বিশেষ সাক্ষাৎকার : মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম

জনসংখ্যা বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ধারণা ভুল

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণার জন্য ২০১০ সালে গ্লোবাল হেলথ কাউন্সিল (ইউএসএ) তাঁকে ‘নিক সাইমন্স স্কলার’ নির্বাচিত করে। তাঁর একটি গ্রন্থসহ ৭০টির বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক প্রকাশনা আছে।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সায়েন্টিফিক স্টাডি অব পপুলেশনসহ বিভিন্ন পেশাগত আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশে জনসংখ্যা সমস্যা, বাল্যবিবাহ, কর্মসংস্থান, নগরায়ণ ও টেকসই উন্নয়নের নানা দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সাম্প্রতিক সমস্যা দিয়েই শুরু করি। জন্মনিবন্ধন পেতে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে?

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: জাতিসংঘের শিশু অধিকারসংক্রান্ত কনভেনশনের ৭ ধারা অনুযায়ী শিশু জন্মের পরপরই তার জন্মনিবন্ধন অত্যাবশ্যকীয় একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। রাষ্ট্র দ্বারা আনুষ্ঠানিক জন্মনিবন্ধন স্বীকৃতি অর্জন করতে সমর্থ না হলে একটি শিশু স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ অনেক আরও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। জন্মনিবন্ধনের কাজটি হতে হয় নির্ভুল, স্বচ্ছ ও অধিকতর সহজ প্রক্রিয়ায়। কিন্তু বাংলাদেশে অতিসম্প্রতি জন্মনিবন্ধনের এ কাজ নিয়ে সমালোচনা ও প্রশ্ন জেগেছে। সুশাসনের ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। কারিগরি জটিলতা, সঠিক পরিকল্পনা কর্মসূচি না নেওয়া ও সমন্বয়হীনতাই মূলত এ ক্ষেত্রে দায়ী।

প্রশ্ন

সমস্যাটি এত প্রকট হলো কেন?

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: ২০০৪ সালে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আইন করে সরকার। তখন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন থেকে সহজেই হাতে লেখা জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করা যেত। ২০০৬ সালে এসে অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা শুরু হয়। ২০১১ সালের নভেম্বরে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের নতুন ওয়েবসাইট ও সার্ভার চালু করা হয়, যার কার্যক্রম হয় ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে। এরপর অনেকেই পুরোনো জন্মনিবন্ধন সনদ নতুন ওয়েবসাইটে যুক্ত করে নিয়েছেন। পাশাপাশি কিছু ইউনিয়ন পরিষদ আগের হাতে লেখা সনদের তথ্য ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করে। তবে বেশির ভাগ হালনাগাদ করা হয়নি। চলতি বছর স্কুলে শিক্ষার্থীদের অনলাইন জন্মসনদ চাওয়া হচ্ছে। এরপরই আগে জন্মসনদ গ্রহণকারী বিপুলসংখ্যক অভিভাবক ভোগান্তিতে পড়েন। সরকারের যথাযথ প্রস্তুতি না থাকায় এই সমস্যা হয়েছে।

প্রশ্ন

ভোগান্তির জন্য কার দায় বেশি—স্থানীয় প্রশাসন না জনপ্রতিনিধি?

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন ইস্যু করার দায়িত্ব ইউপি চেয়ারম্যানের। সংশোধনের দায়িত্বও তঁাদের হাতে থাকা দরকার ছিল। আবার জন্মনিবন্ধন সংশোধনের কাজটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠানোর ফলে মানুষের দুর্ভোগ অনেক বেড়েছে বলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা বলে থাকেন। এখন উপজেলা পর্যায়ে যাওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে। এ ছাড়া ইউনিয়ন পর্যায় থেকে উপজেলা সদরে বা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যাতায়াতের খরচ, সময় ও কষ্ট—সবই আগের চেয়ে বেড়েছে। সংশোধনের কাজগুলো ইউনিয়ন পর্যায়ে রাখা দরকার ছিল। জন্মনিবন্ধনের সময় নাম, ঠিকানা, বাবা-মায়ের নাম, জন্মতারিখ, লিঙ্গসংক্রান্ত ভুল, বাংলা থেকে ইংরেজি করা বা ইংরেজি থেকে বাংলা করাতে গিয়ে মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে বেশি। আগে নগরে-সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক অফিস যেকোনো ধরনের সংশোধন করতে পারত। এখন একটা ছোট ভুলের জন্যও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যেতে হয়। আগে ইউনিয়ন পরিষদ আগের হাতে লেখা সনদের তথ্য ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করার কথা, যার বেশির ভাগ হালনাগাদ করা হয়নি। তা ছাড়া ২০১২ সালের আগে যারা জন্মনিবন্ধন করেছিল, নতুন সার্ভারে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত ২০২১ সালে নেওয়া হয়। সনদগুলো অন্তর্ভুক্ত না করার সিদ্ধান্তে দেশের সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ কোনো আপত্তি করেনি। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন একজন নাগরিকের জন্য আইনগত পরিচিতি। ফলে সরকারের উচিত জনগণের ভোগান্তি দূরীকরণে অবশ্যই সিভিল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমকে উন্নত ও শক্তিশালী করা।

