বিশেষ সাক্ষাৎকার

পরিচ্ছন্ন চেহারার সরকার চাই

সুলতানা কামাল, মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। একাদশ সংসদ নির্বাচন–উত্তর পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল

প্রথম আলো: একাদশ সংসদ নির্বাচনে কেমন সরকার আশা করেছিলেন?
সুলতানা কামাল: আমার আকাঙ্ক্ষা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি যাদের আনুগত্য রয়েছে, তারাই এ দেশ শাসন করবে। যারা কখনো মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করেনি, বরং বিরোধিতা করেছে, এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ তাদের পাওয়া উচিত ছিল না। এখন প্রশ্ন থাকে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের চেহারাটা আমরা কেমন দেখতে চাই? সেই চেহারাটা কেমন হওয়া উচিত? স্পষ্ট করে বলতে চাই, তাতে এমন ছবি দেখতে চাই না, যারা নারী নির্যাতন করে, অন্যের জমি কেড়ে নেয়, যারা ঋণখেলাপি, যে ক্ষমতা বা অবস্থান তাদের রয়েছে, তার সুযোগ নিয়ে অন্যের ওপর অত্যাচার করে, অন্যের জীবন বিপন্ন করে, যাদের বিরুদ্ধে শিশুহত্যার অভিযোগ আছে, সম্মানী মানুষকে অপমান করার অভিযোগ আছে, অথচ অবস্থানগত কারণে তারা এসবের দায় থেকে পার পাচ্ছে—এমন মানুষকে আমরা কখনোই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে দেখতে চাই না। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে পুনরায় ক্ষমতায় দেখে আমি অনেক বেশি স্বস্তি পেতাম, যদি এই ফিরে আসাটা কতখানি শক্ত ভিত্তির ওপর হলো, তা নিয়ে সংশয় রাখতে না হতো।

প্রথম আলো: স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে বিএনপি যখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল, তখন কার্যত তাকে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি হিসেবে দেখাটা অপ্রয়োজনীয় ও আত্মঘাতী কি না?
সুলতানা কামাল: আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সে দেশে রাজনীতি করার অধিকার থাকার কথা নয়।

প্রথম আলো: বিএনপির সরকার করতে পারার মানে কি তাহলে জনগণ স্বাধীনতার বিপক্ষে!
সুলতানা কামাল: বিএনপি তো তাদের (জামায়াত) ফেরত এনেছে, প্রশ্রয় দিয়েছে, প্রতিষ্ঠিত করেছে। জনগণকে তো এভাবে তৈরি করা হয়েছে। ১৯৭৫ থেকে ’৯০ পর্যন্ত সেভাবেই জনমত গড়া হয়েছে।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগকে অধিকতর পরিচ্ছন্ন চেহারা দিয়ে জনগণের সেই মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে?
সুলতানা কামাল: একদম ঠিক। আমি এটাই বলতে চেয়েছি। আওয়ামী লীগ অনেক সময় তার বিচ্যুতি, যেমন খেলাফতের সঙ্গে ৫ দফা চুক্তি, হেফাজতের সঙ্গে হাত মেলানো, নারীনীতি না করা, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না করা—এসবের জন্য তারা অজুহাত দেয় যে সমাজ এখনো তৈরি নয়। একাত্তরে তারা স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দিয়েছিল। এখন তাহলে তারা কিসের নেতৃত্ব দেয়? ‘মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করলেই তো হবে না, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ন্যায়ানুগ সমাজ তৈরির দায়িত্ব কি তাদের নেই? আমি মনে করি, সেটা আছে এবং সেখানেই তাদের প্রকৃত বৈধতার পরীক্ষা।

প্রথম আলো: ভোটের বৈধতার ঘাটতি এভাবে কিছুটা পূরণ হবে?

