বিশেষ সাক্ষাৎকার

আমাদের সামনে অনেক ঝুঁকি: আকবর আলি খান

আকবর আলি খান
আকবর আলি খান
আরও একটি বছর আমরা পেছনে ফেলে এলাম। স্বাগত ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ। বর্ষশুরুর এই বিশেষ আয়োজনে পেছন ফিরে তাকিয়েছেন সাবেক সচিব, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুলেখক আকবর আলি খান। কেমন গেল ২০১৭, সামনের দিনগুলোতে আমরা কী প্রত্যাশা করতে পারি, রাজনীতিতে কী ঘটতে পারে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহমূলক হতে পারে কি না, এবং আরও নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক মশিউল আলম

মশিউল আলম: আমরা ২০১৭ সালের একদম শেষ প্রান্তে এসে পড়েছি; আমাদের এই কথোপকথন যেদিন প্রথম আলোয় ছাপা হবে, সেদিন নতুন বছরের প্রথম দিন। এখন যদি আমরা একটু ফিরে তাকাই, এই বিদায়ী বছরটা আমাদের কেমন কাটল?

আকবর আলি খান: শুভ নববর্ষ! শুভ নববর্ষ মানে হচ্ছে আমরা আশা করছি যে এই বছর আমাদের গত বছরের চেয়ে ভালো হবে। সুতরাং আমাদের নিশ্চয়ই অনেক অপূর্ণতা রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা হলো, বাংলাদেশে মানবাধিকার সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখানে আমাদের ঘাটতি রয়েছে, সুশাসনের অনেক ঘাটতি রয়েছে; কিন্তু সব ঘাটতি সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতি পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের তুলনায় মোটামুটি সাফল্য অর্জন করেছে। সুতরাং বলা যায়, আমাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এ বছর সন্তোষজনক ছিল।

মশিউল আলম: তাহলে এখানে এমন একটা প্রশ্ন কেউ কেউ তুলতে পারেন যে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি সন্তোষজনক হয়, তাহলে মানবাধিকারের অপূর্ণতাটাকে কি একটু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা যায় না?

আকবর আলি খান: না, সেভাবে দেখা যায় না। কারণ, মানবাধিকার আগে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার পরের বিষয়। মানবাধিকারের প্রশ্নে আপস করার কোনো সুযোগ নেই। দেখা গেছে, যেসব রাষ্ট্রে মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল, সেখানে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। গরিব মানুষের জন্য গণতন্ত্রের অপরিহার্যতা নিয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বিখ্যাত উক্তির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। যেখানে গণতন্ত্র নেই, সেখানে দুর্ভিক্ষ পর্যন্ত হতে পারে। সে রকম উদাহরণ দেখিয়ে তিনি বলেছেন যে গণতন্ত্র মানুষের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অর্থনীতিবিদেরা অমর্ত্য সেনের এই মতই মোটামুটিভাবে গ্রহণ করে থাকেন। এর কিছু ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছিল সিঙ্গাপুরে কিংবা মালয়েশিয়ার মতো রাষ্ট্রে। কিন্তু সেখানকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

মশিউল আলম: বাংলাদেশে মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার যে কথা আপনি বলছেন, তার কিছু দৃষ্টান্ত কি দিতে পারেন? কারণ সরকার তো বলছে, আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ঠিক আছে।

আকবর আলি খান: প্রথমত মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংস্থার লোকজন এসবের সঙ্গে জড়িত। এটা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন। এ ছাড়া শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন মহল বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব তৎপরতা চালাচ্ছে, তাতে শুধু যে সাধারণ মানুষের জীবনই বিঘ্নিত হচ্ছে তা নয়, তাদের নিজেদের মধ্যেও খুনখারাবি হচ্ছে। সরকারের পক্ষে এগুলো বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। সুতরাং এদিক থেকে মানবাধিকার পরিস্থিতি মোটেও সন্তোষজনক নয় এবং এই পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে।

মশিউল আলম: গেল বছর ব্যাংকিং খাতের লুটপাট নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে লুটপাট অবিশ্বাস্য রকমের উচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে, এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে?