প্রশ্ন

জনসংখ্যা বাংলাদেশের সম্পদ না বোঝা? এ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও মতভেদ আছে। আপনি কি মনে করেন?

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: এটা নির্ভর করছে বাংলাদেশ কীভাবে বর্তমান জনসংখ্যাকে কাজে লাগাচ্ছে। বর্তমান জনসংখ্যার বয়সকাঠামোর বিবেচনায় দেশে প্রায় ৬৬ শতাংশ মানুষ ১৫-৬৪ বছরের মধ্যে, যারা অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। এ জনসংখ্যাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্প্রসারণ-জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের সর্বাধিক সুবিধা নিতে পারবে আগামী ১৫-১৬ বছর পর্যন্ত। আর তার বিপরীতে এটি ডেমোগ্রাফিক বিপর্যয়েও রূপ নিতে পারে। ফলে কী নীতি ও কৌশল প্রণয়ন এবং প্রয়োগ করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করবে জনসংখ্যা সম্পদ না বোঝা।

প্রশ্ন

১০ বছর পর পর জনগণনা হতো। ২০১১ সালে সর্বশেষ জনগণনা হয়। করোনার কারণে ২০২১ সালে হতে পারেনি। ২০২২ সালের পাঁচ মাস চলে যাচ্ছে। জনগণনার কোনো উদ্যোগ নেই।

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: বাংলাদেশে প্রথম জনশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। দ্বিতীয় শুমারি হয় ১৯৮১ সালে। এরপর ১০ বছর অন্তর এ শুমারি হয়ে এসেছে নিয়মিত। ২০১১ সালে ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহ গণনার কথা ছিল। এ লক্ষ্যে সরকার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রায় চার বছর আগে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করলেও জনশুমারি সঠিক সময়ে একাধিক কারণে করতে পারেনিকারণ হলো, প্রথমত, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব; দ্বিতীয়ত, ম্যানুয়াল পদ্ধতির পরিবর্তে ডিজিটাল ভিত্তিতে ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা পরিচালনা এবং তৃতীয়ত, ডিজিটালভিত্তিক হওয়ায় ট্যাব ক্রয়ের দরপত্রে জটিলতা। মূল শুমারি আগামী ১৫ থেকে ২১ জুনের মধ্যে হওয়ার কথা। হাতে সময় আছে মাত্র এক মাস। এ নিয়ে সরকারের প্রচারণা এখনো দৃশ্যমান নয়। প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সঠিক সুপারিশ প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য হালনাগাদ পরিসংখ্যানের বিকল্প নেই।

প্রশ্ন

বাংলাদেশে এই মুহূর্তের জনসংখ্যা নিয়েও নানা মত আছে। আমরা বিভিন্ন গবেষণায় বিভিন্ন তথ্য পাই। প্রকৃত তথ্য না থাকলে কর্মপরিকল্পনা করাও কি কঠিন নয়?

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য না থাকলে কর্মপরিকল্পনা করা কঠিন। সে ক্ষেত্রে গৃহীত পরিকল্পনা ও কার্যক্রম সফল হতে বাধাগ্রস্ত হবে। করোনাকালে আমাদের হালনাগাদ অনেক উপাত্ত নেই বলে অনেক কর্মসূচির সাফল্য নিয়ে সংশয় রয়েছে। করোনাকালে বাল্যবিবাহ, কিশোরী মাতৃত্ব, মাতৃমৃত্যু হার, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি অপূর্ণ চাহিদা, শ্রমবাজারের অংশগ্রহণ, বেকারত্বের হার—এমন অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় আপডেট তথ্যের ঘাটতি দেখা গেছে।

প্রশ্ন

বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। কিন্তু নাগরিক সুবিধা দিতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে সরকারের কর্মপরিকল্পনার কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে করেন?