সুলতানা কামাল: সেভাবেই হতে পারে বলে আমি মনে করি। আওয়ামী লীগ যে বলবে, তারাই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের, সে দাবির বৈধতাটাই–বা কী? তারা কী বলে ম্যান্ডেট চাইবে? আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের বৈধতার ভিত্তি হওয়া উচিত সুশাসন এবং ন্যায়ানুগ সমাজ তৈরি। এখানে অন্য কোনো কৌশলে যেন তারা বৈধ হওয়ার চেষ্টা না করে। কিংবা অন্যভাবে বলি, ওই ঘাটতি রেখে তারা যদি ভিন্ন পথে ক্ষমতায় আসে, সেটা তাদের জন্য গৌরবের হবে না।

প্রথম আলো: জিডিপি আরও ২ শতাংশ বাড়ল, আরও কিছু পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল গড়ে তুললে?

সুলতানা কামাল: না। এই শূন্যতা থেকেই যাবে। দালানকোঠার উন্নয়ন দিয়ে সুশাসনের সঙ্গে ‘ট্রেড’ হবে না। এটা বিনিময়যোগ্য নয়।

প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কড়া সুরে ভোটের জালিয়াতি যাচাই করতে বলছে?

সুলতানা কামাল: সে জন্যই ফলাফল কতখানি বিশ্বাসযোগ্য, সেটা প্রমাণ করার একটা দায় অবশ্যই বর্তেছে।

প্রথম আলো: বিএনপির মতে, ভোটের আগের রাতেই ২০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট কেটে ঢোকানো হয়েছে।

সুলতানা কামাল: আমরা সবাই বিচারকের জায়গায় বসে যেতে পারি না। বলতে পারি না এটা সত্য, এটা মিথ্যা। ইসির নৈতিক দায়িত্ব এ বিষয়ে তদন্ত করা। ইসিকে এখানে বিচারকের ভূমিকা দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে তারা একটা সমাধানে পৌঁছাক। মানুষকে জানতে দেওয়া উচিত, আসলে ঘটনা কী ঘটেছে।

প্রথম আলো: দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন সম্পর্কে আপনার কী মূল্যায়ন?

সুলতানা কামাল: যদি একটা সমাজে মানবাধিকার বিরাজ করে, সেখানে সব ধরনের মানুষ নিজেদের যথেষ্ট স্বাধীন মনে করবে। আজকের বাংলাদেশে কতজন মানুষ ভাবতে পারে যে, আমি আমার জীবনটা স্বাধীনভাবে কাটাতে পারছি। আরেকটি প্রশ্ন হলো যে আমি এই রাষ্ট্রে বসবাস করে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করি কি না। যখনই আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন তুলি, তখন উত্তর পাই কোন সমাজে এটা ঘটে না। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, যদি মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হয়, তাহলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করেন কি না?

প্রথম আলো: সমাজে এই প্রশ্নগুলো আছে, এর উত্তর কী?

সুলতানা কামাল: এতখানি আমি বলতে পারি, নিজের ছেলের হত্যাকাণ্ডের পর পিতাকে বলতে শুনেছি, আমি বিচার চাই না। আরেকজন পিতা বিচার চেয়েছেন, কিন্তু বিচার না পেয়ে পেয়ে এখন বলছেন তিনি বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন।

প্রথম আলো: সেটা তো হতাশা থেকে।

সুলতানা কামাল: অবশ্যই সেটা হতাশা থেকে। তার মানে মানবাধিকারের জায়গায় আমরা এতটাই পিছিয়ে আছি যে আজকে বলতে বাধ্য হচ্ছি, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম উদ্বেগজনক।

প্রথম আলো: গত এক দশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উন্নয়নের প্রশংসা করেছে।

সুলতানা কামাল: করেছে, তবে যখন জাতিসংঘের বিভিন্ন কমিটিতে গিয়েছি, তখন কিন্তু নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নও আছে। এখন একটু পরপর বিদ্যুৎ যায় না। মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার খরচে প্রচণ্ড বৈষম্য বেড়েছে। আমি একটা গাড়িতে একা যাই। আমাদের সন্তানদের যেতে হচ্ছে টেম্পোর পাদানিতে গাদাগাদি করে।

প্রথম আলো: কিন্তু কেউ কেউ বলছেন, এটি একটি প্রক্রিয়া। এটা দীর্ঘ মেয়াদে থাকবে না।

