ড. এস এম হাফিজুর রহমান। অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ও সার্বিক শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনোজ দে
প্রথম আলো: পাকিস্তান আমলে শুনতাম ব্রিটিশ আমলের শিক্ষা ভালো। বাংলাদেশ আমলে অনেকে বলেন পাকিস্তান আমলের শিক্ষা ভালো। এখন আমাদের শিক্ষাটা কোন অবস্থায় আছে?
এস এম হাফিজুর রহমান: দিন যত যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষার মান তত বাড়ছে। এটা বিস্ময়কর মনে হতে পারে। শিক্ষাকে বোঝার জন্য কারিকুলাম মূল বিষয়। কারিকুলাম বুঝতে হলে তিনটা স্তর জানা দরকার। প্রথমটা ইনটেনশন। শিক্ষাব্যবস্থা আমরা কেমন দেখতে চাই। দ্বিতীয়টা ইমপ্লিমেন্টেশন বা শ্রেণিকক্ষে এর প্রয়োগ। তৃতীয়টা শিক্ষার্থীরা কী অর্জন করছে। যখন উদ্দেশ্যের সঙ্গে অর্জনের ফারাক কম থাকবে, তখন বুঝতে হবে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে। আমি বলব, ইনটেনশন পর্যায়ে আমাদের শিক্ষার মান বাড়ছে। জ্ঞান ও দক্ষতার দিকটা যদি বিবেচনা করি, তাহলে আগের প্রজন্ম ও বর্তমান প্রজন্মের মধ্যকার পার্থক্য সহজেই ধরা যাবে। আগের ভালো শিক্ষার্থীর তুলনায় এখনকার ভালো শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পরিধি বড়। আগে শিক্ষার্থীরা সবকিছু মুখস্থ করত। এখন চিন্তা করার সক্ষমতা তাদের বাড়ছে। এমনকি শ্রেণিকক্ষে পাঠদান আগের থেকে উন্নত। শিক্ষণটা আগের থেকে অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে। গ্রুপ ওয়ার্ক হচ্ছে। আইসিটির ব্যবহার হচ্ছে।
প্রথম আলো: প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে ২০১০ সালের শিক্ষানীতির সামঞ্জস্য কতটা?
এস এম হাফিজুর রহমান: আমরা একটা ভুল জায়গায় হাঁটছি। আমাদের আগে শিক্ষানীতির সংস্কার জরুরি ছিল। শিক্ষানীতির অনেক কিছু আজকের প্রেক্ষাপটে যুগোপযোগী নয়। এসডিজি সামনে রেখে যদি আমরা বিচার করি কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি, শিক্ষানীতির ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষানীতির সংস্কারের আলোকেই শিক্ষাক্রম বা শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়নের দরকার ছিল। এখন যদি শিক্ষানীতি সংস্কার করা হয়, তাহলে রূপরেখাটা আবার সংস্কার করার প্রশ্ন আসবে।
প্রথম আলো: নতুন কারিকুলামে নবম-দশমে মানবিক-বিজ্ঞান-বাণিজ্যের ভাগটা তুলে দেওয়া হলো। এতে কি শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানবিমুখ হবে না?
এস এম হাফিজুর রহমান: শিক্ষাক্রম দশম শ্রেণি পর্যন্ত মানবিক-বিজ্ঞান-বাণিজ্যের বিভাজনটা তুলে দেওয়া হয়েছে। এটা ইতিবাচক। ২০১৬ সালে যখন পাঠ্যবইয়ে ভুল ধরা পড়ল, তখন তিনটি কমিটি হয়েছিল। বিজ্ঞানশিক্ষা নিয়ে ওই কমিটির সুপারিশ ছিল। প্রত্যেক মানুষকে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বাক্ষর করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যাতে তারা বিজ্ঞানশিক্ষার জ্ঞানটাকে ব্যবহার করতে পারে। এটা একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সবার থাকতে হবে। ইউনেসকো এ স্তরের বয়সসীমা নির্ধারণ করেছে ১৫ বছরের বেশি। আমাদের এখানে এ বয়সী শিক্ষার্থীরা নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ে। আবার একজন শিক্ষার্থী কোন বিভাগে পড়বে, সেটার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটা তার অর্জন করতে হবে। আমরা এখানে ছেলেমেয়েদের ওপর চাপিয়ে দিই, কে বিজ্ঞানে পড়বে আর কে মানবিকে পড়বে।
প্রথম আলো: নতুন পাঠ্যক্রমের যে রূপরেখা, সেখানে মানসম্মত পাঠ্যবই তৈরি করা তো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আবার শিক্ষকেরা নতুন পাঠ্যবই পড়াতে কতটা সক্ষম বলে মনে করছেন?
এস এম হাফিজুর রহমান: পাঠ্যবই তৈরি করা বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের আগামী দিনের কথা চিন্তা করতে হবে। আমি এর খুব বেশি সমালোচক আবার আশাবাদীও। আমাদের দু-একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের যে মান, তা উদ্বেগের বিষয়। ব্যানবেইসের এমনও তথ্য আছে যে আমাদের ৬০ শতাংশ বিএসসি শিক্ষক তৃতীয় বিভাগে পাস করেছেন। ভালো শিক্ষার্থীরা এখন আর শিক্ষকতায় আসছেন না। কেন আসছেন না? স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবেই তাঁর পুরো জীবন কাটাতে হচ্ছে। নতুন কারিকুলামেও এ নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। আমরা এই যে ভালো চিন্তাগুলো করছি, কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন কারা করবেন? আমি শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করি। কিন্তু বর্তমান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেটা করা সম্ভব হবে, এমন আস্থা আমার নেই। নীতিনির্ধারকদের শিক্ষকদের বিষয়টা নিয়েও ভাবতে হবে।
প্রথম আলো: পরীক্ষা যে কমানো হচ্ছে, এটাতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক খুশি। শিক্ষাবিদ হিসেবে আপনার মূল্যায়ন কী?
