খেয়ালখুশির উন্নয়নে ঢাকা আজ ‘ক্যানসার রোগী’

ড. মো. সামছুল হক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। ঢাকার মেট্রোরেল, হাতিরঝিল প্রকল্পসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কুড়িল ইন্টারচেঞ্জের পরিকল্পনাকারীও তিনি। ঢাকার ভয়াবহ যানজট পরিস্থিতি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে তাঁর কথা হয়।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব

ড. মো. সামছুল হক
প্রশ্ন

প্রথম আলো: ঢাকার যানজটের অসহনীয় পরিস্থিতি নতুন নয়। এখন সম্ভবত সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এমন কেন হলো?

মো. সামছুল হক: কারণ, সময়ের কাজ আমরা সময়ে করিনি। কৌশলগত পরিকল্পনা অনুযায়ী যার যা করার কথা ছিল, যে সময়ের মধ্যে যেভাবে করার কথা ছিল, তা হয়নি। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু করণীয় ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করার জন্য বলেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তা না করে খেয়ালখুশিমতো উন্নয়ন করাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কোভিড বাস্তবতায় দীর্ঘদিন বিধিনিষেধে থাকার পর মানুষের চলাফেরা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেছে। অনেকে স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার কারণে ব্যক্তিগত গাড়ি কিনেছেন। অনেকে কাজ হারিয়ে কর্মসংস্থানের জন্য রিকশা, ভ্যান ও রাইড শেয়ারের মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। আজকে যা দেখছি, তা এসব কিছুরই সামষ্টিক বহিঃপ্রকাশ।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বলা হচ্ছে করোনার কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে। আমাদের কি তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখতে হবে?

মো. সামছুল হক: দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকে ভেবেছিলেন ঢাকার যানজটের সমাধান হয়ে গেছে। তাঁরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলেন। পরিকল্পনামাফিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমরা গড়ে তুলিনি। বাইরের দেশে সাধারণত স্কুলকেন্দ্রিক যাতায়াত বা ট্রিপটাকে কখনো প্রধান সড়কে যেতে দেয় না। সেখানের স্কুলগুলো হয় কমিউনিটিভিত্তিক। দূরের বাচ্চাদের জন্য নিজস্ব স্কুলবাস আছে। কিন্তু এ দেশে স্কুলগুলো দেখি প্রধান সড়কের পাশে বা যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবং ভালো মানের স্কুল হলে যেকোনো এলাকা থেকে ভর্তির সুযোগ আছে। ফলে দূরদূরান্ত থেকে গাড়ি এসে রাস্তার পাশে জড়ো হয়ে জট লাগায়। স্কুলে সন্তানদের আনা-নেওয়ায় ব্যক্তিগত গাড়ির বিলাসিতা তো আছেই, রাস্তার ধারণক্ষমতা না থাকলেও সেই চাপ আমাদের নিতে হচ্ছে। এর বাইরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আবার কোচিংনির্ভর। স্কুলের পরপর আবার কোচিংয়ের জন্য আরেকটা ট্রিপের চাপ এসে পড়ে। সবকিছু অপরিকল্পিত ও অপেশাদারিভাবে গড়ে তোলারই ফল এটি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: চলমান কিছু উন্নয়নমূলক কাজকেও বর্তমান যানজট পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এসব কবে শেষ হবে?

মো. সামছুল হক: আমাদের আসলে সক্ষমতার বড় অভাব। পৃথিবীতে ১৭৫টি শহরে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) সিস্টেম আছে। এ ধরনের প্রকল্প করতে নয় মাস থেকে দেড় বছর লাগে। সেটি আমরা ১০ বছরেও কূলকিনারা করতে পারিনি। গিনেস বুকে রেকর্ড করে ফেলছি সময় ও খরচের দিকে। সম্প্রতি পাকিস্তান এক থেকে আড়াই বছরের মধ্যে পরপর তিনটি বিআরটি প্রকল্প করে ফেলেছে। আমাদের সঙ্গে একই সময় জাইকার অর্থায়নে জাকার্তা মেট্রোরেলের কাজ শুরু করে, ওদের আবার পাঁচ কিলোমিটার ভূগর্ভস্ত লাইন ছিল, সেটি আরও বেশি খরচ ও সময়সাপেক্ষ ছিল, এরপরেও তারা গত বছর সেটি চালু করে দিতে পেরেছে। জাকার্তা তো উন্নত বিশ্বের শহর না।

