মতামত

সুন্দরবনের টেকসই উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা এখন সময়ের দাবি

পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের মোহনায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এক বিস্তীর্ণ বন, যার নাম সুন্দরবন। হিমালয় থেকে নেমে আসা মিষ্টি পানির প্রবাহের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের লবণ পানির মিশ্রণের ফলে এ বনে বিশেষ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

সুন্দরবনের কথা শুনলেই মনের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে গায়ে ডোরাকাটা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, গোলপাতা, জোয়ার-ভাটা আর মৌয়ালদের কথা। নানা ধরনের গাছপালার চমৎকার সমারোহ এবং বন্যপ্রাণীর সমাবেশ এ বনভূমিকে করেছে আরও আকর্ষণীয়। ভারতীয় উপমহাদেশ দুই ভাগে ভাগ হলে সুন্দরবনের দুই-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের এবং বাকিটা ভারতের অংশে পড়েছে।

১৮৭৫ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবনের নাম ঠিক কী কারণে সুন্দরবন হলো, তা একেবারে স্পষ্ট বলা যায় না, তবে প্রচলিত এবং গ্রহণযোগ্য মত, এই বনের সুপরিচিত সুন্দরী বৃক্ষের নাম থেকেই এ নামকরণ।

প্রকৃতি সংরক্ষণ-বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন বাংলাদেশের একাধিক প্রতিবেদনে বিশ্বের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা হিসেবে সুন্দরবনের কথা বলা হয়েছে। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে এর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ও ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বলেছেন।

বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এ বনের আয়তন প্রায় ৬,০১,৭০০ হেক্টর যা দেশের আয়তনের ৪.১৩% এবং বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির ৩৮.১২%। সুন্দরবনের ৩টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত ১,৩৯,৭০০ হেক্টর বনাঞ্চলকে ইউনেসকো ১৯৯৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে।

সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিসহ জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের মোট বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস সুন্দরবন। কাঠের উপর নির্ভরশীল শিল্পের কাঁচামালের এক বিশাল অংশ জোগান দিয়ে আসছে সুন্দরবন। বহু মানুষ সুন্দরবন কেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ করে। একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান বছরে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। কেবল নামে সুন্দর নয়, মুগ্ধ করার মতো গঠনশৈলী আর প্রাণিসম্পদের নিদর্শন এই সুন্দরবন। অসংখ্য পরিচিত-অপরিচিত বৃক্ষরাজি, প্রাণিকুল নিয়ে যুগ যুগ ধরে দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রেখে চলেছে।

সুন্দরবনের বুক চিরে বয়ে চলেছে ৪০০ নদীনালা এবং ২০০ খাল। এসব নদী ও খালে রয়েছে প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ২০ প্রজাতির চিংড়ি, ৭ প্রজাতির কাঁকড়া, ৬ প্রজাতির ঝিনুকসহ আরও অন্যান্য প্রজাতি।

সুন্দরবনের প্রত্যেকটি উপাদানেরই রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। সুন্দরবনের বৃক্ষের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হলো পশুর গাছের কাঠ। এ ছাড়া সুন্দরী, গেওয়াগাছের কাঠেরও দেশে-বিদেশে সুনাম রয়েছে। এসব গাছের কাঠ দিয়ে পেনসিল, দেশলাইয়ের কাঠি, নিউজপ্রিন্ট কাগজ, দৈনন্দিন আসবাবপত্র, নৌকা প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য গাছের মধ্যে অন্যতম হলো কেওড়া। লবণসহিষ্ণু এ গাছে প্রচুর ফল হয়, যা কেওড়া ফল হিসেবে পরিচিত। সুন্দরবন-সংলগ্ন উপকূলীয় জেলাগুলোর লোকজন কেওড়া ফলের সঙ্গে ছোট চিংড়ি মাছ ও মসুরের ডাল রান্না করে খেয়ে থাকে। অন্য দিকে সুন্দরবনের মধুর একটি বড় অংশ আসে কেওড়া ফুল থেকে। তাই গাছটি হয়ে উঠতে পারে লবণাক্ততায় আক্রান্ত কর্দমাক্ত জমির বিশেষ ফসল। গাছটি উপকূলীয় মাটির ক্ষয়রোধ করে, মাটিকে দেয় দৃঢ়তা ও উর্বরতা।

এ ছাড়া সুন্দরবনের মৎস্যকুল ওই এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবিকা ও আয়ের একটি বড় উৎস। সুন্দরবন থেকে মৌয়ালরা প্রচুর মধু ও মোম সংগ্রহ করে, যা দেশের মধু চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। এগুলো ছাড়াও সুন্দরবন নানা ধরনের পশু-পাখির জন্য বিখ্যাত। সারা বিশ্বে বিপন্ন ৩১ প্রজাতির প্রাণী এখনো সুন্দরবনে টিকে আছে। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির প্রাণী সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এ বনে।

