ড. সেলিম রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় নেওয়া বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মসূচি, অর্থনীতির বর্তমান ও পুনরুদ্ধার পরিস্থিতি এবং সামনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো: করোনা পরিস্থিতির এক বছর পার হলো। করোনার আগের অর্থনীতির সঙ্গে তুলনা করলে এখন দেশের অর্থনীতি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে?
সেলিম রায়হান: করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থার তুলনা করলে আমরা অবশ্যই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারিনি। বৈশ্বিক অর্থনীতিও একটা সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে এবং তা এখনো বজায় রয়েছে। আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তিগুলো হলো রপ্তানি খাত, রেমিট্যান্স এবং দেশীয় অর্থনীতির শিল্প, কৃষি ও সেবা খাত। সেগুলো কিন্তু কমবেশি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর একটা চেষ্টা আমরা গত কয়েক মাসে দেখতে পেয়েছি। করোনার পুরো বিষয়টাই অনিশ্চয়তাপূর্ণ। কখনো মনে হয়েছে যে করোনার সংক্রমণ কমে আসছে। অতএব, অর্থনীতির পুরোনো গতি ফিরে পাওয়ার বুঝি একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সামগ্রিকভাবে করোনার সময়ে আমাদের অর্থনীতির যে ক্ষতিটা হয়েছে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের আরও সময় লাগবে এবং আরও অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন আমাদের আছে।
প্রথম আলো: সরকার বেশ কিছু প্রণোদনা উদ্যোগ নিয়েছিল। সেগুলো কী ফল দিল?
সেলিম রায়হান: করোনা সংকট শুরু হওয়ার পরই বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে এবং এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা দেখব যে এই ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজগুলো ঘোষণা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে ছিল। তবে এক বছর পর, আমরা যদি বুঝতে চাই যে এই প্রণোদনা প্যাকেজ কী ধরনের ফল দিল, তাহলে একধরনের মিশ্র অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। কোনো কোনো প্রণোদনা প্যাকেজ বেশি কার্যকর হয়েছে। তবে খাতভিত্তিক একটা পার্থক্য দেখা গেছে। আমরা সানেমের পক্ষ থেকে প্রতি তিন মাস পর একটা করে জরিপ করছি। শিল্প ও সেবাসংশ্লিষ্ট ১৩টি খাতের প্রায় ৫০০ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে তা করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, প্রণোদনা প্যাকেজ ও প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য আছে। প্রণোদনা প্যাকেজ পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। বিশেষ করে প্রণোদনা প্যাকেজ পাওয়ার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দীর্ঘ এবং অনেক দাপ্তরিক জটিলতাপূর্ণ। পাশাপাশি এর সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাংকের যে প্রক্রিয়া ও আনুষ্ঠানিকতা, তা প্রতিষ্ঠানগুলো জানে না। প্রণোদনা প্যাকেজের পেছনে যে মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়া থাকা দরকার, সেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতার অভাব আছে।
প্রথম আলো: একটা অভিযোগ আছে যে বড় উদ্যোক্তারা প্রণোদনার সুফল বেশি পেয়েছেন কিন্তু ছোট উদ্যোক্তারা এই সুবিধা কাজে লাগাতে পারেননি। এটা কতটা সত্য?
সেলিম রায়হান: সানেমের জরিপেও দেখা গেছে যে প্রণোদনা প্যাকেজের সুফল বেশির ভাগই পেয়েছেন বড় উদ্যোক্তারা। সরকারি তথ্যমতেই, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) জন্য যে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল, তার অনেকটাই বিতরণ সম্ভব হয়নি। অথচ করোনা মহামারিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই খাতগুলো অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের সাপ্লাই চেইনে বা জোগানপ্রবাহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুতরাং এই সব খাতের পুনরুদ্ধার না হলে সামগ্রিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধার অনেক পিছিয়ে যেতে পারে।
প্রথম আলো: করোনা নতুন দরিদ্রের সংখ্যা বাড়িয়েছে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন, ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়েছেন। এই জনগোষ্ঠীর দিন কীভাবে কাটছে?
