৮ মের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দুই শিবিরেই উথালপাতাল অবস্থা চলছে। কোনো পক্ষই নিজেদের নেতা-কর্মীদের মানাতে পারছে না।
বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে অনেক আগেই। এরপরও দলের অনেক নেতা-কর্মী প্রার্থী হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে দল থেকে তাঁদের বহিষ্কার করা হলো। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মিলে ৭৩ জন।
চার পর্বের প্রথম পর্বে ৭৩ জনকে বহিষ্কার করতে হলে বাকি তিন পর্বে এই সংখ্যা কয়েক শতে দাঁড়াবে। গণহারে বহিষ্কার নিয়ে দলের ভেতরেই কথা উঠেছে। বিএনপির অনেকে মনে করেন, এভাবে একের পর এক নির্বাচন বর্জন করলে সরকারই লাভবান হবে। বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়বে।
দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হচ্ছে না বলে বিএনপি প্রথম দিকে কিছুটা নমনীয় ছিল। তাদের ইঙ্গিত পেয়ে জামায়াতে ইসলামী ঘোষণা দিয়েছিল, যেসব উপজেলায় তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী আছেন, সেসব উপজেলায় তাঁরা লড়বেন। কয়েকজন আগাম প্রচারও চালিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপির কঠোর অবস্থানের কারণে জামায়াতও দলীয় নেতাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বলে এবং সবাই সেটা মেনেও নেন। কিন্তু বিএনপিতে তা হয়নি।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলা না করে এখন নিজেরা নিজেদের মোকাবিলা করছেন। জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনেও তারা আরেকটি প্রীতি ম্যাচ খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সত্যিকার ‘ম্যাচটি’ কবে হবে?
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ভেবেছিল বিএনপি নির্বাচনে না আসায় হেসেখেলে বৈতরণি পার হবে। কিন্তু যতই ভোটের তারিখ এগিয়ে আসছে, ততই গোলমাল বাড়ছে।
দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নিষেধ করা হয়েছিল। কে মানে কার কথা। কিন্তু তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের একটাই কথা জয়ী হতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাখা যাবে না।
৭ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। বিরোধিরা এর নাম দিয়েছে ‘আমি’, ‘তুমি’ ও ‘ডামি’র নির্বাচন।
উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদিনই নতুন নতুন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। হুমকি-পাল্টা হুমকি, গর্জন-বর্জনের আওয়াজ আছে। আগে নির্বাচন এলে আমরা দেখতাম এক দলের প্রার্থী অন্য দলের প্রার্থীকে শাসাচ্ছেন। এখন একই দলের দুই বা ততোধিক প্রার্থী পরস্পরকে শাসাচ্ছেন। হুমকি দিচ্ছেন।
জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অন্য প্রতীকের কোনো এজেন্ট কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে না, ঢুকলে হাত ভেঙে যমুনা নদীতে নিক্ষেপ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা সাইদুল হাসান ও খন্দকার মোতাহার হোসেন। সাইদুল সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক। তিনি একটি কলেজের অধ্যক্ষও। আর মোতাহার হোসেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও পিংনা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
এই দুই নেতা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আনারস প্রতীকে অংশ নেওয়া ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলামের সমর্থক। এই দুই নেতার তাঁদের হুমকি দেওয়া একটি ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সমালোচনা হয়।
ভিডিওতে সাইদুল হাসানকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের মধ্যে অসন্তোষ ও হানাহানি করার চেষ্টা করবেন না। যদি করেন, আমি স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, তাদের দাঁত ভেঙে দেওয়া হবে। যাঁদের দাঁত নাই, তাঁদের চাপার হাড্ডি ভেঙে দেওয়া হবে।...আমরা রফিক সাহেবকে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে আজকেই ঘোষণা দিলাম।’
