বিশেষ সাক্ষাৎকার : নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সংস্থাগুলো ক্ষমতাহীন

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অতিরিক্ত আইজি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বর্তমানে তিনি অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও পাহাড়িদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, পুলিশ বিভাগের সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রশ্ন

পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন, যেখানে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে?

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: তিন পার্বত্য জেলার বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে খারাপ বলা যাবে না; যদিও প্রতি মাসেই কোথাও না কোথাও খুন ও প্রতিখুনের ঘটনা ঘটছে। এসব হত্যাকাণ্ডের একটি প্যাটার্ন দাঁড়িয়ে গেছে। খুনোখুনির ঘটনাগুলো ঘটছে মূলত প্রত্যন্ত এলাকায় এবং তা বেআইনি অস্ত্রধারী পাঁচটি উপদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। আগে উপদল ছিল চারটি, বান্দরবানে নতুন গজিয়ে ওঠা মগ পার্টিসহ এখন উপদলের সংখ্যা ৫। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজি সংঘাতের প্রধান কারণ। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন জেলায় সমন্বিত অভিযানের মাধ্যমে বেআইনি অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করা হলে চাঁদাবাজি, সংঘাত ও হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে।

প্রশ্ন

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই যুগ পার হয়েছে। চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে বাদানুবাদ চলছে। এক পক্ষ বলছে চুক্তির প্রায় পুরোটা বাস্তবায়িত হয়েছে। আরেক পক্ষে দাবি, মূল সমস্যা রয়েই গেছে। আপনি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। পরবর্তীকালে উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ অভিজ্ঞতার আলোকে বলুন সমস্যাটি কোথায়।

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: চুক্তির প্রায় পুরোটা বাস্তবায়িত হয়েছে—এ তথ্য যেমন সঠিক নয়, আবার যাঁরা চুক্তির প্রায় কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি বলে থাকেন, তা-ও সত্য নয়। চুক্তির অনেক ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, অন্তত কাগজে-কলমে, কিন্তু তা সব ক্ষেত্রে ইন লেটার অ্যান্ড স্পিরিট হয়নি। চুক্তি ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়/কার্য, যেমন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, সমবায়, স্থানীয় পর্যটন, কৃষি, যুব উন্নয়ন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, যোগাযোগ ইত্যাদি জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হলেও পূর্ণ কর্তৃত্ব দেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো তাদের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব ধরে রেখেছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে যে কয়টা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে: ক. পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় খ. পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গ. চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পরিবীক্ষণ কমিটি ঘ. ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণসংক্রান্ত টাস্কফোর্স ঙ. পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন

মন্ত্রণালয়সহ উল্লেখিত পাঁচটি সংস্থার কোনোটির গঠন ও ক্ষমতায়ন সম্পূর্ণ হয়নি। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি কার্যকরও করা যায়নি। মাত্র তিনটি পার্বত্য জেলা নিয়ে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হলেও এ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থাগুলো হচ্ছে শুধু আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। তিন জেলার ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা, ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান হেডম্যান-কারবারি ইত্যাদির কোনোটির ওপর মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্তৃত্ব নেই। নানা জটিলতার কারণে নির্বাচন না হওয়ায় সরকার-মনোনীত লোকজন নিয়ে দুই দশক ধরে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের কার্যক্রম কোনো জবাবদিহি ছাড়াই চলছে। চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি, টাস্কফোর্স ও ভূমি কমিশন প্রথম থেকেই অকার্যকর। ইদানীং চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি, টাস্কফোর্স ও কমিশনের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না, যা হতাশাজনক।

প্রশ্ন

পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ। এ সমস্যার সমাধান তো এখনো হলো না। গত দুই যুগেও ভূমি কমিশন কাজই শুরু করতে পারল না। এর কারণ রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না আমলাতান্ত্রিক জটিলতা?