সেলিম রায়হান: করোনার যে সংকটটা আমরা দেখেছি এক বছর ধরে, তা কিন্তু শুধু অর্থনৈতিক সংকট নয়; একটা বড় ধরনের সামাজিক সংকটও। বিশেষ করে দারিদ্র্যের হার কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গত কয়েক দশকে বড় অর্জন ছিল। কিন্তু গত এক বছরে অল্প সময়ের মধ্যেই দারিদ্র্যের হারে বেশ বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে। আমরা ২০২০-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে জরিপ করে দেখেছি যে দারিদ্র্যের হার ২০১৯ সালের শেষের দিকে যে ২০ শতাংশের মতো ছিল, সেটা বেড়ে ৪০-৪১ শতাংশ হয়ে গেছে। তার মানে, দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই অপ্রাতিষ্ঠানিক সেবা খাতে জড়িত ছিলেন। শহরে ও গ্রামের এই শ্রমবাজারে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কাজ হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে গেছেন। যাঁরা নানা ধরনের ছোট ছোট ব্যবসা করতেন, সেই ব্যবসাগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন হয়তো একধরনের পুনরুদ্ধার চলছে, কিন্তু এই যে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে করোনাকালে, এটা বড় একটা উদ্বেগের জায়গা।
প্রথম আলো: করোনার সময় শহর থেকে অনেকেই গ্রামে ফিরে গেছেন। এর কোনো বিশেষ আর্থসামাজিক প্রভাব কি চোখে পড়ার মতো?
সেলিম রায়হান: এর অবশ্যই একটা বড় ধরনের আর্থসামাজিক প্রভাবের বিষয় আছে। কারণ, আমরা যেটা দেখছি, যেটাকে আমরা বলি একটা রিভার্স মাইগ্রেশন বা উল্টোমুখী অভিবাসন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে অভিবাসন, সেটা হচ্ছে গ্রাম থেকে শহরে আসা, শহরে এসে নানা ধরনের শিল্প ও সেবা খাতে নিয়োজিত হওয়া। কিন্তু এই ধরনের সংকটকালে আমরা শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখেছি। গ্রামের শ্রমবাজারও কিন্তু সংকুচিত। যাঁরা ফিরে গেছেন, আমাদের জরিপে বা বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান, যারা জরিপ করেছে বা গবেষণা করার চেষ্টা করছে, তারাও দেখেছে যে শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষেরা কিন্তু বেশ সংকটের মধ্যে ছিলেন এবং এখনো আছেন। সরকার সামাজিক সুরক্ষার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে গত বছরে এবং সাম্প্রতিক সময়েও নানাভাবে এই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যেহেতু এই নতুন করে দরিদ্র হওয়া মানুষের তথ্য সরকারের কাছে নেই, সেহেতু তাঁদের অনেকেই সরকারি সহায়তার আওতার বাইরে থেকে গেছেন।
প্রথম আলো: আমাদের অর্থনীতির বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক। করোনার এক বছরে এই খাত কতটুকু বিপর্যস্ত হলো? ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ কি আছে?
সেলিম রায়হান: আমাদের শ্রমবাজারেও কিন্তু যাঁরা নিয়োজিত আছেন, তাঁদের ৮৫ ভাগের বেশি এই অনানুষ্ঠানিক খাতেই নিয়োজিত আছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই অনানুষ্ঠানিক খাতের তথ্য-উপাত্ত তেমন পাওয়া যায় না। কিন্তু এটা আমরা জানি যে করোনার সময়ে যে খাতগুলো সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে, সেগুলোর একটা বিশাল অংশ এই অনানুষ্ঠানিক খাত। অর্থনীতিতে এই আনুষ্ঠানিক খাতের সাপ্লাই চেইন বিভিন্ন জায়গায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা এখন যে সামাজিক অস্থিরতার বেশ কিছু উপসর্গ দেখছি, শহরে ও গ্রামে বিভিন্ন জায়গায় অপরাধ বৃদ্ধি, সেটা নির্দেশ করে যে দেশের শ্রমবাজারের যে সংকটটা করোনাকালে চলছে, সেখান থেকে আমরা এখনো বের হয়ে আসতে পারিনি।
প্রথম আলো: প্রবাসী ও প্রবাসী শ্রমিকদের অনেকেই ফিরে আসছেন। অনেকের ফিরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ। বাইরে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও কমছে। অথচ দেখা যাচ্ছে রেমিট্যান্স থেকে আয় বাড়ছে? এই খাতের পরিস্থিতি কী?