তার মানে প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের সক্ষমতা নেই, প্রথমে সেটি আমাদের স্বীকার করতে হবে। আমাদের উন্নয়ন দর্শনে ভুল আছে। যারা কোনো দিন বিআরটি, মেট্রোরেল করেনি, তাদের দিয়ে প্রকল্প করালে কাজ তো ঝুলে যাবেই। বিশ্বমানের পরামর্শক এনেও লাভ হবে না। অথচ উন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে কাজ কখনো হয়নি তার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি নিয়ে ও সক্ষমতা অর্জন করে কাজটি শুরু করে ও গুণগতভাবে শেষ করে। এতে সময় ও অর্থ কোনোটাই অপচয় হয় না। আর আমরা চলেছি উল্টোপথে। ফলে মানুষের ভোগান্তিও বাড়ছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: মেট্রোরেল চালু হলে যানজট থেকে মুক্তি পাবে নগরবাসী—এমন আশ্বাসের কথা শোনা যায়। উড়ালসড়ক চালু হওয়ার আগেও আমরা তেমন শুনেছি।

মো. সামছুল হক: এ দেশে সুন্দর সুন্দর কথা বলে প্রকল্প পাস করানো হয়, কাজ করার পর সেসবের পুনর্মূল্যায়ন হয় না। কারণ, এখানে সুশাসনের ঘাটতি আছে। আকর্ষণীয় কথা বলে জনগণকে যন্ত্রণা দিয়ে সাতটা উড়ালসড়ক করা হলো, সেটার ওপরও এখন যানজট লেগে থাকে। কারণ, ওপর আর নিচের দুই রাস্তার গাড়ি এক মোড়ে এসে মিশছে। সেটা তো পরিকল্পনামাফিক তৈরি করা হয়নি। বোতলে যত পানিই থাকুক, তার ছোট মুখের সামর্থ্যানুযায়ীই তো পানি বের হবে। যানজটটাকে এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আর্মি নামিয়েও সমাধান সম্ভব নয়।

এখন বিশ্বজুড়ে এ বিশ্বাস চলে এসেছে যে গণপরিবহনই টেকসই সমাধান দেবে, উড়ালসড়ক নয়। ফলে অনেক দেশ উড়ালসড়ক ভেঙে ফেলছে। আর আমরা ষাট দশকের উন্নয়নের ধারণা ঢাকা শহরের মতো মেগা সিটিতে আমদানি করে অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলেছি। এখন ওপরেও বাস চালানোর জন্য পরিবেশটা থাকল না, আর নিচেও সাবওয়ে বা মেট্রো বানানোর সুযোগটা থাকল না। জনগণের টাকায় ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করলাম আমরা। আমরা যাত্রা আরম্ভ করেছি অনেক দেরিতে, সুতরাং সবচেয়ে চৌকস, টেকসই ও স্মার্ট সমাধানের দিকেই আমরা যেতে পারতাম। সেই পথে আমরা হাঁটিনি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সম্প্রতি আপনি বলেছেন, ২০৩৫ সালের মধ্যে পাঁচটি মেট্রো লাইনের কাজ শেষ হলেও যানজট কমবে না, যদি বাস সার্ভিসের উন্নতি না হয়। কিন্তু আমরা কেন একটি কার্যকর বাস সার্ভিস চালু করতে পারছি না?

মো. সামছুল হক: মূলত কৌশলগত পরিপত্রের সুপারিশেই এমনটা বলা আছে। সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, ১৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে পাঁচটি এমআরটি চালু করার পরও সেগুলো পুরো পরিবহনের মাত্র ১৭ শতাংশের চাপ নিতে পারবে। তখনো ৪০ শতাংশ চাপ নেবে গণপরিবহন। কারণ, সেটি অনেক জায়গায় যেতে পারে, মেট্রো তার নির্দিষ্ট লাইনের বাইরে যেতে পারে না। মালিকনির্ভর পাল্টাপাল্টির বাস সার্ভিসগুলোকে একটি বা একাধিক কোম্পানির অধীনে এনে ভালো মানের সেবাদানের প্রক্রিয়াটা খরচবিহীন। কারণ, এখানে কোনো অবকাঠামো লাগবে না। গণপরিবহনকে এমন শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসাটা শুধু সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এখানে কোটি কোটি টাকার খরচ নেই, সময়ও লাগে না। কিন্তু সবাই আছে উন্নয়নের জোয়ারে, বিলাসী প্রকল্প না হলে কারও পোষায় না। যে কারণে সুপারিশগুচ্ছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফুটপাত, গণপরিবহন, বিআরটি, এমআরটি—এভাবে ধাপে ধাপে একটি বিন্যাস করে দেওয়া হলো, সেগুলো না মেনে আমরা একেবারে শীর্ষে চলে গেলাম। শুরুতেই যে গণপরিবহন যানজটের বেশি চাপ নিরসন করবে, সেদিকে নজর দেওয়া হলো না। কারণ, সরকার ফিতা কাটার উন্নয়ন, বড় বিনিয়োগ ও বড় প্রকল্পে বিশ্বাস করে। অথচ গুণগত প্রকল্পের জন্য বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। শুধু দরদ লাগে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ঢাকা নগর পরিবহনের মাধ্যমে দুই সিটিতে কয়েকটি রুটে দুই শতাধিক বাস নামানোর ঘোষণা এসেছে। ইতিমধ্যে একটি রুটে সমন্বিত ব্যবস্থায় পরীক্ষামূলকভাবে কিছু বাস চলা শুরু হয়েছে। এতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে কি না?

