বিশেষ সাক্ষাৎকার: এম হাফিজ উদ্দিন খান

নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করতে দেওয়া যায় না

এম হাফিজ উদ্দিন খান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ তুলে যে ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির কাছে এক চিঠি পাঠিয়েছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। এই সময়ে কী উদ্দেশ্যে তাঁরা এই উদ্যোগ নিয়েছেন, এ থেকে কী প্রত্যাশা করেন, ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম

প্রশ্ন

২০ ডিসেম্বর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা জেনেছি, দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে নানা রকমের গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ তুলে রাষ্ট্রপতির কাছে এক চিঠি পাঠিয়েছেন। আপনি সেই ৪২ নাগরিকের অন্যতম। আমাদের প্রশ্ন, আপনারা কেন এসব অভিযোগ তুলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিকার চাওয়ার জন্য ঠিক এই মুহূর্তটাই বেছে নিলেন? এর কি কোনো বিশেষ উপলক্ষ আছে?

এম হাফিজ উদ্দিন খান: বিশেষ কোনো উপলক্ষ নেই। সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনের পর দুই বছর হতে চলল। আমরা এই দুই বছর ধরে লক্ষ করে দেখেছি, নির্বাচন কমিশনের যেসব দায়িত্ব, তারা তা পালন করছে না। বরং তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ এসেছে; দেশের সংবাদমাধ্যম সেসব তুলে ধরেছে; দেশবাসী জেনেছে। কিন্তু একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তো এভাবে চলতে পারে না, চলা উচিত নয়। তা ছাড়া যদিও অচিরেই জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে না, কিন্তু স্থানীয় সরকারের নির্বাচন তো হবে। সুতরাং আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি।

প্রশ্ন

রাষ্ট্রপতির কাছে আপনারা কী প্রত্যাশা করছেন?

এম হাফিজ উদ্দিন খান: আমরা আমাদের চিঠিতে লিখেছি, বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত রয়েছে। তারা গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, সেগুলো এমন গুরুতর অপরাধ, যার কারণে এই নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের এখতিয়ার হারিয়েছে বলে আমরা মনে করি। সে জন্য আমরা নির্বাচন কমিশনের বর্তমান নেতৃত্বের অভিশংসন চাই। আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো চিঠিতে অনুরোধ করেছি, অভিশংসনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগগুলো তদন্ত করা হোক। এখন আমাদের অভিযোগগুলো যদি রাষ্ট্রপতি বিবেচনায় নেন এবং মনে করেন যে এ জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা প্রয়োজন, তাহলে তিনি তা করবেন। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

প্রশ্ন

আমরা বাংলাদেশে এখন এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেখছি, যেখানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনুমোদন ছাড়া এমনকি রাষ্ট্রপতিও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ। এ রকম পরিস্থিতিতে আপনারা রাষ্ট্রপতির কাছে যা প্রত্যাশা করছেন, সেটা কি তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হবে বলে আপনার মনে হয়?

এম হাফিজ উদ্দিন খান: সেই প্রশ্ন তো রয়ে গেছে। সর্বময় ক্ষমতা প্রয়োগে এমন তৎপর একটা সরকার রয়েছে যে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া কিছু হয় না, হবে না। তবু আমরা বিষয়টা তাঁর কাছে পেশ করলাম। একই সঙ্গে দেশবাসীকেও জানালাম যে এই ব্যর্থ নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে আমরা হতাশ। আমরা তাদের বিষয়ে আমাদের বক্তব্যগুলো গুছিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরলাম, প্রকাশ করলাম। এখন রাষ্ট্রপতি কী সিদ্ধান্ত নেবেন, সরকার কী করবে, তা আমরা বলতে পারি না। আমরা মনে করি, বিষয়টা তুলে ধরা আমাদের কর্তব্য; তাই আমরা তা করেছি। কোনো রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নয়, দেশ-জাতির স্বার্থে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার থেকে আমরা এটা করেছি। রাষ্ট্রপতি ও সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে, তাঁরা যেন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

প্রশ্ন

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা দেশ-বিদেশের সবাই দেখেছেন। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশে এ রকম হতাশাব্যঞ্জক নির্বাচন যে কখনো হতে পারে, এটা হয়তো আমরা কেউই ভাবিনি। নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন মাত্রার অবক্ষয় কীভাবে ঘটতে পারল? আমরা কি এই অবস্থায় এক দিনে পৌঁছেছি?