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া ভূমি কমিশনকে কার্যকর করা যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ অংশের ২ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন এবং উপজাতীয় শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পর সরকার এ চুক্তি অনুযায়ী গঠিতব্য আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে যথাশিগগির পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপকাজ শুরু এবং যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গাজমি–সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করত উপজাতীয় জনগণের ভূমি মালিকানা চূড়ান্ত করিয়া তাহাদের ভূমি রেকর্ডভুক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ চুক্তির ৬(খ) ধারায় বলা আছে, ‘কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন।’ ভূমি কমিশনের আইন প্রণীত হয় ২০০১ সালে। পরবর্তী সময়ে অনেক আলাপ-আলোচনার পর প্রবিধান প্রণীত হলেও তা অজ্ঞাত কারণে অনুমোদনহীন অবস্থায় পড়ে আছে। কমিশন ২২ হাজারের বেশি বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন গ্রহণ করলেও একটিরও সমাধান দিতে পারেনি। বর্তমান কমিশন সম্ভবত সপ্তম কমিশন। উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কমিশনকে কার্যকর করা যাবে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন

চুক্তির সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালিদের জনসংখ্যার যে অনুপাত ছিল, তা এখন নেই। সেখানে পাহাড়িরা অনেকটা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে চুক্তির কার্যকারিতা কতটা থাকবে, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা আছে।

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনামলে সমতলের কয়েক লাখ দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষকে তিন পার্বত্য জেলায় পুনর্বাসিত করার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রথম অংশের প্রথম ধারাটি হচ্ছে, ‘উভয় পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন।’ ভবিষ্যতে চুক্তির কার্যকারিতা কতটুকু থাকবে, তা বলা মুশকিল। বর্তমানেই নানা বাদানুবাদে তা অনেকটা ঠুনকো হয়ে পড়েছে। তবে সময়, পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরকারী উভয় পক্ষকে বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের যে আবহ তৈরি হয়েছে, তা দূর করার লক্ষ্যে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রশ্ন

যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়, তখন প্রায় সমগ্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠী জনসংহতির সমর্থক ছিল। ইউপিডিএফ নামে ক্ষুদ্র একটি অংশ এর বিরোধিতা করে। এখন জনসংহতি ও ইউপিডিএফ দুটোই বিভক্ত এবং অন্তর্দলীয় সংঘাতে লিপ্ত। এ বিভক্তির পেছনে কি নেতৃত্বের কোন্দল, না অন্য কিছু সক্রিয় ছিল বলে মনে করেন?

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও সমগ্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠী জনসংহতির সমর্থক ছিল না। তখনো জাতীয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপির নেতৃত্বে পাহাড়িরা ছিল। হয়তো বেশির ভাগ পাহাড়ি, বিশেষত চাকমারা জনসংহতি সমিতির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, কিন্তু ‘সমগ্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠী’ কখনো একটি নির্দিষ্ট দলের অনুসারী ছিল না, এখনো নেই। যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হলে নেতৃত্বের কোন্দল ও দলের ভাঙন অনিবার্য হয়ে পড়ে। কেউ কেউ বিভিন্ন সংস্থাকেও এ জন্য দায়ী করে থাকেন।

প্রশ্ন

পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আছে। এর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। অভিযোগ আছে, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার সিংহভাগ তারা পাচ্ছে এবং অন্যরা বঞ্চিত হচ্ছে। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ১১টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। জনগোষ্ঠীগুলো হচ্ছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমি, চাক ও খিয়াং। চাকমারা শুধু জনসংখ্যায় বেশি তা নয়, শিক্ষা–দীক্ষা ও চিন্তাচেতনার দিক থেকেও তারা অন্যদের চেয়ে অনেক অগ্রসর। এ কারণে স্বভাবতই সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও তারাই বেশি পেয়ে আসছে। তবে সংখ্যায় কম ও পিছিয়ে পড়া অন্যরাও যাতে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার সম–অংশীদার হতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের মূল ভাবনাটিই হচ্ছে ‘নোবডি টু বি লেফট বিহাইন্ড’, অর্থাৎ কাউকে পিছিয়ে রাখা হবে না।

প্রশ্ন

রাঙামাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল পাহাড়িদের একাংশ। আপনি এ বিরোধিতাকে কীভাবে দেখেন?

