এই লেখা তৈরির সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ৮৫০ দিন পার করল। এই যুদ্ধে কত মানুষ মারা গেছে, তার সত্য তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। নিশ্চিতভাবে সেটা কয়েক লাখ। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা পত্রিকা নিউজ উইক–এর হিসাবে গত ফেব্রুয়ারিতেই এই যুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
যুদ্ধে যে কেবল রাশিয়া–ইউক্রেনের মানুষ মরছে তা নয়, অন্য অনেক দেশের মানুষও প্রাণ দিচ্ছে। এর মধ্যে কিছু দেশের মানুষের জীবনদান বিশেষভাবে বিস্ময় জাগাচ্ছে। যেমন নেপাল। এত দূরের এক যুদ্ধে নেপালের মানুষের বড় সংখ্যায় মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গেলেই নজরে পড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার আর্থসামাজিক বাস্তবতার এক করুণ দিক এবং আসন্ন এক নতুন সামাজিক সংকট।
মূল দুই প্রতিপক্ষ ছাড়াও ইউক্রেনে প্রায় ৫০টি দেশের ভাড়াটে যোদ্ধারা মানুষ মারতে গেছে। মস্কো-কিয়েভ উভয় জায়গার নীতিনির্ধারকেরা নানান লোভে ফেলে এ রকম ভাড়াটেদের সেখানে নিজেদের শিবিরে ভিড়িয়েছে। যুদ্ধে আহত-নিহত মানুষের মতো এ রকম ভাড়াটে যোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা পাওয়াও মুশকিল। আহত, নিহত ও গ্রেপ্তার হওয়া বিদেশি যোদ্ধাদের ইতিমধ্যে প্রচারিত তালিকাগুলো দেখে অনুমান করা হচ্ছে ভাড়াটেদের দেশভিত্তিক সংখ্যায় নেপাল বেশ এগিয়ে। এরা মূলত রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করছে। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে নেপালিরা রাশিয়া গিয়ে স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে ফ্রন্টে চলে যাচ্ছে।
প্রথম দিকে সরকার বিষয়টি স্বীকারও করছিল না। কিন্তু টিকটকে যখন দেখা গেল নেপাল সেনাবাহিনীর সাবেক এক সদস্য মস্কোতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে ইউক্রেনে ঢুকবে বলে—তখন আর কিছু গোপন করে রাখা গেল না। সরকারি হিসাবে ইউক্রেন যুদ্ধে যাওয়া নেপালের নাগরিকের সংখ্যা কয়েক শ মাত্র। তবে বেসরকারি মহলগুলো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য উদ্ধৃত করে বেশ বাড়তি সংখ্যার কথা বলছে। সিএনএন গত ফেব্রুয়ারিতে এ সংখ্যা ১৫ হাজার বলে উল্লেখ করে। নেপালের পার্লামেন্টে এ নিয়ে বিতর্ককালে অনেক এমপি সংখ্যাটা ১৪-১৫ হাজার বলে দাবি করেছেন।
সংখ্যাটা সঠিক কত, সেটা কেবল বলতে পারে মস্কো। তারা সেটা কোথাও উল্লেখ করেনি।
এ রকম প্রবাসীরা যদি কখনো দেশে ফেরেন, তবে যুদ্ধের মনোজাগতিক ক্ষত নিয়েই ফিরতে হবে এবং এভাবে ভিন্ন ধরনের নতুন একটা জনগোষ্ঠীর ভার বইতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজকে। যুদ্ধক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করা নানা ধরনের রোগবালাইও এসব যোদ্ধার মাধ্যমে এ অঞ্চলে আসবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাড়াটে যোদ্ধাদের বৈশ্বিক এক সংযোগেরও বিস্তার ঘটবে এতে। ধনী দেশগুলো ভবিষ্যতে নানা প্রয়োজনে এ অবস্থাকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু বেশুমার দারিদ্র্য জিইয়ে রেখে একে রুখতে পারা যাবে কি?
