মূল্যস্ফীতি নাহয় ঠিক হবে, কিন্তু মনঃস্ফীতি ঠিক করবে কে

ইউক্রেন-রাশিয়া রণ-সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি-মূল্যস্ফীতি শব্দদ্বয় বঙ্গের ঘরে ঘরে পৌঁছেছে। রঙ্গে, ঢঙ্গে নাকি অঙ্গে কে, কখন, কোথায়—এসব জুড়ে দিয়েছে, তা বোঝা কষ্টের।
তবে এসব যে আজকাল কারও কারও হারামিগিরি ঢাকার চেষ্টায় তেষ্টা মেটাচ্ছে তা হলফ করে বলা যায়।

শুধু খেসারত আপনার আর আমার। ‘থলেভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে যাও, আর পকেটভর্তি সদাই নিয়ে বাড়ি আও!’ এতেও বা কম কিসে? বেঁচে আছি তো।

যাগ্গে, আজ্ঞে! অর্থনীতির এসব দামি দামি খটকা খটকা বিষয় বোঝায় কাজ আমাদের নয়। এগুলো ওপরের মানুষজনের। কিন্তু আমাদের মনের যে স্ফীতি (মনঃস্ফীতি) দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, তার কি কোনো খোঁজখবর রাখছি?

একদিন যুদ্ধ থেমে যাবে। গভর্নর মুদ্রাস্ফীতি ঠিক করে ফেলবেন, ডলারের দাম কমে টাকার দাম বেড়ে যাবে। দেশের অভিভাবকেরা মূল্যস্ফীতি ঠিক করে ফেলবেন। মানুষ আবার আধখালি পকেট টাকা নিয়ে বাজারে যাবে, আর থলেভর্তি সদাই নিয়ে ঘরে ফিরবে। সুযোগ করে ঘুরতে বেরোবে নিম্নমধ্যবিত্তরাও।

কাঁধের জোয়াল নামিয়ে, বলদ জোড়া গাছতলায় বেঁধে নজরানা দিয়ে দাওয়াত খেতে যাবেন ক্ষুদ্র বর্গাচাষিও।

কিন্তু আমাদের প্রাণ কি বাঁচবে? পকেট–উপরি টাকা থাকবে, হাঁড়ি উপচানো খাবার থাকবে—তারপরও? মনে হয়, না। কারণ, প্রকৃত প্রাণ বাঁচাতে প্রয়োজন একধরনের সামাজিক সম্পর্কের। যা দিন দিন আমাদের হারিয়ে যাচ্ছে।

বিশেষ করে আমাদের রাজনৈতিক বিভাজন আমাদের সামাজিক সম্পর্ককে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে।

আগে গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় নিদেন বড়বাড়ি-বড়বাড়ি রেষারেষির কথা শোনা যেত। অথচ এখনকার দৃশ্য আরও ভয়ানক। এই ব্যবচ্ছেদ পৌঁছেছে পাশের ঘরের সঙ্গে পাশের ঘরের, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের। হিংসা-বিদ্বেষের এই চিত্র একধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতাও লাভ করেছে।

অমুকে অমুক দল করে তো তমুকে তমুক দল করে—এগুলো আগেও ছিল। তবে তা ছিল ভোটের দিন কয়েকের হিসাব। এরপর সবাই এক পানিতে গোসল সেরে এক পাতে খেতে বসত। এটাই বাংলাদেশ, এটাই বাঙালির সংস্কৃতি।

আজ এর ব্যত্যয় ঘটছে। এর মূলে রয়েছে রাজনৈতিক অর্থনীতি। যখন অমুক দলওয়ালারা দিন দিন তরতর করে ওপরের দিকে যাচ্ছে আর তমুক দলের লোকেরা দিনকে দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, তখন এটি একটি স্থায়ী সংকটের বীজ বপন করে দিচ্ছে।

এর শিকড় অনেক গভীরে, শাখা-প্রশাখার বিস্তৃতি অনেক—যা বিষে ভরা।

আমাদের এই মনঃস্ফীতি শুধু দেশীয় রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই, শুধু একটি উদাহরণমাত্র। এটি সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, লেখাপড়া, উন্নয়ন মডেল—সর্বত্র বিরাজমান। আমরা ‘আমার’ (সেলফ) বলতে কিছু নিজেদের করে রাখিনি।