সুলতানা কামাল: এটা সম্ভব হতো যদি আমরা দেখতাম সরকার এসব দিকে মনোযোগ দিয়েছে। মানবাধিকারের প্রশ্নগুলো যখন তুলি, সরকার সব সময় ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের অসহিষ্ণুতা রয়েছে। যখনই আমরা মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্ন তুলেছি, তখনই তারা তাকে সমালোচনা হিসেবে গণ্য করেছে। অসহিষ্ণুতা প্রতিটি সরকারের অভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তারা সার্বক্ষণিকভাবে শুনতে চায়, তারা যা করছে, সেটাই ভালো। তারা তাদের ত্রুটিগুলো দেখতে চায় না। এ রকম অসহিষ্ণুতা আসে ক্ষমতা হারানোর ভয় থেকে।

প্রথম আলো: নির্বাহী বিভাগের ঘাটতি পূরণ করার জায়গা বিচার বিভাগ। সেখানে কী দেখেন?

সুলতানা কামাল: রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে যে ভারসাম্য থাকার কথা, সেখানে অস্বচ্ছতা দেখা দিয়েছে। বিচার বিভাগের দিকে তাকালে আমরা দেখি, তারা কখনো কখনো অ্যাকটিভিজম দেখাতে চেয়েছে, কিন্তু সেটা রক্ষা করা যায়নি। সেখানে আমরা নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ প্রত্যক্ষ করেছি। আইনপ্রণেতারা আইন প্রণয়নের তুলনায় অন্য অনেক কাজ বেশি করেন। আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অনেক ঘাটতি আছে। মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া খসড়া কোনো বিতর্ক ছাড়াই সংসদে পেশ হয়। স্বার্থের সংঘাতের বিবরণী প্রকাশ, সাংসদ ও মন্ত্রীদের আচরণবিধি তারা করেনি। এবার এগুলোর বাস্তবায়ন দেখতে চাইব।

প্রথম আলো: ক্ষমতাসীনেরা নাগরিক সমাজের প্রতি বৈরী মনোভাব দেখিয়ে থাকে।

সুলতানা কামাল: বিজয়ের পরে প্রধানমন্ত্রী বললেন তিনি সবার সহযোগিতা চান। এই সবার মধ্যে তিনি কি নাগরিক সমাজকে নিচ্ছেন? আমরা কি মানুষের ক্ষমতায়ন দেখব? সুশীল সমাজের প্রতি তাদের বৈরিতা দেখতে পাই।

প্রথম আলো: নির্বাচনের পরেই রিটার্নিং কর্মকর্তার তথ্য সঠিক ধরে নিয়ে সাংবাদিক গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডে পাঠানো হলো। আপনি কি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধন চান?

সুলতানা কামাল: এটিসহ কিছু কিছু আইন আমাদের আছে, যা সভ্য সমাজে থাকতে পারে না। সমাজ কতখানি সভ্য, কতখানি মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কতখানি গণতান্ত্রিক, তা দেখার নৈতিক দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। সেই দায়িত্ব থেকেই বলি, এ ধরনের আইন অবিলম্বে বাতিল হওয়া উচিত।

প্রথম আলো: জাতীয় পার্টিকে আপনি সরকারের বিরোধিতাকারী মনে করেন? বিএনপি বয়কটে যাবে?

সুলতানা কামাল: জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে বসবে, নাকি সরকারে যাবে, সেটা নির্ধারণের দায়িত্ব তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়েছে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তাদের ভূমিকা কতটা স্বাধীন বা সক্রিয় হবে। বিএনপি বয়কটে গেলে তা হবে একটি ঐতিহাসিক ভুল।

প্রথম আলো: স্পিকারের কি বিএনপিকেই বিরোধী দল মানা উচিত?

সুলতানা কামাল: অবশ্যই। তারা আসুক না–আসুক, স্পিকার আইনমতে ‘সরকারের বিরোধিতাকারী’ দলকে বিরোধী দল বলবেন। তাঁর সিদ্ধান্ত কেন অন্যের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে?

প্রথম আলো: গণফোরামের দুজন যাবেন?

