সাক্ষাৎকার: আ ন ম মুনিরুজ্জামান

জঙ্গিরা সব সময়ই নতুন নতুন কৌশল নেয়

>১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারি হামলার চতুর্থ বার্ষিকী। মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজ্জামান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট ওই ঘটনার নানা দিক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করেছেন।  সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: হলি আর্টিজান হামলার চার বছর পর যখন সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের তথাকথিত খিলাফতে ধস নেমেছে, তখন আইএসের শক্তি-সামর্থ্যকে কীভাবে দেখছেন? গত এপ্রিলে প্রথমবারের মতো মালদ্বীপের উপকূলে তারা আঘাত হানল। 

মুনিরুজ্জামান: ওই ঘটনার পরে আর কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বড় হামলা হয়নি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নির্মূল হয়ে গেছে। ছোট পরিসরে হলেও আইএস–সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো জীবিত আছে। সিরিয়া থেকে তারা বিতাড়িত কিন্তু নির্মূল হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তারা নানা কৌশলে সক্রিয় রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছে। একইভাবে বাংলাদেশের ছোট-বড় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো আপাতত স্তিমিত থাকলেও তারা তাদের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। সিরিয়ায় বিতাড়ন ঘটলে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আগেই করা হয়েছে। আপনি যেমনটা মালদ্বীপের কথা বলেছেন, তেমনি তারা মালে, মোজাম্বিকসহ আরও কিছু জায়গায় হামলা করতে সক্ষম হয়েছে। 

প্রথম আলো: হোলি আর্টিজানের পরে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেটা মূল্যায়ন করুন। 

মুনিরুজ্জামান: বেশ কিছু সাফল্য এসেছে। তবে সেটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীনির্ভর পদক্ষেপ। অপারেশনাল পদক্ষেপ যথেষ্ট নেওয়ার কারণেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো স্তিমিত। কিন্তু দুর্বলতা হলো উগ্রবাদ বিস্তারের পথগুলো আমরা কার্যকরভাবে বন্ধ করতে পারিনি। এর আগে আমরা দেখেছি তরুণ, নারী ও পুরো পরিবারের ওপর তারা প্রভাব ফেলার চেষ্টা করেছে এবং কিছুটা সফল হয়েছে। 

প্রথম আলো: জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রভাষক স্মিথ বলেছেন, যে সমাজ বিভক্ত ছিল, সেই সমাজগুলো এখন করোনা মোকাবিলায় মনোযোগী। তাই করোনা সেই বিভক্তিতে আরও তীব্রতা দেবে। এর সুযোগ নেবে আইএস। 

মুনিরুজ্জামান: আমি এই মত সমর্থন করি। কারণ, আমাদের দেশসহ বিভিন্ন সমাজের মধ্যে যে বিভাজন ও বৈষম্য রয়েছে, সেটা কোভিড–১৯–এর কারণে আরও বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা যে সামাজিক বৈষম্যের মধ্যে ছিল, সেটা করোনা অনেক বেশি উন্মোচিত করল। বৈষম্যের কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়বে। আমি আশঙ্কা করছি, জঙ্গিরা সেটা সহজে কাজে লাগাতে পারবে। এ জন্য বাংলাদেশকে সজাগ হতে হবে। বৈষম্য দূর করতে নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে হবে। করোনার কারণে উগ্র মতবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার কিছু বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। রুদ্ধ জীবনে বর্তমানে আমরা সবাই ইন্টারনেট–নির্ভরশীল। তরুণ জনগোষ্ঠী ইন্টারনেটে বেশি সময় দিচ্ছে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্লেষণ ও সমীক্ষা থেকে এটা সন্দেহাতীত যে তাদের উগ্রবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

প্রথম আলো: সাইট ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক রিটা কাটজ বলেছেন, বিশ্বজুড়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এখন কোভিড–১৯ মোকাবিলায় ব্যস্ত। আইএসের জঙ্গিরা এর সুযোগ নিতে পারে। বাংলাদেশের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক? 

মুনিরুজ্জামান: এটা আমাদের জন্য পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো এখন করোনা মোকাবিলায় ব্যস্ত। এই শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে গত কিছুদিনের মধ্যে তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু হামলা পরিচালনা করেছে। লিবীয় বংশোদ্ভূত এক সন্ত্রাসী লন্ডনে, এর আগে এডিনবরায় হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। এরই মধ্যে করাচি স্টক এক্সচেঞ্জে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে জঙ্গিদের দ্বারা বায়োটেররিজম বা জীবাণু–সন্ত্রাসের আশঙ্কা। করোনাকে জঙ্গিদের অনেকে আল্লাহর দান হিসেবে দেখছে। তারা মনে করছে, একটা নতুন ধরনের সৈনিক, যারা সম্পূর্ণ নতুন কৌশলে যুদ্ধ করতে পারবে। কয়েক দিন আগে রিটা কাটজ তাঁর টুইটে উল্লেখ করেছেন, করোনায় আক্রান্ত আইএসের জঙ্গিরা ইহুদি উপাসনালয়ে গিয়ে হাঁচি-কাশি দিয়ে জীবাণু ছড়াতে পারে। ট্রাম্পের সমাবেশগুলোতে হাজির হয়ে সমর্থকদের প্রতি সংক্রামক ছড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে আইএস। সুতরাং জীবাণুকে অস্ত্রে পরিণত করার চিন্তা তাদের মধ্যে রয়েছে। এই কৌশল যদি তারা রপ্ত করতে পারে, তাহলে অতীতের মতো তারা গোলাবারুদ ব্যবহারের দিকে যাবে না। ক্ষুদ্র পরিসরে তারা বড় আঘাত হানতে পারবে। তাই প্রতিটি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য এটা বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে আসছে। 