এম হাফিজ উদ্দিন খান: নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর অধীনে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোই শুধু গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আর কোনো নির্বাচনই সেই মাত্রায় গ্রহণযোগ্য হয়নি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, তা লক্ষ করে আমরা বলেছি, এটা কোনো নির্বাচনই হয়নি। শুধু আমরা নই, আরও অনেকেই এটা বলেছেন। নির্বাচনটি যে একবারেই সুষ্ঠু হয়নি, তা তো নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালেই স্পষ্ট দেখা যায়। শুধু একটি উদাহরণ দিলেই চলে: ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে ভোট পড়েছে শতভাগ, যা বাস্তবে সম্ভব নয়। ৫৯০টি কেন্দ্রে শতভাগ বৈধ ভোট পড়েছে একটিমাত্র প্রতীকের পক্ষে। এর অর্থ কী, তা সবাই বুঝতে পারে। শুধু ক্ষমতাসীন দল ছাড়া দেশের প্রত্যেক মানুষ এই নির্বাচনের ব্যাপারে দুঃখিত, ক্ষুব্ধ, হতাশ। অথচ নির্বাচন কমিশন দাবি করে আসছে যে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়েছে, সঠিকভাবেই হয়েছে। এমনকি তারা বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তারা যদি এমন কথা বলে, তাহলে তাদের কী বলা যায়!

প্রশ্ন

অনেকে মনে করেন, কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন অবক্ষয়ের দিক থেকে এম এ আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকেও ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৬ সালের শেষ দিকে এম এ আজিজের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছিল; কিন্তু এখন তেমন কিছুই হচ্ছে না। কেন?

এম হাফিজ উদ্দিন খান: মানুষ বিক্ষুব্ধ এবং হতাশ। সে জন্য বিক্ষোভ-প্রতিবাদ নেই।

প্রশ্ন

রাজনৈতিক দলগুলোর কী হলো? এম এ আজিজের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো, সেই সময়ের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল, নাগরিক সমাজের সমর্থন ছিল। আজ বাংলাদেশে আমরা এমন কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক শক্তিকে দেখতে পাচ্ছি না, যারা সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলন করবে, নেতৃত্ব দেবে। কেন?

এম হাফিজ উদ্দিন খান: আমারও প্রশ্ন সেটাই। আমি অনেক জায়গায় বলেছি, ৩০ ডিসেম্বর যে এ রকম একটা খারাপ নির্বাচন হলো, তার প্রতিবাদে আমরা ৩১ ডিসেম্বর বা জানুয়ারির ১ তারিখে কাউকে রাস্তায় নামতে দেখলাম না কেন? এই প্রশ্ন আমারও। নির্বাচনে অনিয়ম হলে অন্যান্য দেশে কী হয়? বেলারুশে আমরা কী দেখতে পেলাম? কী প্রবল জনবিক্ষোভ হয়েছে সেই দেশে! অতীতে আমাদের দেশেও হয়েছে। বিএনপির সেই মাগুরা নির্বাচন নিয়ে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়েছে, বিরাট আন্দোলন হয়েছে। সেই বিক্ষোভের পরিণতিতে এই দেশে অনেক কিছু ঘটেছে; নির্বাচনের অনিয়ম ঠেকাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পর্যন্ত প্রবর্তন করতে হয়েছে। আজকে সেসব কিছু নেই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা।

প্রশ্ন

রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠিতে আপনারা যেসব অভিযোগ তুলেছেন, নির্বাচন কমিশন সংবাদ সম্মেলন করে সেগুলোকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

এম হাফিজ উদ্দিন খান: আমরা যেসব অভিযোগ করেছি, সেগুলো তো নতুন নয়। সংবাদমাধ্যমে সেসব নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। সাংবাদিকেরা খোঁজখবর নিয়ে রিপোর্ট করেছেন, জনগণকে জানিয়েছেন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দ্বারা কী কী গুরুতর অসদাচরণ সংঘটিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন কেন এত দিন প্রতিবাদ করেনি, কেন বলেনি যে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন? আর দ্বিতীয় কথা হলো, ভিত্তিহীন কি ভিত্তিহীন নয়, তা খতিয়ে দেখা হোক। সে জন্যই তো আমরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে আমাদের অভিযোগগুলো সত্য না ভিত্তিহীন, তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দেখার অনুরোধ করেছি। অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না।

প্রশ্ন

ধরা যাক, রাষ্ট্রপতি আপনাদের অনুরোধ রাখলেন। তিনি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো তদন্তের নির্দেশ দিলেন। সেখান থেকে নিরপেক্ষ তদন্ত প্রত্যাশা করেন কি?

এম হাফিজ উদ্দিন খান: আমরা আশা করতে চাই। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের উদ্যোগ নিন, আমরা ভরসা রাখি যে তাঁরা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করবেন। কারণ, এর সঙ্গে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থার অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত; এটা আমাদের গণতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলনের ধ্বংস ঠেকানোর প্রশ্ন। আমাদের অবশ্যই সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক নির্বাচনব্যবস্থা রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এম হাফিজ উদ্দিন খান: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।