সব অন্যদের দিয়ে দিয়েছি। কোনো উন্নয়ন মডেলের কথা জানতে চাইলে বলা হয়, পশ্চিমা কোনো দেশের কথা অথবা বড় জোর প্রাচ্যের গুটিকয়ের। অথচ আমাদের এই মাটিতেও যে এমন মডেলের নজির থাকতে পারে, তা আমরা স্বীকৃতি দিতে চাই না।

ধরুন, সমাজ গবেষণার কোনো তত্ত্ব পড়তে যাবেন, দেখবেন পুস্তক ভরা শুধু ‘অ্যাডাম স্মিথ’দের নাম। এটা দোষের নয়। কিন্তু যখন আমাদের গুণীদের নাম সমানভাবে স্মরণ বা অনুসরণ করা না হয়, তখনই বাধে বিপত্তি।

সেখানে প্রকাশ পায় মানসিক দৈন্য।

আমাদের বড় বড় রাজনীতিক গণমাধ্যমে বেশ জানান দিয়ে চিকিৎসা করাতে বিদেশে যান। এটা কত বড় মনঃস্ফীতির উদাহরণ হতে পারে একটু ভাবুন তো! ৭ থেকে ১৬ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা আপনারা ৫৩ বছরে নিশ্চিত করতে পারলেন না অথচ সমসাময়িক জেলেপল্লি (সিঙ্গাপুর) আজ কোথায়! থাইল্যান্ডের সামাজিক অবস্থান কি আমাদের চেয়ে উন্নত? আয়বৈষম্যের দিক থেকে দেশটির অবস্থান প্রথম দিকে।

অথচ তারাও তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অথচ আমাদের নামীদামি সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন পর্যন্ত রক্তের সাধারণ পরীক্ষাগুলোও আস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে পারেননি।

আচ্ছা, আমাদের যেসব রাষ্ট্রীয় অভিভাবকেরা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অথবা চিকিৎসা করানোর কথা বলে বিদেশে যান, তাঁদের কি একটু লজ্জাও লাগে না? নাকি সেই বোধটুকুই তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন?

রক্তের দামে কেনা এই স্বাধীন দেশটিতে দিন দিন ধনী-দরিদ্রের আয়বৈষম্য যেন ঘোষণা দিয়ে বেড়ে চলেছে।

অক্সফামের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ বাংলাদেশি জাতীয় সম্পদের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশের মালিক ছিলেন। আর সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের মালিকানায় ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা গেছে, দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতেই এখন দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।

গত এক যুগে দেশে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি যেমন বেড়েছে, সঙ্গে দ্রুতগতিতে বৈষম্যও বেড়েছে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না।

সুশাসনের অভাব মানুষের মনঃস্ফীতি ঘটায়। এর কারণে দেহকাঠামোয় অনেকে মানুষ থাকলেও মনুষ্যত্ব বিচারে অনেকেই এই মর্যাদা হারান। মনঃস্ফীতি রোধে প্রয়োজন সুশাসনের অন্যতম শর্ত—আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, দক্ষতা ও সার্বিক কল্যাণসাধনের মতো বিষয়গুলো।

এই মনঃস্ফীতি আমাদের সংগীত খেয়ে ফেলেছে, নাটক খেয়ে ফেলেছে, চলচ্চিত্র খেয়ে ফেলেছে, পোশাক থেকে শুরু করে বসার ধরন বা রাস্তায় চলার পথে বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে করা কুশল বিনিময়ের আদর্শটা পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছে।

সংস্কৃতিচর্চায় আমাদের মনঃস্ফীতি তুঙ্গে বলা যেতে পারে। বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর ভিনদেশি ‘লম্ফঝম্প’ বিষিয়ে তুলছে পুরো সংস্কৃতি অঙ্গন। দুঃখজনক হলো এতে গা ভাসাচ্ছেন ‘রোল মডেলরাও’।

শুধু বোশেখ আর ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান দিয়ে আমাদের সংস্কৃতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রশ্ন রাখি, আচ্ছা, আমাদের সংস্কৃতির ভিত যেন কী?  আহ ভুলে গেছি, মনে আসছে না, উম...উম...।

এই মনঃস্ফীতি আমাদের সংগীত খেয়ে ফেলেছে, নাটক খেয়ে ফেলেছে, চলচ্চিত্র খেয়ে ফেলেছে, পোশাক থেকে শুরু করে বসার ধরন বা রাস্তায় চলার পথে বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে করা কুশল বিনিময়ের আদর্শটা পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছে।

  • মো. ছানাউল্লাহ প্রথম আলোর সহসম্পাদক