বাংলাদেশের মতোই কাজের খোঁজে নেপালের বিপুল মানুষ প্রতিবছর বিদেশে যায়। সংখ্যার হিসাবে এটা বছরপ্রতি গড়ে চার লাখের বেশি। এর মধ্যে অর্থের বিনিময়ে বিদেশের হয়ে যুদ্ধ করতে যাওয়ার ঐতিহ্যও এ দেশে বেশ পুরোনো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৪০ ব্যাটালিয়ন নেপালি (গোর্খা) ব্রিটেনের হয়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়েছে। এরও আগে ভারত-বার্মার বহু জনপদ দখলে গোর্খারা ছিল ব্রিটেনের শ্বেতাঙ্গদের প্রধান ভরসা। ভারত ভাগের পরও নানাভাবে সেই ঐতিহ্য আজও আছে নেপালে।
রাশিয়ার হয়ে যারা ইউক্রেনে যাচ্ছে, তাদের অনেকেই আফগানিস্তানেও ন্যাটো জোটের নানা ‘বেসরকারি সংস্থা’র হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। মূলত অর্থ আয়ের একটা মাধ্যম হিসেবে দরিদ্র নেপালিরা এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যায়। দেশটিতে প্রায় ২০ ভাগ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বেঁচে থাকার লড়াই করছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চেয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাতে তাদের কাছে বেশি লাভের হয়—মনে হচ্ছে সেই দায়িত্ব এখন নিতে চাইছে মস্কো।
বাড়তি ডলার পেলে হয়তো এ রকম মানুষেরা কিয়েভে যেতেও আপত্তি করবে না।
ভাড়াটে যোদ্ধাদের জন্য রাশিয়ার ঘোষিত সুবিধার মধ্যে আছে মাসে প্রায় দুই হাজার ডলার মাসিক মজুরি এবং দ্রুত রুশ নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। সংশোধিত আইন অনুযায়ী রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনে এক বছর যুদ্ধ করার চুক্তি করলে যে কেউ দেশটির নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করতে পারবে। এ রকম আবেদনের উত্তর দেওয়া হবে তিন মাসের ভেতর এবং সেটা মঞ্জুর হওয়া মানে রাশিয়াজুড়ে উচ্চ মাইনায় কাজের সুযোগ। এই সুযোগ ভাড়াটে যোদ্ধাদের স্বামী-স্ত্রীর বেলায়ও প্রযোজ্য হবে। বলা বাহুল্য, এ রকম ‘সুযোগে’র খবর ছড়াতে নেপালে আদম ব্যাপারীর অভাব নেই। ভাড়াটেদের কেউ যাচ্ছে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে, কেউবা পর্যটক ভিসায়। আরব আমিরাত হয়ে এদের মস্কোতে পৌঁছে দেয় ব্যাপারীরা কমবেশি ৯ হাজার ডলারের বিনিময়ে। এ রকম অন্তত ১০ জন ব্যাপারীকে কাঠমান্ডু সরকারও আটকও করেছে।
রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনে ভাড়ায় যুদ্ধ করতে যাওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে নেপালের সমাজজীবনে দ্বিমুখী স্রোত বইছে। নেপালের নিয়ম হলো নাগরিকেরা সেসব দেশের সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করতে পারবে, যাদের সঙ্গে এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় চুক্তি থাকবে। নেপালের সঙ্গে এ রকম চুক্তি আছে কেবল ব্রিটেন ও ভারতের। ফলে রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনে যুদ্ধযাত্রা পুরোপুরি অনানুষ্ঠানিক ও অঘোষিত একটা ব্যাপার। তবে ফারাকটা কেবল চুক্তি থাকা না–থাকা।
