>ড. আবু জামিল ফয়সাল একজন জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে তিনি সরকার নিয়োজিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দলের (সিলেট বিভাগ) সদস্য। এ ছাড়া তিনি অ্যাডজাংকট ফ্যাকাল্টি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের সঙ্গে যুক্ত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।
প্রথম আলো: আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আবু জামিল ফয়সাল: এটা সবারই প্রশ্ন। বেশি টেস্ট করতে পারলে এটা বলা যেত। কিন্তু সেটা আমরা পারছি না।
প্রথম আলো: জোনিংও তো খুব কার্যকর নয়। তাহলে বড় ধরনের সংক্রমণ অনিবার্য?
আবু জামিল ফয়সাল: ফেব্রুয়ারি-মার্চে বিভিন্ন দেশ থেকে ছয় লাখ লোক ঢুকল, তখন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাটাই তো ছিল বড় সংক্রমণের বিস্তার।
প্রথম আলো: ইতালি ও স্পেনে যেভাবে স্পাইক বা উল্লম্ফন ঘটেছে, তেমন কিছু কি সামনে?
আবু জামিল ফয়সাল: হ্যাঁ, আমাদেরও একটা ধারণা যে একটা স্পাইক হবে, এরপরে প্লাটু হবে। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম স্পাইকটা জুনের শেষ সপ্তাহে হতে পারে। এরপর হয়তো দুই থেকে তিন সপ্তাহ চলবে। এরপর নামবে। কিন্তু এটা যে বলছি, তার তো শর্ত রয়েছে। সেটা মনে রাখতে হবে। প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা কার্যকর হচ্ছে কি না। যদি কার্যকর না হয়, তাহলে তো পজিটিভ লোকজনের চলাফেরা চলতে থাকবে। তাহলে আমরা কী করে বুঝতে পারব যে স্পাইক কবে আসবে। এখন এটা জুনের শেষে না হয়ে জুলাইয়ে চলে যেতে পারে।
প্রথম আলো: আপনাদের হাতে কি কোনো পূর্বাভাস আছে? লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজ নতুন করে দিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত শনাক্ত ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৮৬ জনে পৌঁছাল।
আবু জামিল ফয়সাল: অবশ্যই আছে। যেটা বলছি, সেটা পূর্বাভাসের প্রেক্ষাপটেই বলা হচ্ছে। কিন্তু ইম্পিরিয়াল কলেজ যেভাবে বলছে, তেমনটা আমরা কখনোই দেখতে পাইনি। সরকারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা পূর্বাভাস করেছি। বর্তমানে আমাদের প্রজেকশন অনুযায়ী জুনের শেষে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫৪ হাজার থেকে ১ লাখ ৬১ হাজার হতে পারে। এরপরও যদি চলতে থাকে, তাহলে হয়তো ২ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এখন আমাদের বড় উদ্বেগ দুটো জায়গায়। প্রতিরোধের উপায় কার্যকর করা এবং মৃত্যুর সংখ্যা কমানো। মৃত্যুর সংখ্যার পূর্বাভাস বলা কঠিন। এটা বলাটা ঠিক হবে না। তার কারণ, আমরা জানি না মোট কত লোক আক্রান্ত। সেটা জানা নেই বলে ঠিক কতজন শনাক্তের বিপরীতে মৃত্যু হচ্ছে, সেটাও বলা সম্ভব হচ্ছে না। ২৪ ঘণ্টায় ৩৮ বা ৪০ জনের যে মৃত্যুর সংখ্যা, সেটা কমাতেই আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে।
বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে, যার মধ্যে অনেক ছোট দেশও আছে, যাদের লক্ষ্য ছিল সংক্রমণ ঘটলেও যাতে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য থাকে। কিন্তু সেই রকম লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশে খুব বেশি কাজ এখনো আমরা করতে পারিনি। তবে করার চেষ্টা হচ্ছে। এতে সফল হলে আমরা মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে পারব।
প্রথম আলো: আপনি কি নির্দিষ্ট করে দু-একটি পদক্ষেপের কথা বলবেন, যা ইতিমধ্যেই ওই লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে?
আবু জামিল ফয়সাল: যেমন ওই লক্ষ্যে কিছু ওষুধ, প্লাজমা ব্যবহার, অক্সিজেনের ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চীনা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে তাঁরা রোগীর চিকিৎসা দেন একটা মাল্টিডিসিপ্লিনারি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। সেখানে আইসিইউ সুবিধা এবং বক্ষ বিশেষজ্ঞ থাকলেই চিকিৎসা হবে, তা নয়। ওখানে কার্ডিওলজিস্ট ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ থাকবেন। আর তাঁরা প্রথমেই দেখেন করোনা রোগীটির কো-মরবিডিটি আছে কি না। আমরা এটা দেখি অনেকটা দেরিতে। চীনে দ্বিতীয় যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেটা হলো করোনা রোগীর পুষ্টিগত অবস্থা এবং তার মনস্তাত্ত্বিক সাপোর্ট আছে কি না। আমাদের রোগীদের অর্ধেক মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। এই ভয় তাড়াতে রোগীদের পুষ্টিগত ও মনস্তাত্ত্বিক সাপোর্ট দিতে হবে। উপরন্তু শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা থাকলে দরকার রেসপিরেটরি এক্সারসাইজ। কেবল ফুসফুসের উত্তম অনুশীলন ঘটিয়ে সুফল লাভের অনেক উদাহরণ চীনের রয়েছে। এখন চীনাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরাও কাজ শুরু করেছি। এটা করতে পারলে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমিয়ে ফেলা সম্ভব।
প্রথম আলো: আপনি তো নির্দিষ্টভাবে সিলেট বিভাগের দায়িত্বে। সিলেটের সিভিল সার্জন (এই প্রতিবেদককে) বললেন, তিনি সিটি করপোরেশনের ১৯টি এলাকা ‘রেড জোন’ করেছেন। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার জানালেন, এটা কে কার্যকর করবে, তা পরিপত্রে নির্দিষ্ট নেই। দেশের অন্যত্রও এ রকম সমন্বয়হীনতা চলছে। তাহলে এর পরিণতি কী হবে?