সুন্দরবনের মোট আয়তনের প্রায় ৬৩ শতাংশ বাংলাদেশে। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এ বন সমুদ্র থেকে উঠে আসা দুর্যোগগুলোকে প্রথম মোকাবিলা করে। বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবন অক্সিজেনের এক বিশাল ফ্যাক্টরি হিসেবে কাজ করে। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’-এর সময় সুন্দরবন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় এক লাখ দশ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা করেছিল।

গবেষকেরা বলছেন, সুন্দরবন না থাকলে টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হতো। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৯৬০ সালের পরে সংগঠিত ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে আম্পান সবচেয়ে দীর্ঘ সময় এবং বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘসময় এবং বিস্তীর্ণ এলাকা ধরে চলা এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতির পরিমাণ ও হতাহতের সংখ্যায় ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর কিংবা ২০০৯ এর আইলার চেয়েও কম হওয়ার অন্যতম কারণ সুন্দরবন। ১৫১ কিলোমিটার গতিতে আম্পান বাংলাদেশের সাতক্ষীরায় আঘাত হানে, তবে এর আগেই সুন্দরবন ঝড়ের গতিবেগ অনেকটাই কমিয়ে দেয়। ঘূর্ণিঝড়টির সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১৫ থেকে ১৮ ফুট হওয়ার আশঙ্কা করা হলেও সুন্দরবনের কারণে উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় ১০ থেকে ১২ ফুটে নেমে আসে। ফলশ্রুতিতে উপকূলের মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি কম হয়।

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে রক্ষায় নদীগুলোর ভূমিকা অন্যতম। কিন্তু বর্তমানে সুন্দরবনের আশপাশের নদীগুলোতে কয়লা ও তেলবাহী জাহাজ চলাচল নদীর পানি দূষণের অন্যতম কারণ। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার তেল নিয়ে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে একটি জাহাজ জাহাজ ডুবে যায়। এই দুর্ঘটনায় সুন্দরবনের ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তেল, যা পরবর্তীতে জীববৈচিত্র্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাছাড়া চলমান রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকেও সুন্দরবনের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে পরিবেশবিদেরা শুরু থেকে বলে আসছেন। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কাঁচামাল যেমন- কয়লা পরিবহনের বড় মাধ্যম হচ্ছে নদীপথ।

কখনো উন্নয়নের নামে, আবার কখনো ব্যক্তি বা মুষ্টিমেয় দলগত স্বার্থের কারণে সুন্দরবনকে আমরা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছি। নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস ও প্রাণী হত্যা সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানকে দিন দিন বিপন্ন করে তুলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, অবৈধ বসতি স্থাপন ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটায় গত ৩৭ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ১৪০ বর্গকিলোমিটার। সৌন্দর্যের প্রতীক সুন্দরীগাছ কমে গেছে প্রায় ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

২০০২ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে সুন্দরবনে তেল দূষণের ওপর একটি গবেষণা চালানো হয়। ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়, তেল দূষণে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করে ওই গবেষণায় উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সংগ্রহের সুপারিশ করা হয়েছিল; কিন্তু দীর্ঘ ১৮ বছর পরও সে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। সুন্দরবনের বিপন্ন প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম হলো, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, মেছো বাঘ, ছোট মদন টাক, গ্রেট নট পাখি, রাজগোখরা, জলপাই রঙের কাছিম, দুই প্রজাতির ডলফিন (ইরাবতী ও গাঙ্গেয়), দুই প্রজাতির উদবিড়াল ও লোনা পানির কুমির ইত্যাদি।

বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেসকো বলেছে, সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র শ্বাসমূলীয় বন, যেখানে এখনো পলি পড়ে পড়ে নতুন ভূমির গঠন হচ্ছে। এসব ভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে শ্বাসমূলীয় বনভূমি গড়ে উঠেছে। সুন্দরবনের অন্য অঞ্চলগুলো থেকে সেখানে হরিণ, সাপ ও বাঘের মতো প্রাণীরা এসে বসতি গড়ছে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইউনেসকোর পক্ষ থেকে সুন্দরবনের জন্য ১০টি হুমকি চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, দূষণ, অবৈধ তৎপরতা ও পশুর নদের খননকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ জন্য বলা যায়, ইউনেসকোর উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সুন্দরবন রক্ষায় আমাদের ব্যাপকভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

সম্প্রতি আইপিসিসি’র এক প্রাক্কলনে দেখানো হয়েছে যে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশ তার ভূমির ১৭ শতাংশ এবং খাদ্য উৎপাদনের ৩০ শতাংশ হারাবে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাসমূহ এবং এসব জেলায় বসবাসরত জনগোষ্ঠী।

জলবায়ু পরিবর্তন এর ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। এসব ঝুঁকির অন্যতম হলো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর মিঠা পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়া। ফলে বাংলাদেশে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও নদ-নদীতে সমুদ্রের পানি ঢুকে লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতের মহাবিপদ হতে রক্ষা পেতে হলে আমাদের অবশ্যই সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে। জাতীয় স্বার্থেই সুন্দরবন রক্ষা ও এর টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

শিব্বির আহমেদ তাশফিক
গবেষক
ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট (আইডব্লিওএফএম)
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: shibbiriwfm.buet@gmail.com