একই ভিডিওতে মোতাহার হোসেনকে বলতে শোনা যায়, ‘সাইদুল স্যার যে ঘোষণা দিয়েছেন, আমরাও তাঁর ঘোষণার সঙ্গে একমত। অন্য কোনো মার্কার এজেন্ট কোনো কেন্দ্রে দিতে দেব না। এজেন্ট দিলে তার হাত বাড়ি দিয়ে ভেঙে আমরা যমুনা নদীতে নিক্ষেপ করব।’
পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করে। ভোটের আগেই যদি কাউকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে দেওয়া যায়, তাহলে নির্বাচনের দরকার কী? ভোট ভোট খেলা না করে অমুকে নির্বাচিত হয়েছেন বলে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে দিলেই হয়।
এদিকে গৌরনদী উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে হারিছুর রহমানকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁর শিষ্যরা। মঙ্গলবার উপজেলার চাঁদশী ইউনিয়নের চাঁদশীহাটে আওয়ামী লীগের কর্মিসভায় সরকারি গৌরনদী কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শরীফ নাহিয়ান হোসেন রাতুল বলেন, ‘হাসানাত আবদুল্লাহর সিদ্ধান্ত হলো, হারিছুর রহমান হারিছ ভাই একমাত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী। তা ছাড়া কোনো প্রার্থী গৌরনদীতে নাই, চাঁদশী ইউনিয়নে নাই। কোনো কুচক্রী মহল আঙুল তুলে দাঁড়াতে চাইলে ছাত্রলীগ তথা গৌরনদীর সাধারণ জনগণ তাদের চাঁদশীর মাটি থেকে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবে।’
হারিছ ২০১২ সাল থেকেই গৌরনদী পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তৃতীয় ধাপে এখানে ভোট গ্রহণ করা হবে ২৯ মে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২ মে। উপজেলা চেয়ারম্যান হারিছের বিশেষ গুণ হলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া। বিএনপির অনেক নেতার দোকানে তালা ঝুলিয়ে তিনি পরে তাদের আপসরফা করতে বাধ্য করেছেন।
আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখাতে পারলেও উপজেলায় পারছে না। ৮ মের উপজেলা নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হলেন ২৫ জন। বাগেরহাট সদর, মুন্সিগঞ্জ সদর, মাদারীপুরের শিবচর ও ফেনীর পরশুরাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। পরবর্তী তিন ধাপেও আমরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেক নির্বাচিত প্রতিনিধি পেতে যাচ্ছি। সব উপজেলায় এই পদ্ধতি চালু হলে নির্বাচন কমিশনেরই প্রয়োজন হবে না।
সহকর্মী প্রণব বল চট্টগ্রাম থেকে রাউজান মডেল নিয়ে লিখেছেন, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর পর থেকে রাউজানে স্থানীয় সরকারের প্রায় সব পর্যায়ের নির্বাচনে বিনা ভোটের প্রচলন শুরু হয়।
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ১৪টি ইউপি নির্বাচনের মধ্যে ১১ টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০২১ সালে ১৪ ইউনিয়নের সব কটিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান ও সাধারণ সদস্যরা নির্বাচিত হন। একই বছর পৌরসভা নির্বাচনেও পৌর চেয়ারম্যান ও সাধারণ সদস্যরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। গত উপজেলা নির্বাচনে এই মডেল বাগেরহাট ও ফেনীসহ আরও কয়েকটি জেলায় সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মন্ত্রী ও এমপির স্বজনদের নির্বাচন না করার নির্দেশ দেওয়ার পরও তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। কেননা তাঁরা জানেন, দল যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, একবার নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নিতে পারবে না।
আর মন্ত্রী-এমপির স্বজন তো কেবল উপজেলা নির্বাচনে নেই, সিটি করপোরেশনে আছেন, পৌরসভায় আছেন, জেলা পরিষদে আছেন, ইউনিয়ন পরিষদে আছেন। আবার বেছে বেছে অনেক প্রতিষ্ঠানে তাঁদের বসানো হয়েছে। সেসব স্থানে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তারের প্রশ্ন না থাকলে উপজেলায় কেন আসবে?
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলা না করে এখন নিজেরা নিজেদের মোকাবিলা করছেন। জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনেও তারা আরেকটি প্রীতি ম্যাচ খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সত্যিকার ‘ম্যাচটি’ কবে হবে?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com