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা কিছু মানুষের অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, যা ইতিমধ্যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাঁরা মনে করেছিলেন, এসব প্রতিষ্ঠান পার্বত্য এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হলে আরও বেশি সংখ্যায় ‘বাঙালি অনুপ্রবেশ’ ঘটবে। যাঁরা বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরাই এখন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে চাকরি ও ভর্তির জন্য নিয়মিত তদবির করেন বলে শোনা যায়। তবে সমতলের অন্যান্য জেলার মতো গতানুগতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় না করে চীনের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার শিক্ষার্থীদের ‘মিনজু’ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা নরওয়ের স্যামি ইউনিভার্সিটির আদলে রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশেষায়িত হলে তা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হতো।

প্রশ্ন

পার্বত্য চট্টগ্রামে জনজীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা কতটা ফিরে এসেছে? রাষ্ট্র ও জনসংহতি সমিতি যে আস্থার ভিত্তিতে চুক্তি করেছিল, সেই আস্থা পরবর্তীকালে কাদের জন্য নষ্ট হলো বলে মনে করেন।

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: সংঘাতের সময়ের দুঃসহ অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে চুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্য এলাকায় শান্তি ও স্বস্তি অনেকখানি ফিরে এসেছে। শিক্ষা, যোগাযোগ, কৃষি—সব ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য উন্নতি হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধিক্ষেত্র ও বরাদ্দ আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ২০১১ সালে সচিব হিসেবে এ মন্ত্রণালয়ে আমার যোগদানের সময় প্রকল্প সহায়তাসহ উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩১৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে আমার অবসরের সময় তা ৯১৫ কোটিতে উন্নীত হয়। তবে এ বরাদ্দ আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পার্বত্য চুক্তির ‘ঘ’ অংশের ৯ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের লক্ষ্যে অধিকসংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করিবেন। এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করার লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করিবেন এবং সরকার এ উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করিবেন।’ কাদের জন্য আস্থা নষ্ট হলো, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে যেকোনো ধরনের আলোচনা ও দর-কষাকষিতে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। অনমনীয় অবস্থান অনেক সময় স্থবিরতা এনে দেয়।

প্রশ্ন

স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগ এখনো চলছে ঔপনিবেশিক আইন দ্বারা। আপনি পুলিশ বিভাগে দায়িত্বশীল পদে থাকাকালে পুলিশ সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশনের সুপারিশগুলো পরবর্তীকালে বাস্তবায়িত হলো না কেন?

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: আমাদের দেশের পুলিশ এখনো ১৮৬১ সালে প্রণীত পুলিশ আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যার আশু সংস্কার প্রয়োজন।
ফখরুদ্দীন সাহেবের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুলিশের সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে ‘পুলিশ সংস্কার কর্মসূচি’ গ্রহণ করেছিল, যার জাতীয় প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেটি ছিল কর্মসূচি, কমিশন নয়। ২০১০ সালে পুলিশ ছেড়ে আসার আগপর্যন্ত আমি এ দায়িত্বে ছিলাম। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ২০০৭ সালের জুন মাসে আমরা পুলিশ আইনের যুগোপযোগী একটি খসড়া তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দিই। কিন্তু পুলিশ সংস্কারের বিপক্ষে নানামুখী চাপের কারণে তা আর বিবেচিত ও বাস্তবায়িত হয়নি। পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল জনগণ ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, গণতান্ত্রিক সমাজের উপযোগী, জনবান্ধব ও পেশাদার একটি পুলিশ সার্ভিস গড়ে তোলা। পুলিশের ভাবমূর্তি নিপীড়ক বাহিনী হিসেবে নয়, বরং সেবাধর্মী একটি সংস্থা হিসেবে বিনির্মাণ ছিল কর্মসূচির অভীষ্ট। কিন্তু স্বার্থান্বেষী নানা মহলের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

প্রশ্ন

পুলিশ বিভাগের মূল সমস্যা অদক্ষতা ও অতি রাজনীতিকীকরণের সম্মিলনই এ বিভাগকে নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: বর্তমানে পুলিশ বিভাগের ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে, উন্নয়ন হয়েছে অবকাঠামোর, সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন ইউনিটের। পুলিশের দক্ষতা ও সামর্থ্যও বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। আইনি সংস্কার, কনস্টেবল-এসআই পদে নিয়োগে স্বচ্ছতা এবং বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে শারীরিক-মানসিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনে সক্ষম ও যোগ্য ব্যক্তিদের পুলিশের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে পারলে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব। পুলিশ সংস্কার কর্মসূচিতে পুলিশের ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপ বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আইনি সংস্কারের মাধ্যমে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করা সম্ভব হয়নি।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: আপনাকেও ধন্যবাদ।