মো. সামছুল হক: আমার মনে হয় না। দেখতে হবে কারা এ সমন্বিত ব্যবস্থাটা তৈরি করছে। পরামর্শক দিয়ে সেটি আরম্ভ করা যায়, কিন্তু দুই দিন পর তারা চলে গেলে তা রক্ষণাবেক্ষণ কে করবে? আগে মেয়রকে সেটি ধারণ করতে হবে। তার হাতে গণপরিবহন ও সিগন্যাল দেখভালের জন্য পৃথক ইউনিট থাকতে হবে। যারা অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে ধারাবাহিকভাবে বিষয়টি দেখবে, তাদের না রাখলে এসব প্রকল্প উদ্বোধন পর্যন্তই থেকে যাবে। যাত্রীরা যদি দেখে আধা ঘণ্টায়ও বাস পাওয়া যায় না, সেটি কাকে বলবে? রাতের বেলায়ও একই সেবা দিচ্ছে কি না, সেটা কে দেখবে? তাছাড়া বাস রুট ফ্র্যাইঞ্জাইজ হচ্ছে মনোপলির জায়গা। তাকে কিছু উপযোগিতা দিতে হবে, প্রতিজ্ঞা দিতে হবে, তখন সে কিছু শর্ত মানবে। এখানে একটি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে, কিন্তু সেটিকে তারা প্রকল্প হিসেবে নিয়েছে। সাংবাদিক ডেকে ফিতা কেটেই নিজে নিজে বলবে, ‘সফলভাবে আরম্ভ করে দিলাম।’ নিজের মূল্যায়ন নিজে করলে বুঝতে হবে সেটি আত্মতুষ্টির জন্য। এতে জনগণের ভোগান্তি দূর হবে না। টেকসই উন্নয়নের দর্শন এখানে নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা সড়কনির্ভর হয়ে পড়েছে। নৌ ও রেলপথকে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকলেও সেটি কেন করা হচ্ছে না?

মো. সামছুল হক: পৃথিবীতে অনেক শহর আছে, যেখানে একটিও নদী নেই। সেখানে ঢাকার চারপাশে চারটি নদী। আমরা সেগুলো কাজে লাগাতে পারিনি। সড়ক, নদী ও রেল—সব পথকে সমন্বয় করে গণপরিবহনের কথা বলা হয়েছিল সরকারের ২০১৩ সালের একটি পরিকল্পনায়। চমৎকার পরিকল্পনা ছিল সেটি। আমাদের ভূমি কম, জনসংখ্যা বেশি—সেই বিবেচনায় ভারসাম্যপূর্ণ একটি যোগাযোগব্যবস্থা করতে হলে নদী কিছু চাপ নেবে, সড়ক কিছু চাপ নেবে, রেল কিছু চাপ নেবে। সেই সম্ভাবনাগুলোই কিন্তু মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম নামের পরিকল্পনাটিতে বলা হয়েছিল। ওখানে যে কথাগুলো বলা হয়েছিল, সেগুলো কিছুই মানা হয়নি। নদীগুলো দখল হয়ে গেছে। সেতুগুলো হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই ২০০ কোটি টাকা খরচ করে ওয়াটার বাস চালু হলো, কিন্তু বর্ষাকালে সেতুর নিচ দিয়ে সেগুলো চলতে পারে না, ফলে সেই ওয়াটার বাস বন্ধ হয়ে গেল। উন্নয়নের নামে নদী ধ্বংস করা হলো, এখন নাকি ১৩টি সেতু ভাঙা হবে। কথা হচ্ছে বানানোর সময় বিষয়টা কেন দেখা হলো না। অনুমোদন প্রক্রিয়ায় কি একজনের মাথায়ও আসেনি, যে উন্নয়ন করা হচ্ছে, সেটি অন্য কিছুর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে কি না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ঢাকা সিটির উত্তরের মেয়র বলেছেন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেলে তিনি নম্বরপ্লেটের জোড় বা বিজোড়ের ভিত্তিতে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করবেন। এটা কতটুকু বাস্তবসম্মত?

