৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও কামরুল হাসান
প্রথম আলো: দলীয় সরকারের অধীনে এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক প্রধান হিসেবে আপনি কী কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন।
মোহাম্মদ নুরুল হুদা: দেখুন, দলীয় সরকারের অধীনে আগেও নির্বাচন হয়েছে।’ ৭৩-এ দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়েছে। তবে’ ৯১-এর পরে দলীয় সরকারের অধীনে সব দলকে নিয়ে নির্বাচন আর হয়নি। নির্বাচনের সময় পুলিশের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। এটা আইনেই আছে। নির্বাচন কমিশন যে পরিপত্র দেবে, সেই অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাজ করতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তাঁদের নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রথম আলো: নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বা পরে তাদের ভূমিকার কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? একের পর এক মামলা হচ্ছে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নামে।
নুরুল হুদা: আমি বিষয়টি সেভাবে দেখি না। ফৌজদারি অপরাধ প্রতিরোধ ও তদন্ত করা পুলিশের কাজ। তফসিল হলে তো আর অপরাধ বন্ধ থাকে না। অপরাধ হলেই পুলিশ কাজ করবে। তবে নির্বাচনের সময় তাদের দায়িত্বটা বেশি থাকে।
প্রথম আলো: তফসিল ঘোষণার আগে পুলিশ রাজনৈতিকভাবে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। যেহেতু রাজনৈতিক সরকার ছিল, সে কারণে তারা তাদের কথামতো কাজ করেছে। গায়েবি মামলা দিয়ে রেখেছে। এখন নির্বাচনের সময় সেই মামলায় নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় করছে। এ অবস্থায় কী করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব?
নুরুল হুদা: পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করলেও সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকে ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর। তদন্ত পর্যায়ে যদি ম্যাজিস্ট্রেট দেখেন কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে, তা হলে তিনি আদেশ দিতে পারেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন।
প্রথম আলো: এখন যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে পুলিশের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ নেই বলে অনেকের ধারণা। তাঁদের যুক্তি, কোনো ঘটনা ঘটেনি কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার জন্য পুলিশ মামলা করেছে। এখন যাঁরা নির্বাচন করবেন, বেছে বেছে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ অবস্থাকে কীভাবে দেখেন?
নুরুল হুদা: এটা যদি বড় আকারে হয়ে থাকে তাহলে আদালতের সাহায্য নিতে হবে। আদালত যদি দেখেন এর প্রমাণ আছে, তাহলে ব্যবস্থা নেবেন। আবার নির্বাহী বিভাগের কাছেও প্রতিকার চাইতে পারে।
প্রথম আলো: যেখানে পুলিশ দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করছে, তারা সবকিছু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করছে, সেখানে মানুষ কীভাবে প্রতিকার পাবে?
নুরুল হুদা: আমি মনে করি না যে আপনি যা বলছেন সেটা হয়েছে। আমি মনে করি, ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তির বিচ্যুতি হতে পারে। কিন্তু পুরো সংস্থা এভাবে একপেশে হতে পারে না। পুলিশ নির্বাহী বিভাগের অংশ। তারা রাজনীতি করতে পারে না। করলে সেটা আচরণবিধি লঙ্ঘনের মধ্যে পড়বে। তাদের কর্তৃপক্ষ আছে। সেখানে অভিযোগ করার সুযোগ আছে। আর যদি মামলার ক্ষেত্রে সেটা হয়, তাহলে তো উচ্চ আদালত আছেন। সেখানেও অভিযোগ জানানোর সুযোগ আছে।
প্রথম আলো: জনমনে এ রকম একটি ধারণা আছে যে পুলিশই সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় পুলিশ কর্মকর্তারা সেটা বড়াই করে বলেনও।
নুরুল হুদা: কে কাকে টিকিয়ে রাখছে? জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার কি নির্বাহী বিভাগের কোনো অংশ দ্বারা টিকে থাকতে পারে? এটা হতে পারে না। আমার মনে হয়, সরকারের সে প্রয়োজনও নেই।
প্রথম আলো: আপনি বলছিলেন, পুলিশের কাজ হলো অভিযোগটি আদালতের কাছে তুলে ধরা। কিন্তু সময়টিও দেখার বিষয়। বিরোধী দলের যেসব প্রার্থী ও নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেসব নেতা এখন নির্বাচন করতে ভোটারের কাছে যাবেন, না আইনি লড়াই করার জন্য আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরবেন?
নুরুল হুদা: জরুরি অবস্থায় হয়তো আলাদা সিদ্ধান্ত হতে পারে। এটা পুলিশের ব্যাপার নয়। রাজনৈতিক নেতাদেরই সমস্যাটি বুঝতে হবে। কারণ, পুলিশকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। আইনের অধীনে থেকে তাদের কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুলিশকে ব্যবহার করা রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৈন্য বলে মনে করি। এ অবস্থা থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রথম আলো: এ দৈন্য কাটিয়ে উঠতে হলে কী করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
নুরুল হুদা: কাউকে না কাউকে সাহস করে এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন কিছুই হবে না। কোথাও নোংরা জমলে তো সেটি পরিষ্কার করতে হবে।
প্রথম আলো: ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
নুরুল হুদা: গণতন্ত্রের পথে এটা একটা বড় পরীক্ষা। আমি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে নই। দেখুন, যে লোককে আপনি পাঁচ বছর শাসন করতে দিতে পারছেন, নির্বাচনের সময় তাঁর ওপর আস্থা রাখবেন না, এটা কেমন কথা? তবে এটা শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যও একটা পরীক্ষা। তাঁরা কীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, সেটাও দেখার বিষয়।
প্রথম আলো: মাগুরার উপনির্বাচনে যে কারচুপি ও দখলবাজির উদাহরণ তৈরি হয়েছিল, তা থেকে তো আমরা বেরিয়ে আসতে পারলাম না। এরপর অনেক মাগুরা তৈরি হলো। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে ব্যাপক অনিয়ম ও সন্ত্রাস হয়েছে, তা একজন নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যেই উঠে এসেছে। এটা কেন হলো?