সুলতানা কামাল: ড. কামাল হোসেন যখন ঐক্যফ্রন্ট গড়ার চেষ্টা করলেন, তখন আমার সঙ্গে যত মানুষের কথা হয়েছে, তঁারা যেন একটা নিশ্বাস ফেলার জায়গা পাচ্ছিল। কিন্তু যখন তিনি বিএনপির সঙ্গে চলে গেলেন, আমি বিস্মিত হলাম। তবে ড. কামাল হোসেন, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ সাকি সবাই মিলে যে আসন পেতে পারতেন, সেটা বর্তমান চিত্র পাল্টে দিতে পারত। বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে আমার অনেক নৈতিক প্রশ্ন রয়েছে। তারা জামায়াতকে পুনর্বাসিত করেছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের আঁতাতকে নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য মনে করি না।

প্রথম আলো: আওয়ামী লীগ যখন জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল? ফটো তুলেছিল?

সুলতানা কামাল: আমি তখনো সমালোচনা করেছি। এখন পর্যন্ত সেটা আমি অনৈতিক মনে করি। হেফাজতের সঙ্গে তারা যে আপস করল, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাতে খুবই হতাশ। একই সঙ্গে বলব, রাজনৈতিকভাবে বিএনপির সঙ্গে গত বছরগুলোয় যা হয়েছে, সেটা আমি একেবারেই অনুমোদন করি না। তাদের জনসভা, মানববন্ধন করতে না দেওয়া, নির্বাচনে আসার পর তাদের ব্যাপক ধরপাকড়, প্রচারণায় বাধা দেওয়া দুঃখজনক।

প্রথম আলো: আপনার ভোট-অভিজ্ঞতা কেমন হলো?

সুলতানা কামাল: আমার জানামতে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। আমার বাড়ির নৌকা সমর্থক লোকেরা ভোট দিতে পারেননি। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ফাঁকা দেখেছেন। দুজন পোলিং কর্মকর্তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী রকমের ভোট হয়েছে, তাঁরা বলেছেন, যেমন হওয়ার তেমনই হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু তাঁরা বলতে চাননি। এক তরুণ নিজের শহরে ভোট দিতে গিয়েছিলেন, বললেন, ‘গিয়ে বুঝলাম, না গেলেও চলত।’

প্রথম আলো: আজ যদি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাহলে কি বিএনপি একটি গ্রহণযোগ্য দল হবে?

সুলতানা কামাল: আমার কাছে হবে না। কারণ জিয়াউর রহমান এক কলমের খোঁচায় ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে দিয়েছেন। আমি মনে করি, এটা মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করার শামিল।

প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ যে রাষ্ট্রধর্ম চালু করলেন?

সুলতানা কামাল: সেটা অবশ্যই দোষের, বাংলাদেশের রাজনীতি তাতে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

প্রথম আলো: বিএনপি কথিত মতে, স্বাধীনতাবিরোধী নৌকা প্রার্থীদের একটি তালিকা তৈরি করেছে।

সুলতানা কামাল: আমি খবরটা দেখেছি। একজন যিনি চা-বাগানের শ্রমিকদের জমি কেড়েছেন, আরেকজন মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, আরও একজন মুক্তিযোদ্ধা খুনের আসামির বাবা—এই মানুষগুলো কীভাবে নির্বাচিত হলেন? এসব নিয়ে আমার মনঃকষ্ট আছে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছিল এসব লোক যাতে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে সামনে আসতে না পারেন, সেটা দেখা।

প্রথম আলো: ইতিহাসে এই প্রথম বেশি নারী নির্বাচিত হলেন।

সুলতানা কামাল: শুধু সংখ্যা দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের মূল্যায়ন হতে পারে না। এবার নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পারিবারিক সূত্রেই মনোনয়ন পেয়েছেন। আমার মায়ের নেতৃত্বে নারী আন্দোলনের কর্মীরা সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এখন সংসদে আরও ২৫ বছর নারীকে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়াটা হতাশাব্যঞ্জক।

প্রথম আলো: পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার বিষয়ে মন্তব্য?