আকবর আলি খান: এটা সম্ভব হয় তখনই, যখন সরকার এই ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে। সরকার যখন দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ করে তখন ব্যাংকে এ ধরনের লুটপাট সম্ভব হয় না। সরকার এই ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করেছে মূলত তিনভাবে। একটা হলো, বেসরকারি ব্যাংক খোলার লাইসেন্স যাদের দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকের ব্যাংক পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। লাইসেন্সগুলো দেওয়া হয়েছে মূলত রাজনৈতিক স্বার্থে রাজনীতিকদের। এই রাজনীতিবিদেরা ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক স্বার্থে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেন। এটা হলো প্রথম সমস্যা। দ্বিতীয় সমস্যা হলো, যে সরকারি ব্যাংকগুলো আছে, সেগুলোর পরিচালনা পর্ষদেও রাজনীতিবিদদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। রাজনীতিবিদেরা অনেক ভালো কাজ করতে পারেন, কিন্তু ব্যাংক চালানোর অভিজ্ঞতা তাঁদের নেই। এবং অনেক রাজনীতিবিদ এটাকে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উপায় হিসেবে গণ্য করেন। সুতরাং এই অবস্থার জন্য সরকার অনেকাংশে দায়ী। তৃতীয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতাও ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেখানে আরও ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে চাইছে না, সেখানে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জোর করে অতিরিক্ত লাইসেন্স দিতে বাধ্য করছে। আমার মনে হয় না দেশে এতগুলো ব্যাংকের প্রয়োজন আছে। এই ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকার যদি অবিলম্বে সজাগ না হয়, তাহলে তার দুটি খারাপ পরিণতি দেখা দেবে। একটি হলো আমানতকারীদের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে এবং তারা নিরুৎসাহিত হবে। আরেকটি হলো, দেশে সত্যিকারের বিনিয়োগ হবে না; যারা পয়সা নিয়ে পয়সা ফেরত দেবে না, তারাই ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে এবং পাবে। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি বাধাগ্রস্ত হবে। সুতরাং অর্থনীতির স্বার্থে এই ব্যবস্থা অবিলম্বে পরিবর্তনের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

মশিউল আলম: মানবাধিকার প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন যুক্ত করা যায়, সেটা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এ বছর দেখা গেল, অনেকগুলো ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারপর বিরুদ্ধ মত বা সরকারের সমালোচনা করে যাঁরা ফেসবুকে বা অন্যত্র লেখালেখি করেন, তাঁরা কেউ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা হচ্ছে। এসব কারণে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমে একধরনের সেল্ফসেন্সরশিপ দেখা দিয়েছে। এটা কিসের লক্ষণ এবং এটা কোন দিকে যাচ্ছে?

আকবর আলি খান: এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। এর একটি উপাদান হলো, আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে অভিযোগ আসছে যে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেই লোকজন গুম হচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগ আমরা সংবাদপত্রে দেখতে পাচ্ছি। এটাও আরেকটা উদ্বেগের কারণ। তিন নম্বর হলো, বিভিন্ন দলের মধ্যে যে অন্তর্ঘাতমূলক সংঘাত হচ্ছে, এতেও লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সমস্ত মিলে আমাদের দেশে আসলে একটা গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এবং এখানে কথা বলার স্বাধীনতা অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সম্ভবত সিভিল সমাজকেও উদ্যোগ নিতে হবে, দেশের সব নাগরিককে উদ্যোগ নিতে হবে। যদি না নেওয়া হয় এবং এ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন বিরাজ করে, তাহলে এখানে স্বেচ্ছাচারী শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হতে পারে।

মশিউল আলম: সিভিল সোসাইটিও তো নিরপেক্ষ ভূমিকায় নেই...

আকবর আলি খান: সিভিল সোসাইটি বাংলাদেশে অনেক দুর্বল, ক্রমশ আরও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কারণ সিভিল সোসাইটির মধ্যেই অনেক দ্বন্দ্ব রয়েছে, সিভিল সোসাইটির অনেক অংশ রাজনৈতিক প্রভাবে পড়েছে। তবুও যা আছে, সেটাও যদি সংগঠিত করা যায়, তাহলে অন্তত ক্ষীণ প্রতিবাদ হতে পারে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে দেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। যদি গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে এ ধরনের পরিবেশ বিরাজ করতে পারে না।

