সরকারের নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ল ৫ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) জানিয়েছে, এখন থেকে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করা হবে। (বিদ্যুতের দাম বাড়ল, বাসস, ১২ জানুয়ারি ২০২৩) আশঙ্কা হলো, যেহেতু বেসরকারি খাত থেকে প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিদ্যুৎ ক্রয় করা হয়, কাজেই সমন্বয়ের নামে কার্যত নিয়মিত দাম বাড়ানোই হবে।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত এমন একটি সময়ে নেওয়া হলো, যখন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এমনিতেই মানুষ ব্যাপক চাপে রয়েছে। গত আগস্টে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম এক লাফে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে দেয় সরকার। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে লিটারে ৫ টাকা কমানো হলেও দ্রব্যমূল্যের ওপর তার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। (ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা বাড়ানোর পর কমল ৫ টাকা, প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট ২০২২) কাজেই অতীত ইতিহাস বলে, বিদ্যুতের দাম যদি কোনো মাসে কমানোও হয়, সেটার কোনো প্রভাব দ্রব্যমূল্যের ওপর না পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের অর্থ হবে নিত্যপণ্য ও সেবার দামে নতুন করে অরাজকতা তৈরি করা।
বলা হচ্ছে, আইএমএফের শর্ত অনুসারে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর জন্যই এই মূল্যবৃদ্ধি। প্রশ্ন হলো, ভর্তুকি কেন দিতে হচ্ছে এবং সেই ভর্তুকির টাকা কোথায় যাচ্ছে, কারা পাচ্ছে? ভর্তুকি দিতে হচ্ছে; কারণ, আমদানিনির্ভর ও ব্যয়বহুল তরল জ্বালানিভিত্তিক বেসরকারি মালিকানার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে পিডিবিকে। সেই সঙ্গে রয়েছে ক্রমবর্ধমান ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা যত বেড়েছে, পিডিবির লোকসান তত বেড়েছে। আর সেই লোকসান কমানোর কথা বলে গত ১৪ বছরে এ নিয়ে ১১তমবারের মতো গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে কিন্তু লোকসান ও ভর্তুকি কমেনি; বরং বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চাপ তৈরি হয়েছে। (৫ শতাংশ বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম, প্রথম আলো, ১২ জানুয়ারি ২০২৩)
তলা ফুটো চৌবাচ্চার অঙ্কের কথা আমরা জানি। চৌবাচ্চার তলায় যদি ফুটো থাকে, তাহলে যতই পানি ঢালা হোক না কেন, চৌবাচ্চা পূর্ণ হবে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চৌবাচ্চার ফুটো হলো বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০২০-২১ সালে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ছিল ৬ টাকা ৬১ পয়সা, যা ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১-২২ সালে দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৮৪ পয়সা। এর মধ্যে পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ ৫ টাকা ২ পয়সা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ ৪ টাকা ৪৭ পয়সা হলেও বেসরকারি খাতের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় উৎপাদন খরচ ৯ টাকা ৮০ পয়সা ও আইপিপিগুলোর গড় উৎপাদন খরচ ১১ টাকা ৫৫ পয়সা। এক বছর আগে বেসরকারি খাতের রেন্টাল ও আইপিপি বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ছিল যথাক্রমে ৭ টাকা ৪৭ পয়সা ও ৮ টাকা শূন্য ২ পয়সা। (পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২১-২২, পৃষ্ঠা ৯৬) বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার কারণে বেসরকারি খাতের কোনো কোনো আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে ৫৫ টাকা এবং ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট ২৭ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে। (পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২১-২২, পৃষ্ঠা ১১৪-১১৭) ফলে এটা স্পষ্ট যে বেসরকারি খাতের আইপিপি ও রেন্টাল মডেলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়েই পিডিবির লোকসান বাড়ছে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার একটা বড় অংশ সারা বছর অব্যবহৃত থাকে। কিন্তু বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে বিদ্যুতের একক ক্রেতা হিসেবে পিডিবি কর্তৃক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়া দিতে হয়। ২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। (অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের চার্জ গলার কাঁটা, সমকাল, ২৫ জুলাই ২০২২) প্রতিবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানের পরিমাণ এবং সেই সঙ্গে বাড়ছে পিডিবির লোকসান ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চাপ। একদিকে অপরিকল্পিতভাবে অতিরিক্ত সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও উচ্চ হারে কেন্দ্র ভাড়া ধরে চুক্তি করা; অন্যদিকে গ্যাসের মতো স্থানীয় উৎসের জ্বালানি অনুসন্ধান ও উত্তোলনে গুরুত্ব না দিয়ে এলএনজি, তেল ও কয়লার মতো আমদানিনির্ভর প্রাথমিক জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় পিডিবির ব্যয় ও লোকসান বাড়ছে।
বাড়তি অর্থ ভর্তুকি থেকেই আসুক কিংবা দাম বাড়িয়েই সংগ্রহ করা হোক—দুই ক্ষেত্রেই তা কিন্তু জনগণেরই অর্থ। কাজেই বিদ্যুৎ খাতে জনগণের অর্থ জনগণেরই কাজে লাগানোর শর্ত হলো উৎপাদন খরচ কমানো এবং বেসরকারি খাতের হাত থেকে মুক্ত করে বিদ্যুৎ খাতে রাষ্ট্রীয় খাতের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা।