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: বাংলাদেশের প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ এখন শহরে বাস করছে। ২০৪০ সালের মধ্যে তা পৌঁছে যাবে ৫০ শতাংশে, মানে প্রতি ২ জনে ১ জন হবে শহর বা নগরবাসী। বাংলাদেশে নগর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের দ্বিগুণের বেশি। মোট নগরায়িত জনগোষ্ঠীর ৬০ ভাগ বাস করে চারটি শহরে। তার মধ্যে ঢাকা এককভাবে ৩২ ভাগ বহন করছে। আনুমানিক ২ কোটি মানুষের বাস এ শহরে, যা ২০৩০ সালে বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল নগরে পরিণত হবে। তখন জনসংখ্যা ২ কোটি ৮০ লাখ অতিক্রম করতে পারে। জনঘনত্বের বিচারেও হবে সর্বোচ্চ। এখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত প্রধান ভূমিকা পালন করছে—বস্তির সংখ্যা ও বস্তিবাসী বাড়ছে। গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে মানুষ—অতিদরিদ্র, দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যাই এখানে বেশি, প্রায় ৬০ ভাগ। আমাদের জাতীয় নগরায়ণে কোনো নীতিমালা নেই। মাইগ্রেশন পলিসি নেই। নগর স্বাস্থ্যসেবায় সমন্বিত সেবা কার্যক্রম নেই, যানজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এ কারণেই জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে।

প্রশ্ন

বাংলাদেশের সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। অথচ ঢাকা এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ নিতে পারছে না।

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: ঢাকাকে এক শহরকেন্দ্রিক নগরায়ণ করা যাবে না। প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ঢাকার বাইরে শিক্ষা, চাকরির-স্বাস্থ্যসেবা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। অপ্রয়োজনীয় শিল্পকারখানা ঢাকার বাইরে স্থানান্তর এবং গ্রাম থেকে ঢাকা শহরমুখী স্থানান্তর নিরুৎসাহিত করতে হবে।

প্রশ্ন

স্বাধীনতার পর জনসংখ্যাকে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বর্তমানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কি অনেকটা শিথিল?

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-১৯৭৮) জনসংখ্যাকে ১ নম্বর জাতীয় সমস্যা বলে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৭৫ সালে সমগ্র প্রজনন হার বা টিএফআর ছিল অনেক বেশি, ৬ দশমিক ৩ ভাগ। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে ১৯৯৩-৯৪ সালে টিএফআর নেমে আসে অর্ধেকে, ৩ দশমিক ৪ শতাংশে। বর্তমানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে শিথিলতা লক্ষ করা যায়। ২০০৪ সালের জনসংখ্যানীতিতে ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট ছিল, যা ২০১২ সালের নীতিতে—দুটি নয়, একটি হলেই যথেষ্ট বলা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রজ্ঞাপন আকারে পরিবর্তন করে পূর্বের স্লোগানে ফিরে যায় সরকার। ২০১১ সালের পর টিএফআর ও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারে অগ্রগতি নেই। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে কোভিড-১৯–এর কী প্রভাব পড়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তা ছাড়া বাল্যবিবাহ, কিশোরী মাতৃত্ব ও মাতৃমৃত্যুর উচ্চ হার আমাদের জন্য বড় সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ।

আমাদের মাথাপিছু আয় ও জিডিপি বাড়লেও কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়েনি। প্রতিবছর ২০ লক্ষাধিক মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন। যুব বেকারত্ব ১৯৯৩-৯৪ সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যদি মনে করি যে জনসংখ্যা বাড়িয়ে বিদেশে পাঠিয়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করব, সে ধারণা ভুল। আমাদের দরকার দক্ষ জনশক্তি। আমাদের দেশের প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ কাজের সন্ধানে বিদেশে গিয়েছেন। এঁদের ৬৪ শতাংশ অদক্ষ বা সেমি-স্কিলড কাজে যুক্ত। জাতীয় জনসংখ্যানীতি বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদ বলে একটি পরিষদ আছে, যা একেবারেই নিষ্ক্রিয়। গত এক দশকেও এর কোনো বৈঠক হয়নি।