সেলিম রায়হান: এই করোনাকালে একটা স্বস্তির জায়গা আমরা দেখেছি যে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্সের বড় ধরনের বৃদ্ধি। তবে সানেমের পক্ষ থেকে চালানো জরিপে একেবারে পরিবার পর্যায় থেকে আমরা যে তথ্যগুলো তুলে এনেছি, তার সঙ্গে অফিশিয়াল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের যে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি, তার একটা অসামঞ্জস্য দেখতে পাচ্ছি। আমাদের জরিপে দেখা যাচ্ছে, যে পরিবারগুলো রেমিট্যান্স পেয়ে থাকে, তাদের ৮০ ভাগের ওপরে বলেছে, তারা আগের তুলনায় করোনাকালে রেমিট্যান্স কম পেয়েছে। সুতরাং এখানে আমরা একটা ম্যাক্রো-মাইক্রো মিসম্যাচ বা সামষ্টিক চিত্রের সঙ্গে ব্যষ্টির চিত্রের অসামঞ্জস্য দেখছি। ম্যাক্রো লেভেলে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি, কিন্তু মাইক্রো লেভেলে দেখা যাচ্ছে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এটার মানে কী? এটার একটা ব্যাখ্যা আমরা এভাবে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি: বাংলাদেশে যে রেমিট্যান্স আসে, সেটা দুটো বড় চ্যানেলের মাধ্যমে আসে। একটা হচ্ছে আনুষ্ঠানিক, আরেকটা হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক। কিছু গবেষণা এবং কিছু অনুমান নির্দেশ করছে যে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের রেমিট্যান্স আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের রেমিট্যান্স থেকে খুব কম নয়। সে ক্ষেত্রে এই করোনাকালে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো যখন বড় রকমের বাধাগ্রস্ত হয়েছিল, তখন তা আনুষ্ঠানিকে চ্যানেলে এসেছে এবং সে কারণেই সম্ভবত আমরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে রেমিট্যান্স হয়তো বাড়েনি। আমরা দেখেছি, রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো করোনাকালে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। অনেক প্রবাসী শ্রমিকই দেশে ফিরে এসেছেন এবং সেখানে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা কাজ করছে। পাশাপাশি দেশের বাইরের শ্রমবাজারগুলো, যেখানে আমাদের শ্রমিকেরা কাজ করেন, সেই অর্থনীতিগুলোরও পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। ফলে রেমিট্যান্সে আমাদের বর্তমান যে প্রবৃদ্ধি, সেটা আসলে কতটুকু টেকসই, সেই প্রশ্ন চলে আসছে।
প্রথম আলো: শ্রমবাজারে নতুন জনশক্তি যুক্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা ও শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন কি?
সেলিম রায়হান: করোনার সময়ে আমরা দেখেছি যে শ্রমবাজারে বড় ধরনের সংকট, মানুষ কাজ হারিয়েছেন। একই সঙ্গে আমরা এটাও জানি যে প্রতিবছরই নতুন করে আমাদের শ্রমবাজারে নতুন জনশক্তি সংযোজিত হচ্ছে। এই নতুন জনশক্তি যাঁরা যুক্ত হচ্ছেন, তাঁদের কর্মসংস্থানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ আছে। আমরা দেখেছি যে গত এক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেভাবে হয়েছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে কিন্তু সে ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়নি। অনেকেই একে কর্মসংস্থানবিহীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি পর্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমরা জানি করোনার আগে থেকেই কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটা জটিল সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ছিল। করোনার সময়ে তা আরও জটিল হয়েছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের বিভিন্ন বিশ্লেষণ ও উপাত্ত থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এবং শ্রমবাজারে শিক্ষিত বেকারদের একটা বড় সমস্যা রয়েছে। বেকারত্বের হার তাদের মধ্যে অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে কী উদ্যোগ নেওয়া উচিত? একটা তো হচ্ছে অবশ্যই, আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াটাকে জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি আরেকটা বিষয় হচ্ছে রপ্তানি খাতে আমাদের যে একক পণ্যনির্ভরতা অর্থাৎ তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর যে নির্ভরতা রয়েছে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের রপ্তানি বহুমুখীকরণের একটা বড় অ্যাজেন্ডা অনেক বছর ধরেই আছে, এটাকে আরও কার্যকর করা দরকার। পাশাপাশি স্পেশাল ইকোনমিক জোনগুলো, যেগুলো নিয়ে সরকারের বড় উদ্যোগ আছে, সেগুলোর কয়েকটাকেও যদি অল্প সময়ের মধ্যে কার্যকর করা যায়, তাহলে নতুন কর্মসংস্থানের অবস্থা সৃষ্টি হবে।
প্রথম আলো: গত এক বছর যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেল, তা হয়তো আগের অর্থনৈতিক শক্তি ও সামর্থ্যের কারণে কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া গেছে। করোনা পরিস্থিতি আবার খারাপ হচ্ছে। নতুন করে যদি লকডাউন করতে হয়, তখন মানুষের জীবিকা নতুন করে সমস্যার মুখে পড়বে। এই পরিস্থিতি সামনে আমাদের ওপর কোন মাত্রায় আঘাত হানতে পারে?
সেলিম রায়হান: সাম্প্রতিক মাসগুলোতে করোনার সংকট থেকে পুনরুদ্ধারের যে প্রক্রিয়া অর্থনীতিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটা করোনার যে নতুন সংক্রমণ দেশে এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে, তার জন্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এটাকে সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান যে উদ্যোগ আছে, টিকা এবং অন্যান্য উদ্যোগ, সেগুলো এটাকে কতটুকু সামাল দিতে পারবে? বৈশ্বিক পর্যায়ে বড় ধরনের একটা অনিশ্চয়তা আছে। আমাদের রপ্তানি খাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোনো কোনো মাসে তারা কিছুটা ভালো করছে। আবার পরবর্তী মাসগুলোতে, বিশেষ করে বড় দুটো বাজার উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে যখন সংক্রমণ নতুন করে বৃদ্ধি পায় এবং দেশগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, তখন আমাদের দেশের রপ্তানি আবার বাধাগ্রস্ত হয়। সুতরাং অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য রপ্তানি খাতের পুনরুদ্ধার যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, একই সময়ে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আমাদের দেশীয় শিল্প, দেশীয় সেবা, দেশীয় কৃষি এবং এগুলোর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পুনরুদ্ধার করাটা খুবই জরুরি। এটা যতক্ষণ আমরা না করতে পারছি, আমরা পুনরুদ্ধারটাকে সেভাবে শক্তিশালী করতে পারব না।
প্রথম আলো: গত এক বছরের করোনা পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা ও নতুন সংক্রমণের আশঙ্কা—এই বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে করণীয় সম্পর্কে আপনার বা আপনার প্রতিষ্ঠানের তরফে কোনো পরামর্শ আছে কি?
সেলিম রায়হান: পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তিনটি পরিসরে আমি মনে করি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রথমত, অবশ্যই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ যেটা আছে, সেটাকে আরও বেশি কার্যকরভাবে প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে এর ব্যাপ্তি বাড়ানো দরকার। এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আছে, সেগুলোকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করা এবং যে খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা যেন প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধাগুলো পায়, তা নিশ্চিত করা দরকার।
দ্বিতীয়ত, এই যে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, পাশাপাশি যারা আগে থেকে দরিদ্র ছিল এবং করোনার কারণে আরও দরিদ্র হয়েছে, তাদের জন্য সরকারের যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও কার্যক্রম আছে, সেটার ব্যাপ্তি, পরিধি ও বরাদ্দ আরও বাড়ানো দরকার। এই ক্ষেত্রে যে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কথা আগে বলেছি, তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
তৃতীয়ত, আমাদের শ্রমবাজার বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং শুধু শহরে নয়, গ্রামীণ এবং বিদেশের শ্রমবাজারেও বড় সংকট সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমবাজারকে কেন্দ্র করে এবং সেটাকে টার্গেট করে নানা ধরনের নীতি ও কর্মকৌশল নেওয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি একটা লেবার অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট কমিশন হওয়া দরকার, যারা বর্তমান অবস্থার একটা মূল্যায়ন করবে। শ্রমবাজারকে কেন্দ্র করে যদি নতুন কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির প্রয়োজন থেকে থাকে, সেই ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রবর্তন করা দরকার।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
সেলিম রায়হান: আপনাকেও ধন্যবাদ।