকে নতুন চেহারা দেওয়ার এখনো সময় আছে। প্রথমেই ভাবতে পারি স্বাস্থ্য খাত নিয়ে। এটি বরাবরেরই অবহেলিত খাত। সম্ভবত গোটা বিশ্বের মধ্যেই। সামগ্রিকভাবে এ খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। কিছু অপচয় হবে। তারপরও। আমরা মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উঠছি। অথচ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশের কম বরাদ্দ পায় স্বাস্থ্য খাত। এত কম টাকায় এত বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য ভালো কিছু করা যাবে না।
প্রথম আলো: স্বাস্থ্য খাতেই তাহলে অগ্রাধিকার দিতে হবে?
সেলিম রায়হান: বটেই। পাশাপাশি আছে কৃষি। বাজেটে খাদ্যনিরাপত্তার কথা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ, এর সঙ্গে অনেক মানুষ যুক্ত। কৃষি খাতে ভর্তুকি আছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে শুল্কও আছে। এসব শুল্কহার শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। ভালো দিক যে করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশের মতো বড় আকারের একটি প্যাকেজ ঘোষিত হয়েছে। এর মধ্যে কৃষিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু এই প্যাকেজ বাস্তবায়ন করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রথম আলো: এই যে সবকিছু বন্ধ, অর্থনীতির ক্ষত কি মলমের প্রলেপে শুকাবে?
সেলিম রায়হান: আমাদের কর-জিডিপির হার ৯ শতাংশের নিচে। এই হার অতি লজ্জাজনক। আমি যদি বলি, এই হার উন্নয়নের দায়িত্বটা কার? কত ফাঁকিজুকি হচ্ছে, চুরিচামারি হচ্ছে, এগুলো বন্ধ করার দায়িত্ব আসলে কার? এখনো কত খাত রয়ে গেছে, সরকার সেগুলোতে পৌঁছাতেই পারছে না। অর্থের সংকট তো থাকবেই। এত অর্থ পাচারের কথা আমরা শুনি। এগুলো কি বন্ধ হয়েছে? বন্ধ করার দায়িত্বটা কার? মানুষের প্রকৃতিটাই এমন যে সুযোগ পেলেই সুযোগটা নিতে চায়। দায়িত্বশীলদের কাজটা তাহলে কী? তাঁরা এগুলো বন্ধ করছেন না কেন? না করে খালি খালি যাঁরা কর দেন, তাঁদের ওপরই বাড়তি করের বোঝা চাপানো হয়। এ অন্যায়। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে এ যেন আরেকটা অন্যায় করা হয় অসহায় করদাতাদের সঙ্গে।
প্রথম আলো: এখন তো একধরনের জরুরি অবস্থা চলছে। এই সময়ে করণীয় কী?
সেলিম রায়হান: অর্থের টানাপোড়েন যেহেতু আছে, ফলে প্রথমেই অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিতে হবে। দুই বছর মেয়াদি একটা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি নেওয়া দরকার। আর স্বল্প সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়ার দরকার। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশে আটকে রাখার এই সময়ে দরকার নেই। এটা ৮ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত হলেও অসুবিধা নেই কোনো।
প্রথম আলো: অনেক মানুষ যে কষ্টে আছে, না খেয়ে আছে?
সেলিম রায়হান: এটা ঠিক। সামাজিক সুরক্ষার জায়গাটায় ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না। যারা ত্রাণ বা সাহায্য পাওয়ার যোগ্য তারা পাচ্ছে না, আর যারা পাওয়ার যোগ্য নয় তারা পাচ্ছে। এ ব্যাপারে যথাযথ তথ্যভান্ডারও নেই। সরকার জিডিপির তুলনায় এ খাতে ভালো বরাদ্দ আছে বলে দেখায়। পেনশন ও বৃত্তি বাদ দিলে বাস্তবে এর পরিমাণটা বেশি নয়। আগামী অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতকে অগ্রাধিকার তো দিতে হবেই, পাশাপাশি এ–বিষয়ক ত্রুটিগুলোও দূর করতে হবে।
প্রথম আলো: কোভিডের কারণে সরকারের আয়ের খাতগুলো তো সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এত ব্যয়ের চাপ, সরকার চলবে কীভাবে? আপনার পরামর্শ কী?