নুরুল হুদা: এর শুরু কিন্তু মাগুরা থেকেই। নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে তখন জেলখানা থেকে অপরাধীদের বের করে আনা হয়েছিল। সার্কিট হাউসে দলীয় মাস্তানরা আস্তানা গেড়েছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুর রউফ যদি সেখান থেকে চলে না এসে নির্বাচনটিই বন্ধ করে দিতেন, হয়তো আমাদের নির্বাচনী ইতিহাসটাই অন্য রকম হতো।
প্রথম আলো: আইন অনুযায়ী যার যে কাজ করার কথা, সেটি করে না বলেই রাজনীতিতে এত অঘটন, এত অবিশ্বাস। এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
নুরুল হুদা: আসলে রাজনীতি হলো সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। রাজনীতিকেই চালকের আসনে রাখতে হবে। কিন্তু আপনি যখন দেখছেন প্রত্যক্ষ ভোটে কাঙ্ক্ষিত প্রতিনিধি পাওয়া যাচ্ছে না, তখন একটা ভারসাম্যের কথা ভাবা যেতে পারে, যারা রাজনীতিকদের বিকল্প নন, বরং পরিপূরক হবেন। আমি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলছি। ভারতসহ অনেক দেশেই এই ব্যবস্থা আছে।
প্রথম আলো: জনগণ মনে করে, পুলিশ ও জনপ্রশাসনের ওপরই নির্বাচনটি সুষ্ঠু হওয়া না–হওয়া নির্ভর করছে।
নুরুল হুদা: প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যদি পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন, তবে দেশের জন্য সেটা ভালো হবে না। একদল লোক একসময় সরকারে থাকে, আরেক দল অন্য সময়ে। নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার পরিবর্তন হবে। ক্ষমতাকে কেউ স্থায়ী ভাববেন না।
প্রথম আলো: কিন্তু এখানে তো সবাই (রাজনৈতিক নেতৃত্ব) তা–ই ভাবেন।
নুরুল হুদা: দেশের কল্যাণের জন্য এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রথম আলো: নির্বাচনের আগেই বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু সহিংস ঘটনা ঘটেছে, আপনি কি মনে করেন এতে নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট হতে পারে?
নুরুল হুদা: এলাকাবিশেষে কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। তবে অন্য সময়েও সহিংসতা ঘটে থাকে। এসব ঘটনায় কতখানি রাজনীতি আছে আর কতখানি রাজনীতি নেই, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা কঠিন।
প্রথম আলো: তারপরও পুলিশের পক্ষপাতমূলক আচরণকে তো খাটো করে দেখা উচিত নয়।
নুরুল হুদা: আমি যে কথাটি বলব, তা হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে; যাতে মানুষ পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে পারে।
প্রথম আলো: এবারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান দুই দল যাঁদের মনোনয়ন দিয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? কেমন জনপ্রতিনিধি পেতে যাচ্ছি আমরা?
নুরুল হুদা: রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসতে চায়, ক্ষমতার জন্যই তারা রাজনীতি করে। সেই বিবেচনায় হয়তো তারা মনোনয়ন দিয়েছে। তবে আমি মনে করি, আরও বেশি তরুণ প্রতিনিধি আসতে পারতেন। সেটা ভালো হতো। বিতর্ক নেই বা বিতর্ক কম আছে, এমন লোকদের মনোনয়ন দিলে দল সম্পর্কে মানুষ ভালো ধারণা করে।
প্রথম আলো: তরুণ নেতৃত্বের কথা বললেন। ২৮ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশ চালাচ্ছে। কিন্তু তাদের শাসনামলে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় না। তাহলে তরুণ নেতৃত্ব আসবে কীভাবে? বিষয়টি নিয়ে খোদ রাষ্ট্রপতিও উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
নুরুল হুদা: অস্বীকার করা যাবে না যে ছাত্র সংসদ হলো নেতা তৈরির ক্ষেত্র। শিক্ষাজীবন থেকেই নেতৃত্বগুণ অর্জন করতে হবে। আগের রাজনীতিতে সেটাই চালু ছিল। আমি মনে করি, ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়মিত হওয়া উচিত।
প্রথম আলো: আমরা অনেক নির্বাচন কমিশন পেয়েছি। তুলনামূলক বিচার করুন।
নুরুল হুদা: বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে বলব প্রশাসন থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা বেশি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আবু সাঈদ, মোহাম্মদ আবু হেনা ও এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন ভালো নির্বাচন করেছে।
প্রথম আলো: কিন্তু রকিব কমিশন তো সবাইকে নিয়ে একটি নির্বাচন করতে পারল না। সেই বিবেচনায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাজকর্মকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নুরুল হুদা: আমি মনে করি, বর্তমান কমিশন চেষ্টা করছে। সাধ্যমতো করার চেষ্টা করছে। তারা নিজেদের কাজের গুরুত্ব বুঝতে পারছে। দেখুন, নির্বাচন ছাড়াও তাদের অনেক কাজ আছে। যেটা ঃসারা বছর চলে। তবে আমি মনে করি, নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করতে হলে তাদের আরও শক্ত ভূমিকা নিতে হবে। নিজেদের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
নুরুল হুদা: আপনাকেও ধন্যবাদ।