মশিউল আলম: এ বছর আমরা বড় ধরনের বন্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম, ব্যাপক ফসলহানি ঘটেছে। এর পরিণতিতে হোক, বা খাদ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি, অদক্ষতা বা পরিকল্পনাহীনতার কারণে হোক, চালের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়েছে। গত প্রায় এক দশকের মধ্যে চালের দাম সর্বোচ্চ হয়েছে।

আকবর আলি খান: এটা ঠিক যে দেশে চালের দাম বেড়েছে, আবার এটাও ঠিক যে দেশে খাদ্য উৎপাদনও অনেক বেড়েছে। ১৯৭০ সালে আমরা যেখানে প্রায় ১ কোটি টন খাদ্য উৎপাদন করতাম, সেখানে এখন ৩ কোটি ৮০ লাখ টন বা তার চেয়েও বেশি খাদ্য উৎপাদন করছি। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও একটা বড় সমস্যা আমাদের রয়ে গেছে। কারিগরি পরিবর্তনের ফলে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু উৎপাদন খরচ চাষিরা পাচ্ছেন না। এঁদের জন্য খাদ্যের যে দাম নিশ্চিত করা দরকার, সেটা সরকার করতে পারছে না। এর ফলে বিরাট সমস্যা দেখা দিচ্ছে এবং সরকারের খাদ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যেও দুর্বলতা রয়েছে। সরকার বলে যে তারা ইনসেনটিভ প্রাইসে কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্য কিনছে, কিন্তু কৃষকেরা এই ইনসেনটিভ প্রাইসের সুফল পায় না। এটা ভোগ করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। কাজেই এই মধ্যস্বত্বভোগীদের ক্ষমতা হ্রাস না করলে এবং কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ব্যবস্থা করা না হলে কৃষিব্যবস্থাতেও খারাপ প্রভাব পড়বে এবং খাদ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনা যাবে না। এই ক্ষেত্রে সরকারের অনেক কাজ করা দরকার। সবার সঙ্গে পরামর্শ করে এ সম্বন্ধে নীতি নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

মশিউল আলম: এই বছর প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের নিয়ে আমরা বিরাট সমস্যায় পড়েছি এবং এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এ বিষয়ে আপনি কী ভাবেন?

আকবর আলি খান: রোহিঙ্গাদের যে ট্র্যাজেডি, এটা একবিংশ শতাব্দীর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই ঘটনা বাংলাদেশ সৃষ্টি করেনি, কিন্তু তা বাংলাদেশের ওপর চেপে বসেছে। এই ঘটনা মোকাবিলার কোনো সহজ সমাধান নেই। সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা পেয়েছে, আবার অনেক বড় রাষ্ট্রের সহযোগিতা পায়নি। এর কারণ যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর তৎপরতা, সেই বাহিনীর কাছে যাদের স্বার্থ রয়েছে, তারা তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যেমন চীন ও রাশিয়া, এমনকি ভারতও। যদিও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সমর্থন আমরা পেয়েছি, কিন্তু যাদের সমর্থন প্রয়োজন তাদের সমর্থন পেতে পারিনি। সে জন্য আমাদের সামরিক দিক থেকে আরও তৎপর হতে হবে। তাদের সামরিক বাহিনী যে ধরনের আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে কাজ করছে, সেটাকে দমন করার মতো শক্তি যদি আমরা অর্জন করতে পারি, তাহলে তাদের কিছুটা বোধোদয় হতে পারে।

মশিউল আলম: জনপ্রশাসনের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে, জনগণ সঠিকভাবে সেবা পাচ্ছে না, দুর্নীতি বেড়ে গেছে। কিন্তু আবার আমলারা নিজেদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে নিচ্ছেন। এ রকম কেন হচ্ছে? এটা থেকে বেরোনোর পথ কী?