কিন্তু কাঠমান্ডুতে গত এক বছরে রুশ দূতাবাসের সামনে স্থানীয় মানবাধিকারকর্মীদের বেশ কটি বিক্ষোভ হয়েছে এই প্রক্রিয়া রুখতে। আবার এ–ও সত্য, রাশিয়া প্রলুব্ধ করার বাইরে তাদের হয়ে যুদ্ধে যেতে কাউকে চাপ দিচ্ছে না। রাশিয়ার নিয়ম এ বিষয়ে অনেক উদার। যে কেউ তাদের দেশের প্রতিরক্ষা বিভাগের সঙ্গে চুক্তি করে এভাবে ভাড়া খাটতে পারে। দরিদ্র নেপালিরা এভাবেই রাশিয়ায় গিয়ে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সেরে যুদ্ধের ময়দানে পৌঁছে যাচ্ছে। সবকিছু নিজ ইচ্ছাতেই ঘটছে। কারণ, কর্মসংস্থানের দেশজ বিকল্প সুযোগ তাদের সামনে কম। কিন্তু মাসে মাসে ইউক্রেন থেকে ফেরত আসা আহত ব্যক্তিরা বিভীষিকাময় স্মৃতি নিয়ে ফিরছে। লাশ হয়েও ফিরছে অনেকে। কেউ কেউ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাচ্ছেও। ইউক্রেনের কিছু সংবাদমাধ্যমে সে রকম খবরও দেখা গেছে।
কাঠমান্ডুর বিভিন্ন সমাবেশে অংশ নেওয়া ফেরত আসা যোদ্ধাদের বক্তৃতায় ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রের যেসব বিবরণ মিলছে, তা রোমহর্ষ। এসব শুনে নেপালবাসী যুদ্ধে যাওয়া তাদের সন্তানদের নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কিন্তু মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার লোভ সামলানোও কঠিন। বিশেষ করে দেশে যখন কাজ পাওয়াই সমস্যা।
যেসব নেপালি যোদ্ধা আহত হয়ে দেশে ফিরেছে, তারা জানাচ্ছে, রুশরা নেপালি, আফগান ও তাজিক যোদ্ধাদের বেশি করে ফ্রন্টলাইনে পাঠাচ্ছে। ফলে আহত-নিহত হওয়ার হারও তাদের বেশি।
নেপাল সরকার এ বছরের জানুয়ারিতে তাদের দেশের মৃত যোদ্ধাদের পরিবারের জন্য রাশিয়ার কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছে এবং জীবিতদের ফেরত পাঠাতে বলেছে। কিন্তু ফেরত এসে এই মানুষগুলো সন্তোষজনক কোনো কাজ পাবে কি না, সে প্রশ্নও রয়েছে।
দারিদ্র্যের সমস্যা নেপালের বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও বেশ আছে এবং সৈনিক সংগ্রহের বিভিন্ন উদ্যোগও এ অঞ্চলের আনাচ–কানাচে খবর হিসেবে পৌঁছে গেছে। ইউক্রেনে ভাড়াটে সৈনিকদের তালিকায় ভারত-শ্রীলঙ্কার মতো দেশের নাগরিকেরাও আছেন। আল-জাজিরার গত ১ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সে রকমই দাবি রয়েছে। এর মধ্যে লঙ্কানদের সংখ্যা কয়েক শ হবে। ভারতীয়দের সংখ্যা প্রায় এক শ। শ্রীলঙ্কা থেকে বেশি সংখ্যায় যোদ্ধা যাওয়ার কারণ গত দুই বছরের অর্থনৈতিক সংকট।
তবে সংখ্যায় কমবেশি যা–ই হোক এবং এই যোদ্ধারা যখনই ফিরে আসুক, অনেক ধরনের সামাজিক সমস্যার শঙ্কা ইতিমধ্যে ডালপালা মেলছে। প্রথমত, চলতি অবস্থা দক্ষিণ এশিয়ায় এ রকম পেশার প্রসার বাড়াতে পারে; যা সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ভালো খবর নয়। শ্রীলঙ্কার বেলায় দেখা গেছে, সশস্ত্র বাহিনীর অনেক যোদ্ধা অধিক আয়ের লোভে পড়ে চলতি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হলেও রাশিয়ার ডাকে সাড়া দিতে চাইছে।
এ রকম প্রবাসীরা যদি কখনো দেশে ফেরেন, তবে যুদ্ধের মনোজাগতিক ক্ষত নিয়েই ফিরতে হবে এবং এভাবে ভিন্ন ধরনের নতুন একটা জনগোষ্ঠীর ভার বইতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজকে। যুদ্ধক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করা নানা ধরনের রোগবালাইও এসব যোদ্ধার মাধ্যমে এ অঞ্চলে আসবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাড়াটে যোদ্ধাদের বৈশ্বিক এক সংযোগেরও বিস্তার ঘটবে এতে। ধনী দেশগুলো ভবিষ্যতে নানা প্রয়োজনে এ অবস্থাকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু বেশুমার দারিদ্র্য জিইয়ে রেখে একে রুখতে পারা যাবে কি?
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক