>কাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচন। এই নির্বাচনে সভাপতি পদে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের পক্ষে প্রার্থী হয়েছেন দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। শিক্ষক সমিতির নির্বাচন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই শিক্ষক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান।
প্রথম আলো: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে একাধিকবার নির্বাচিত হয়েছেন। শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ ও মান উন্নয়নে কী করেছেন?
এ এম এম মাকসুদ কামাল: আমরা শিক্ষকদের পেশাগত মান উন্নয়নে অনেক কাজ করেছি। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তরুণ শিক্ষকদের জন্য বঙ্গবন্ধু ওভারসিস বৃত্তি চালু হয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত ৫২ জন বিদেশে পিএইচডি ও ১৭ জন মাস্টার্স করছেন। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বাজেটে আলাদা করে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। বাংলাদেশ সরকারের বৃত্তিতে আমাদের শিক্ষকেরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন, এটি মর্যাদার বিষয়। তবে কেউ যাতে এই বৃত্তির সুবিধা নিয়ে বাইরে থেকে না যান, সে জন্য কঠোর নীতিমালা করা হয়েছে। যাঁরা ফিরে আসবেন না, তাঁদের অভিভাবকদের এ অর্থ ফেরত দিতে হবে।
প্রথম আলো: আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতা, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ কতটুকু আছে? প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে ক্যাম্পাসে হাঙ্গামার খবর
ছাপা হয়।
মাকসুদ কামাল: শিক্ষার পরিবেশের বিষয়টি এক দিন বা দুই দিনের বিষয় নয়। শিক্ষক সমিতি বরাবর শিক্ষার পরিবেশের পক্ষে কাজ করছে।
প্রথম আলো: কিন্তু শিক্ষা গবেষণায় তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বেশ পিছিয়ে আছে।
মাকসুদ কামাল: আমরা শিক্ষা গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি করেছি এবং আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটে ২০ কোটি টাকা আলাদা বরাদ্দ করা হয়েছে। আগে বাজেটে গবেষণায় যে বরাদ্দ ছিল, এটি তার অতিরিক্ত। আগে গবেষণায় যে বরাদ্দ ছিল, সেটি সাধারণত প্রায়োগিক গবেষণা ও এর আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম কেনার কাজে ব্যয় হতো। এখন প্রায়োগিক ও মৌলিক—উভয় খাতে বরাদ্দ থাকবে।
প্রথম আলো: আপনার নীল দলের শিক্ষকেরা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবি করেন। তাহলে আপনাদের বিপক্ষে যাঁরা নির্বাচন করছেন, তাঁদের কি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি বলবেন?
মাকসুদ কামাল: তাঁদের সম্পর্কে আমি কোনো মন্তব্য করব না। তবে আমরা একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, আর সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের জায়গা। শিক্ষক সমিতির গঠনতন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করার কথা বলা আছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সমুন্নত রাখছি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণে অতীতে এই সমিতি থেকে একাধিক শিক্ষক বহিষ্কৃত হয়েছেন। আমরা আমাদের কথা বলি। অন্যরা তাঁদের কথা বলবেন।
প্রথম আলো: আপনাদের নীল দলের শিক্ষকেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ বলে দাবি করেন। কিন্তু আপনাদের মধ্যকার বিভক্তির জন্যই তো সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে পদ থেকে সরে যেতে হয়েছে।
মাকসুদ কামাল: সেটি ছিল তাৎক্ষণিক ঘটনার ফল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো কাজ নয়। পরে এর সুন্দর সমাধানও হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শই আমাদের ভিত্তি।
প্রথম আলো: আপনার প্রতিপক্ষের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ থেকে সব ক্ষেত্রে দলীয়করণ হয়েছে। বিএনপির আমলেও আপনারা একই অভিযোগ করতেন?
মাকসুদ কামাল: এই অভিযোগ সঠিক নয়। শিক্ষক নিয়োগ থেকে সব কার্যক্রমেই সাদা দলের শিক্ষকেরা থাকেন। নিয়োগ কমিটিতে একজন সহ-উপাচার্য আছেন। সাদা দলের শিক্ষকেরা আছেন। সিন্ডিকেটেও তাঁদের প্রতিনিধি আছেন। আমলের বিতর্কে না গিয়েও আমি যে কথাটি জোর দিয়ে বলতে চাই, তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময় মেধাবীরা শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। নিয়মনীতি মেনেই তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে গুরুতর অভিযোগ আছে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: শিক্ষক সমিতির নেতা হিসেবে শিক্ষকদের স্বার্থ কতটা রক্ষা করতে পেরেছেন?
মাকসুদ কামাল: জাতীয় বেতনকাঠামোয় আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের অবস্থান ছিল গ্রেড–৩। টাইম স্কেলের অধ্যাপকেরা গ্রেড–২–এ বেতন পেতেন। এখন অধ্যাপকেরা গ্রেড-১–এ বেতন পান। আমাদের আন্দোলনের ফলেই এটি হয়েছে। আমরা স্বাস্থ্যঝুঁকি ভাতা চালু করেছি। ইন্টারনেট সার্ভিস ফ্রি করেছি।
প্রথম আলো: বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সম্প্রতি এক সমাবেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স খোলার তীব্র সমালোচনা করেছেন। আপনার মন্তব্য কী?
মাকসুদ কামাল: বর্তমান বিশ্বের প্রধান শক্তি নলেজ ইকোনমি বা জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি। যদি জ্ঞান তৈরির
লক্ষ্যে, জনশক্তির দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সান্ধ্য কোর্স পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু থাকে, তাতে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। হার্ভার্ডেও এ ধরনের কোর্স আছে। তবে দেখতে হবে, নিয়মিত শিক্ষার কোনো ক্ষতি না হয়। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে সান্ধ্য কোর্স থাকতে পারে; এলোমেলোভাবে নয়।
প্রথম আলো: একদা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন বিশ্বের সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই। বিষয়টি কি বেদনাদায়ক নয়?
মাকসুদ কামাল: বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয় আমলে আনা হয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত। গবেষণায় পরিমাণ, গবেষণা খাতে ব্যয়, নিজস্ব আয়, বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ইত্যাদি। এই মাপকাঠিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তালিকায় ওপরের দিকে না থাকার অর্থ এই নয় যে এখান থেকে নিম্নমানের স্নাতক তৈরি করেছেন। এখানকার স্নাতকেরা বিদেশের অনেক উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন। আমাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার হলো শিক্ষকদের গবেষণার সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের সারিতে নিয়ে যাওয়া।
প্রথম আলো: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক বারবার ক্যাম্পাসে মার খাচ্ছেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিকার করছে না। শিক্ষক সমিতিও নীরব।
মাকসুদ কামাল: আমরা যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে এই হামলার নিন্দা করেছি এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছি। বিবৃতিতে আমরা বলেছি, তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের এই হামলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে অশান্ত করার অপপ্রয়াস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মুক্তবুদ্ধি চর্চার লালন কেন্দ্র। এ ধরনের কাজ শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশকেই শুধু নষ্ট করে না, বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করারও রসদ জোগায়। একই সঙ্গে ভিপি নুরুলকেও বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল হতে বলেছি।
প্রথম আলো: আপনারা নীল দলের হয়ে নির্বাচন করছেন। জয়ের বিষয়ে কতটা আশাবাদী?
মাকসুদ কামাল: আমরা সাধারণ শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সাধ্যমতো কাজ করেছি। দেনদরবার করে ৪ শতাংশ সরল সুদে গৃহঋণের ব্যবস্থা করেছি। গবেষণা বৃত্তি ও আনুষঙ্গিক ভাতা বাড়িয়েছি। বই কেনার টাকা বাড়িয়েছি। পোস্ট ডক্টরেট বৃত্তি চালুর চেষ্টা অব্যাহত আছে। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদ্যাপিত হবে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার দাবিও আমরা পূরণ করতে পারব আশা করি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধুর এ সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই ঘোষণার আগেই ওই দিন ভোরে কুচক্রীরা তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
প্রথম আলো: ধন্যবাদ।
মাকসুদ কামাল: ধন্যবাদ।