আকবর আলি খান: অল্প কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ শক্ত ব্যাপার। এ বিষয়ে আমি একটা বই লিখেছি, সে বইয়ের নাম গ্রেশামস ল সিনড্রোম। এ বইয়ের মধ্যে বিস্তৃত বর্ণনা আছে আমাদের প্রশাসনের কী অবক্ষয় ঘটছে এবং কেন অবক্ষয় ঘটছে। আসলে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলই এ দেশের প্রশাসনিক সমস্যা বুঝতে পারেনি। ব্রিটিশরা বাংলাদেশে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল সেটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অনুপযুক্ত। আমাদের উচিত ছিল সেটাকে নতুন করে ঢেলে সাজানো, কিন্তু তা না করে ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া ব্যবস্থায় অল্পস্বল্প পরিবর্তন করে, সেটা অভিযোজন করে আমরা চালাতে গিয়েছি। এটা এভাবে চালানো সম্ভব নয়। শুধু তা-ই না, ব্রিটিশরা যে ধ্যানধারণার ওপরে কাজ করেছিল, সেসব ধ্যানধারণা থেকে এক শ বছর আগে যেসব কাজ করা হতো আমরা সেসব কাজ এখন করছি। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের প্রশাসন আছে বলে আমাদের জানা নেই। যেমন নিয়োগের কথা যদি ধরেন, বাংলাদেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, কূটনীতিক, প্রশাসক এঁদের সবাইকে একই পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের কাণ্ড হয় না। এবং আমাদের দেশে ২৫৭টি কোটা চালু করা হয়েছে, পৃথিবীর কোনো দেশে ২৫৭টি কোটা নেই এবং ২৫৭টি কোটা থাকলে বানরের পিঠা ভাগের মতো চাকরিবাকরি ভাগাভাগি করা হয়। এখন ভালো ছেলেরা আদৌ প্রশাসনে আসছে না এবং প্রশাসন সম্বন্ধে অনভিজ্ঞভাবে দেশ চালানোর ফলে আরও দুটি মারাত্মক কাজ হচ্ছে। একটি কাজ হলো, প্রশাসনিক কাজের ধাপগুলো ক্রমশ বাড়ানো হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে চারটি ধাপ ছিল—সেকশন অফিসার, ডেপুটি সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি ও সেক্রেটারি। অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি ছিল অল্প কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে, যেখানে সেক্রেটারির কাজ খুব বেশি ছিল। সেই চারটি ধাপ এখন আটটি হয়েছে। আগে সেকশন অফিসার প্রথম নোট লিখতেন। এখন সেকশন অ্যাসিস্টেন্ট প্রথম নোট লেখেন। অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি বাংলাদেশ হওয়ার পরও অল্প কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে ছিল, আর বড় বড় করপোরেশনের চেয়ারম্যানরা ছিলেন। এখন প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে তিন-চারজন করে অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি করা হয়েছে এবং নিয়ম করা হয়েছে যে অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি হয়ে ফাইল যেতে হবে। সুতরাং আরেকটা স্তর হলো, সেটা হলো পঞ্চম স্তর এবং ষষ্ঠ স্তরে হলো সেক্রেটারি। সেক্রেটারির পরে, আগে ডেপুটি মিনিস্টারের কাছে কোনো ফাইলই যেত না। তাঁরা পার্লামেন্টে সেক্রেটারির কাজ করতেন, তাঁদের দায়িত্ব ছিল পার্লামেন্টে প্রশ্নের জবাব দেওয়া। এখন ডেপুটি মিনিস্টারদের কাছে ফাইল যায়, স্টেট মিনিস্টারদের কাছে ফাইল যায়, তারপরে মন্ত্রীর কাছে ফাইল যায়। এই আট দফায় ফাইল যদি উপরের দিকে যায় এবং নিচের দিকে নামে, তাহলে যদি সবাই অনেস্ট হয়, তবুও কমপক্ষে ১৬ দিন লেগে যাবে শুধু ফাইল ওঠানামা করতে। এ ছাড়া সমস্ত ক্ষমতা মন্ত্রীদের হাতে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। সব ফাইল প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রীদের কাছে চলে যায়। এর ফলে কোনো সিদ্ধান্ত তাড়াতাড়ি পাওয়া সম্ভব হয় না। সিঙ্গাপুরের সরকারের কাছে যদি আপনি চিঠি লেখেন, হয়তো আপনি তিন দিন কিংবা চার দিনের মধ্যে জবাব পাবেন, বাংলাদেশে তিন মাসের মধ্যেও জবাব পাবেন কি না সন্দেহ আছে এবং কয় দিনে জবাব পাবেন এটা কেউ বলতে পারবে না। আমরা হাজার হাজার লোককে প্রমোশন দিয়েছি; হাজার হাজার লোককে প্রমোশন দিলে নিচের দিকের পদগুলো শূন্য হয়ে যায়। সচিবালয়ে এখন অতিরিক্ত সচিবেরা গড়াগড়ি খাচ্ছেন, যুগ্ম সচিবেরও কোনো অভাব নেই, কিন্তু নিচের দিকের পদে দেখা যাবে লোক নেই। অনেক জায়গায় দেখা যাবে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ল্যান্ড রেভিনিউ নেই। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ল্যান্ড রেভিনিউ কাজ করলে তো ফাইল ওপরের দিকে আসবে। নিচের দিকে কাজ করার লোক নেই, ওপরের দিকে সব লোকজন ফাইলের প্রত্যাশায় বসে আছে। এই এক অদ্ভুত ধরনের প্রশাসন; যাঁরা প্রশাসন সম্বন্ধে জানেন, তাঁরা এ ধরনের প্রশাসন মোটেও সমর্থন করবেন না। আমাদের এখানে যে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, সেটাও চাকরি দেওয়ার জন্য করা হচ্ছে। এত পদেরও কোনো দরকার নেই। বিশেষ করে বিসিএস অ্যাডমিনে যে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, এত নিয়োগের কোনো প্রয়োজন বাংলাদেশে নেই। কাজ নেই, কিন্তু পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। কাজ ছাড়া পদ সৃষ্টি করলে শুধু টাকার অপচয়ই হয় না, প্রশাসনিক দক্ষতাও কমে যায়।