এস এম হাফিজুর রহমান: পরীক্ষা ও মূল্যায়ন দুটি ভিন্ন জিনিস। নিচের স্তরে পরীক্ষা কমেছে। এটা ভালো সিদ্ধান্ত। কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা কখনো বলেননি পিইসি, জেএসসির মতো পরীক্ষাগুলো হোক। এটা সরকারের একটা চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত। আমাদের দেশে কারিকুলাম করছে এনসিটিবি (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড)। আর শিক্ষা বোর্ড সিদ্ধান্ত দিচ্ছে পরীক্ষা দেওয়ার। কয়টা পরীক্ষা হবে না হবে, সেটা বলার অধিকার বোর্ড কি রাখে? এটা করবে এনসিটিবি। বোর্ড সেটা বাস্তবায়ন করবে। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক এখতিয়ার মানা হয় না। নিচের স্তরে পরীক্ষা যে বন্ধ করা হচ্ছে, সেটার একটা ইতিবাচক ফল আমরা পাব। কিন্তু আবার দশম, একাদশ, দ্বাদশ পরপর তিন বছরে তিনটি পাবলিক পরীক্ষা রাখা হচ্ছে। এটা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে।
প্রথম আলো: পাঠ্যবই নিয়ে গুরুতর অভিযোগ, যেভাবে লেখা হয়, অধিকাংশ বিষয় শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে না।
এস এম হাফিজুর রহমান: আমার কাছে জাপানের কিছু পাঠ্যবই আছে। ৬০ জন লেখক দুই বছর খেটে একেকটা বই তৈরি করেছেন। আমাদের এখানে আসলে কী হচ্ছে? সাম্প্রতিক কালে আমার একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা বলি। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নবম ও দশমের ১৩টি বই সংশোধন করা হচ্ছে। ৩০০ পৃষ্ঠার একেকটা বইয়ের জন্য সময় দেওয়া হয়েছে ১০ দিন। এত অল্প সময়ে লেখকেরা কী করবেন? ফলে অনেকে গুগল থেকে নামিয়ে বই তৈরি করে দিচ্ছে।
প্রথম আলো: এই শিক্ষাক্রমে মাদ্রাসা বা কারিগরির ক্ষেত্রে কী হবে?
এস এম হাফিজুর রহমান: মাদ্রাসা ও কারিগরির ক্ষেত্রে কী হবে, সেটা স্পষ্ট করে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখায় কিছু বলা নেই। এটাকে আমি অসম্পূর্ণ রূপরেখা বলব। শিক্ষাক্রমটাকে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বলা হচ্ছে। কিন্তু দশম শ্রেণির পর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রম নিয়ে কিছু বলা নেই এখানে। এনসিটিবি যে প্রক্রিয়ায় কারিকুলাম করেছে, সেটা ঠিক হয়নি। এনসিটিবি কমিটি বানিয়েছে। সবই করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারা এটা করেছে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
প্রথম আলো: নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
এস এম হাফিজুর রহমান: শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বিজ্ঞানশিক্ষার একটা ব্যাপক প্রভাব আছে। এটা আবার টেনশনেরও বিষয়। স্কুলে আমাদের বিজ্ঞানের শিক্ষক মাত্র দুজন। ফলে এ বিষয়গুলো পড়াবেন কারা? শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমাদের একটা বিশাল চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে। বর্তমান এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের যে অবস্থান, সেটার সঙ্গে এই রূপরেখা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেও এটা সাংঘর্ষিক। আমাদের বর্তমান টিচিং ফোর্সের সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক। এটা বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষক নিয়োগে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার। না হলে এটা বড় ধরনের বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি করবে। প্রত্যাশাটা অনেক বেশি হয়ে গেছে। ইনটেনশনটা অনেক বড়।
প্রথম আলো: শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য যে সময় নেওয়া হয়েছে, তা কি যথেষ্ট মনে করেন?
এস এম হাফিজুর রহমান: এই শিক্ষাক্রম নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়েছে। যাঁরা কথা বলেছেন, যুক্তি তুলে ধরেছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে অনেক কথা বলার সুযোগ আছে। এখানে অনেক ভালো দিক আছে। কিন্তু সেই ভালো দিকগুলো আমরা যদি টেকসই করাতে না পারি, তাহলে ভালো চিন্তা করে লাভটা কী?
প্রথম আলো: করোনায় শিক্ষার কতটা ক্ষতি হলো?
এস এম হাফিজুর রহমান: এই ক্ষতি ব্যাপক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা ছিল। বিশ্বের যে আটটা দেশ পুরো করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। এটার যে বহুরূপী প্রভাব, সেটা ভবিষ্যতে দৃশ্যমান হবে। করোনাকালে সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগটা কী, আমি খুঁজতে চেষ্টা করেছি। এক বছর আগে আমরা বলতাম নেটওয়ার্ক নেই। এখনো তাই বলছি। সরকারকে হয়তো কেউ কেউ বুঝিয়েছে কিছুদিন পর করোনা ভালো হয়ে যাবে, এখানে বিনিয়োগ করে লাভ কী?
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
এস এম হাফিজুর রহমান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।