আবু জামিল ফয়সাল: আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর এভাবে দেব না। প্রথমত, আমরা এয়ারপোর্টে স্ক্রিনিং করতে পারিনি। তারপর সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের একটা মিশ্রণ পেলাম। এখন জোনিং, তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। কিন্তু যেটা একেবারেই গুরুত্ব পায়নি, সেটা হলো কমিউনিটির সম্পৃক্ততা। জনপ্রতিনিধি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট এলাকার ইমাম, শিক্ষক, এনজিও, গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্পৃক্ততা লাগবেই। অথচ শুরু থেকেই এ রকম চেষ্টা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এটা পারলে আমরা হয়তো আরেকটু তাড়াতাড়ি সুফল পেতাম। এই মুহূর্তে সরকারের উচিত হবে এদিকেই সব থেকে বেশি নজর দেওয়া।
প্রথম আলো: সব হাসপাতালকে কোভিড ও নন-কোভিড দুভাগ করার কাজে গতি নেই। রোগী খুব বেড়ে গেলে আমাদের করোনা চিকিৎসার হালটা কী হবে?
আবু জামিল ফয়সাল: আপনি যথার্থই বলেছেন, হাসপাতালে ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়া উচিত। তাই আমরা তিন সপ্তাহ আগে একটি গাইডলাইন করেছি। এটা সর্বত্র প্রেরণের ব্যবস্থা করা উচিত। এক জায়গায় চিকিৎসা করতে হবে, এটা শুনেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। অবশ্য ওই গাইডলাইন মেনে দেশের অনেক জায়গায় একই সঙ্গে চিকিৎসা হচ্ছে। কিছু জায়গায় সম্ভব হলে অন্যত্র হবে না কেন?
প্রথম আলো: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ ‘ভুল করে’ দু-তিন বছর এই সংকট চলবে বলেছিলেন। এটা কত দিন ভোগাবে?
আবু জামিল ফয়সাল: স্মলপক্স ও পোলিও ভাইরাসজনিত দুটি রোগ। এ থেকে আমরা নিজেদের মুক্ত ঘোষণা করেছি। কিন্তু পোলিওর টিকা আজও চলমান। ডিজি সাহেব হয়তো একটা সময়ের কথা বলেছেন। আমি কিন্তু কোনো সময়ের কথা বলতেই পারব না। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো এর সঙ্গেও আমাদের বসবাস করতে হবে। হয়তো এখনকার মতো মানুষ এতসংখ্যক মারা যাবে না।
প্রথম আলো: আপনি বলছেন, চলতি মাসে এটা ১ লাখ ৫৪ হাজার থেকে ১ লাখ ৬১ হাজার হবে। কিন্তু অল্প সময়ে তো দ্বিগুণও হতে পারে?
আবু জামিল ফয়সাল: দ্বিগুণ হয়তো না-ও হতে পারে।
প্রথম আলো: ধরুন, সেটা ঘটল, কিন্তু সম্ভাব্য দ্বিতীয় দেড় লাখ বর্তমান ধারার মতো নগরবাসী না হয়ে গ্রামবাসী হলো। নগরে তো যাহোক হাসপাতাল আছে। তখন?
আবু জামিল ফয়সাল: আমরা এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। কিন্তু গত চার মাসে আমরা দেখছি, এটা শহরকেন্দ্রিক রয়ে গেছে। এর একটা বড় কারণ হলো আমাদের যত ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা সব শহরকেন্দ্রিক। তবে যদি ছড়িয়ে পড়ে, সে জন্য সরকার উপজেলা ও জেলাকে প্রস্তুত থাকতে বলেছে। অবশ্য বেশির ভাগ উপজেলায় অক্সিজেনের ব্যবস্থা অপ্রতুল। তবে সে ক্ষেত্রে তখন রেফারেল ব্যবস্থা, মানে কাছের মেডিকেল কলেজ, বিশেষায়িত হাসপাতাল বা ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রথম আলো: সরকারি মুখপাত্র বলছেন অক্সিজেন মজুত না করতে। কেউ বলবেন, পানি কিনতে পারলে অক্সিজেন নয় কেন?
আবু জামিল ফয়সাল: অক্সিজেন কিনলেই তো হবে না। এটার সঠিক ব্যবহার জানতে হবে। সে জন্যই সমানে অক্সিজেন কিনলে কোনো লাভ হবে না।
প্রথম আলো: এই মুহূর্তের সুপারিশ?
আবু জামাল ফয়সাল: রিস্ক কমিউনিকেশন ও কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা। মানুষকে এটা বোঝানো যে কারও করোনা হলেই ঠাস করে পড়ে মরে যায় না। যাঁদের বয়স ৬০ বছরের বেশি এবং যাঁরা অন্যান্য রোগে আগে থেকেই কাবু, তাঁদের বিশেষভাবে সতর্ক হতে হবে। কেননা, তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। মৃত্যু কমানোর জন্য আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আর ব্যাপকভিত্তিক টেস্টের জন্য অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন টেস্ট কিটের বিষয়ে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আবু জামাল ফয়সাল: ধন্যবাদ।