মশিউল আলম: তাহলে কি আমরা বলতে পারি যে প্রশাসন একটা সেলফ-সার্ভিং করপোরেট গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে?

আকবর আলি খান: হ্যাঁ, এবং এদের বেতন অনেক বাড়ানো হয়েছে, এবং আমি ডেপুটি সেক্রেটারিদের গাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে হিসাব করে দেখেছিলাম, সরকারের বছরে দেড় শ-দুই শ কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। এখন যদি তাঁদের সবাইকে গাড়ি দেওয়া হয় এবং গাড়ির জন্য অ্যাডভান্স দেওয়া হয়, তাহলে সরকারের হাজার কোটি টাকার ওপরে অতিরিক্ত ব্যয় হবে, যেটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এভাবে একদিকে সরকারের অর্থের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের প্রশাসনিক অবক্ষয় ঘটছে। এগুলো হচ্ছে এ জন্য যে মূল সমস্যা যেগুলো সেগুলো কেউ দেখছে না। এবং জুডিশিয়ারির ক্ষেত্রেও একই রকম অবস্থা হয়েছে। জুডিশিয়ারিতে ৭৫০ খণ্ডকালীন ম্যাজিস্ট্রেটের বদলে ৭০০ ফুলটাইম জুডিশিয়াল অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেল জুডিশিয়ারিতে মামলার জট বাড়তেই আছে, আজও কমছে না। এসব সমস্যা নিয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আমার মনে হয় এগুলো নিয়ে সব দলের চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু কোনো দলই এই সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তা করছে না। এ জন্য বাংলাদেশের প্রশাসনে অদূর ভবিষ্যতে কোনো উন্নতি হবে বলে আমি আশা করি না। যাঁরা আমলাতন্ত্রে আছেন, তাঁরা এই ব্যবস্থার সুবিধা ভোগ করছেন, তাঁরা এই ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন চাইবেন না। আর সরকারের দিক থেকে যদি দূরদর্শী নেতা না থাকে তাহলে এই ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। দল পরিবর্তন হতে পারে, সরকার পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু প্রশাসন পরিবর্তনের কোনো চিহ্নই এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

মশিউল আলম: প্রশাসনকে দিয়ে দেশ চালিয়ে সরকার টিকে থাকে। এদের খুশি রাখার জন্য এরা যা চায় সরকার তাই করে...

আকবর আলি খান: না, শুধু যা চায় তাই যে করে তা নয়, তাদের দিয়ে যেসব কাজ করানো হচ্ছে, এগুলো তাদের কাজ নয়। আবার তাদের সমস্ত ক্ষমতা এবং তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বর্তমান ব্যবস্থায় সমস্ত ক্ষমতা মূলত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কেন্দ্রীভূত এবং তারপরে মন্ত্রীদের অফিসে কেন্দ্রীভূত। আমলাতন্ত্র অনেক দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের তবু পয়সা দিয়ে খুশি রাখা হচ্ছে এ জন্য যে তাঁদের অনেকে নির্বাচনের সময় রিটার্নিং অফিসার এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং অফিসারের কাজ করেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কিন্তু প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমানে যে ধরনের প্রশাসন চালু আছে, এটার কোনোই যৌক্তিকতা নেই।

মশিউল আলম: এখন আমরা একটু রাজনীতির প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশে তো কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি যেটাকে বলে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেটা কাজ করে, সরকারের ভুলত্রুটির সমালোচনা, প্রতিবাদ, একটা বিরুদ্ধ মত, সেটা রাজনৈতিক অঙ্গনে নেই বললেই চলে। প্রধান প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল বিএনপি অভিযোগ করে তাদের রাস্তায় নামতে দেওয়া হয় না, জনসভা করতে দেওয়া হয় না, তারা কোণঠাসা। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের বছর চলে এল। তো সামনে কী হতে যাচ্ছে?

আকবর আলি খান: বাংলাদেশে সংঘাতের রাজনীতি বিরাজ করছে এবং বাংলাদেশে যে বর্তমান পরিস্থিতি, এটার জন্য দুটি দলই দায়ী। বর্তমানের সরকার বিএনপিকে কাজ করতে দিচ্ছে না, আবার বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারাও আওয়ামী লীগকে একইভাবে অত্যাচার করেছে, কাজ করতে দেয়নি। সুতরাং এই ব্যাপারে আমাদের কারও ওপরেই আশা করার কারণ নেই। তবে আশার কারণ দেখা যাচ্ছে দুটি। একটি হলো, গত নির্বাচন যখন সরকার করে, তখন শতকরা ৫০ ভাগের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হয়েছে। এটা গণতন্ত্রের কোনো লক্ষণ নয়। যদিও আদালত বলেছেন যে এই সরকার বৈধ এবং আদালতের আদেশ আমাদের সকলের জন্য বাধ্যতামূলক, কিন্তু নৈতিকভাবে এটা সরকারের একটা বড় পরাজয়। আমার মনে হয় সরকার এটা বুঝতে পেরেছে এবং সে জন্য সরকার চাচ্ছে যে বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। আর বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করে বর্তমানে খুব খারাপ আছে। প্রকৃতপক্ষে মোট ভোটারের সংখ্যার ভিত্তিতে যদি আমরা দেখি, তাহলে বাংলাদেশে বিরোধী দল হওয়ার কথা বিএনপির, জাতীয় পার্টির নয়। কিন্তু সেই আসনে জাতীয় পার্টি বর্তমানে বসে আছে। বিএনপি অনেক সুযোগ-সুবিধা হারাচ্ছে এবং তাদের অসুবিধা হচ্ছে। সুতরাং বিএনপি সম্ভবত কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও কমপক্ষে বিরোধী দলের আসন পাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত হবে। এই দুটিই হলো আশার লক্ষণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হবে, এটা শেষ মুহূর্ত ছাড়া বলা যাবে না। যদি নির্বাচনের একটা মোটামুটি আবহাওয়া সৃষ্টি করা হয় এবং সেই আবহাওয়ায় যদি দুই দল অংশ নেয় এবং সরকার যদি বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়, তাহলে হয়তো নির্বাচন হবে। এবং এটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু হবেই, এটা নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়।

মশিউল আলম: তাহলে দেখা যাচ্ছে, এ বছর বড় বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর আশ্রয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন, নির্বাচনের বছর কিন্তু রাজনীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই বলে নির্বাচন হবে কি না বা হলে কেমন নির্বাচন হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা—এই সমস্ত কিছুর পটভূমিতে আমরা একটা নতুন বছরে পদার্পণ করছি। এই পরিস্থিতিতে আমাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? কারণ এগুলোর সবই আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে।

