সেলিম রায়হান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের নানা দুর্বলতা উঠে আসে সানেমের সাম্প্রতিক জরিপে। ওই জরিপের বিভিন্ন দিক ছাড়াও কোভিডকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতের ক্ষতি এবং সার্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিয়ে তিনি কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো: দক্ষিণ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) সম্প্রতি সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে পঞ্চম দফা জরিপের ফল প্রকাশ করেছে, যাতে এই কর্মসূচির নানা দুর্বলতা প্রকাশিত হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
সেলিম রায়হান: সরকারের এই প্রণোদনা প্যাকেজ অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের আগেই সরকার এই কর্মসূচি ঘোষণা করে। রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা, কৃষি, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পসহ অনেক খাতেই এই প্রণোদনা দেওয়া হয়। অর্থের পরিমাণও কম ছিল না—জিডিপির ৪ শতাংশ। অর্থায়নেও বড় সমস্যা হয়নি। ব্যাংকের মাধ্যমেই বেশির ভাগ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। সরকার কিছু ভর্তুকি দিয়েছে। কিন্তু বিপুল অঙ্কের অর্থ বিতরণের জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও লোকবল প্রয়োজন, তার ঘাটতি ছিল। ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দিতে খুব উৎসাহী ছিল না। এ ছাড়া নানা লবি, তদবির ও প্রভাবের বিষয়ও ছিল। সেসব সামাল দিয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের কাছে প্রণোদনা পৌঁছানো কঠিন কাজ। এ কারণে কিছু অনিয়ম হয়েছে। উৎকোচের ঘটনাও ঘটেছে, যা সানেমের জরিপে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এসব তদারক করার কেউ ছিল না।
প্রথম আলো: আপনারা পাঁচ দফা জরিপ করেছেন। এবারের ফলাফল কি আগেরগুলোর চেয়ে খারাপ?
সেলিম রায়হান: গত জানুয়ারি-মার্চ মেয়াদে আমরা যে জরিপ করি, সেখান প্রশ্ন ছিল গত বছরে একই সময়ে যে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল, সেটি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে কি না। ৫৭ শতাংশ বলেছেন, সম্ভব হয়েছে। বড় শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ। কিন্তু এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বলেছেন ৩৫ শতাংশ পুনরুদ্ধার হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে অবস্থা খারাপই বলতে হবে।
প্রথম আলো: আপনারা বলেছেন, ২০–২১ শতাংশ উদ্যোক্তা প্রণোদনা পেয়েছেন। সে ক্ষেত্রে বিশাল অংশ সহায়তার বাইরে থেকে গেছে। তারা কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে?
সেলিম রায়হান: এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর যেমন অনীহা ছিল, তেমনি প্রক্রিয়াগত সমস্যাও ছিল। ঋণ নিতে ব্যাংকে যেসব কাগজপত্র দিতে হয়, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অনেকের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। অনেক ছোট উদ্যোক্তা ব্যাংকিং সিস্টেমেরও বাইরে ছিলেন। ফলে তঁারা ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ পুঁজি খরচ করে ফেলেছেন। ফলে তাঁদের পক্ষে ব্যবসায় টিকে থাকাও কঠিন হবে। ব্যবসা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
প্রথম আলো: আপনারা দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে কাজ করেন। অন্যান্য দেশে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি কোন পর্যায়ে আছে?
সেলিম রায়হান: আমি বলব, সব দেশই সংগ্রাম করছে। তবে সব দেশ একই হারে প্রণোদনা দেয়নি। ভারতের প্রণোদনা পরিমাণ সবচেয়ে বেশি—জিডিপির ১১–১২ শতাংশ। ভারতে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য আছে। কোনো কোনো অঞ্চল ভালো করেছে। আবার কোনো কোনো অঞ্চল খারাপ করেছে। আবার পাকিস্তান দিয়েছে জিডিপির ২.৫ শতাংশ। ভুটান, নেপালসহ যেসব দেশের প্রধান আয় ছিল পর্যটন, সেসব দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নেপাল ও বাংলাদেশ ছাড়া সব দেশের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক। সেই বিবেচনায় আমরা ভালো অবস্থায় আছি। ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছি।
প্রথম আলো: আপনি একজন শিক্ষক। কোভিডকালে শিক্ষার ক্ষতি কীভাবে নিরূপণ করবেন?
সেলিম রায়হান: শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর এর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সেটি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যাবে, সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখতে হবে, কোভিড থাকবে, এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের চলতে হবে। আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক কৌশল ঠিক করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে গেছে, অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। আর দেরি করা ঠিক হবে না। অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া প্রয়োজন। একটা প্রজন্মকে আমরা গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিতে পারি না।
প্রথম আলো: কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের ভূমিকাই প্রধান। কিন্তু তারা কি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে?
সেলিম রায়হান: স্বাস্থ্য খাতে দেখছি ভয়াবহ সংকট। বলা যায়, দীর্ঘমেয়াদি এক সংকটের খাত। কোভিডের কারণে স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্বলতা আরও প্রকট রূপে ধরা পড়েছে। প্রথমত, স্বাস্থ্য খাতে আমাদের বাজেট খুব কম। জিডিপির ১ শতাংশের কম। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে স্বাস্থ্য খাতে এত কম বরাদ্দ নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলো যে বরাদ্দ আছে, তা–ও আমরা ভালোভাবে খরচ করতে পারছি না। টাকা ফেরত যাচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে কেনা যন্ত্রপাতি অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। করোনার শুরুতে টিকা সংগ্রহের উদ্যোগেও ঘাটতি ছিল। একটি উৎসের ওপর নির্ভর করা ঠিক হয়নি। পরে অন্যান্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ করা হলেও এখনো চাহিদা মেটানোর মতো টিকা আমাদের সংগ্রহে নেই।
প্রথম আলো: করোনাকালে দুটি অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হয়েছে। বিশেষ করে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট যখন দেওয়া হয়, তখন করোনার প্রাদুর্ভাব ছিল প্রকট। কিন্তু বাজেটে তার প্রতিফলন কতটা ছিল?
সেলিম রায়হান: করোনায় অর্থনীতির যে বিরাট ক্ষতি হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও বেশি ক্ষতি হতে পারে, বাজেটে তার যথাযথ স্বীকৃতি ছিল না। ফলে ক্ষতি পোষানোর জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা অপ্রতুল। এ ক্ষেত্রে উচিত ছিল ক্ষতিটা আরও অনুপুঙ্ক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা; যার ভিত্তিতে স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া যেত।
প্রথম আলো: কেবল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নয়, কোভিডে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হলো, সেসব থেকে উত্তরণের উপায় কী। কত দিনে সংকট কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা যাবে বলে মনে করেন?
সেলিম রায়হান: প্রথম কথা হলো কোভিড শিগগিরই চলে যাচ্ছে না। আরও অনেক দিন থাকবে। তাই আর্থসামাজিক পরিকল্পনা নেওয়ার সময় আমাদের এ কথাটি মনে রাখতে হবে। আবার পরিকল্পনা নেওয়ার ক্ষেত্রে খাত ও অঞ্চলভিত্তিক সমস্যার স্বরূপটিও বিবেচনায় নিতে হবে। ঢাকার জন্য যে কর্মসূচি, সেটি রংপুরে কার্যকর না–ও হতে পারে। স্বাস্থ্য খাতে যে ধরনের পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন, কৃষিতে সেটা কাজ না–ও করতে পারে। প্রতিটি খাত ও এলাকার ভিত্তিতে টেকসই কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে, যাতে বেশি সুফল পাওয়া যায়।
প্রথম আলো: কোভিড মোকাবিলায় দাতা সংস্থা বা উন্নয়ন সহযোগীদের ভূমিকা কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন? তাদের সহায়তা কি যথেষ্ট বলে মনে করেন? আমরা নতুন করে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ব কি না?
সেলিম রায়হান: কোভিড সমস্যাটি বিশ্বব্যাপী। তাই বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ বা অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তার ক্ষেত্রে একটা প্রতিযোগিতা তো থাকবেই। সব দেশই বেশি সহায়তা চাইবে। বাংলাদেশে তাদের ঋণসহায়তা ঠিক আছে বলে মনে করি। কিন্তু ঋণসহায়তার সঙ্গে সংকট উত্তরণে তারা কোন দেশে, কী পদ্ধতিতে কাজ করে সাফল্য পেয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা এখানেও কাজে লাগবে কি না, সেসব নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। এ বিষয়ে তাদের যেমন পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন, তেমনি আমাদেরও সেই অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। অনেক দেশ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ঋণ নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমরা এখনো আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছি বলা যাবে না। তবে আমাদের সমস্যা হলো ঋণটি কীভাবে ও কোথায় খরচ হচ্ছে, তার জবাবদিহির ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। প্রকল্পের মান নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কী কী বাড়তি চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করেন?
সেলিম রায়হান: স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা পেতাম। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে গেলে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে। অনেক সুবিধা কমবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, শুল্ককাঠামো সুবিন্যস্ত করতে হবে। উন্নয়ন নীতি–পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যেসব দুর্বলতা আছে, তা কাটিয়ে উঠতে হবে। সর্বোপরি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। কোভিড বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজাতে হবে। প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা বাড়াতে হবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
সেলিম রায়হান: আপনাকেও ধন্যবাদ।