প্রশ্ন

যাদের জন্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বেশি দরকার, বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের বিরাট অংশ এখনো এর বাইরে আছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: বর্তমানে দেশে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ৩–এ স্থিত হয়ে আছে (বিডিএইচএস) এবং ক্ষেত্রবিশেষে এই মোট প্রজনন হার হ্রাসে রয়েছে ভিন্নতা। যেমন সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগে এখনো প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রজনন হারের চেয়ে অনেক বেশি। দরিদ্র ও শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত মায়েদের মধ্যে প্রজনন হার বেশি (২ দশমিক ৬)। দেশে মোট কাঙ্ক্ষিত প্রজনন হার ১ দশমিক ৭, যেখানে গ্রাম এলাকায় ১ দশমিক ৮ হলেও বাস্তবে তা ২ দশমিক ৩। এ ছাড়া গ্রাম ও শহরভেদে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারে পার্থক্য যেখানে গ্রামে এ হার (৬০ দশমিক ৪ শতাংশ), শহর থেকে ৫ শতাংশ কম। ফলে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম গ্রামীণ ও দরিদ্রপ্রবণ এলাকায় আরও জোরদার করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন

জনসংখ্যাবিজ্ঞানের ভাষায় পরিমিত জনসংখ্যা কাকে বলব আমরা? বাংলাদেশ অনেক আগেই কি সেই স্তর পার হয়ে আসেনি?

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: দেখুন, অপটিমাম পপুলেশন বলে একটি ধারণা রয়েছে, যেখানে জনসংখ্যার সর্বাধিক আকারের সঙ্গে প্রত্যাশিত জীবনযাত্রার সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের দেশের আয়তন সীমিত—বিপরীতে জনসংখ্যা অনেক বেশি। জনঘনত্বের বিচারে পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে এখানে বাস করছে ১ হাজার ২৬৫ জনের মতো, যা ২০৩০ সালে হবে ১ হাজার ৩৭৫ আর ২০৪০ সালে ১ হাজার ৪৪৭। বিশ্বের ছোট নগররাষ্ট্রের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশই সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। চীনে ১৫৩ জন আর ভারতে ৪৬০ জন বসবাস করে প্রতি বর্গকিলোমিটারে। অর্থনীতিবিদেরা অধিক জনঘনত্বের বিষয়টিকে কেউ কেউ ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চান কিন্তু যেখানে জনগণের সেবার জন্য থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল, সেখানে জনগণের গুণগত জীবন ও মান উন্নয়নে বড় চ্যালেঞ্জ বলেই আমি মনে করি। ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন মডেল অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে জন্মহার ও মৃত্যুহার উভয়ই কমে এসেছে। বাংলাদেশের এখন জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের সময় পার করছে। হাতে আর ১৫-১৬ বছর সময় আছে জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের। নীতি–কৌশলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নেওয়া এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। জনসংখ্যাকে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে সুশিক্ষা-সুস্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সুশাসন নিশ্চিত করা দরকার।

প্রশ্ন

গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও অনেক বেশি। কিন্তু তাঁদের নিয়ে রাষ্ট্র কতটা ভাবছে?

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: বয়সকাঠামোর বিচারে বর্তমানে বাংলাদেশে ৬০ বছর ও এর বেশি বয়সী জনসংখ্যা ৮ দশমিক ৩ ভাগ, যা জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৩০ সালে পৌঁছে যাবে প্রায় ১২ শতাংশে। ২০১১ সালের গৃহ ও জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী দুই-তৃতীয়াংশের অধিক এ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম অবস্থায় আছেন। বর্তমান কোভিড-১৯ সংকটকালে এ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অনেকেই স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়েছেন। বিপুলসংখ্যক এই প্রবীণের খুব কম শতাংশই ভোগ করে থাকেন পেনশন বা সামাজিক নিরাপত্তাসুবিধা। বেশির ভাগেরই নিজের সঞ্চয়, সম্পত্তি কিংবা সন্তানের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় তাঁদের। পরিবারের ধরনে যৌথ বা বর্ধিত পরিবার প্রথা থেকে পরিবর্তিত বর্তমানে মূলত অণু পরিবারব্যবস্থায় বয়স্ক এ জনগোষ্ঠীর যত্ন ও সেবা প্রদান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উদ্ভূত হচ্ছে। এ জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাত অধিকতর শক্তিশালী করা দরকার।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।