সেলিম রায়হান: আয়ের মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক), আয়কর ও আমদানি শুল্ক—এই হলো তিনটি প্রধান খাত। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে মূসক। এই মূসক থেকে আরও বেশি আয় আসা সম্ভব। কিন্তু নানা জটিলতা পার করে মূসক আইনটি হয়েছে ঠিকই, বলা যায় এখনো তা কার্যকর নয়। আয়করেও নানা ফাঁকি আছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে না পারার কারণে সরকার বেশি আয়কর আদায় করতে পারে না। প্রথাগত পদ্ধতিতে আর চলবে না। আয়ের খাত বাড়াতে হবে। কোন কোন খাত থেকে কী পরিমাণ রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব, সরকার এ ব্যাপারে গবেষণাও করতে পারে।
প্রথম আলো: তাহলে আগামী বাজেটের অর্থায়নে ভালোই টান পড়ছে বলা যায়।
সেলিম রায়হান: সে তো বটেই। বড় চাপটা ব্যাংক খাতের ওপর পড়ছে। প্যাকেজ বাস্তবায়নের চাপ তো আছেই। তার ওপর ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণ বাড়ছে। আগামী অর্থবছরেও এ ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়বে বলেই ধরে নেওয়া যায়। ভালো হতো সরকার যদি দর-কষাকষি করে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে লম্বা সময়ের জন্য ঋণ নিতে পারত। এলডিসি হিসেবে ঋণ বেশি নেওয়ার কথা আমরা বলতেই পারি। তবে চীন থেকে ঋণ নেওয়ার সময় শর্তগুলো স্বচ্ছ থাকে না। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। ওদিকে খেলাপি ঋণের একটা চাপ আছে। ব্যাংক কমিশন একটা হওয়ার কথা কেবল শুনেই আসছি। এটা হলে ভালো একটা কাজ হতো। দেখা যাক আগামী বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে কী ঘোষণা দেন।
প্রথম আলো: সরকারের ব্যাংকঋণ বাড়লে ব্যক্তি খাতের ঋণবঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না?
সেলিম রায়হান: তা তো থাকেই। কিন্তু বাস্তবে সেটাই হতে যাচ্ছে। ব্যাংক খাত একটা জিনিস থেকে রেহাই পেতে পারত, যদি ভালো একটা পুঁজিবাজার গড়ে উঠত। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছি, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সফল উদাহরণও আছে আমাদের। কিন্তু পুঁজিবাজারটা দাঁড়ালই না। এই অপরিপক্ব পুঁজিবাজার চূড়ান্ত বিচারে বড় শিল্পায়নের পথে অন্তরায়। পুঁজিবাজারে যখনই বড় ধরনের অঘটন হয়েছে, তার তদন্তও হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো আর মানা হয়নি। সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে। আমরা অপেক্ষা করতে পারি, দেশে প্রকৃত পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে তাঁরা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন।
প্রথম আলো: আয় কম হওয়ার কারণে ব্যয়ও কি কমাতে হবে?
সেলিম রায়হান: অতিপ্রয়োজনীয় ব্যয় তো করতেই হবে। কিন্তু কিছু প্রকল্প থাকে, রাখার জন্য রাখা। এগুলোর বিষয়ে শক্ত হওয়ার সময় এসেছে। কৃচ্ছ্রসাধনও করতে হবে। এ ব্যাপারে জাতীয়ভাবে দুই বছরের জন্য একটা ঘোষণা আসতে পারে। সরকারি তরফ থেকেই তা শুরু হোক। হতে পারে যে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উঁচু গ্রেডের সরকারি কর্মচারীরা তাঁদের বোনাসটা নিলেন না।
প্রথম আলো: প্রবাসী আয়ে যে বড় ধাক্কা আসছে, এর কী হবে?
সেলিম রায়হান: সামনে খারাপ দিন আসছে, আঁচ করতে পারছি। জ্বালানি তেলের দাম এভাবে কমতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাবে। এর ফলে বিদেশে শ্রমিক যাওয়া কমে যেতে পারে। তার ওপর নতুন করে কিছু শ্রমিক ফিরে আসছেন। তাঁরা হয়তো আর বিদেশে কাজ করতে যেতে পারবেন না। তাঁদের জন্য বাজেটে একটা ঘোষণা থাকতে পারে, যাতে তাঁরা কিছু একটা করে খাওয়ার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ পেতে পারেন।
প্রথম আলো: করোনার শিক্ষা বাজেট প্রণয়নে সরকার কাজে লাগাচ্ছে বলে মনে করেন?
সেলিম রায়হান: কিছুটা আশাবাদ দেখতে পাচ্ছি। অনেক দিন পর হলেও স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনকে কার্যকর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। এখন দরকার সমন্বয়ের। আর দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছার। এত বড় প্যাকেজ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে সুযোগসন্ধানী থাকবে। এদের ব্যাপারে নজরদারি বাড়াতে হবে। বড় কথা হচ্ছে অর্থ পাচার ও দুর্নীতির কারণে দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিবছর বঞ্চিত থাকছে। এ টাকায় সরকার আরও বড় বড় কাজ করতে পারত। অর্থের অভাবে সরকারকে এত হাহাকার করতে হতো না। আগামী বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলবেন বলে আশা রাখছি।
প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সেলিম রায়হান: আপনাকেও ধন্যবাদ।