প্রথম আলো: মালদ্বীপের হামলার ঘটনায় ভারত মহাসাগর তথা বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে তাদের নতুন কৌশলগত সক্রিয়তার গন্ধ পান? সম্প্রতি মোজাম্বিকের তেলক্ষেত্র অঞ্চলে তারা ৫২ জনকে হত্যা করল। 

মুনিরুজ্জামান: আমি আগেও বলেছি, তারা সব সময় নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবন করে। সমুদ্রকেন্দ্রিক হামলাটি আমাদের জন্য একটা শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে। আমাদের বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক স্থাপনা রয়েছে। সুতরাং এটা আমাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিল। তারা এর পুনরাবৃত্তির চেষ্টা করতে পারে। ভারত মহাসাগর এবং আমাদের অবস্থান কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই মালদ্বীপের ঘটনার পর সুরক্ষার জন্য দরকারি পদক্ষেপ এখনই নেওয়া দরকার, যাতে আমরা এ ধরনের শিকার না হই। 

প্রথম আলো: উহানে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর আইএস বলেছে, এটা চীনা কমিউনিস্টদের ওপর ঐশী শাস্তি। ইরান আক্রান্তের পর বলল শিয়া বহুত্ববাদীদের ওপর শাস্তি। ইউরোপ আক্রান্তের পর বলল ক্রুসেডার জাতির ওপরে শাস্তি। সম্প্রতি তাদের পত্রিকা নাবা বলেছে, মুসলমানরাও আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো কাউন্টার ন্যারেটিভস না থাকার বিষয়টি উদ্বেগজনক কি না। 

মুনিরুজ্জামান: আপনি যথার্থ চিহ্নিত করেছেন যে এ বিষয়ে যে কাউন্টার ন্যারেটিভ থাকা দরকার, সেটা নেই। এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই, তারা এ ধরনের ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে যে সুবিধা পেয়ে থাকে, সেটা প্রতিরোধে আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। এ দুর্বলতা আগেও ছিল, এখনো আছে। রাষ্ট্রগুলো কোভিড–১৯ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে এ বিষয়ে ধর্মীয় ব্যাখ্যা যে দিতে হবে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় পাচ্ছে না। তারা একতরফাভাবে অনলাইনে তাদের প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। হয়তো কিছু মানুষ এটা গ্রহণ করবে। কারণ, মানুষ বড় ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে আছে। মানুষ যখন মানসিকভাবে দুর্বল থাকে, তখন তারা ভুল ব্যাখ্যা অজান্তেই গ্রহণ করতে প্রস্তুত হতে পারে। 

প্রথম আলো: চার বছর আগের ঘটনাটির গোয়েন্দা, প্রশাসনিক, বিচারিক বা রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে কীভাবে দেখেন? 

মুনিরুজ্জামান: আগেই বলেছি, অপারেশনাল দিকেই বাংলাদেশ বেশি সফল। বড় সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি কিন্তু সন্ত্রাসী ঘটনা না ঘটা শেষ কথা নয়। কারণ, এর আগে অনেক স্তর থাকে। সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে শেষের একটা পর্ব। উগ্র মতবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার যে ক্ষেত্রগুলো সক্রিয় রয়েছে, সেগুলো রোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হবে না, সেটা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সীমিতভাবে হলেও তারা কিন্তু তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। বাংলাদেশের কতগুলো রাষ্ট্রীয় নীতিমালার দরকার ছিল, যা এখনো প্রণীত হয়নি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যেই সীমিত থাকছে। এখানে একটা জাতীয় কৌশলগত নীতি থাকতে হবে। যার দ্বারা আমরা এই উগ্র মতবাদের বিস্তার ঠেকাতে পারি। এখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন স্তর ও গোষ্ঠীর ভূমিকা অবশ্যই থাকতে হবে। সেই ভূমিকাগুলো পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করে সবাইকে কাজ করার জন্য ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ধর্মীয় নেতাদের, নাগরিক সমাজ, সংবাদমাধ্যম ও আমরা যাঁরা চিন্তাশালার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কী ভূমিকা হবে—সবগুলোকে একত্র করে নিয়ে একটি জাতীয় কৌশল নীতি করতে হবে। জঙ্গি মোকাবিলা কর্মসূচি শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো হয়তো কিছু সময় কোণঠাসা থাকবে, কিন্তু সুযোগ পেলেই আবার তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখাবে। উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মকাণ্ড সার্বিকভাবে পরিচালনা করার পদক্ষেপই সব থেকে জরুরি বলে আমি মনে করি। সেটা পারলে আমরা দেখব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ নয়, আমরা সন্ত্রাস নির্মূল করার দিকে এগোচ্ছি।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মুনিরুজ্জামান: ধন্যবাদ।