আকবর আলি খান: আপনি যেগুলো বললেন, এগুলো অবশ্যই উপাদান। বাংলাদেশে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে তা বেশ সন্তোষজনক। ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এ নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও যদি ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয় তাহলে এটা নিশ্চয়ই একটা সাফল্যের স্বাক্ষর, কারণ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে না। কিন্তু এই পরিবর্তনের পেছনে অবদান রয়েছে বাংলাদেশের কৃষকদের, পোশাকশ্রমিকদের এবং যাঁরা বিদেশে কাজ করে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন তাঁদের। মূলত এই তিনটি গোষ্ঠীই বাংলাদেশের অর্থনীতির নিয়ন্তা। যদিও অর্থমন্ত্রীরা দাবি করেন যে তাঁদের নীতির জন্যই এই সাফল্য অর্জিত হচ্ছে, আমার মনে হয় যে কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। ৭৫ ভাগ অবদান এই তিনটি গোষ্ঠীর আর ২৫ ভাগ অবদান সরকারের। এই তিনটি গোষ্ঠীরই ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এই তিনটি গোষ্ঠীর সমস্যা সম্পর্কে আমরা যদি সজাগ না হই, তাহলে অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে। বিদেশে যাঁরা কাজ করছেন, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে, সেখানে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তার ফলে সেখান থেকে প্রেরিত অর্থের পরিমাণ কমে যাবে। যদি কমে যায়, তাহলে এটা আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতিকে শ্লথ করবে। বিশেষ করে গৃহায়ণ খাতে ধস নামার এবং দেশি শিল্পপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এগুলো সম্বন্ধে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। দুই নম্বর হলো, কৃষি খাতে কৃষকেরা উৎপাদন করছেন কিন্তু পণ্যের দাম পাচ্ছেন না। সুতরাং এই সমস্যার যদি সমাধান না করা হয়, তাহলে বছরের পর বছর কৃষকেরা লোকসানের বোঝা টানতে পারবেন না। সুতরাং সেখানেও ঝুঁকি রয়েছে। আর পোশাকশিল্প মূলত বৈদেশিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল; কিন্তু পোশাকশিল্পের একটা বড় সংকট অদূর ভবিষ্যতে আসবে। সেটা হলো পোশাকশিল্পে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক সস্তায় নিজেদের মাপ অনুসারে পোশাক তৈরি করা সম্ভব। ইংরেজিতে এটাকে বলে ‘কাস্টোমাইজড ড্রেস’। এখন যে ধরনের পোশাক আমরা বিদেশে পাঠাচ্ছি, সেগুলো কতকগুলো বড় মাপের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়, যেগুলো সবার গায়ে লাগে না। সবার গায়ে লাগে এমন পোশাক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে উন্নত দেশে তৈরি করা সম্ভব। এর ফলে পোশাক খাতে যাঁরা বিদেশে কারিগরি পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করতে পারবেন না, তাঁরা বিপদের সামনে পড়বেন। এ ছাড়া বিদেশি প্রতিযোগিতা বাড়ছে এবং অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে আমাদের দেশে মজুরি বাড়ছে। এই ঝামেলাগুলো ছাড়া আর তিনটি বড় ঝামেলা আমাদের হয়েছে। প্রথমটি হলো আমরা অবকাঠামো খাতে অনেকগুলো বড় প্রকল্প নিয়েছি। আমাদের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা সীমিত এবং আমাদের দেশে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রায়ই দুর্নীতি ও অর্থ অপচয়ের অভিযোগ আসে। আমরা যেসব প্রকল্প পিপিপিতে এবং অন্যান্য খাতে গ্রহণ করেছি, এগুলোর অর্থনৈতিক দায় বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করতে হবে। সুতরাং আমরা যদি ঠিকমতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারি, তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ওপরে প্রচণ্ড চাপ পড়বে। এসব ঝুঁকি আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে দৃশ্যমান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সমস্যাগুলো সম্পর্কে যদি সরকার সতর্ক থাকে এবং ব্যবস্থা নেয়, তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ থেকে বাড়ানো সম্ভব। দ্বিতীয়ত ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা না হলে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। তৃতীয়ত, প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য অবশ্যই সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে এখানে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসবে না। আমরা এখন যে বৈদেশিক বিনিয়োগ পাই, সেগুলো তাদের অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার ফলে পাই। কিন্তু যেসব দেশে সুশাসন নেই সেসব দেশে এসব বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। সুতরাং আমাদের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

মশিউল আলম: না হলে আমাদের অর্থনীতির ঝুঁকি...

আকবর আলি খান: আগামী বছরেই হয়তো নয়, কিন্তু আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই এই ঝুঁকিগুলোর প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক ঝুঁকিই আমাদের নাড়িয়ে দিতে পারে, সে ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অনেক শ্লথ হয়ে যেতে পারে।

মশিউল আলম: আপনাকে ধন্যবাদ।

আকবর আলি খান: ধন্যবাদ।