২০১২-১৩ সালে যখন বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট, তখন পিডিবির লোকসান ছিল ৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭-১৮ সালে উৎপাদনক্ষমতা ১৫ হাজার ৪১০ মেগাওয়াটের বিপরীতে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২১-২২ সালে ২১ হাজার ৬৮০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার বিপরীতে লোকসান হয় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। (সক্ষমতার সঙ্গে লোকসানও বেড়েছে, প্রথম আলো, ২৯ জুলাই ২০২২) এই লোকসানের টাকা সরকারকে ঋণ বা ভর্তুকি হিসেবে পিডিবিকে দিতে হয় যেন পিডিবি তা বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে দিতে পারে। ভর্তুকি বা ঋণের পরিমাণ হ্রাস করার জন্যই এভাবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণের পকেট থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। এখন আইএমএফের শর্ত মেনে হোক আর পিডিবি তথা সরকারের লোকসানের বোঝা কমানোর জন্য হোক, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে লোকসান বাড়বে জনগণের। জনগণের পকেট থেকে আগের চেয়ে আরও বেশি পরিমাণ অর্থ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে গিয়ে ঢুকবে। আলটিমেটলি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির অর্থ হলো, লোকসানটাকে সহনীয় রেখে পিডিবি কর্তৃক বেসরকারি মালিকদের কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার মেকানিজমটাকে অক্ষুণ্ন রাখা।
আইএমএফ অনেক ধরনের সংস্কারের কথাই বলে, কিন্তু জনগণের অর্থে বেসরকারি খাতের অতি মুনাফার বিরুদ্ধে আইএমএফের কোনো অবস্থান থাকে না। আইএমএফের অ্যাজেন্ডা হলো দেশের শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পানি ইত্যাদি পাবলিক সেক্টর বা সর্বজন খাতকে হয় বেসরকারিকরণ করা অথবা ভর্তুকি কমিয়ে বেসরকারি খাতের মতো মুনাফাকেন্দ্রিক নীতিতে পরিচালনা করা যেন এগুলো দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত হয়। কাজেই আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য গেলে আইএমএফ ভর্তুকি কমানোর শর্ত দেবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো রিজার্ভ কমতে কমতে আইএমএফের কাছে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন? সরকারের পক্ষ থেকে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হলেও ক্রমবর্ধমান বাজেটঘাটতি, বাণিজ্যঘাটতি, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কিংবা আমদানি-রপ্তানিতে মূল্যের তারতম্যের মাধ্যমে বিদেশি পুঁজি পাচার, ঋণনির্ভর ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণ ও জ্বালানি আমদানির ঘটনাগুলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই ঘটছিল। আইএমএফের শর্তের কথা বলে সরকার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির দায় এড়াতে পারে না। কারণ, নানান অব্যবস্থাপনা ও লুটপাটের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আইএমএফের শর্তের জালে ঢোকানোর ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন সরকারই করেছে।
সবশেষে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ঘাটতি থাকলেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অত্যাবশ্যকীয় কি না, জনগণের জন্য কল্যাণকর কি না, সে বিষয়ে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট করা দরকার।
প্রথমত, ঘাটতি কমানোর জন্য উৎপাদনমূল্য যেন কম থাকে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। উৎপাদন খরচ বাড়ানোর সব মেকানিজম চালু রেখে বিক্রয়মূল্য বাড়ালে ঘাটতি কমে না; বরং দিনে দিনে ঘাটতি বাড়তে থাকে। ফলে বারবার দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে, যা এই সরকারের আমলে বারবার বাড়ানোর পরও হাজার হাজার কোটি টাকা ঘাটতির ঘটনা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়।
দ্বিতীয়ত, তারপরও কোনো কারণে যদি ঘাটতি রয়েই যায়, তাহলে ভর্তুকি প্রদান করতে হবে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে গোটা অর্থনীতিতে এর মাল্টিপ্লায়িং ইফেক্ট পড়ে এবং বিদ্যুৎ ব্যবহার করে উৎপাদিত সব পণ্যের দাম বাড়ায় জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে, তাই জনগণের দেওয়া কর-ভ্যাটের অর্থের একটা অংশ জনদুর্ভোগ ঠেকানোর জন্য বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ করাই উচিত।
যদি ভর্তুকির অর্থ পাবলিক বা রাষ্ট্রীয় খাতে যায় তবে জনগণের টাকা জনগণের কাজেই লাগে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাত বেসরকারীকরণ করা ও সেখান থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার অর্থ হলো জনগণের অর্থ বেসরকারি খাতে দেওয়া ও সেই খাতের বাড়তি মুনাফা নিশ্চিত করা। বাড়তি অর্থ ভর্তুকি থেকেই আসুক কিংবা দাম বাড়িয়েই সংগ্রহ করা হোক—দুই ক্ষেত্রেই তা কিন্তু জনগণেরই অর্থ। কাজেই বিদ্যুৎ খাতে জনগণের অর্থ জনগণেরই কাজে লাগানোর শর্ত হলো উৎপাদন খরচ কমানো এবং বেসরকারি খাতের হাত থেকে মুক্ত করে বিদ্যুৎ খাতে রাষ্ট্রীয় খাতের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করা।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক, প্রকাশিত গ্রন্থ: বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি
ই–মেইল: kallol_mustafa@yahoo.com