মো. সামছুল হক: তিনি না জেনে এসব কথা বলেছেন। কোনো ধরনের সক্ষমতা অর্জন না করে, ডিজিটাল ব্যবস্থায় পারদর্শী না হয়ে, কীভাবে এ ব্যবস্থা চালু করার কথা তিনি বলেন। মেগা সিটি চালানোর বিচক্ষণতাই তো তাদের নেই। সরকারকে তো তাঁরা বলতে পারেন না—এ শহরে উড়ালসড়ক হতে দেব না, গণপরিবহন হবে যোগাযোগব্যবস্থার মেরুদণ্ড। এখন নম্বরপ্লেটের জোড়-বিজোড় ভিত্তিতে গাড়ি নামানোর ব্যবস্থা করলে কয়েক দিন দু–এক জায়গায় ম্যাজিস্ট্রেট নামানো হবে, না মানলে জরিমানা করা হবে। কিছু মানুষ ভোগান্তিতে পড়বে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তা সফট লোনে গাড়ি কিনে বা প্রকল্পের একাধিক গাড়ি ব্যবহার করে, তাদের ও তাদের পরিবারকে তো আটকাতে পারবে না। তাদের কষ্ট না দিলে তো সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ তারা বুঝবে না। এখন পর্যন্ত দিনের বেলায় ময়লার গাড়ির চলাচলই তারা বন্ধ করতে পারেনি। নিজেদের মার্কেটগুলোর ফুটপাত তারা দখলমুক্ত করতে পারে না। তাদের এসব কথার মধ্যে আমি আসলে আস্থা পাই না। তঁারা ড্রেনে ঢুকে চমকই দেখাতে পারবেন।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনা, সড়কে চাঁদাবাজির মতো বিষয়গুলোরও তো কোনো সমাধান দেখি না।

মো. সামছুল হক: শিক্ষার্থীরা একাধিকবার রাস্তায় নামল। বিশ্ব মিডিয়ায় শিরোনাম হলো। কারও কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। সবকিছু তারা উন্মুক্ত করে দিল। এরপরও কিছু বদলাল না। মূলত অনেকে এ যানজটের কারণে সুবিধাভোগী। সবকিছু সুশৃঙ্খল হয়ে গেলে তো ‘ডার্ট মানি’র জোগান বন্ধ হয়ে যাবে। পুলিশ, পরিবহননেতা, রাজনৈতিক নেতা-মাস্তানেরা মিলে বড় সিন্ডিকেট তৈরি হয়ে আছে এখানে। ঢাকার বাস পাঁচটি কোম্পানির অধীনে নেওয়া কীভাবে সম্ভব। তাহলে তো দুই হাজার বাসমালিক আর থাকছে না, তাদের নেতা হওয়ার সুযোগও আর থাকছে না। সরকারের ডাকে ঢাকা অচল করাও তখন সম্ভব হবে না। তাদের বরং আরও সুযোগ করে দেওয়া হয়। এ কারণে বিষয়গুলোর সমাধান হয় না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ব্যক্তিগত গাড়িই ৭৬ শতাংশের বেশি সড়ক দখল করে রাখছে। এখন ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কীভাবে কমানো যায়?

মো. সামছুল হক: আমি বলব এটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। তবে এ সরকারের জন্য এটি কিছু না। আগে শুধু নিজের ঘরটাকে সামাল দিতে হবে। সরকারের উচ্চপদস্থদের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, প্রকল্প থেকে গাড়ির সুবিধাভোগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আগে বন্ধ করতে হবে। সরকারের মন্ত্রীরা কথায় কথায় ‘সিঙ্গাপুরের মতো হতে চাই’ বলেন। সেটি হওয়ার জন্য তো তার দর্শনটা আগে ধারন করতে হবে। সেখানে তো ক্রয়ক্ষমতা থাকলেও সবাই গাড়ি কিনতে পারে না। এক পরিবারের কাছে একটির বেশি গাড়ি তো নেই, এর জন্য টাকাও গুনতে হয় বেশি। রেজিস্ট্রেশন ফিও বিপুল পরিমাণ। সেই টাকা খরচ করা হয় অত্যাধুনিক গণপরিবহন সুবিধার পেছনে। যার গাড়ি আছে, সে–ও যাতে গণপরিবহনে চড়তে আগ্রহী হয়, সেভাবে সব ধরনের সুবিধা যুক্ত করা হয়। এখন আমরা চলেছি উল্টো পথে। সরকারের অনেক অর্জন আছে, সবকিছুই ম্লান হয়ে যাচ্ছে, যখন আমরা দেখি বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ আমরা। এর পেছনে কিন্তু গাড়ির জ্বালানির ব্যবহার বড় অংশে দায়ী।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সিগন্যাল, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে কয়েক শ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। যার কোনো ফলই আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

মো. সামছুল হক: ঢাকার মতো দ্রুত, মাঝারি ও ধীরগতির গাড়ি একসঙ্গে চলে, প্রচুর পথচারী আছে এমন শহরের জন্য পশ্চিমা সিস্টেমে সিগন্যাল ডিজাইন করলে তো হবে না। বিদেশ থেকে বিশ্ববিখ্যাত পরামর্শক এনে সেটিই করা হলো। আমেরিকায় যেখানে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা আছে, রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়েও পরিবহনের সংখ্যা কম, সবাই আইন মেনে চলে, সেখানকার সফটওয়্যার দিয়ে এখানে কীভাবে সড়ক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? দুঃখ লাগে জনগণের টাকা এভাবে নষ্ট করা হচ্ছে। একবারও কেউ জিজ্ঞাসা করেনি, এত টাকা দিয়ে এই সিস্টেম তৈরি করা হলো, পরামর্শকেরা চলে যাওয়ার পর সেটি চালাবে কে।

ট্রাফিক সিগন্যালের প্রকল্প নিয়ে আরও বাজে উদাহরণ তৈরি করেছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। প্রায় ৭০ কোটি টাকা খরচ করে জাপান থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি নিয়ে আসল, সেটি নাকি ‘ম্যাজিক’! ঠিকই ব্যর্থ হলো। কথা হচ্ছে, প্রযুক্তি তো ঠিক আছে কিন্তু সেটি জাপানের জন্য, যেখানে গাড়ীচালক, যাত্রী ও পথচারী সবাই আইন মানে। বনানী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ডিজিটাল করিডোর করা হলো, সেটিও পরিত্যক্ত হলো। জনগণ থেকে ৫৭০ কোটি নিয়ে ডিজিটাল নাম্বারপ্লেট করা হলো, সেটির যেসব সুবিধার কথা বলা হয়েছিল, কোনো কাজ হয়নি, শুধু টাকা খরচ হয়েছে।

এভাবে একের পর এক প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার পর একই ধরনের আরও মোটাতাজা প্রজেক্ট নেওয়া হচ্ছে। আগের প্রকল্পগুলো কেন ব্যর্থ হলো সেই অনুসন্ধান করা হচ্ছে না। কারণ, এখানে কারও কোনো জবাবদিহি নেই। এতে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির উন্নয়ন হয়েছে, জনগণের নয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: যানজটে ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। রাজধানীতে যানবাহনের গতি এখন হাঁটাগতির সমান। সামনে যানবাহনের গতি কি হাঁটার গতিকেও পেছনে ফেলবে?

মো. সামছুল হক: এক দশক আগে ঢাকার যানবাহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার, সেখান থেকে নামতে নামতে সেটি এখন ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার, প্রায় হাঁটার গতির সমান। ঢাকার অবস্থা এখন অনেকটা ‘ক্যানসার রোগীর’ মতো। তার হৃৎস্পন্দন ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে, ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সে। যানবাহনের গতি দিয়ে ঢাকা নিজেই বলে দিচ্ছে—আমি ভালো নেই, আমি গুরুতর অসুস্থ। অতীতের এতগুলো ডেটাই বলে দিচ্ছে, যানবাহনের গতি জিরো কিলোমিটারের দিকে যাচ্ছে। এরপরও যদি আমরা না বুঝি, এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী আছে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মো. সামছুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।