সুলতানা কামাল: আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ২২ বার আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারের পর তাদের হঠাৎ বোধোদয় হলো আদিবাসী বলে কিছু নেই। একচ্ছত্রভাবেই তারা দীর্ঘ ১০ বছর সংসদ বা রাষ্ট্র চালিয়ে গেল। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করল না। বারবার শুনি, প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে ভীষণ আন্তরিক। আমিও তা–ই বিশ্বাস করি। তাহলে আটকাচ্ছে কারা? যারা আটকাচ্ছে তাদের নিবৃত্ত করতে সরকার কী পদক্ষেপ নেবে? অন্যদিকে আমাদের কাছে এমন উদাহরণও তৈরি হয়নি, যেখানে একটিও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করা হয়েছে। অথচ হিসাবমতো আওয়ামী লীগের লোকদের কাছেই বেশি অর্পিত সম্পত্তি রয়েছে। উপরন্তু, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে সম্পত্তি অর্পণ আটকানোর চেষ্টাও চলেছে। এমনকি প্রত্যর্পণ করতে আদালতের রায়ের পরে আইনমন্ত্রী বলছেন, এর বিরুদ্ধে রিট হবে।

প্রথম আলো: আইনমন্ত্রী বলেছেন, কথাটি নথিতে একটি মতামত হিসেবে এসেছে যে এটি রিটে চ্যালেঞ্জযোগ্য। তিনি নিজে রিট করার পরামর্শ দেননি। তাঁকে ভুল বোঝা হচ্ছে।

সুলতানা কামাল: এ কথা কেন আসবে। এ ধরনের কথা তো তাদের অধস্তনদের বিশেষ একটা বার্তা দেয়। জানতে চাই, আজ পর্যন্ত একটি সম্পত্তিও প্রত্যর্পণ হলো না কেন?

প্রথম আলো: এবার আশাবাদী?

সুলতানা কামাল: আজ আওয়ামী লীগ খুবই উৎফুল্ল যে তারা সমস্ত সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাস্ত করেছে, জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন তো পরিবেশটা তাহলে শতভাগ তাদেরই অনুকূলে, তাই নতুন সরকারের কাছে অবিলম্বে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ এবং নারীনীতির বাস্তবায়ন চাই। এসব পথে বাধার কথা তো নিশ্চয় আর শুনতে হবে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একবার সংখ্যালঘুদের বলেছিলেন, ‘আমাদের থেকে ভালো তো আর আপনাদেরকে কেউ রাখবে না।’ ওটা খুব আপত্তিকর কথা। এমন কথা যেন জনগণকে আর শুনতে না হয়। সংবিধানমতে প্রত্যেক নাগরিক মানবিক মর্যাদা নিয়ে থাকবে। সমতলের আদিবাসীদের ভূমি কমিশন এবং সংখ্যালঘু কমিশন করার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হোক। এবারের শক্তিশালী সরকারের কাছে সবার আগে চাইব, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হোক। যাদের পরিবারের সদস্যরা হারিয়ে গেছে, গুমের অভিযোগ যত আছে, আমি চাই, ১০০ দিনের মধ্যে এসবের বিষয়ে একটা দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হোক। কাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন আসুক। বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হোক। বিচারক নিয়োগের আইন হোক। দুর্নীতি বন্ধে দেশ একটা সম্মানজনক জায়গা পাক। ঋণখেলাপিরা যে সংসদে এলেন, এটা দুঃখের ব্যাপার, তারও একটা বিহিত হোক।

প্রথম আলো: মেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে না করলেন হেফাজতের আমির আহমদ শফী, মন্তব্য করুন।

সুলতানা কামাল: এ কথাটি স্পষ্টতই সংবিধানবিরোধী। মানবাধিকারের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, নারীবিদ্বেষী এবং সর্বোপরি নারীর ক্ষমতায়নে বর্তমান সরকারের ঘোষিত প্রতিশ্রুতির প্রতি একটা সরাসরি চ্যালেঞ্জ। কেউ যদি সংবিধানবিরোধী কথা বলেন বা কাজ করেন, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের যে পদক্ষেপ নেওয়ার নীতি আছে, এই সরকার সে মতে পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করছি।

প্রথম আলো: একটি বাক্যে নতুন সরকারের কাছে কী চান বলুন।

সুলতানা কামাল: মুক্তিযুদ্ধের ধারক–বাহক বলে যারা ক্ষমতায় এল, তাদের পরিচ্ছন্ন চেহারা দেখতে চাই।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সুলতানা কামাল: আপনাকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন...