মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এ এন এম মুনীরুজ্জামান সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলা, বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা, অর্থনীতি ও ভূরাজনীতিতে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া—এসব প্রসঙ্গ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো: ইউক্রেন পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? রুশ হামলাকে ইউক্রেন যেভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করছে, তেমনটি কি রাশিয়ার বিবেচনায় ছিল? নাকি এই অভিযানকে খুব সহজ মনে করেছিল?
এ এন এম মুনীরুজ্জামান: ইউক্রেনের পরিস্থিতি দুঃখজনক এবং সেখানকার সর্বশেষ যে পরিস্থিতি, তাতে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। ইউক্রেনে হামলার আগে রাশিয়া সম্ভবত আশা করেছিল যে তেমন কোনো বাধা ছাড়াই তারা সহজে রাজধানী কিয়েভ দখল করে নিতে পারবে। সেই আশা থেকেই সম্ভবত আক্রমণের ধারণটা পরিকল্পনা করা হয়েছিল। রাশিয়ার হালকা অস্ত্রশস্ত্র এবং যুদ্ধযানের ব্যবহার থেকে তেমনটিই বোঝা যাচ্ছে। ইউক্রেনে রাশিয়া যে প্রতিরোধের মুখে পড়েছে, তা শুধু দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর কাছ থেকে আসেনি, বরং ইউক্রেনের জনগণও সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যেভাবে সম্মুখ রণাঙ্গনে থেকে এই প্রতিরোধের অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাতে প্রতিরোধ আরও জোরদার হয়েছে। এই চলমান অভিযান কীভাবে এবং কী পরিস্থিতিতে এগোয়, কয়েক দিনের মধ্যে সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে।
প্রথম আলো: হামলার মুখে পড়া ইউক্রেনকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। কিন্তু এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে খুবই শক্ত অর্থনৈতিক ও নানা নিষেধাজ্ঞা আসছে। এই মাত্রার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি রাশিয়ার বিবেচনায় ছিল বলে মনে করেন কি?
এম মুনীরুজ্জামান: ইউক্রেনকে বাঁচাতে অন্য কোনো দেশ সরাসরি তাদের সামরিক বাহিনীকে যুক্ত করেনি। কিন্তু বহুমাত্রিক প্রতিরোধের সব পন্থা তারা অবলম্বন করছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদেশগুলোর পক্ষ থেকে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও নানামুখী নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমা রাশিয়ার উড়োজাহাজ চলাচলের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বৈশ্বিক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থা থেকে তাদের সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের বড় বিনিয়োগ ছিল—এমন রুশ তেল কোম্পানিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হচ্ছে। গাজপ্রমের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহৃত হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার রুবলের মান অবিশ্বাস্য নিচে নেমে গেছে। এক রুবলের দাম এক আমেরিকান সেন্টের নিচে নেমে গেছে। আক্রমণের আগে সম্ভবত এ রকম ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা তারা করেনি। যে কারণে এই অনেক প্রতিরোধের মুখে তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে। যেমন রাশিয়া ঘোষণা করেছে, যেকোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে পারবে না, অথবা এখন থেকে রাশিয়ার বাইরে কেউ ১০ হাজার ডলারের বেশি মুদ্রা নিতে পারবে না। এই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পরিণতি সামনে যে আরও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে, তা পরিষ্কার।
প্রথম আলো: হামলার পক্ষে পুতিন রাশিয়ার নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এনেছেন। সীমান্তবর্তী ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাশিয়ার প্রবল আপত্তি রয়েছে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে এমন ধারণা দেওয়া হচ্ছে যে হামলা ছাড়া কোনো পথ ছিল না। রাশিয়ার এই যুক্তিকে কীভাবে দেখেন?
এম মুনীরুজ্জামান: শুরু থেকেই রাশিয়া ন্যাটোর পূর্ব সীমান্তে সম্প্রসারণের বিরোধিতা করে আসছিল। রাশিয়া অভিযোগ করে আসছে যে এ ব্যাপারে পশ্চিমারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা রক্ষা করেনি। লাটভিয়া ও মলদোভা ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাশিয়ার আশঙ্কা হচ্ছে, ন্যাটো ইউক্রেনকে অন্তর্ভুক্ত করবে। সে ক্ষেত্রে ন্যাটোর উপস্থিতি রাশিয়ার দোরগোড়ায় চলে আসবে। তবে ইউক্রেনে আক্রমণের আগে প্রেসিডেন্ট পুতিন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করলে মনে হবে, এটাই শুধু আক্রমণের একমাত্র কারণ নয়। ইউক্রেনকে তিনি ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ মনে করেন এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্মকেই তিনি ভুল বলে মনে করেন। রাশিয়ার নিরাপত্তা ছাড়াও অতীতে যে ভুল হয়েছে বলে পুতিন মনে করেন, তা সংশোধনের একটি বিষয়ও সম্ভবত এখানে রয়েছে। সবকিছু মিলে একটি জটিল মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি থেকে এ আক্রমণের সূচনা হয়।
প্রথম আলো: ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ঠেকাতে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া কি সম্ভব ছিল? পশ্চিমের বিরুদ্ধে অনেকেই অভিযোগ করছেন, তারা ইউক্রেনকে গাছে তুলে মই কেড়ে নিয়েছে। আসলেই কি তা-ই?
এম মুনীরুজ্জামান: আক্রমণের আগে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে, এমনকি ন্যাটোর সদস্য ফ্রান্স অথবা তুরস্কের পক্ষ থেকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধানেরা মস্কো গিয়ে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে এই কূটনৈতিক উদ্যোগগুলো সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। কূটনীতির বাইরে অন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়াকে সমীচীন মনে না করায় তারা সামরিক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের পথে এগোয়নি। এটা বিবেচনায় রাখতে হবে যে তৃতীয় কোনো রাষ্ট্র এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে, তা বৈশ্বিক রূপ নিতে পারে, যা আকাঙ্ক্ষিত নয়।
প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন অর্থনৈতিক অবরোধের বিকল্প ছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করা। আপনিও তা-ই মনে করেন?
এম মুনীরুজ্জামান: যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নানা কঠোর নিষেধাজ্ঞা ইতিমধ্যে এসেছে এবং এর আওতা আরও বাড়তে পারে। বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক এবং অন্যান্যভাবে একটি দেশ যদি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে সেটাই দেশটির ওপর সবচেয়ে বড় চাপ তৈরি করে। দেখা যাচ্ছে, রাশিয়া এরই মধ্যে কঠোর চাপে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো বা অন্যান্য দেশ যদি এই নিষেধাজ্ঞার পথ না ধরে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ত, তাহলে সংঘাত দ্রুতই ইউরোপ এবং বিশ্বে ছড়িয়ে পরত। এই পরিস্থিতি এড়াতেই হয়তো এই সংঘাতের সঙ্গে অন্য কোনো দেশ সরাসরি যুক্ত হয়নি।
প্রথম আলো: পশ্চিমের অর্থনৈতিক অবরোধ রাশিয়াকে কতটুকু কাবু করতে পারবে বলে মনে করেন?
এম মুনীরুজ্জামান: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা। এটা ছাড়া বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশের পক্ষে শক্তভাবে কোনো কিছু পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে এবং অন্যান্য যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, সে কারণেও রাশিয়ার অর্থনীতিতে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে কঠোর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। রুবলের দাম পড়ে যাওয়ার কথা আগেই বলেছি। খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে। রুশ নাগরিকদের আন্তর্জাতিক চলাচল সীমাবদ্ধ হয়ে আসছে। রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং সুইফট ব্যবস্থা থেকে অনেক ব্যাংক বাদ পড়ায় বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে। রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার পরিস্থিতির ওপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রাশিয়ার ৬৫০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার যে তহবিল ছিল, সেটা ইতিমধ্যে পশ্চিমা বিশ্ব আটকে দিয়েছে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা বিশ্ব অর্থনীতি থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্ট পুতিন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ এবং রাশিয়ার ধনকুবেরদের অনেকেরই বিদেশের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার আওতা আরও বিস্তৃত হতে পারে এবং চূড়ান্তভাবে এটা কোথায় যাবে, তা রাশিয়া হয়তো এখনো বুঝতে পারেনি। তবে এতে রাশিয়ার অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যে বিপর্যস্ত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রথম আলো: রুশ সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা করছে ইউক্রেন। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়া শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই চলার আশঙ্কা কতটুকু?
এম মুনীরুজ্জামান: রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিরোধে ইউক্রেন সাহসী অবস্থান নিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য, অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে এবং ইতিমধ্যে তা পৌঁছাতে শুরু করেছে। খুব দ্রুত না হলেও একটি পর্যায়ে হয়তো রাশিয়া পুরো ইউক্রেনের দখল নিয়ে নেবে। তবে এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী হয়তো জনগণের সঙ্গে মিশে গিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ সৃষ্টি করবে। সংঘাত যদি এভাবে গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়, তাহলে এই সংঘাত দীর্ঘায়িত হবে এবং রাশিয়া কোনোভাবেই ইউক্রেনের ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে না। আমরা জানি, আক্রমণ করে দখল করা অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাটা অনেক কঠিন।
প্রথম আলো: পশ্চিমাবিরোধী চীন ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার পক্ষ নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা গেল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চীনের সঙ্গে ভারতও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। অথচ, ভারত এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কৌশলগত মিত্র, বিশেষ করে চীনবিরোধিতার জায়গা থেকে।
এম মুনীরুজ্জামান: কূটনৈতিকভাবে, বিশেষ করে জাতিসংঘের উদ্যোগগুলো থেকে এটা পরিষ্কার, যেসব দেশ রাশিয়াকে সমর্থন দিয়ে আসছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ভারত। শুধু নিরাপত্তা পরিষদেই নয়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদেও ইউক্রেন পরিস্থিতির ওপর ভোটদানে ভারত বিরত ছিল। বোঝা যাচ্ছে, কোনোভাবেই রাশিয়ার বলয় থেকে ভারত বেরিয়ে আসতে পারছে না। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, রাশিয়ার অস্ত্র ও গোলাবারুদের ওপর ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর নির্ভরতা এবং দুই দেশের মধ্যে বিস্তৃত বাণিজ্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত একটি দ্বৈত অবস্থান বজায় রাখছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি বা কোয়াডে ভারতের অগ্রণী অবস্থানের কারণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ হিসেবে পরিচিতি পেলেও ভারত প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অনিচ্ছুক মিত্র’।
প্রথম আলো: ভারতের অস্ত্রের অন্যতম উৎস রাশিয়া। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতে রাশিয়ার অস্ত্র রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করেন কি?
এম মুনীরুজ্জামান: ভারতের সশস্ত্র বাহিনীতে অস্ত্র ও সরঞ্জামের যে তালিকা রয়েছে, তার প্রায় ৭০ শতাংশ রাশিয়ার থেকে কেনা। রাশিয়ার ওপর ভারতের নির্ভরতাটা তাই অনেক বেশি। তবে ইতিমধ্যে রাশিয়ার এসব অস্ত্রশস্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ ও ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি যাতে ভারতেই তৈরি করা যায়, সেই অনুমতি রাশিয়ার কাছ থেকে পেয়েছে এবং ভারত তা করতে সক্ষম হচ্ছে। নতুন সরঞ্জাম কেনার পথে সমস্যা তৈরি হলেও বর্তমানে ভারতের কাছে রাশিয়ার তৈরি যে অস্ত্রশস্ত্র এবং সরঞ্জাম রয়েছে, সেগুলোকে তারা নিজ ক্ষমতায় সচল রাখতে সক্ষম হবে বলে মনে হয়।
প্রথম আলো: প্রতিবেশী ও দুর্বল দেশের ওপর রাশিয়ার এ ধরনের সামরিক হামলার ব্যাপারে বাংলাদেশ যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাকে যথাযথ মনে করেন কি? বাংলাদেশের মতো একটি ছোট রাষ্ট্র কেন স্পষ্ট করে হামলার নিন্দা করতে পারল না?
এম মুনীরুজ্জামান: বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবে নিরাপত্তার ব্যাপারে একটি পরিষ্কার ও জোরালো অবস্থান নেবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার নিন্দা করে নেওয়া প্রস্তাবে বাংলাদেশের ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীতে গেছে। অন্য ক্ষুদ্র দেশের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদের যে সমর্থন দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেই দায়িত্ব আমরা পালন করিনি। ৫০ বছরে আমাদের কূটনৈতিক অবস্থান অনেক সুদৃঢ় হয়েছে, কিন্তু এত বড় একটা আন্তর্জাতিক বিষয়ে কেন আমাদের কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান নেই, তা আমার বোধগম্য নয়। আমরা অন্য প্রভাববলয় দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, বিশেষ করে আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অবস্থানের দ্বারা কোনোভাবে প্রভাবিত হচ্ছি কি না, তা যাচাই-বাছাই করে দেখা দরকার।
প্রথম আলো: ইউক্রেনে রুশ হামলা বিশ্বরাজনীতিতে সামনে কোনো নতুন মেরুকরণ তৈরি করতে যাচ্ছে কি? অনেকে মনে করেন এই হামলা চূড়ান্ত বিচারে চীন এবং কিছুটা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে যাবে? আপনি কী মনে করেন?
এম মুনীরুজ্জামান: ইউক্রেনে হামলার মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বের কূটনৈতিক এবং কৌশলগত অবস্থানের আমূল পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এই আক্রমণের মধ্য দিয়ে ন্যাটো এবং পশ্চিমা বিশ্ব অথবা ইউরোপ আরও সংঘবদ্ধ হয়েছে। আন্ত-আটলান্টিক সম্পর্কের মধ্যে যে শীতলতা এসেছিল, তা দূর হয়ে আরও জোরালো হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিশ্ব এখন মূলত দুটি প্রধান শিবিরে বিভক্ত হতে যাচ্ছে। বিশ্বরাজনীতিতে যে দুই মেরু দৃশ্যমান হচ্ছিল, তা আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে যাচ্ছে। এই শিবির দুটির অগ্রভাগে যাঁরা নেতৃত্ব দেবেন, সেই দুটি দেশ হচ্ছে—চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিস্থিতির কারণে রাশিয়া আরও দুর্বল হয়ে গেলে তারা চীননির্ভর হয়ে পড়বে, যা বর্তমান বিশ্বের বিভাজন সামনের দিনগুলোতে আরও জোরালো হবে।
প্রথম আলো: ইউক্রেন সংঘাতে কী প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ওপর পড়তে পারে?
এম মুনীরুজ্জামান: বাংলাদেশের ওপর এর নানামুখী বিরূপ প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে, যা আরও বাড়বে। একটি জ্বালানি আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার চাপ নিতে হবে এবং তা আমাদের জ্বালানিনিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে যে পারমাণবিক প্রকল্প নির্মাণাধীন, সেটার ভবিষ্যৎ অগ্রগতি অনিশ্চয়তার ভেতরে পড়ে যাচ্ছে। আমাদের তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের সঙ্গে গাজপ্রমের নানা রকম যৌথ কার্যক্রম রয়েছে, সেগুলোরও ভবিষ্যৎ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কাছে, বিশেষ করে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কাছে অনেক যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য সরঞ্জাম আছে, যেগুলো রাশিয়া থেকে আমদানি করা, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও সচল রাখাটা দুরূহ হয়ে পড়তে পারে। কোভিডের কারণে ইতিমধ্যে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ইউক্রেন সংঘাতে তা আরও বিপর্যস্ত হবে। রপ্তানি ও আমদানি বাণিজ্য কার্যক্রমে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। ইউক্রেন ও বেলারুশ বিশ্ব খাদ্যবাজারে গমের অন্যতম জোগানদাতা। গমের এই উৎস যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে খাদ্যনিরাপত্তার ওপর চাপ তৈরি হবে এবং বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক চলাচল এবং বিভিন্ন যোগাযোগের ক্ষেত্রে খরচ বাড়ার প্রভাব বাজারে পড়বে। আমাদের উচিত হবে এই পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
এম মুনীরুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ।